ব্রামাকা পরিবারের কাহিণী ইসলাম ও ইতিহাসের এক অন্যতম অধ্যায়। পারস্য দেশের এই পরিবার আব্বাসীয় বংশের খলীফার পারিবারিক বন্ধুত্ব অর্জন করতে পেরেছিলো এবং পরবর্তীতে প্রশাসনিক কাজ-কর্মের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো। ব্রামাকা শব্দের অর্থ হচ্ছে পারস্যের আগুন পূঁজার মন্দিরের সবচেয়ে বড় পুরোহিত। এই ব্রামাকা পরিবারের একটা গোপন মিশন ছিলো–তা হলো আরবদের কাছে থেকে পারসীয়ান রাজত্বের পুনরুদ্ধার করা, কিন্তু যদিও সেই মিশনে সফল হয়নি কিন্তু ইসলামের আসল রুপ পরিবর্তনে অনেকাংশেই সফলতা অর্জন করেছিলো। তাদের প্রভাব-প্ররোচনায় আব্বাসীয় খিলাফতের ইসলাম, বিশেষ করে আরবীয়দের জীবন-যাপনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।‘জামাসাপ’, যিনি ব্রামাকা পরিবারের পূর্বপুরুষ ছিলেন, পারস্য সাম্রাজ্যের রাজ পদে কর্মরত ছিলেন। তার সাথে পারস্যের এক নবী ‘যারদাশ্ত’ এর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো। খালিদ ব্রামাকা আব্বাসীয় রাজদরবারে কাজ করতো। কোন এক ভাবে তিনি প্রথম আব্বাসীয় খলিফা মুহম্মদ বিন আলী, যিনি ‘সাফফা’ নামে পরিচিত ছিলো তার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠে। যার ফলে খলিফার পরিবারের সাথেও তার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে সময় লাগে না। পরবর্বতীতে খালিদ ব্রামাকা ফারাসের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হয়। ‘ইয়াহিয়া’ ছিলো খালিদের ছেলে যে বাবার চেয়েও অত্যন্ত প্রখর বুদ্ধিমান ছিলো। খালিদ, খলিফা মনসুরের আজার বাইজান প্রদেশের গভর্নর ছিলো। কিন্তু খালিদ ব্রামাকা তার ছেলের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত রাজ পদ খুঁজে বের করেছিলো, আর তা হলো খলিফা মনসুরের ছেলে হারুন রশিদের শিক্ষকের পদ। শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হবার ফলে ব্রামাকা পরিবের প্রভাব প্রশাসন পরিচালনা এবং খলীফার পরিবারের উপর এমনভাবে বিস্তার করে যে তারা এই শিক্ষকের পদবীটি ক্ষমতা অর্জনের প্রধান হাতিয়ারের মতই ব্যবহার করতে শুরু করে।

ইয়াহিয়া ব্রামাকার ফজল এবং জা’ফর নামে দুই ছেলে ছিলো। হারুন রশিদের রাজত্বকালে প্রায় পুরো ক্ষমতাটাই ইয়াহিয়ার হাতে ছিলো। খলিফার নামে ইয়াহিয়া পরিবার রাজ্য চালাতে থাকে। সেই সময় ইয়াহিয়া পারস্যের অনেক রীতি-নীতিই ইসলামের নামে প্রচার করতে শুরু করে। ইয়াহিয়া সেই সময় ‘বায়তুল-হিকমাত’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান স্হাপন করে। এর মাধ্যমে পারস্য ভাষার অনেক সাহিত্য আরবীতে অনুবাদ করা হয় এবং উচ্চ পর্যায়ের অনেক সভা-সমিতি, সেমিনার, অনুষ্ঠানের প্রচার কার্য শুরু করে। এই অনুষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় বিতর্ক প্রাধান্য পেত। এই বিতর্কে পারসীয়ান, ইহুদি, এবং খ্রীষ্টানগণ একদল হিসেব বিবেচিত হতো আর অন্য দিকের দলে ছিলো মুসলিম প্রতিনিধিগণ (মূলতঃ আরবগণ) এবং এই বিতর্কের বা আলোচনার মূল বিষয়-বস্তু থাকত ‘ইসলামের আদর্শ ও বিশ্বাস’। আরবরা ছিলো সাধারন মনের লোক যারা এই ধরনের দার্শনিক বিতর্ক, সমালোচনার সাথে অভ্যস্ত ছিলো না, অন্যদিকে সাহিত্যে-দর্শনে পারসীয়ানরা অনেক দক্ষতা ও প্রজ্ঞা লাভ করেছিলো। সেই সময় ইহুদি এবং অনেক খ্রীস্টানগণ পারস্যের এই দার্শনিক মতবাদের সাথে পরিচিত ছিলো। যার ফলে এই আরব প্রতিনিধিগণ বেশ কঠিন অবস্হানে থাকে। ফলাফল দাঁড়ায় যে, বিতর্কের শুরুতেই সাধারন জনগনের মনে ইসলামের বিশ্বাস ও আদর্শ নিয়ে নানা সন্দেহ শুরু হয় এবং অন্যদিকে পারসীয়ান দলের অভিজ্ঞ আলোচনা ও তার্কিক পারদর্শিতার কারনে সাধারন জনগন তাদের আদর্শ অনেক বেশি সত্য ও নির্ভরযোগ্য বলে ভাবতে শুরু করে। আর যেহেতু রাজ্য ভান্ডার থেকে খরচ করার ক্ষমতাও ব্রামাকাদের ছিলো তাই বিতর্কে জিতে ইহুদি ও খ্রীস্টান তার্কিকরা মোটা অংকের পুরস্কার পেতে থাকে।

ইয়াহিয়া ব্রামাকা পরিবারের সাথে আরো একটি কারণে খলীফার পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো, আর তা হলো জা’ফরের মা ফয়সল ও হারুন রশিদের দুধ-মা ছিলো। তাই যখন হারুন রশিদ ক্ষমতায় আসে তখন ফজলকে প্রাসাদের ভিতরেই উচ্চ পদে নিয়োগ দান করে। অন্যদিকে জা’ফরকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া হয়। যার ফলে প্রাসাদের ভিতর ও বাইরের সৈন্য ও রক্ষীবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এই দুই ভাইয়ের হাতে এসে যায়; আর তাদের অভিজ্ঞ বাবা ইয়াহিয়া পেছন থেকে দিক-নির্দেশনা দিতে থাকে। এক সময় হারুন রশিদ তাদের উদ্দেশ্য ও চতুরতা বুঝতে শুরু করে। যখনই হারুন রশিদ নগর ভ্রমনে বের হতেন লক্ষ্য করতে লাগলেন যে ব্রামাকা পরিবারই দেশটাকে শাসন করছে, তার প্রভাব নাম মাত্র। বিষয়টা তাকে চমকিত করে এবং পরবর্তীতে জা’ফর হত্যার ঘটনা ঘটে এবং ইয়াহিয়া ও ফজলকে বন্দী করে এবং কঠিন শাস্তির প্রদান করে এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

তথ্য সূত্রঃ ‘কন্সপিরেসিস এগেইন্সট দ্য ইসলাম’ —- ড. সৈয়দ আব্দুল ওয়াদুদ