পর্ব-৬

ভারসিটি খুলে গেল। দেখতে দেখতে গরম চলে গিয়ে শীত জাঁকিয়ে বসলো। আমি আর আঁখি যেনো এক দন্ড একা থাকিনা। ক্লাস শেষ হলেই আড্ডা। এর মাঝে একদিন শেষ বাস ফেল করলাম। বাসা যাবো কি করে ? ভয় পেলাম ।
আঁখি বলে,
কিংশুকের গাড়িতে যা।
আমি ইতস্ততঃ করেও রাজি হলাম। কি করব , ও দিকে বাসার চিন্তা। সারা রাস্তা চুপচাপ থাকলাম। শুনলাম কিংশুকের জীবনের অনেক বিছিন্ন ঘটনা। বাবা এর একটা বিয়ে করেছেন। ও ক্লাস টেন এ থাকাকালীন মায়ের ক্যান্সারে মৃত্যু। ভীষন কষ্ট লাগল। ওর বেদনা ভরা চেহারা দেখে মমতায় বুক ভরে গেলো। যদি ওর জন্য কিছু করতে পারতাম। কি বা করতে পারি , আমার ক্ষমতা কতো দূর। এক সময় কিংশুক জিজ্ঞেস করে ,
–তোমার ভয় করে না ?
-ভয় ? মানে ? কেনো ভয় পাবো ?
–আমার সাথে গাড়িতে একা , সবাই আমাকে খারাপ জানে –
–হুম তুই আমার কি করবি ? কেও আমার কিছু ই করতে পারবে না , এটা মাথায় রাখিস। ততো দিনে আমরা তুই এ চলে গেছি।
বাসার কাছে গাড়ি থেকে নামলাম। তাকে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকলাম।
কাপড় না ছেড়েই নিজকে বিছানায় ছুঁড়ে দিলাম। ক্লান্তিতে সারা শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে। বালিশে মুখ গুজেঁ কত কি এলোমেলো ভাবনা। মা বারবার খাবার জন্য তাগাদা দিলো।
প্রায় মনে হয় চারপাশের মানুষ একই সুরে গান গায়। জীবন মনে হয় এক সুত্রে গাঁথা, কিন্তু। আমি কী করছি ? কার জন্যে কি কারনে পৃথিবীতে এসেছি ? আমি কি অন্য সবার চাইতে আলাদা ?
খেয়ে দেয়ে ঘুমের ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। আমার কি ইনসোমনিয়া হল নাকি ? রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাই ।

পর্ব-৭

ভারসিটি থেকে বাসায় ফিরলেই ছোট বোনের কাছে শুনি অনেকে ফোন করেছিল। কোন দিন আহাদ, বিরু ভাই, কখন ও সারোয়ার। এতো মানুষ আমার বাসার ফোন নাম্বার জানল কি করে বুঝিনা। বাসায় থাকলেও বলি নাই। ভাল লাগেনা ঘুরে ফিরে একই কথা শুনতে।
তখনও মোবাইল বের হয়নি দেশে। ভাগ্য ভালো।
এক দিন আঁখি বলে ,
–কিংশুকের সাথে কথা বলিস না কেন ভালো করে ?
–কথা তো বলি –কেন?
–ও বলে তোর বান্ধবীর অনেক দেমাগ। আমাকে পাত্তা দেয় না ।
ভাবতে বসি। ভেবে কুল কিনারা পাইনা। সবাইকে এক রকম লাগে ।
তবে কিংশুকের মা নেই – সব মিলিয়ে একটা মমতা বোধ আছে বৈকি। আমি তো তা প্রকাশ করতে জানিনা। আমি অনেক কিছুই পারিনা। মনে হয় ,
মন খারাপ মানুষের কখন লাগে আর কেনো লাগে তার কি নিয়ম আছে ? মন খারাপ হওয়াটা বেশ লাগে এক এক সময়। কিন্তু তা বলা যায়না কারো কাছে ।
ভালোলাগাটা বলতেই হয়না। সেটা এমনি ছড়িয়ে পড়ে। মন যা বলতে চায় সেটা বলতে পারেনা বলেই কি গান লেখা ? কবিতা বানায় কবিরা ? কতো দিনই না মন খারাপ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের যাতে ঐ সব গান, কবিতা বানিয়েছেন।

আজকের দিনটায় আমি পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। সারা দিন পড়াশোনার কাজে বাইরে ছিলাম। সাথে আঁখি। ও যেনো আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে গেছে।
খুব সুখের মুহূর্তে আমি আনমনা হয়ে যাই। জানি এই সুখ এই আনন্দ ক্ষনিকের। তাই যে মুহুর্তে আনন্দ পাই, সেই মুহূর্তে মন বিদায়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়।

আমার আত্মবিশ্লেষনের জন্য আমার একাকীত্ব আমায় নতূন ভাবে চিনতে শেখায় পথ দেখায় আমি সেই পথ ধরে এগোতে চেষ্টা করি। জানিনা আমার গন্তব্যের শেষ কোথায়।
একদিন আমি আর আঁখি হোস্টেল থেকে বার হবার সময় আঁখি বলে –
–আমার হাতের লেখা ভালো নারে—তুই এই কার্ডটাই কিছু লিখে দে,
দেখলাম নতুন বছর উপলক্ষে অগ্রীম সুভেচ্ছা জানাবে কিংশুককে। লিখে দিলাম, ও কার হাতে পাঠাবে সেই মানুষ খুঁজতে লাগল। বিকেল গড়িয়ে গেল ।
শীত তখন ও আছে। তবে হাল্কা। কিংশুকের গাড়ি এসে আমাদের সামনে থামল। নেমে বলে
–চল আজ বেড়াতে নিয়ে যাই তোদের –
আমি ইতস্ততঃ করেও রাজী হলাম। আঁখি আগেই পেছনের সীটে বসে পড়েছে। অনেক বললাম —সামনের সীটে বসতে। বসলনা ।
অগত্যা আমি বসলাম। কিংশুক কে মনে হল আনমনা। চোখ দুটো লালচে ভাব।
বসলাম লেক পাড়ে ‘ হঠাৎ কি ভেবে কিঙ্ঘুক’কে বললাম,
–দেখ আজ যদি তোর মা থাকতো তাহলে এমন হতিসনা তুই –

কিংশুক ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি একটু হতভম্ব হলাম। কাছে বসেছিলাম বলে একটা গন্ধ হাওয়ায় এসে নাকে লাগলো। আমি অবাক চোখে আঁখির দিকে তাকালাম। আঁখি কানে কানে বললো,
–ড্রিঙ্ক করেছে কিংশুক। –
এই প্রথম আমার জীবনে মদ্য পান করা জলজ্যান্ত মানুস দেখলাম। আমাদের পরিবার তো দূরে থাক। আশে পাশে কাওকে দেখিনি। খুব খারাপ লাগল। মানুষের জীবন এমন হয় কেনো খুঁজে পেলাম না। এই বয়সে কি দুঃখে ছেলেটা যে এমন পথে পা বাড়িয়েছে তা কি ওদের পরিবার দেখেনা ?
অনেক বোঝালাম তাকে। ওর ছলছলে চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না ।
সন্ধ্যার পরপরই বাসায় এলাম। কিংশুকের মুখটা মনে পড়ছে বার বার।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেলো ভোর বেলা ।

পর্ব-৮

খুব ভোর। কলিং বেল এর আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চিন্তিতঃভাবে দরজা খুললাম। এতো ভোরে কে? দরজা খুলে স্তম্ভিত আমি ! কিংশুক ! উস্ক খুস্ক মুখ। রাতজাগা ক্লান্তি সারা চোখে।
–আয় ভেতরে।
ততো দিনে কিংশুক এ বাসায় পরিচিত আঁখির ভাই বলে। কিন্তু, আজকের এই আসাটা অন্যরকম। উপরে নিয়ে এলাম। বসবার ঘরে বসতে বলে মুখে চোখে পানি দিয়ে দাঁত ব্রাস করে এলাম।
–হ্যাঁ, -এইবার বল কি হয়েছে তোর –
–আমার গাড়ি হারিয়ে ফেলেছি, কি করবো বুঝতে পারছিনা। এই তোদের আসে পাশেই ।
–গাড়ি তোর চুরি হয়েছে ?
–নাহ ! তাও না –
–তবে? গাড়ি চুরি না হলে হারায় কি করে?
এর পর কিংশুক যা বলে তার অর্থ হল – গত রাতে তার বন্ধু হাসানের বাসায় গেছিল। গল্প গুজবে রাত হয়ে যায়। যখন আঁখির কার্ড গাড়িতে পায়না, ভাবে হাসানের বাসায় ভুলে রেখে এসেছে।

ফিরে যায় হাসানের বাসায়। কার্ড হাতে নিয়ে উল্টো রাস্তা দিয়ে হেটে এসে দেখে গাড়ি নেই। নেই তো নেই। কোথাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যায়। সেখানেও নেই। আবার হাসানের বাসা ও খুঁজে পায়না। এক সময় হাঁটতেই থাকে। তার যেনো মনে হয় সে গোলক ধাঁধাঁয় পড়েছে।

এই ভাবে ভোর হয়। ভোর বেলা যে রাস্তা সোজা দেখে ও রাস্তায় ওঠে। ঐ রাস্তার উঠে দেখে মেইন রোডে এসে গেছে। আর ঐ রাস্তা ঘেসেই আমাদের বাসা।
–কি করবি ? চা দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
–তাই তো বুঝতে পারছিনা কি করা যায় ।
–আগে যা হাত মুখ ধো। মাকে বলে আসি। তার পর দেখি কি করা যায়।
মা’কে সব খুলে জানালাম,
-মা আমাদের সাথে বুলু আছে চেনো তো তাকে –ওকে নিয়ে দেখি কি করা যায়। এই এলাকা তো কিংশুক চেনেনা।
দু’জনা বেরিয়ে পড়লাম গাড়ির সন্ধানে। একটা অটো রিক্সা নিলাম। কিংশুক বলে,
–এক কাজ করি ওয়ার্কশপে অনেক গাড়ি আছে। একটা নিয়ে আরো ভাল ভাবে দেখি।
–তাও করতে পারিস। থানা পুলিশ বড্ডো হ্যাপা, একগাদা টাকা নষ্ট হবে।
ওয়ার্কশপ থেকে একটা গাড়ি নিলো। দু’জনা বের হলাম সন্ধানে। সাথে একজন মেকানিক নিল। প্রথমেই গেলাম হাসানের বাসার রাস্তায়। ওখানে নেই। দু’চার জাগা খুঁজলাম পেলাম না। হঠাৎ শুনি কিংশুকের চিৎকার,
–পেয়েছি –পেয়েছি,
গিয়ে দেখি এক রাস্তার শেষ মাথায় দিব্বি ঘুমিয়ে আছে গাড়ি। পাবার আনন্দে খুশি হলাম দু’জনায় । সামনে তাকিয়ে দেখি লাল ধুলো পথের বাঁকে গাড়িটা।
মেকানিক’কে বলল ওয়ার্কশপে নিতে। ইতি মধ্যে বেলা চড়ে গেছে। দ্বিতীয় গাড়িতে উঠলাম। ওকে বেশ অন্যমনষ্ক দেখাচ্ছে। কি ভাবছে বুঝলাম না ।
–বাসায় দিয়ে আয় আমাকে,
–অনেক ভাবনা বুঝলি। আমার যেনো কেমন লাগছে আজকের দিনটা।
গাড়ি চালায় আর সামনের দিকে তাকিয়ে বলে। ওর চালানোর ভঙ্গিটা বেশ সাবলীল । আমাদের বাসায় যাবার সময় সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যেতে হয়। কিংশুকের গাড়ি বাসার দিকে না গিয়ে লেকের দিকে নিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
–কোথায় যাচ্ছিস ?
–তোমার সাথে কিছু কথা বলবো।
ভেবে পাইনা ও কি বলবে। গাড়িতো পাওয়া গেলো। এখন যে যার ঠিকানায় যাবো। ঘ্যাঁচ করে থামলো।
–শোনো আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। ও বেশ আবেগপ্রবন ভাবে বলতে শুরু করে,
আগে ভাবতাম মরে গেলেই ভালো । কিন্তু , এখন কেনো জানিনা বাঁচতে ইচ্ছে করে। তাই ভাবছি বিয়ে করব।
কেন জানিনা এই সময় এমন সব কথা-বার্তা ভালোলাগছিলনা। বললাম,

–তুই বিয়ে করবি ভাল কথা। আমাকে বলেছিস মেয়ে দেখতে খুঁজছি ও – কিন্তু , একটু থেমে বললাম – যেমন মেয়ে তোর দরকার, আর এখন থাক পরে কথা হবে, কেননা মেয়ে পাচ্ছিনা, যেমন তুই চাস,
ও একটূ ঝুঁকে তাকালো

–কেমন মেয়ে ? কিংশুক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে ,
— যেমন
আমি নড়ে চড়ে বসি।
তোকে শাসন করবে, সময়ে বোনের স্নেহ দেবে , দরকারে মায়ের মত যত্ন করবে –মোট কথা তোকে বুঝতে হবে।
এই বলে চুপ করলাম, নিজ মনে বললাম , এমন মেয়ে পাইনা রে। অনেক খুঁজেছি। দেখি কি করা যায় ।
–তুমি কি জান ? ডাক্তার আমার সময় বেঁধে দিয়েছে বেশী দিন বাঁচবনা। এত মদ খাই রোজ ।
চিন্তিত হয়ে যাই। কিংশুক আবার গাড়িতে স্টার্ট দেয়, আবার থামায়। ব্যাপারটা আমার মনকে বেদনায় ভরিয়ে দেয়। কিন্তু জানিনা আমার কি করা উচিত।
এতো কম বয়সে ও যে পথে গিয়েছে সে পথ থেকে কি ভাবে ফিরবে। বড্ড মায়া লাগে ওর জন্যে।
ওর শুস্ক বিবর্ণ হয়ে যাওয়া জীবনটা আবার কুসুমিত হোক।
–শোন একটা কথা বলি,
আমি তাকিয়ে ওর দিকে। কিংশুক সামনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আজকেই জবাব দেবার দরকার নেই। তিন দিন পর ভেবে চিন্তে উত্তর দিবে।
–তোর নেশা কি যায়নি ? বিস্ময়ে কন্ঠ রোধ হয়ে আসে আমার।
–আমি তো জবাব এখুনি চাইনি। তিনদিন পর জবাব দিবে।
আমার গলায় কে যেনো কাঁটা ঢুকিয়ে দিল। কোনমতে বললাম,
—-আমি বাসায় যাবো, আমাকে নামিয়ে দে।
ওর তখন কথায় পেয়েছে, আবেগে কণ্ঠ বুঁজে আসছে। আমার ভালোলাগছে না। দু’হাতে কান চেপে ধরে আছি।
-বাঁচতে চাই । বাঁচতে হলে তোমাকে আমার জীবনে ভীষণ দরকার। এতো দিন তোমায় দেখেই গেছি। কিছুই বলিনি। আজ যা সত্যি তাই জানিয়ে গেলাম।
তোমার যা উত্তর হবে তিনদিন পরে শুনবো।

বাসায় নামিয়ে দিল। নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।অস্থির পাইচারি করলাম। শেষ বিকেলে আকাশে শীতের দিনেই মেঘের ঘনঘটা। অপমানে, রাগে ক্ষোভে কেঁদে ফেললাম ঝর ঝর করে। ও দিকে ঝম ঝম কর বৃষ্টির ফোঁটা নামল। আমার চোখের জল আর বৃষ্টির ফোঁটা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো। কিংশুক – তুই আমাকে এভাবে অপমাণ করলি ? আমি তোকে কোন দিন অন্য চোখে দেখিনি। তবে আমার কোথায় তুই কী দেখি? বালিশে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কোথায় যেনো বাজ পড়ার শব্দ হল কড়াৎ করে।

পর্ব-৯

মনে হচ্ছে আমি গভীর স্তরের কোনো স্বপ্ন দেখছি। গভীর স্তরের স্বপ্ন মস্তিষ্কে
কোন কাজ করতে পারে না ভালো করে। আজকের রাত যেনো অন্যরকম হয়ে গেছে। অনেকে ভালবাসার কথা শুনিয়েছে ,কিন্তু, —
নিজের ওপর তীব্র অভিমান হচ্ছে। ক’দিন পরে আঁখিদের দেশের বাড়ি যাবো এমনটা ঠিক করাই ছিলো। এখন কি ভাবে যাবো কিংশুকের সাথে ?
কেননা , ওর প্রশ্নের জবাব তো এখনো জানা নেই আমার। নিজ সম্পর্কে সম্পুর্ন উদাসীন আমি। আগে কখনো এমন করে ভাবিনি। কিংশুকের জীবনে কখন স্থায়ী আসন করে নিয়েছি তাও বুঝতে দেয়নি আমায়।

সকল রাতের অবসান হয়। সেদিনও রাত গিয়ে সকাল হল। বিকেল গড়ালো আবার রাত এলো। মেঘ মুক্ত ঝকঝকে আকাশ। মনের গুমোট মেঘ তখনো কাটেনি। এর মাঝে কিংশুকের না পেলাম খোঁজ, না পেলাম বার্তা।
ইউনিভারসিটি ছুটির কারনে আঁখি ও নেই, দেশে গেছে। ঠিক তিনদিন পর কিংশুক’কে খবর দিলাম আঁখির দেশের বাড়ি যাবো। ও চাইলে যেতে পারে।
ততোদিনে আঁখি আমার বাসায় প্রায়শঃ থাকতো বিধায় ওর বাড়িতে যেতে কোন বাধা নেই।
সকাল বেলা কাপড় বদলে আমি তৈরি। কিংশুকের দেখা নেই। এক সময় বিরক্ত হয়ে কাপড় বদলে ফেলি। নাহ ! যাবো না।
তখনই শুনলাম কিংশুক এসেছে। দো-টানায় পড়ে আবার তৈ্রি হয়ে গাড়িতে উঠলাম। ও কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি ও কোন কথা বললাম না। দু’টো চলমান মুর্তি আমরা। গাড়ি ছুটে চল্ল।
মাথার অবশ ভাব যাচ্ছে না কিছুতেই। বুঝলাম আজকের দিনটা পাঁশুটে যাবে।
তবু অল্প শীতের ঝক ঝকে আকাশ। নীলাভ কড়াই থেকে সুর্য যেনো সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে সব জাগায় ।

পর্ব-১০
গ্রামে পৌঁছাতে বেশ দেরী হয়ে গেলো। নদীটা শুকিয়ে মরে গিয়েছে। গাড়িটা নদীর নিচে নেমে পার হয়ে ওপরে ওঠার সময় ফেঁসে গেলো।
আমি হঠাৎ হেসে ফেললাম। কিংশুককে রাগানোর জন্যে বললাম,
-আরিফ ভাই হলে এক টানে গাড়ি উঠীয়ে নিতো। ওর চেহারা থম থমে।
আমাকে নামতে বলে জেদের বশে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে একটানে গাড়ি ওপরে তুলে ফেলল।
হাঁসি মুখে আঁখি এগিয়ে এল। বাকি রাস্তা আমি হেঁটেই গেলাম ,
–তোরা এলি শেষ পর্যন্ত ?
— আমি আসব তুই জানিস , কিন্তু কিংশুক আসবে তা জানতিস ?
আঁখির এমন ভাব করলো যার অনেক অর্থ বোধগম্য হল না ।
ধুলি ধূসরিত হাত মুখ ধুয়ে চা খেলাম। সন্ধ্যা গাঢ় হবার পর বেরিয়ে পড়লাম তিনজন মরা নদীর কাছে। হাঁটতে হাঁটতে ইচ্ছে করেই পিছিয়ে থাকলাম ।
আঁখি এগিয়ে এলো ।
— তুই কি জানতিস ? প্রশ্ন ছূঁড়ে মারলাম ,
–হ্যাঁ জানতাম , তাতে কি ?
–তুই একবার জানানোর দরকার মনে করলিনা ?
–আমি তো তিন মাস আগেই জানি। অন্য দিকে তাকিয়ে আঁখি বলে।
–তাহলে তিথী, শান্তা ? পালটা প্রশ্ন করি।
— ও গুলো কিছুই নয় , ওগুলো বলে তোকে ফাঁকি দিয়েছে –
আমি বিস্ময়ে বিস্ফারিত !
–হ্যাঁ।মনে আছে ? ছুটির পর আমি বলেছিলাম আমার ভাইকে দেখে রাখিস ?
ভাবলাম তাইতো একথা তো আঁখি যাবার আগে আমায় বলেছিলো। আমি আমল দেইনি। ভাবলাম বাউন্ডুলে ভাই, তাই হয়ত বলেছে।
কিংশুক অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। আবার কাছাকাছি এলো। আমি চুপ।
–আঁখি তোর বান্ধবী কিন্তু এখনো কিছু বলেনি। হঠাৎ অসহিষ্ণু ভাবে বলে আমি কিন্তু না হলে গুলি করব
মনেমনে হেসে ফেললাম ওর ছেলেমানুষি দেখে। কি বোঝে ও বিয়ের ?
বিয়ে কি এতোই সহজ বিষয় !
কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে বললাম
—চল বাড়ী যাই , ঠান্ডা লাগছে। পাতলা শালটা টেনে টুনে ঠিক করলাম।
বাড়ীর উঠোনে পা দিয়ে কিংশুক বলে,
– আমি একটা সিরাপ আনি কাশির। ঠান্ডায় গলা ব্যাথা করছে। একটু বাজার থেকে আসি।
দো” তালায় ঊঠলাম দু’বান্ধবী। আঁখি চেয়ারে বসল। আমি খাটে। আঁখি বলে ,
–আমার একটা ইচ্ছে ছিল বিরু ভাই কে দিয়ে তোকে বউ করে আনব এ বাড়ীতে – কিন্তু , কিংশুক আগে চেয়ে বসে। দেখ – কিংশুক এই বয়সেই টাকা ইনকাম করে। ভাল ব্যাবসা করে। ছেলে ভালো , বিরুদা আর কিংশুক আমার কাছে আলাদা নয়।
বিরু ভাই পড়া শেষ করে আরো ক’বছর লাগবে। তার চাইতে খারাপ কি?
জবাব দিলাম না। প্রথম যেদিন কিংশুককে দেখি তার সাথে আজকের কিংশুক – কত পার্থক্য !

ফিরে এল কিংশুক, বাজার থেকে টুকটাক ফলমুল , আর কাশির সিরাপ। গলা পরিষ্কার করতে আমি একঢোক খেয়ে নিলাম।
কিন্তু , এখন কেমন যেনো মনে হচ্ছে। তন্দ্রা ভাব এল। এই ব্যাকুল মানুষটাকে আঘাত দিতে কষ্ট লাগবে।

আমি ডাকলাম – কিংশুক সত্যি কি আমায় কাছে পেলে সুখী হবে ?
হঠাৎ কিংশুক আমার হাতটা ধরে নিজের মুঠিতে নেয়
–আমার মায়ের কসম –আমি তোমায় চাই । আমার স্ত্রী হিসেবে –
আমি কেঁদে ফেললাম। এই প্রথম কিংশুকের বুকে মাথা রাখলাম।
ভুলে গেলাম কোথায় আছি। ভুলে গেলাম ভুত ভবিষ্যত !
নাহ ! এই সিরাপ টায় কিছু আছে। নাহলে আমি এমন কিছু করার মানুষ না ।

ওকে আমার আরো বুঝবার দরকার ছিলো। একটু পরে থিতু হই। নিজকে ঠিক করি মনেমনে। রাতে তেমন কিছুই খাওয়া হলনা।
আঁখির মা অনেক অনুযোগ করলেন। আমরা দু ‘বান্ধবী শুয়ে পড়লাম।
কিংশুক কোথায় গেলো জানিনা । কেননা , তখন ঘুম – রাজ্যের ঘুম দু’চোখে ভর করেছে ।
ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল – নিজের জীবন নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমার কী আরো ভাবা উচিৎ ছিল না ? ততক্ষনে সব ভাবনার উর্ধে চলে গেছি। আবার ক্ষণিকের জন্যে মনে হল—নিজকে দিয়ে দিব তাতে যদি ওর মঙ্গল হয় !

ফেরার পথে সঙ্গী হল আঁখি। ঢাকায় ফেরার তখন ওর কথা ছিল না। আমার মানসিক অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। চলে এল আমার সাথে।
গুনে-গুনে তিন মাস পর কিংশুকের সাথে আমার খুব ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল।
ভারসিটি’তে পড়ার সময় আমাদের পরিবারে মেয়ের মতামত’কে যথেষ্ট গুরুত্ত্ব দেয়া হত। তাই কিংশুকের পরিবার থেকে প্রস্তাব এলে বাবা মা অরাজী হলেন না।
ধুমধাম করেই বিয়েটা হয়ে গেলো। কিংশুককে জামাই হিসেবে পেয়ে বাবা খুব খুশি।
বাবা নিশ্চয় আশীর্বাদ করেছেন। বাবার মুখ উজ্জল হবে না এমন কাজ আমি কখনো করিনা, বা করবো না। বাবা কেবল বললেন আমাকে বিয়ের আগের দিন,
–কাল থেকে তুমি এ বাড়ীর মেহমান। শ্বশুর বাড়ির সবাইকে মানিয়ে চলবে মা –
চলে এলাম শ্বশুর বাড়ি ।
আমি জানিনা তখনো আমার ভবিষ্যৎ আমার জন্যে কী অপেক্ষা করছে ।

তীব্র ডোর বেলের স্বরে যেনো আমার ঘুম ভাঙ্গলো ,

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কোথা থেকে গানের কন্ঠ ভেসে এলো ‘মন পাখি তুই আর কতকাল থাকবি খাঁচাতে’।

মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করে ,

–মা তোমার চোখে জল কেনো ?

–ওকিছু না মা সকাল থেকে আমার চোখ কড় কড় করে আজকাল। আজকেও তেমন। আজকাল আমার চোখে কেবল ময়লা পড়ে কেন জানি ভাবলাম ভাবলাম। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বুক চিরে হা-হাকার হয়ে কোন সুদূরে মিশে গেলো। শুনেছি ‘যে জীবন দোয়েলের, কোয়েলের, মানুষের সাথে তার কোনোদিনই দেখা হয় না’

ধুলি ধুসরিত স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। ফানুসের মতো উড়ে গেলো। কি আশ্চর্য্য!

(প্রথম খন্ড সমাপ্ত)