পুর্ববর্তী পর্বের পর …
নয়
ব্রুনো ছিলেন ডমিনিকান মতবাদী (১২১৫ সালে সেন্ট ডমিনিক প্রতিষ্ঠিত একটি ক্যাথলিক ধর্মগোষ্ঠী) ধর্মযাজক। পেশা ও বিশ্বাসে ধর্মগতপ্রাণ হলেও বুদ্ধি ও চিন্তার জগতে তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও জ্ঞানপিপাসু মানুষ, যাঁর নৈতিক আনুগত্য গীর্জার প্রতি থাকলেও বৌদ্ধিক আনুগত্য ছিল যুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রতি। ষোড়শ শতাব্দীর আশির দশকে তিনি On the Infinite Universe and Worlds নাম দিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। নাম থেকেই বোঝা যায় সেযুগের পরিপ্রেক্ষিতে লোকটার চিন্তাভাবনা কতখানি অগ্রসর ছিল, এবং কত দুঃসাহসী। একেতো তিনি বিশ্বজগতকে infinite অর্থাত্ সীমাহীন বলছেন, যা প্রচলিত এরিস্টটোলিয়ান মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তার ওপর বলছেন worlds—একটা দুটো নয়, অসংখ্য পৃথিবী। তার অর্থ আমাদের এই অতিপরিচিত বিশ্বস্ত পৃথিবীটি বিশ্বব্রম্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু তো নয়ই, আমাদেরটির মত আরো বহু বিশ্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা মহাকাশব্যাপী, হয়তবা অগণিত সংখ্যায়।
আরো একটি মারাত্নক জিনিস ছিল গ্রন্থটিতে—কপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্বের সঙ্গে একমত পোষণ করা। এটা ছোটখাট বেয়াদবি নয়, রীতিমত বিদ্রোহ ঘোষণা করা। ব্রুনো ভাল করেই জানতেন ১৫৪৩এর পর থেকে কতটা কড়াকড়ি হতে শুরু করেছে ইঙ্কুইজিশনের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে ইতালিতে, যেখানে চার্চের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। কপার্নিকাসের মৃত্যুর পরপরই তাঁর বই বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, এবং সে বই থেকে সংগৃহিত কোনও তথ্য বা তত্ব ব্যবহার করাকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়। ভাল করেই জানতেন তিনি ইঙ্কুইজেশনের ভয়ঙ্কর জল্লাদবাহিনী কতখানি তত্পর হয়ে উঠেছে তাঁর মত “ আইনভঙ্গকারি”দের ধরে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে। কিন্তু লোকটার বুকে ছিল ভয়ানক সাহস, ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। যা তিনি সত্য বলে জানতেন, প্রাণের ভয়ে তাকে চেপে রাখার কোনও যুক্তি তিনি মানতে রাজি ছিলেন না। ১৬০০ খৃষ্টাব্দে এই অসমসাহসী বীর বিদ্রোহীকে সত্য ও যুক্তির সপক্ষে নিরাপোষ অবস্থান রাখার অপরাধে অগ্নিকুণ্ডে দগ্ধ করা হয়।
ব্রুনোর এই ভয়াবহ পরিণতির খবর পেয়ে তত্কালীন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি এমন ঘাবড়ে গেলেন যে কপার্নিকাস তত্বের নির্ভুলতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া সত্বেও প্রকাশ্যে সেটা প্রচার করা স্থগিত থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এবিষয়ে তাঁর কি মতামত সেটা কারুরই অজানা ছিল না। চার্চের রোষবহ্নি থেকে ছাড়া পাওয়া তাঁর সম্ভব হয়নি শেষ পর্যন্ত। একদিন কার্ডিনাল বেলার্মিন নিজে তাঁকে ডেকে হুঁশিয়ার করে দিলেন যাতে এসব বাজে মতামত প্রকাশ করা বন্ধ করেন। মনে মনে যা’ই ভাবুন বাইরে যেন কাকপক্ষী কেউ টের না পায় গ্যালিলি কি ভাবছেন। তাহলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না’ও হতে পারে।
কার্ডিনাল ম্যাটিও বার্বেলিনি ছিলেন একজন অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল পাদ্রী। এবং গ্যালিলির দারুণ ভক্ত ও ব্যক্তিগত বন্ধু। সৌভাগ্যবশতঃ কার্ডিনাল বার্বেলিনি অষ্টম আর্বান নাম ধারণ করে পোপ হয়ে এলেন রোমে। বন্ধুর পোপ নিযুক্ত হওয়া দেখে গ্যালিলি একটু ভরসা পেলেন বুকে—হয়ত বিপদ কেটে গেল এবার। সেই ভরসাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশ করে ফেলবেন—এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। বই প্রকাশ করতে চার্চের অনুমতি নিতে হত। ভাবলেন, বন্ধু যেখানে সর্বেসর্বা সেখানে অনুমতি আটকাবে কে। কিন্তু দেখা গেল চার্চের স্বার্থ যেখানে সেখানে বন্ধুত্বের মূল্য খুব একটা নেই। অনুমতি পেলেন না। তাতে দমে গেলেন খানিক, কিন্তু একেবারে নিরুত্সাহ হলেন না। ঠিক আছে, রোমে হল না, অন্যত্র হবে। শেষ পর্যন্ত ফ্লোরেন্সের চার্চ থেকে প্রকাশের অনুমতি পাওয়া গেল, ১৬৩২ খৃষ্টাব্দে। বই বেরুল। সাথে সাথে বেজে উঠল বিপদের শিঙ্গা।
ফ্লোরেন্সের সাধারণ চার্চ তাঁকে প্রকাশের অনুমতি দিলেও ইঙ্কুইজেশনের পাদ্রীদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল তাঁর গ্রন্থটি। তাঁরা বললেন, ঠিক আছে, বই বেরিয়ে গেছে, কিছু করা যাবে না, কিন্তু খবরদার, বইটা যেন প্রচার না হয় কোনভাবে, যেন কোনও ক্রেতার হাতে না পড়ে, কোনও বাইরের লোকের চোখ না পড়ে তাতে। ব্যাপারটা সেখানেই চুকে গেল না কিন্তু। এবার এল স্বয়ং রোমের ইঙ্কুইজেশন। তাঁরা সমন পাঠালেন গ্যালিলিকে চার্চের আদালতে হাজিরা দেওয়ার জন্যে। ১৬৩৩ খৃষ্টাব্দের ২২ শে জুন তিনি আসামীর কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে কঠিন জেরার সম্মুখিন হলেন। চার্চের বিচারে তাঁর গুরুতর অপরাধের সুযোগ্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, তবে সেটা মকুব করে গৃহবন্দিত্বের সাজায় নামানো যেতে পারে যদি তিনি নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন চার্চের বিচারকবৃন্দের কাছে, এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে এসব বেয়াইনি কথাবার্তা জীবনে আর কখনও উচ্চারণ করবেন না। প্রাণের দায়ে ঠিক তাই করলেন গ্যালিলি ( পাঠকদের মনে থাকতে পারে বায়তুল মোকাররমের দরজায় ঠিক এমনিভাবে নতজানু অবস্থায় ‘প্রথম আলোর’র সম্পাদক মতিউর রহমানের ক্ষমাপ্রর্থনা করার দৃশ্য)। সেই যে বন্দী হয়ে থাকলেন তিনি ১৬৩৩ সাল থেকে, সেই বন্দী দশাতেই ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই মহাপুরুষ নয় বছর পর।
জিয়োর্ডিনো ব্রুনো আর গ্যালিলিও গ্যালিলির করুণ কাহিনী সেকালের খৃষ্টধর্মের করুণা ও ক্ষমার আদর্শের চেয়ে বরং মধ্যযুগের পৈশাচিক রূপটাই বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছিল। দুঃখের বিষয় যে কোন কোন ধর্মের সেই পৈশাচিক রূপ আজকের অত্যাধুনিক যান্ত্রিক যুগেও নির্মূল হয়ে যায়নি।
সৌভাগ্যবশত যা সত্য ও শাশ্বত, যা স্বচ্ছ, সুন্দর ও পবিত্র তাকে অগ্নি অস্ত্র আর বাহুবল, কোনকিছু দিয়েই দমিয়ে রাখা যায়না বেশিদিন। শত আবর্জনার স্তূপ থেকেও বুনোফুল একসময় বের হয়ে আসে সূর্যের পিপাসায়। আলোর পুন্যধারাতে অবগাহনই প্রাণের প্রকৃতি। ইঙ্কুইজিশনের শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও কপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ব ইউরোপের বুদ্ধিজগতে সাড়া সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয়নি, শতদলে প্রস্ফূটিত হয়ে নানা বর্ণে নানা পত্রপুষ্পে বিস্তৃত হতে শুরু করে।
মধ্যযুগের ইতালিতে ধর্মের কৃপাণ যখন বিজ্ঞান আর গণিতের মুণ্ডচ্ছেদের যজ্ঞানুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত, ইউরোপের অন্যত্র তখন রেনেসাঁর অগ্নিশিখা অনির্বান উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়ে চলেছে। পোলাণ্ডের কপার্নিকাস যে আলোর বর্তিকা নিয়ে এলেন ইউরোপে সেই আলোর পুন্যধারাতে সিক্ত হয়ে জার্মানীর ইওহান কেপ্লার (১৫৭১-১৬৩০) বেরিয়ে এলেন তার চেয়েও গূঢ়তর বানী নিয়ে। কপার্নিকাস শুধু বলেছিলেন পৃথিবী সুর্যের চারদিকে ঘোরে বৃত্তাকার পথে, কেপ্লার তাঁর দূরবীন দিয়ে খুব ভাল করে পরীক্ষা করে বললেনঃ না, ঠিক বৃত্ত নয়, উপবৃত্ত (ellipse)। তিনি আরো বললেন যে, সূর্য থেকে পৃথিবী বা অন্য যেকোন গ্রহ পর্যন্ত যদি একটি সরলরেখা কল্পনা করা যায় তাহলে সেই রেখাটি একই বেগে পরিক্রমন করবে একই সমতল ক্ষেত্র। অর্থাত্ এই প্রদক্ষিণের আঞ্চলিক গতিবেগের কোন পরিবর্তন নেই। কেপ্লারের তৃতীয় একটি সূত্র আছে যা বত্সরের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে এই আঞ্চলিক গতির একটা সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। এই তিনটি সূত্রই আশ্চর্যভাবে মিলে যায় প্রকৃত পর্যবেক্ষণের সাথে। মজার ব্যাপার যে, সেসময় আইজ্যাক নিউটনের যুগান্তকারি অভিকর্ষ তত্ব কারো জানা না থাকলেও কেপ্লারের তত্বকে সত্য বলে মেনে নিলে তা থেকে নির্ধারণ করা যায় যে পৃথিবী ও সূর্যের ভেতরে একটা আকর্ষণের ব্যাপার আছে এবং সেটা বিপরীত দূরত্ব-বর্গের সূত্র পালন করে। কিন্তু এই আকর্ষণটি যে একটি সর্বজনীন প্রাকৃতিক নিয়ম, এবং তা শুধু সৌরমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্রম্মাণ্ড জুড়েই তার বিস্তার, সেই বিপুল অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। এবং সেই অসামান্য দূরদর্শী পদক্ষেপটি তিনি নিয়েছিলেন কোনও দূরবিণ বা অন্য কোনও যন্ত্রের সাহয্যে নয়, গণিতের সাহায্যে। এবং সে গণিত ছিল তাঁর নিজেরই উদ্ভাবিত গণিত। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী বাগানে আপেলপতনের দৃশ্য থেকেই সেই দিব্যজ্ঞান উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর মনে যে আপেলটি ওপরে না গিয়ে নিচে নেমেছে, তার কারণ বিশ্বপৃষ্ঠ তাকে টেনে নিয়েছে বিপরীত দূরত্ববর্গের নিয়ম অনুসারে। সব গল্প সবসময় সত্য হয়না, এগল্পও হয়ত কেবল গল্পই। তবে এটা সত্য যে পৃথিবীর বড় বড় আবিষ্কারগুলোর বেশির ভাগেরই প্রায় একই ইতিহাস—হঠাত, হঠাত, দৈববানীর মত উদয় হয় সাধকের মনে—হয়ত বাগানে, গোসল করতে গিয়ে, কিম্বা খেলার মাঠে। এমনকি টয়লেটে বসেও মহান দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছেন অনেকে, যেমন মার্টিন লুথার। আইজ্যাক নিঊটন এই একটি কাজ ছাড়া আর কোন বড় কাজ যদি না’ও করতে পারতেন তাহলেও তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট বিজ্ঞানী হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন । কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব ছিল তাঁর অসংখ্য যুগান্তকারি সৃষ্টির অন্যতম মাত্র। গণিতজগতে তিনি বিশেষভাবে খ্যাত ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে, যদিও ওটা নিয়ে খানিক বিতর্ক আছে। সত্যি সত্যি নিউটন এর প্রথম আবিষ্কারক,না, জার্মানীর গটফ্রিড উইলেম লাইবনিজ(১৬৪৬-১৭১৬) সে নিয়ে এক বিরাট ঝগড়া ব্রিটেন আর ইউরোপের মধ্যে। ব্রিটেন বলে, নিউটন, ইউরোপ বলে লাইবনিজ। এই বিতর্ক বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দুই দলকে বিভক্ত করে রেখেছে, যার পরিণতি ইউরোপের চাইতে ব্রিটেনের জন্যেই হয়েছে বেশি ক্ষতিকর। সৌভাগ্যবশত উভয়পক্ষেরই এখন মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে খানিক, ফলে দুই দেশেই গণিতসাধনায় এসেছে নবজীবনের প্রানোচ্ছ্বাস।
কথিত আছে যে নিঊটনের পর্বতপ্রমান কর্মকাণ্ড—- গণিত, পদার্থবিজ্ঞানের একাধিক শাখা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তার অধিকাংশ কাজই তিনি করেছিলেন ১৬৬৫ আর ১৬৬৭, এই দুটি বছরের মধ্যে, যখন ব্রিটেনব্যাপী এক ভয়াবহ মহামারির কারণে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দু’বছর বন্ধ থাকাকালে তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিরিবিলি কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যখন তাঁর বয়স মোটে তেইশ থেকে পঁচিশ! এই দুই বছরের ভেতরে তিনি ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন, অভিকর্ষ তত্ব, শক্তিশালী দূরবীন ও আলোকরশ্নি বিষয়ক আরো অনেক মৌলিক তথ্য, বলবিদ্যার মৌলিক সূত্রাবলী (বস্তুর ভর ও ত্বরণের গূণফল যে গতির চালিকাশক্তির সঙ্গে আনুপাতিকভাবে সম্পর্কিত, এ তথ্যটি তাঁর গতিতত্বের তিনসূত্রের দ্বিতীয়সূত্র নামে খ্যাত), সবই সেই দুটি অবিশ্বাস্য বছরের ফসল। নিউটন সম্বন্ধে আইনস্টাইনসহ অনেক বড় বড় মণীষী এমন মন্তব্য করেছেন যে তিনি প্রকৃতির আজ্ঞাবহ ছিলেন না, বরং উল্টোটাই সত্য ছিল তাঁর বেলায়। প্রকৃতি যেন নিউটনের কাছে এসে তার সব রহস্য উজাড় করে দিয়েছিল। প্রকৃতি ছিল তাঁর পোষা জীব। এজন্যেই ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি মানুষই নিউটনের অনন্যসাধারণ প্রতিভায় ছিলেন বিস্মিত, অবিশ্বাসের ঘোরে আচ্ছন্ন। নিউটন সাধারণ রক্তমাংসে গড়া মানুষ ছিলেন না।
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, নিউটনের কাজের সঙ্গে শূন্যের সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক আছে। কতটা আছে সেটা হয়ত নিউটন নিজেও অতটা বুঝতে পারেননি সেসময়, কারণ তাঁর ক্যালকুলাসের ভেতরেই যে সূক্ষভাবে লুকিয়ে ছিল শূন্য সেটা পরিষ্কার হতে আরো অনেক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিজ্ঞানজগতকে। সেপ্রসংগ পরে আলোচনা করব আমরা। এখানে শুধু এটুকু বলা যাতে পারে যে সম্পর্কটি দার্শনিক না হলেও বৈজ্ঞানিক তো অবশ্যই। দু’টি বস্তুর পারস্পরিক আকর্ষণ, সেটা কেন্দ্রিক, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় central force, সেই ‘কেন্দ্র’ শব্দটিতেই আছে ‘শূন্যে’র আভাষ। কেন্দ্র একটি বিন্দু যার কোনও মাত্রা নেই, যা সাংখ্যগাণিতিক ‘শূন্যের’ই জ্যামিতিক রূপায়ন। সেই বিন্দু ইউক্লিডের কাজে ছিল, গ্রীসের ‘শূণ্য’বিদ্বেষী পণ্ডিতদের কাজেও ছিল প্রচ্ছন্নভাবে, কিন্তু তাঁরা তার অস্তিত্বকে স্বীকার করেননি তাঁদের দর্শনের সঙ্গে সংঘাত ঘটার কারণে। নিউটনের সেই দর্শনসমস্যাটি ছিল না। তিনি ধার্মিক ছিলেন বটে, কিন্তু শূন্য আছে কি নেই সে প্রশ্ন তাঁর বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেনি।
দশ
নিউটনের জন্ম যেবছর, সেবছর ইউরোপের আরেক যুগস্রষ্টা পুরুষ, ফ্রান্সের রেনে ডেকার্ট, তাঁর বয়স ৪৬। তাঁর দর্শন ও গণিতের ভক্ত সারা ইউরোপ জুড়ে। আধুনিক দর্শনশাস্ত্রের জনক বলে ভাবা হয় তাঁকে। দর্শনের ব্যাকরণ ও রচনাপ্রণালী তাঁরই হাতে গড়া। কিন্তু তাঁর অমরত্ব যদি দর্শনশাস্ত্রে পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত না’ও হয়ে থাকে তাঁর গণিতের কাজ তাঁকে চিরঞ্জীব করে রাখবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গণিতের প্রাচীন দু’টি শাখা— জ্যামিতি ও বীজগণিত–এদু’টিকে একসাথে যুক্ত করে একটি নতুন শাখা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এর নাম Coordinate geometry—বাংলা অভিধান অনুযায়ী বৈশ্লেষিক জ্যামিতি। জ্যামিতির সঙ্গে মানুষের পরিচয় আদিযুগ থেকে, সেই মিশরীয় সভ্যতার সময়ই জ্যামিতির জন্ম। কিন্তু বীজগণিতের প্রথম অঙ্কুর সম্ভবত গজায় ভারতবর্ষে, তারপর তা পূর্ণতা পায় আরবের আলখোয়ারিজমির হাতে। সেটা ঘটে মধ্যযুগের প্রাক্কালে। তখন কারো পরিষ্কার ধারণা ছিল না, দুটি আপাতবিচ্ছিন্ন শাখার মধ্যে কোন সরাসরি সম্পর্ক থাকতে পারে। জ্যামিতির প্রধান বাহক হল ছবি, রেখাচিত্র (figures), আর বীজগণিতের ভাষা হল সংখ্যা —১,২,৩,…, a,b,c, …ইত্যাদি। একটা ত্রিভুজের সঙ্গে এগুলোর কি সম্পর্ক থাকতে পারে? ডেকার্ট দেখিয়ে দিলেন যে গণিতের সংখ্যা দিয়েই ত্রিভুজ দেখানো যায়, আঁকবার দরকার হয় না। দুটিকে এভাবে জোড়া লাগিয়ে নতুন একটা শাখা তৈরি করাতে মৌলিক যে জিনিসটা ব্যবহার করতে হয়েছিল তাঁকে সেটা হল ‘শূন্য’। ধরুন একটা দ্বিমাত্রিক সমতল। সেখানে একটা বিন্দু স্থাপন করা দরকার যেখান থেকে দূরত্ব গণনা করা হবে সরাসরি ডানে বা সরাসরি উর্ধে, অর্থাত্ আনুভূমিক (horizontal), অথবা উল্লম্ব(vertical) রেখা। সেই বিন্দুটিকে বলা হয় মূল (origin), এবং তা প্রকাশ করা হয় এভাবেঃ(0,0)। ত্রিমাত্রিক ঘনক্ষেত্রে তা হবে (0,0,0)।যতই মাত্রা বাড়বে ততই বাড়বে শূন্যের সংখ্যা। এভাবে ‘শূন্য’ তাঁর নতুন গণিতে অপরিহার্যভাবেই প্রবেশাধিকার পেয়ে গেল। উদাহরণ স্বরূপ (২,৪)এমন একটি বিন্দু যার দূরত্ব মূল থেকে দুই একাঙ্ক(unit) ডানদিকে, আর চার একাঙ্ক লম্বতে, সে একাঙ্ক একেক ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে ( ইঞ্চি বা সেন্টিমিটার, মিলিমিটার ইত্যাদি)। ডেকার্টের নতুন তত্ব অনুযায়ী একটা সরলরেখাকে বর্ণনা করা যায় এভাবেঃ ax+by=c, যেখানে a,b, c হল তিনটি পূর্বনির্ধারিত সংখ্যা যার কোন পরিবর্তন হয়না রেখাটির একবিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে। কিন্তু x এবং y দুটোই চলমান সংখ্যা, একেক বিন্দুতে তাদের একেক মান। এমন করে শুধু সরলরেখা কেন পুরো একটা ত্রিভুজ, একটা চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ, ইত্যাদি সবরকম জ্যামিতিক আকারকেই বীজগণিতের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। শুধু তাই নয়, ইউক্লিডের সমস্ত উপপাদ্য, সম্পাদ্য ইত্যাদিও প্রমাণ করা সম্ভব কেবল বীজগণিতের ব্যবহার দ্বারা। ডেকার্টের এই অভনব আবিষ্কার বিজ্ঞানজগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। বর্তমান যুগের সেরা গবেষকদের অন্যতম বড় আকর্ষণীয় বিষয়, Algebraic Geometry, তার পূর্বসূরি হিসেবে ডেকার্ট সাহেবকে চিহ্নিত করা হয়ত অন্যায় হবে না।
অথচ মানুষের বুদ্ধির জগত আর বিশ্বাসের জগতে যে কতটা সঙ্ঘাত্ ঘটতে পারে ডেকার্টের জীবনই তার উজ্জ্বল উদাহরণ। ‘শূন্য’ সংখ্যাটি একহিসেবে তাঁর নবসৃষ্ট গণিতের মূল স্তম্ভ, কিন্তু তা সত্ত্বেও দার্শনিক দৃষ্টিকোন থেকে ‘শূন্যের’ আইডিয়াকে পুরোপুরি গ্রহণ করাটাও ছিল তাঁর পক্ষে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন গোঁড়া জেসুটপন্থী ক্যাথলিক। জেসুট স্কুল থেকেই তাঁর ছোটবেলার শিক্ষাদীক্ষা। ইউরোপের সমগ্র মহাদেশব্যাপী যখন প্রটেষ্টান্ট আন্দোলেনের ঝড় ঊঠেছে, ঠিক তখনই তিনি ঘোর ক্যাথলিক বিশ্বাসী ধার্মিক পুরুষ। তিনি ছিলেন এরিস্টটোলের ভক্ত, ছিলেন শূন্যবিরো্ধী, ছিলেন সরলগতিবিরোধী। অথচ তাঁর গণিতই শূন্যনির্ভর। এ এক মহা যন্ত্রণা। একদিকে তাঁর বুদ্ধির পূর্ণ সমর্থন কপার্নিকাস তত্বের প্রতি, আরেকদিকে এরিস্টটোলের ভূকেন্দ্রিক বিশ্বকেও তিনি বর্জন করতে পারছিলেন না। বিজ্ঞান আর ধর্ম পরস্পরবিরোধী নয়, এই মতবাদ যারা আঁকড়ে থাকতে চান, তারা সম্ভবত ডেকার্টের জীবনকাহিনীর সঙ্গে পরিচিত নন।
‘শূন্য’ ও তার বিপরীত ‘অসীম’কে নিয়ে ডেকার্টের নানা দ্বিধাদন্দ্বের সমাধান তিনি নিজেই করেছিলেন। প্রাচীন দার্শনিকদের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন যে যার অস্তিত্ব নেই তার ভেতর থেকে হঠাত্ করে কিছু বের হয়ে আসতে পারেনা (nothing can come out of nothing), যা আসলে গ্রীক দার্শনিক লুক্রেসিয়াস (১০০-৫৫ খৃঃপূঃ) বলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। এমনকি জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য বলে ভাবতেন ডেকার্ট—অর্থাত্ নতুন জ্ঞান বলতে কিছু নেই, বা নতুন চিন্তা, নতুন ধারণা। বাহ্যত নতুন মনে হলেও এসব কোনকিছুই নতুন নয়। সেগুলো কোনও সর্বজ্ঞ সত্তার কাছ থেকে একপ্রকারের সূক্ষ্ণ দৈবসূত্রে প্রাপ্ত প্রতিভাস মাত্র। সেই সর্বজ্ঞানের জ্ঞানী সত্তা, সেই সর্বজ্ঞ অধীশ্বরের অস্তিত্ব যিনি ধারণ করেন তিনিই ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা। তিনি অসীম, একমাত্র অসীম। বাদবাকি সব সীমার মধ্যে আবদ্ধ—মানুষ, প্রকৃতি, বিশ্বজগত, জ্ঞান, সাধনা, প্রেম ভালোবাসা। গোটা সৃষ্টি দু’টি বিপরীত মেরুর মধ্যে সীমাবদ্ধ—একদিকে অসীম অর্থাত্ ভগবান। আরেক প্রান্তে শূন্য, অর্থাত্ যা অস্তিত্বহীনতার পর্যায়ে গণিতের বিমূর্ত জগতে বিরাজমান। তার অর্থ, এরিস্টটোল যেখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান করেছিলেন শূন্য আর অসীমকে অস্বীকার করে, ডেকার্ট সেই একই ঈশ্বরকে প্রমাণ করার প্রয়াস পেলেন দুটিকে স্বীকার করেই।
এগারো
ঠিক আছে, ‘শূন্যের’ একটা ঠিকানা হল অবশেষে—বাস্তবে না হলেও গণিতের খাতায়, চিন্তায়, দর্শনেও হয়তবা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় তখনও, সত্যি সত্যি কি শূন্য বলে কিছু আছে প্রকৃতিতে? এরিস্টটোলের তত্ব অনুযায়ীঃ শূন্য অস্তিত্বহীন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আজো শেখানো হয়ঃ শূন্যাবস্থাকে ঘোর অপছন্দ করে প্রকৃতি (nature abhors a vacuum)। তার অর্থ জড়জগতে ফাঁকা জায়গা নেই কোনখানে। ফাঁকার উপক্রম হওয়ামাত্র প্রকৃতি তাকে ভরাট করার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যাবে।
সত্যি কি তাই? এটা কি কেবলই বিশ্বাস, না, বৈজ্ঞানিক তথ্য?
গ্যালিলির জীবনকালে ইতালির একদল শ্রমিক একটা সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন তাঁর কাছে। কুয়ো থেকে নল আর পিস্টনের সাহায্যে, বা খাল থেকে পানি তোলার সময় দেখা যায় যে নলের ওপর দিকটায় খালি জায়গা থাকা সত্ত্বেও পানি বড়জোর ৩৩ ফুট পর্যন্ত ওঠে, তার ওপরে কিছুতেই তোলা যায় না, হাজার পরিশ্রম করেও না। তার কারণটা কি?
গ্যালিলি ছিলেন মূলত গণিতের লোক, ল্যাবরেটরির কাজ সাধারণত করতেন টরেসিলি নামক তাঁর সুযোগ্য সেক্রেটারি। ১৬৪৩ সালে, অর্থাত্ গ্যালিলির মৃত্যুর বছরখানেক পর, এই রহস্যের সমাধান খোঁজার চেষ্টায় টরেসিলি একটা লম্বা টিউব নিয়ে পারদ দিয়ে সেটা ভরে ফেললেন একেবারে কানায় কানায়। তারপর টিউবটিকে উপুড় করে ডোবালেন এক পারদভর্তি পাত্রের ভেতর, যাতে একফোঁটা পারাও বের না হয়ে আসে নল থেকে। তিনি ভাবলেন, যেহেতু নলটি টায়ে টায়ে ভরা, এককনা বায়ু বেরুবার বা ঢুকবার কোনও পথ নেই সেহেতু উপুড় অবস্থাতেও ঠিক একই ভরাট অবস্থায় থাকবে নলটি। কিন্তু পরম বিস্ময়ে তিনি দেখলেন, বারবার পরীক্ষা করার পরও, পারার ওপরের দাগটি নল বেয়ে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত উঠছে, তার ওপরে যেতে চাচ্ছে না, বা যেতে পারছে না। তার অর্থ যেখানে খালি থাকার কথা না, সেখানেও খালি সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে আপনা থেকেই। তাহলে সেই ৩০ ইঞ্চির ওপরের জায়গাটুকু কি? কিছুই না। বাতাস ঢুকবার তো কোনও উপায়ই ছিল না, সুতরাং সেটা নিশ্চয়ই শূন্যতায় ভরা, অর্থাত্ ভ্যাকুয়াম। এতে প্রমাণ হয়ে গেল যে প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ না করলেও অপছন্দের একটা সীমা আছে, ঐ ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত, পারাভর্তি নলে, আর ৩৩ ফুট পর্যন্্ পানির টিউবে।
কিন্তু বিজ্ঞানের ধর্মই এমন যে এক সমস্যার সমাধান সাধারণত নতুন সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। ডেকার্টের চেয়ে ২৭ বছরের ছোট ছিলেন ব্লেই পাস্কেল (১৬২৩-১৬৬২) নামক এক তীক্ষ্ণধী ফরাসী বিজ্ঞানী-গাণিতিক। তিনি প্রশ্ন দাঁড় করালেনঃ ঠিক আছে, বুঝলাম, পানি ওঠে ৩৩ ফুট, আর পারা ওঠে ৩০ ইঞ্চি, কিন্তু কেন? বিষয়টা কি? কি একটা খেয়ালের বশে, এক সহকর্মীকে যন্ত্রপাতিসহ পাঠিয়ে দিলেন এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে ঠিক একই পরীক্ষা করে দেখা গেল, নলের পারদ ৩০ ইঞ্চিও উঠছে না, তার আরো নিচে উঠেই যেন দম হারিয়ে ফেলছে। পাস্কেল ভাবলেন পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যটা কি? কম বায়ুচাপ, সমতলের তুলনায়। তাহলে রহস্যটা নিশ্চয়ই আর কিছুতে নয়, বায়ুচাপে। পাহাড়ে বায়ুর তেমন শক্তি নেই বেশি ওপরে ঠেলার, কিন্তু নিচে চাপ একটু বেশি হওয়াতে পারা বা পানি ঠেলে ওপরে তুলতে অতটা বেগ পেতে হয়না।
যাই হোক, একটা জিনিস তো মীমাংসা হয়ে গেল— প্রকৃতির সেই শূন্যভীতির ব্যাপারটি। অবস্থাবিশেষে প্রকৃতি শূন্যকে প্রশ্রয় দেয় বইকি। সুতরাং এরিস্টটোলের শূন্যতত্ব আর পাইথাগরাসের সরলগতিবিরোধী তত্ত্ব একেবারেই অমূলক। প্রকৃতি যখন যে অবস্থা সে অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। টরেসিলি আর পাস্কেলের পরীক্ষা থেকে এই সিদ্ধান্তটিই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। শূন্য সত্যি সত্যি আছে পৃথিবীতে। ভ্যাকুয়াম কোনও আজগুবি কথা নয়। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে।
কয়েক শতাব্দী কেটে গেছে তারপর। শূন্য আছে এই বিশ্বাসটি বিজ্ঞানমানসে প্রায় স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছে। ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যবহার আধুনিক প্রযুক্তি জগতের সর্বত্র। তাহলে কি প্রকৃতিতে শূন্যের অস্তিত্ব অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল? হয়তবা। আবার হয়ত না। আধুনিক বিজ্ঞানে, বিশেষ করে অণুপরমাণুবিষয়ক পদার্থবিজ্ঞানে, এই শূন্যতাবাদী চিন্তাভাবনা একটু নতুন আলোকে পরীক্ষিত হতে শুরু করেছে। কোন কোন পণ্ডিত বলছেনঃ আপাতদৃষ্টিতে যা শূন্য তা আসলে শূন্য নয়, সেখানেও পদার্থ আছে। ঠিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থ হয়ত নয়, কিন্তু পদার্থপদবাচ্য অবশ্যই। কিন্তু সে প্রসংগ আমাদের আজকের আলোচ্যবহির্ভূত।
ভিন্ন আলোচনায় যাবার আগে ব্লেই পাস্কেল সম্বন্ধে দুচারটে মন্তব্য করার লোভ সামলানো যাচ্ছে না। পাস্কেলের জন্ম এক প্রচণ্ডরকমের গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারে, অনেকটা ডেকার্টের মতই। কিন্তু ডেকার্ট পরিবার ছিল জেসুটপন্থী, আর পাস্কেলরা ছিল জ্যানসেনবাদী। জ্যানসেনপন্থীরা এতটাই উগ্র মতবাদের ছিলেন যে তারা বিজ্ঞানকে পাপাচার ভাবতেন, বিজ্ঞানসাধনা ছিল শয়তানের অনুগামী হওয়ার শামিল। সৌভাগ্যবশতঃ পাস্কেল নিজে ধর্মকর্ম নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। বিজ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ জেনেও বেশির ভাগ সময় বিজ্ঞান নিয়েই কাটত তাঁর। পাস্কেল ছিলেন এক ক্ষণজন্মা পুরুষ, এত বড় প্রতিভার মানুষ শতাব্দীতে একজন কি দুজন জন্মায় পৃথিবীতে। কৈশোর আর যৌবনে খানিক উশৃংখলা হয়ত ছিল তাঁর চরিত্রে। বিজ্ঞানচর্চা থেকে যেটুকু বিরতি পেতেন সেটুকু তাঁর কাটত জুয়ার আড্ডায়। ভীষণ জুয়ার নেশা ছিল লোকটার। নিজে যে জুয়া খেলতেন তেমন তা নয়, কিন্তু তাঁর অঙ্কের মাথা দিয়ে পেশাদার জুয়ারিদের পরামর্শ দিতেন কখন কোথায় কত টাকা বাজি রাখলে কত লাভ হতে পারে, কত লোকশান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ কাজে লেগে যেত। ফলে অত্যন্ত বিত্তশীল জুয়ারিরা টাকার বস্তা নিয়ে তাঁর কাছে ধর্না দিতেন বাজির পরামর্শ নেবার জন্যে। এতে করে পাস্কেল নিজে জুয়া না খেলেও প্রচুর ধনসম্পদ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এটা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত লাভ। সেটা সাময়িক, অস্থায়ী। চিরস্থায়ী লাভটা হয়েছিল গোটা বিশ্বের। তাঁর বাজিবিদ্যার সূত্র ধরে কালে কালে একটা নতুন শাখা তৈরি হয়ে যায় গণিতশাস্ত্রের—সম্ভাবনাতত্ত্ব(Probability Theory)। বর্তমান জগতে probability আর statistics এর ব্যবহার নেই এমন কোন শাখা বিজ্ঞানে তো নেই’ই, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি—এধরণের যাবতীয় মূল-বিজ্ঞানবহির্ভূত বিষয়েও এর ব্যবহার প্রায় অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যে জুয়ার মত একটি খারাপ নেশা, যার প্রতি ধর্ম এবং সমাজ দুটিরই বিরূপদৃষ্টি, সেই ঘৃণিত জিনিসটি থেকেই উত্পন্ন হয়েছে জ্ঞানবিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা, এবং সপ্তদশ শতাব্দীর এই পথভ্রষ্ট উশৃংখল যুবক তার আদি জনক। আমার ব্যক্তিগত মতঃ সম্ভাবনাতত্বের আবিষ্কার অনেকটা অভিকর্ষ তত্বের মতই এক যুগান্তকারি, মৌলিক আবিষ্কার। প্রকৃতির অন্যান্য মৌলিক সত্যের মত সম্ভাবনাও একটি মৌলিক সত্য।
পাস্কেলের গল্প অবশ্য এখানেই শেষ হয়ে যায় না। ১৬৫৪ সালের ২৩শে নভেম্বর। তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। পুরাকালের পয়গম্বররা যেমন দৈববানী বা অহি লাভ করতেন হঠাত্ হঠাত্, তেমনি করে পাস্কেলেরও এক অতিপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা হল সেদিন। কোথা থেকে এক ঐশী বানী এসে তাঁর জীবনের মোড় আগাগোড়া বদলে দিল এক রাতের মাঝে। ধর্মকর্মে পরম উদাসীন মানুষটি হঠাত্ করে পরম ধার্মিক হয়ে উঠলেন। গণিত, জুয়া, বিজ্ঞান সব ছেড়ে ছুড়ে সাধুব্রত গ্রহণ করলেন পরের দিন থেকে। একেবারে ভিন্ন মানুষ। ৩১ বছর বয়সে পাস্কেল ফিরে এলেন তাঁর পৈত্রিক ধর্মচর্চায়।
কিন্তু ঐশীবানী হলে কি হবে, সহজাত মেধা যাবে কোথায়। কৌতূহল আর অনুসন্ধিত্সা যার রক্তমজ্জায় তাকে ধর্মের তাবিজ দিয়ে বশ মানানো কি সম্ভব? ধর্ম তাঁর একপ্রকারের অস্থিরতা কমাতে সক্ষম হলেও বুদ্ধির অস্থিরতা অন্যরকমের অশান্তির ঝড় তুলল তাঁর মনে। চার বছর পর একটা শক্ত অসুখ হল তাঁর। তখন তিনি জ্ঞাতসারেই প্রভুর কাছে কিছুদিনের জন্যে ছুটি কামনা করে জ্ঞানসাধনায় মনোযোগ দিলেন। ঠিক বিজ্ঞান না হলেও বিজ্ঞানসংক্রান্ত, সাথে সাথে ধর্মবিষয়কও। ভাবলেন তাহলে নিশ্চয়ই মহাপ্রভু ক্ষমার দৃষ্টিতেই দেখবেন তাঁর কর্মকাণ্ডকে। ঠিক করলেন জুয়ার বাজিতত্ব দিয়েই তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। ঈশ্বর বিশ্বাস করাতে কত ঝুঁকি আর না করাতে কত ঝুঁকি তার একটা আনুমানিক সংখ্যা দাঁড় করিয়ে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে বিশ্বাস করাটাই কম ঝুঁকিপূর্ণ, না করাতে বিস্তর বিপদের সম্ভাবনা। রীতিমত অঙ্ক কষে বের করা সব ফলাফল, যদিও অঙ্কটা কিভাবে করা হল, কি ধ্যানধারণার ভিত্তিতে সেবিষয়ে আধুনিক চিন্তাবিদদের কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে বৈকি। পাস্কেলের যুক্তিটা ছিল অনেকটা এরকমঃ ধরুণ খোদা আছে। তাহলে তাঁকে বিশ্বাস করাতে ‘অসীম’ ফায়দা। তিনি যদি না থাকেন তাহলে বিশ্বাস করে লাভ বা লোক্শান কোনটাই নেই, তার অর্থ ‘শূন্য’ ফায়দা। আর যদি খোদা থাকেন এবং তা সত্ত্বেও বিশ্বাস করা হচ্ছে না তাহলে তার শাস্তি গুরতর, অর্থাত্ ‘অসীম’ বিপদ। তবে তিনি না থাকলে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস তাতে কিছু আসে যায় না। মোটমাট তাঁর হিসেব মতে বিশ্বাস স্থাপন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ, এতে কোন ঝুঁকি নেই। পাকা ধার্মিকের যুক্তি হয়ত নয় এটা, তবে পাকা জুয়ারির যুক্তি তাতে সন্দেহ নেই। জুয়ারির যুক্তি দিয়ে তিনি একাধারে শূন্য, অসীম ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে দিলেন।
ব্লেই পাস্কেলের বর্ণাঢ্য জীবনের বিচিত্র কাহিনী বিস্তারিতভাবে জানবার আগ্রহ থাকলে পাঠককে তাঁর পূর্ণ জীবনী পড়তে হবে।
ডঃ মীজান রহমানের লেখার আমি একজন গুনমুগ্ধ পাঠক, তাই সময় করে নিয়ে উনার লেখাটি পড়ে শেষ করলাম। গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস নিয়ে তাঁর এই প্রাঞ্জল লেখাটি সত্যি প্রসংসার দাবীদার। সুপঠিত এই চমতকার ধারাবাহিকটি উপহার দিবার জন্য ডঃ রহমানকে অজস্র ধন্যবাদ।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
খুব ভালো লাগলো, মীজান ভাই। আপনার প্রতিটি লেখায় ঢুকি নতুন কিছু জানার আশায়…প্রতিবারই কিছু না কিছু নিয়ে ফিরি।
মীজান ভাই, কি চমৎকার লেখা। বাংলায় এই বিষয়ে এমন প্রাঞ্জল লেখা নেই। আপনি লিখছেনঃ
এই ভাষার অক্ষরাবলী যেমন মোহিত করে, এর অন্তর্নিহিত সত্যও তেমনই অভিভূত করে – পরবর্তীতে ইতালী ইউরোপের অন্য অংশের তুলনায় পিছিয়ে পরে। আমরা আশা করব মুদ্রিত অক্ষরে আপনার এই লেখাটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান-পিপাসু মানুষের (সব বয়েসেরই) কাছে পৌঁছাবে।
মীজান ভাই, কেপলার প্রসঙ্গে আমার একটা ছোট প্রশ্ন ছিল। আপনি লিখেছেনঃ
দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী সূর্য থেকে পৃথিবী বা অন্য যেকোন গ্রহ পর্যন্ত যদি একটি সরলরেখা কল্পনা করা যায়, তাহলে সেই রেখাটি একই সময়ে একই ক্ষেত্রফল রচনা করবে, সেই ক্ষেত্রে কি প্রদক্ষিণের আঞ্চলিক গতিবেগের পরিবর্তন হবে না?
ভাল থাকবেন।
@দীপেন ভট্টাচার্য,
আমার লেখা আপনি আগ্রহ নিয়ে পড়ছেন, সেটাই অনেক আমার জন্যে। উপরি হিসেবে পাচ্ছি আপনার স্তুতিবাক্য, এর বাইরে আর কি প্রত্যাশা থাকতে পারে আমার মত ক্ষুদ্র লেখকের। আপনার প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গত। হয়ত আমারই ভাষার দৈন্যের কারণে ভালো করে ব্যাখ্যা করতে পারিনি। ইংরেজিতে কেপ্লারের সূত্রটি হলঃ the radius vector sweeps out equal areas in equal times. এটা অভিকর্ষ শক্তিটির কেন্দ্রিক চরিত্রেরই পরিনাম। তথ্যটি নির্ভুলভাবে পরিবেশন করতে পারিনি বলে লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আগামীতে আরো যত্নবান হতে চেষ্টা করব। মীজান রহমান।
মীজান ভাই, আপনি হচ্ছেন রেনেসাঁ মানুষ, নিজেকে “ক্ষুদ্র লেখক” বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। আপনার উত্তরের জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
পাঠকদের অশেষ অশেষ দন্যবাদ। তাঁদের মন্তব্যগুলো বিশেষভাবে উত্সাহিত করছে আমাকে গণিত নিয়ে আরো লিখার জন্যে। গণিত আমার জীবন, আমার চিন্তা আর কর্মজগতের প্রায় সবটা জুড়েই তার অবস্থান। কিন্তু কর্মের কোলাহল শেষ হবার আগে আমি নিজেও বুঝতে পারিনি পুরোপুরি এর মোহময়ী শক্তি। বুঝিনি তার কত রহস্য, কত জাদুময়তা। আমার মনে হয় জ্ঞানবিজ্ঞানের যত শাখাপ্রশাখা আছে তার সবকটারই মোহানা এখানে, সব স্রোত এসে মিশেছে তার গভীর জলেতে। তাই সে এত সুন্দর, এত নির্মল। আমি জানি শূন্যের একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে। এত ক্ষুদ্র হয়ে সে যেন সমগ্র ভুবন জুড়ে ছড়িয়ে আছে। কাছে থেকে প্রায় দেখাই যায়না তাকে অথচ দূর নীহারিকা থেকে সে যেন বারবার মুচকি হেসে কি বলেও বলছে না। সে চিররহস্যময়ী মায়ামরিচীকা। হ্যাঁ, বলতে পারেন আমি শূন্যের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। হ্যাঁ, অবশ্যই তার মানমন্দিরে আমি বারবার যাব অঞ্জলি নিয়ে। একটু সময় দিন।
মীজান রহমান।
@মীজান রহমান,
আপনার লেখার স্টাইল দারুন। কী বলব বুঝতে পারছিনা। গান হলে বলতাম সুললিত কন্ঠ। শূন্যের কথা বলতে গিয়ে আনুসাংগিক সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য আপনার লেখায় আছে।
এটি যে একখানি Bestseller বই হচ্ছে তা বুঝতে পারছি। স্কুল ছাত্রছাত্রীদের জন্মদিনের উপহারের জন্য এটি একটি Hotcake হবে। পরবর্তী প্রজন্মের অংকভীতি দূরীভূত করার জন্য আপনার বইখানি মূল্যবান ভূমিকা রাখবে। বড়রাও বইখানি সংগ্রহ করে অঙ্কপ্রেমীর দলে নাম লিখিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে।
অনেক কথাই বলার ছিল। কিছুই আর বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু, একটা কথা ছাড়া। এটা ই-বই হিসেবে ছাড়া হোক।
ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করছি না।
চলুক সিরিজটা আরো…
গোটা বিশ্বই তো শূন্যের খেলা।বলা হচ্ছে স্রেফ শূন্য থেকে সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে কোয়ান্টাম ফ্লাক্সুয়েশনের মাধ্যমে। এভাবে চিন্তা করলে আমাদের জীবনটাই তাহলে শূন্যের ওপর দাড়িয়ে আছে। তাহলে নৈতিকতার ভিত্তিটা কি হবে, কেন আমরা নীতি বোধকে মেনে নিয়ে জীবন যাপন করব সেটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা যায় বলে ধারনা। জীবনটাকে সত্যি সত্যি শূন্য বা অসার বলে মনে হয়। যাবতীয় কাজ কর্ম সবকিছুই অসার বলে মনে হয় যা পরিনামে মানুষকে মারেফতি লাইনে নিয়ে যায়। ভূললে চলবে না যে, ধর্মব্যবসায়ীরা সাধারন মানুষকে সবচেয়ে যে দুর্বল জায়গাতে আঘাত করে তা হলো মৃত্যু। মৃত্যু মানুষের জীবনকে শূন্যে মিলিয়ে দেয়। জন্ম, মৃত্যু ও শূন্য আর চিন্তা করতে পারছি না ভাই , মাথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে শূন্য নিয়ে লেখাটা কিন্তু আমাকে শূন্যের দিকে ঠেলে দেয়নি। ধন্যবাদ চমতকার একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য।
মীজান রহমান সত্যই চমৎকার লেখেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে এত সহজ ভাষায় আর কেউ লিখতে পারেন বলে আমার জানা নেই।
তিলকে তাল করার আমার দূর্নাম আছে বাসায়। কিন্তু জনাব মিজান রহমান যে শুন্যকে সমগ্র বিশ্বব্রম্মান্ডে পরিব্যাপ্ত করে দিলেন কি সহজে! অঙ্ক, জ্যামিতি ভাল বুঝি না বলে ফিজিক্স বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়ার চেষ্টাই করিনি, অথচ কিছু বুঝে উঠার আগেই কিভাবে যেন তিনি এলজ্যাব্রা, ক্যালকুলাস, জ্যামিতি, বৈশ্লেষিক জ্যামিতি, পিথেগোরাসের সূত্র থেকে টরিসেলির জুয়া খেলার সূত্র পর্যন্ত সব শিখিয়ে দিলেন! অঙ্ক যে এতো সুন্দর সাহিত্য হতে পারে এটা না পড়লে জীবনেও বুঝতে পারতাম না। সহস্র সালাম আপনাকে, মিজান ভাই।
বেশ কয়েক বছর আগে অভিজিৎ রায় যখন আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী লিখছিলেন/লিখেছিলেন, গ্যালিলিও বা নিউটনের প্রসঙ্গে আমি একটি মন্তব্য করেছিলাম ওমর খৈয়ামের উদাহরণ টেনে। মিজান রহমানের “শুন্য” এর প্রথম পর্বের ষষ্ঠ পরিচ্ছদে এসম্পর্কে আলোকপাত দেখে বহুদিন আগে পড়া সেই গল্পটা আবার মনে পড়ে গেল। স্কুলে থাকতে ‘হ্যারল্ড ল্যাম্ব’ নামে এক লেখকের ওমর খৈয়ামের জীবনীর বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম। যে ওমর খৈয়ামকে আমরা কবি হিসেবে জানি, আদিতে তিনি ছিলেন অঙ্কবিদ ও জ্যোতির্বিদ। এক রাতে তিনি তাঁর মানমন্দিরে নিমন্ত্রণ করলেন ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ’ ইসলামিক চিন্তাবিদ ঈমাম গাজ্জালীকে (যিনি একসময়ে নাস্তিক হয়ে গিয়েও পরে আধ্যাতিকতা ও আনুষঙ্গিকতার (রিচুয়ালিষ্টীক) সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ধার্মিক হয়ে যান)। খৈয়াম জিজ্ঞেস করলেন ‘গাজ্জালী আপনি কী দেখছেন?’ গাজ্জালীঃ ‘আকাশে অনেক তারা’। খৈয়ামঃ ‘এখন কী দেখছেন?’ গাজ্জালীঃ ‘তারাগুলি আমার চারপাশে ঘুরছে’। খৈয়ামঃ ‘না তারাগুলি নয়, আপনিই ঘুরছেন, তারাগুলি দাঁড়িয়ে আছে’ বলে আলো জ্বালিয়ে দেখালেন যে তিনি যে মঞ্ছে দাঁড়িয়েছিলেন সেটিই ঘুরছে, কৃত্রিম ভাবে বানানো তারাগুলো স্থির ছিল। বলেছিলেন, আমাদের পৃথিবীটাও সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। যতদূর মনে পড়ে, গাজ্জালী হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েও তাঁর বিশ্বাস থেকে সরে আসতে রাজী হন নাই, এরকম লেখা ছিল। পৃথিবী ও সূর্যের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর এই বৈপ্লবিক মনোভাবের কারনে মৌলবাদী শক্তি শুধু মানমন্দিরটি নয়, কয়েক সহস্র বইএর পাঠাগারটিও পুড়িয়ে দেয় তাঁর সারাজীবনের গবেষণালব্ধ পান্ডুলিপি গুলো সহ। সংসার বিবাগী হয়ে পথে পথে ঘুরে তিনি কবি পরিচয়ে বেঁচে রইলেন।
আমরা কি আবার ব্রুনো, বা গ্যালিলিও বা খৈয়ামের যুগে ফিরে যাচ্ছি? ।
@আশরাফ আহমেদ,
চারদিকের হাল চাল দেখে আপনার কি এখনো সন্দেহ আছে নাকি ????
@আশরাফ আহমেদ,
আমরা তো তার চাইতেও খারাপ যুগে বাস করছি। দেখুননা সারা বিশ্বব্যাপি কি চলছে ইসলাম নিয়ে। আমাদের কারও জীবন কি বিপদমূক্ত? গোটা বিশ্ব যে এখন ইসলামী তরবারীর নিচে জিম্মি হয়ে আছে। এক্ষেত্রে প্রথম আলোর সম্পাদক তো কিছুই নয়। এমনকি বারাক ওবামা পর্যন্ত ইসলামের প্রশংসায় পঞ্চমূখ, যদিও তার দেশ ক্রমশঃ ইসলামীদের লীলাভূমিতে পরিনত হতে যাচ্ছে ।
মিজান ভাইকে প্রচুর ধন্যবাদ এত সুন্দর, সহজ এবং মসৃন ভাষায় বিজ্ঞান ও গণিতের মমার্থ ব্যাখ্যা করার জন্য। বিজ্ঞান এবং গণিতকে সবার জন্যে সহজ করে দেওয়া সহজ নয়।
@আশরাফ আহমেদ,
ঈমাম গাজ্জালী সম্বন্ধে পড়েছি নাস্তিক হওয়ার পরে একটানা তিরিশ বছর ধরে একনিষ্ঠভাবে (এবং একান্তে) জ্ঞানসাধনা করেন। এই সাধনার শেষে “বিশ্বাসে মিলায় সত্য, তর্কে বহুদূর” জাতীয় একটা সিধ্বান্তে আসেন। তখনকার মুসলমান পন্ডিতদের মধ্যে যে দর্শন এবং যুক্তিচর্চার চল ছিল তাকে আক্রমণ করে মোটা দাগের এক বই লিখে ফেললেন, “দর্শনের অসংলগ্নতা” (The Incoherence of Philosophy)। তখনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক আবু রুশ্দও ছাড়বার পাত্র নন। ঈমাম গাজ্জালীকে মোক্ষম একটা জবাব দেওয়ার জন্য লিখলেন, “অসংলগ্নতার অসংলগ্নতা” (The Incoherence of the Incoherence)।
গাজ্জালীর আর একটা বইয়ের নাম ছিল, “কিমিয়ায়ে সাআদত” (The Chemistry of Virtue)। এতে বোঝা যায় তখন বিজ্ঞানচর্চার রমরমা অবস্থা ছিল এবং ধর্মশাস্ত্রের লেখাতেও বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যাবহার করাটা হয়ত ফ্যাশনেবল ছিল।
আমরা কখনো অতীতে ফিরে যাইনা তবে অতীতের ভূত মাঝে সাঝে আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়। কিন্তু বেশিদিন ঘাড়ে চেপে থাকতে পারেনা। নিজেই নেমে যায় অথবা জোর করে নামিয়ে দেয়া হয়। বিজ্ঞান আর চিন্তার অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য; মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে যায় কিন্তু কখনোই থেমে পড়েনা।
@মীজান রহমান,
শূন্যের মধ্যে এত বর্ণ লুকিয়ে ছিল তা কে জানত?
ধন্যবাদ মীজান রহমানকে তার এই সাবলীল এবং গতিময় পর্বের জন্য।
আগে গণিতের ফাঁকফোকর দিয়ে শূণ্যকে অন্যকোন সংখ্যার সমান দেখানোর চেষ্টা করতাম। একবারতো শূন্যকে অসীমের সমানও প্রমান করে ফেলেছিলাম। যাহোক এখন মনে হচ্ছে শূন্য আসলেই অসীম হবার দাবি রাখে।
আশা করি শূন্য পর্ব আকারে চলতে থাকবে এবং মীজান রহমান আমাদেরকে শূন্যের মধ্য দিয়ে অসীমের পথে নিয়ে যাবেন।
মুক্তমনায় গণিতের লেখা এমনিতে একটু কমই মনে হয় পাওয়া যায়। আশা করি মীজান রহমান গণিতের অন্যান্য বিষয় নিয়েও লিখবেন।
অসম্ভব ভালো একটা লেখা পড়লাম। আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির স্কুল প্রোগ্রাম গুলোতে বাচ্চারা নানা রকম প্রশ্ন করে। এই লেখা থেকে সেসব প্রশ্নের কিছু উত্তর পেলাম। তার সাথে এমন কিছু ক্লু, যেখান থেকে তাদের মনে আরও প্রশ্ন জাগাতে পারব। ধন্যবাদ লেখক কে।
আসলেই দুর্দান্ত এবং সেই সাথে সাবলীল লেখা। এ লেখাগুলো মুক্তমনার বিজ্ঞান আর্কাইভের জন্য খুবই দরকারী।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। মিজান সাহেবের কাছে প্রত্যাশা বেড়েই যাচ্ছে।
পরিচিত সব ব্যাক্তিত্বদেরও যে এমন বিচিত্র কাহিনী আছে কে জানত।
আশা করি এই সিরিজ় চলবে।