অম্লান কুসুম দত্ত নামটা যখন শুনি, স্কুল ফাইনালের গণ্ডি পেরুতে তখনও বছর দেড়েক বাকি। সে প্রায় ৫৬ বছর আগেকার কথা। তার দশ বছর পরে তাঁর যে বই টা প্রথম পড়ি, তার নাম For Democracy যা পড়ে আইন্সটাইন অম্লানবাবুকে চিঠি লেখেন। “It takes more time than one would expect from his size.” . অম্লানবাবু এটি প্রকাশ করেন ১৯৫৩ সালে, আইন্সটাইনের জীবনাবসানের দু’ বছর আগে। একদম শুরুতেই লেখা –
“The etymological platitude that democracy means the rule of the people and in modern states, of the representations of the majority of the people, has in the present century, done dubious service to the cause it proposes to uphold. The definition of democracy is wrong as well as dangerous. It is not by counting the heads of the Hitlerite regime was democratic or not” ।
চমক লেগেছিল। তিনি যখন ১৩০ পৃষ্ঠার কোয়ার্টার ডিমাই সাইজের বইটার পান্ডুলিপি লিখছেন, যোসেফ ভিনারিয়োনভ স্তালিন তখন বেঁচে, কিন্তু প্রথমেই সমালোচনার কশাঘাত করলেন হিটলারকে। আমি তখন সরকারি চাকুরে, কিন্তু গোপনে যুক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপি আই ) সঙ্গে। আমাদের শেখানো হ’ত , অম্লান দত্ত, শিব নারায়ন রায় প্রভৃতি আমেরিকার দালাল। চমক লেগেছিল সে কারণেই। পরে ইতিহাসবিদ ও সিপি আই-এর প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী-বাগ্মী গৌতম চট্টোপাধ্যায় বা মার্ক্সবাদী অর্থশাস্ত্রজ্ঞ কল্যাণ দত্তর মত কেউ কেউ এই রকম তকমা আঁটার বিরোধী ছিলেন। এঁরা (যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্য) অম্লানবাবুর সহপাঠী। এরা তিনজন সিপি আইতে যোগ দেন। অম্লান বাবু স্তালিন আমলের গণতন্ত্র-সংহার নীতি তথা সরকারী মার্ক্সবাদ মেনে নিতে পারেন নি। এই চার জনের মধ্যে মতান্তর তীব্র ছিল ( অবশ্য সন্তোষবাবু ১৯৮০ দশকে ভাবনার দিক থেকে অম্লানবাবুর কাছাকাছি এসে গিয়েছিলেন), কিন্তু মনান্তর ঘটে নি।
ঐ বইটি লেখার পরিপ্রেক্ষিত ‘দেশ’ পাক্ষিক-এ তিনি বিবৃত করে গেছেন জীবনের অন্তিম পর্বে ।
“হিটলারি স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটেছে, স্তালিনি একনায়কতন্ত্র তখন তুঙ্গে, চিনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। গণতন্ত্রের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক তখন প্রবল। আমি ছিলাম কমিউনিস্ট একদলীয় শাসনতন্ত্রসহ সব রকমের স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে।… সেই উত্তাল সময়ে আমার বই নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হল তাতে উত্তেজনা ছিল একটু বেশী মাত্রাতেই। সমালোচকদের মুখে যত যুক্তি তত ছিল না যত ছিল আক্রোশ। ‘ইতিহাস’ সেদিন আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধবিজয়ী স্তালিনবাদের সপক্ষে অথচ আমি বলছি বিপক্ষে, এটাই হয়তো সেই মুহূর্তে সমালোচকদের দৃষ্টিতে অমার্জনীয় ঔদ্ধত্য মনে হয়েছিল।”
যেহেতু আমি নিজে স্তালিনের অনুরাগী ছিলাম বহুদিন [অধুনালুপ্ত ও ইতিহাসে স্মরণীয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে(ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬) স্তালিনের ব্যক্তিপূজার তীব্র সমালোচনার সঙ্গে সহমত পোষণ করা সত্বেও] পরে যখন জানলাম ঐ সব সমালোচকদের কেউ কেউ আইনস্টাইনের For Democracy সম্পর্কে সপ্রশংস উক্তি শোনার পরে বলেছিলেন, ‘আইন্সটাইন বিজ্ঞান জানেন। রাজনীতির কি বোঝেন?”,স্বভাবতই বিস্মিত হয়ে ছিলাম। এদের অনেকেই পরে মান্থলি রিভ্যু পত্রিকায় আইন্সটাইনের বিখ্যাত প্রবন্ধ Why Socialism? প্রকাশিত হ’বার পরে কলার উঁচু করে বলতেন, ‘সমাজতন্ত্রের পক্ষে যখন আইনস্টাইন, তখন মার্ক্সবাদ অপরাজেয়, বিজ্ঞান (অবশ্য মার্ক্স বা এঙ্গেলস কিন্তু মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান বলেন নি)।
সেই সময়ে (১৯৫০এর দশকে) সিপিআই-এর ভিতরে একাংশ চীন বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে পার্টির ভিতরে-বাইরে আওয়াজ তুলেছিল, চীনের সাফল্য ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবে দিশারী, অনুসরণীয়। নক্সালপন্থী আন্দোলনের প্রথম দশকে চারু মজুমদারের শ্লোগান – ‘চীনের পথ আমাদের পথ। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, সেই আওয়াজ থেকেই উত্থিত।। অম্লানবাবু For Democracyতে লিখেছিলেন,
“With the best of luck insurgents may gain a limited success in parts of the Himalayan territory; beyond that they must face the certainty of defeat. But in the very process of this defeat, not only will incalculable suffering be inflicted on the people, but the government will be brutalized by the very methods of repression” (p 87).
নক্সালপন্থী আন্দোলনের বছর পনেরো আগে তিনি যে আশংকা করেছিলেন, তা দুঃখজনক হলেও প্রমাণিত হয়েছিল। চারুবাবু ও তাঁর ‘ঐতিহ্যবাহী’ সি পি আই (এম-এল)-এর কোন গোষ্ঠীই এই সত্য স্বীকার করেনি।
অবশ্য তাঁর কিছু কিছু তত্বগত অস্বছ্বতা ছিল For Democracyতে। যেমন তিনি ধরে নিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। ঠিক হ’ত য দি বলতেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। বারে বারে লিখেছেন সোভিয়েত কমিউনিজম। তারঁ আর একটি বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন জাগে। প্রযুক্তির বিকাশে তিনি যৌক্তিক বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে ‘টোটালিটেরিয়ান’-এর সংকেত নির্দেশ করলেও, জর্মনিতে নাতসীবাদের বীজ আবিস্কার করেছিলেন মার্ক্সবাদী বিকাশের মধ্যে- “It is not wholly an accident that Nazism rose in a country which earlier had been deeply under the spell of Marxism” (পৃ ৬৩)। তিনি কোনো সমীক্ষার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আসেন নি। Politics is the concentrated expression of economics, লেনিনের এই উক্তিটি ভেবে দেখতে পারতেন। ইতিহাস লেনিনের পক্ষে। পূর্বতন পশ্চিম জর্মনির একাধিক রাষ্ট্রদূত এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে বলতেন- নাতসীবাদ জর্মনির ইতিহাসের সঙ্গে মেলে না ( Nazism as a phenomenon doesn’t fit into German history and tradition)। কোন কোন য়োরোপীয় ইতিহাসবিদ মনে করেন, জর্মনিতে রেনেসাঁর স্পর্শ না লাগায় গণতন্ত্র প্রস্ফূটিত না হওয়ায় নাতসিবাদের অনুকূল প রিবেশ গড়ে ওঠে নি। কিন্তু এখানেও খটকা লাগে। ইতালিতে তো রেনেসাঁ ফুলে-ফলে বিকশিত হয়েছিল। তাহলে মুসোলিনী ও ফ্যাসিবাদের উত্থান কি করে হ’ল? ফ্রান্সে দালাদিয়ে বা ব্রিটেনে চেম্বারলেনের মত ঘৃণার্হ রাষ্ট্রনায়কের উদ্ভব কি করে হ’ল? অম্লানবাবুর ঐ উক্তি যেন তড়িঘড়ি সুত্রায়ন-উদ্বীগ্নতা, (too hypothetical to be formulated, disorderly haste)। মার্কিণি প্রশাসন-বিশেষজ্ঞ হেনরি বিয়েনেন-এর Violence and Social Change পুস্তকে নাতসী ও কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থাকে টোটালিটেরিয়ান ধাঁচে ফেলার প্রয়াস সুস্পষ্ট হ’লেও, তিনি বলেছেন হিংসা/সন্ত্রাস শুধুমাত্র instrumentality নয়, যদিও তার স্ব-সংহারের বীজ তার অন্তর্নিহিত।
অম্লানবাবুর সংসদীয় গণতন্ত্রের বিষময় অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বার বার লিখেছেন। তিনি ঠিকই লিখেছিলেন, “দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্বন্ধ যেমন তাদের লাভ-ক্ষতিতেই শুধু নিবদ্ধ, তেমনি এর লাভের দিকটা থাকে প্রধানত দলের নেতাদের অধিকারে আর ক্ষতিটা তার প্রায় সবটাই পড়ে সাধারণ মানুষের ভাগে”। কিন্তু তার বিকল্প কি ‘দলহীন গণতন্ত্র’? বিহার, উত্তর প্রদেশে তো পঞ্চায়েতী নির্বাচন দলহীন গণতন্ত্রের ভিত্তিতে হয়। সেখানে গণতন্ত্রের হাল অত্যন্ত খারাপ। তাছাড়া দলহীন গণতন্ত ও ‘মতাদর্শের ইন্তেকাল’- এই দুটি ধারণা অধুনালুপ্ত কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম-এর মিলান কংগ্রেসে(১৯৫৫) তে উত্থাপিত ও আলোচিত হয়। প রে ফাঁস হয়েছিল ঐ কংগ্রেসের যাবতীয় ব্যয় বহন করেছিল সি আই এ। কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম ও তার সাময়িকী ‘এঙ্কাউন্টার’ তুলে দিতে হয়েছিল। আমাদের এই সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই লড়তে হবে। সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম গ্রাম সেই শিক্ষাই দিয়েছে। তা না হ’লে অম্লানবাবু মমতা ব্যানার্জির অনশন মঞ্চে গিয়ে সংহতি জ্ঞাপন করতেন না। প্রতীকী অনশন করতেন না। এই খানেই তো সিভিল সোসাইটির ভূমিকা উজ্বল হয়ে উঠেছিল।
নরসিমহা রাও-এর আমলে যখন আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ( আই এম এফ)এর নির্দেশে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি গৃহীত হয়। অম্লানবাবু তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কেন্দ্রীভূত ও লাইসেন্স-পারমিট রাজ থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় অর্থনীতি বিকশিত হবে। শেষের দিকে তাঁর মোহভঙ্গ হয়। বাজার অর্থনীতির চেয়ে জোর দেন গ্রাম-জনপদ-ভিত্তিক বাজারের কথা লিখলেন ‘বিশ্বায়নের কবল থেকে….বাঞ্ছনীয় এমন গ্রাম সমাজ যেটা যথাসম্ভব স্বয়ম্ভর। ( বহুরূপে সম্মুখে তোমার – দেশ ২ অগাস্ট ২০০৯)। ছেষট্টি বছর আগে কার্ল পোলানয়ি এই ধারণা পেশ করেছিলেন, মার্কেট সোসাইটি’র তত্ব সুত্রায়িত করেছিলেন , তাঁর গ্রেট ট্রান্সফরমেশ্যন্স গ্রন্থে। ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা যে বাস্তব সত্য, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হ’ল। সেই বছরেই অর্থাত ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস-এ বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আই এম এফ-এর জন্ম। পোলানয়ি ও ঐ দুই ব্রেটন উডস যমজের মতাদর্শগত অবস্থান বিপরীত।
পূর্বোক্ত প্রবন্ধে তিনি আদিবাসী সমাজের অনুকরণীয় দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঐ সমাজে ও তার চরিত্রে ‘কিছু গুণ আছে যেখানে তাঁরাই শ্রেষ্ট’, এই কথাগুলি অকপটে বলেন। উন্নয়নের নামে ‘মাত্রাহীন যে দর্প নিয়ে আমরা আদিবাসীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছি,সেই দর্পই আমাদেরও বিনাস করবে। লালগড় য দি আমাদের কিছু সংযমের শিক্ষা দেয় তবে সেটা সকলের পক্ষেই মঙ্গল হবে”।
তিনি শেষের দিকে গান্ধিজির ভাবনায় (এবং রবীন্দ্রনাথের পল্লীভাবনা) নিজেকে নিমগ্ন করেছিলেন। বোধ হয় ( আংশিকভাবে হলেও) মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘রয়াডিক্যাল হিউম্যানিজম থেকে সরে এসেছিলেন।
অম্লান দত্তকে স্মরণ করিয়ে দেয়া চমৎকার এ লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ, শঙ্করদা।
মুক্তমনায় নিয়মিত লিখবেন আশা করছি।
চমৎকার লাগল।কিন্তু নকশালদের শোচনীয় পরাজয়ের কারণ হিসেবে তৎকালীন নেতারাও দায়ী ছিলেন,
কথাটা কি সত্য নয়?নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতাকে কি দায়ী করা যায়না? জানতে ইচ্ছুক।