চব্বিশ এপ্রিলের বীরদের প্রণতি

চব্বিশ এপ্রিলের বীরদের প্রণতি চব্বিশ এপ্রিলের বীরদের প্রণতি ব্রিটিশ শাসনামলেও এ দেশে রাজবন্দিরা কিছু অধিকার ভোগ করতেন। কারাগারে তাঁদের আলাদা একটা মর্যাদা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাজবন্দিদের সেই অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়া হলো অল্প দিনের মধ্যেই। অথচ এই পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যই পূর্বাঞ্চলের বাঙালি মুসলমানরা কিনা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ‘লরকে ল্যাঙ্গে পাকিস্তান বলে’। দেশ ভাগ হতে না হতেই পাকিস্তান সরকার আঘাত হানল পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষার ওপর। আর দলে দলে গ্রেপ্তার শুরু করল বাংলার কমিউনিস্টসহ অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদের। শুরুর দিকে রাজবন্দিরা আগের মতো অধিকারগুলো ভোগ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা হরণ করে নেয় ফ্যাসিস্ট সরকার। রাজবন্দিরা সরকারের সেই পদপে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেননি। কারাগারের ভেতরেই তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ এমনকি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। বাইরে জনমত গড়ে ওঠার কোনো আশা সেদিন ছিল না। কারণ সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল তখন ভিন্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজবন্দিরা ছিলেন অনড়। বিশেষ করে কমিউনিস্ট বন্দিরা ছিলেন অদম্য। কারণ রাজবন্দিদের মর্যাদার বিষয়টি তাঁদের কাছে কেবল কারাগারে ভালো থাকা-খাওয়ার বিষয় ছিল না, সেটি ছিল রাজনৈতিক মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের প্রশ্ন। সেই অধিকার আদায়ের সংগ্রামেরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকার শুধু যে রাজবন্দিদের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল তা-ই নয়, সাধারণ বন্দিদের সঙ্গেও অমানবিক আচরণ করত। রাজশাহী জেলে তখন এমনকি গরুর বদলে সাধারণ কয়েদিদের দিয়ে ঘানি টানানো হতো! নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি ওই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন রাজবন্দিরা। আর সেটা তাঁরা করেছিলেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে দরখাস্ত দেওয়ার মাধ্যমেই। কারা বিভাগের মহাপরিদর্শক (আইজি) রাজশাহী জেল পরিদর্শনে গেলে তাঁর কাছে রাজবন্দিরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সেদিন অবশ্য আইজির সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর ওই জেল পরিদর্শনের আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারেননি রাজবন্দিরা। আইজি (প্রিজন) রাজশাহী যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন তাঁকে ডেকে বলেছিলেন, ‘বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছে রাজবন্দিরা। ওদের শিা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ সেই শিা দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই সেদিন রাজশাহী কারাগার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তখনকার আইজি (প্রিজন)। ইংরেজ জেল সুপার বিলকে সে নির্দেশই সেদিন তিনি দিয়ে এসেছিলেন। যেকোনো ছুতোয় চূড়ান্ত শিা দিতে হবে রাজবন্দিদের। ঘটনার দিন ২৪ এপ্রিল ভোর। রাজবন্দিরা সবে ঘুম থেকে উঠেছেন। সেই সময় হঠাৎ এক কারারী গিয়ে তাঁদের বলল, তার সঙ্গেই রাজবন্দিদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে যেতে হবে জেল অফিসে। জেল সুপার ও জেলার ডেকে পাঠিয়েছেন জরুরি আলোচনার জন্য। রাজবন্দিরা বললেন, একটু পরে যাবেন তাঁরা। এতে খেপে গিয়ে ওই কারারী তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং শাসিয়ে চলে গেল। কিছুণের মধ্যে জেলার উত্তেজিত হয়ে খাপড়া ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে রাজবন্দিদের অকথ্য গালি দিতে লাগলেন। তাঁর এ দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ জানালেন রাজবন্দিরা। একপর্যায়ে জেলার হুমকি দিয়ে বললেন, জেল সুপারের সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই মুহূর্তেই না গেলে পরিণাম ভালো হবে না। এ হুমকি দিয়েই চলে গেলেন জেলার। অফিসে গিয়ে জেল সুপারকে নিজের মতো করে জানালেন বিষয়টি। অমনি গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন জেল সুপার। সঙ্গে সঙ্গে বাজিয়ে দেওয়া হলো কারাগারের পাগলা ঘণ্টা। আর সশস্ত্র জেল পুলিশ বাহিনী সঙ্গে নিয়ে রাজবন্দিদের ওপর আক্রমণ চালালেন জেলার। প্রথমে সব রাজবন্দিকে খাপড়া ওয়ার্ডের লকআপে ভরে এলোপাতাড়ি লাঠিপেটা ও বেয়নেট চার্জ করা হলো। বন্দিরাও থালা-বাটি দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। তারপর বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে বৃষ্টির মতো চালানো হলো গুলি। এতে সাত রাজবন্দি শহীদ হন। আহত হন ৩৪ জন। পুরো ওয়ার্ডে তখন ভাসছিল রক্তের স্রোত। ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবর তখন কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। প্রচারিত হয়নি বেতারেও। গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রসারিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে সেই বর্বরতার কাহিনী জানতে পারে দেশবাসী। অথচ প্রকৃত অর্থে খাপড়া ওয়ার্ডের সেই লড়াই ছিল পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের বীর শহীদরা হলেন ১. কমরেড বিজন সেন (রাজশাহী), ২. কম্পরাম সিং (দিনাজপুর), ৩. আনোয়ার হোসেন (খুলনা), ৪. সুধীন ধর (রংপুর), ৫. হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), ৬. সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ), ৭. দেলোয়ার হোসেন (কুষ্টিয়া)। খাপড়া ওয়ার্ডে ওই সময় বন্দির সংখ্যা ছিল ৪১। তাঁদের মধ্যে দুজন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কর্মী। কমিউনিস্টদের ওপর প্রচণ্ড দমন-পীড়নের পাশাপাশি সরকার তখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কমিউনিস্ট বন্দিদের নিয়ে রাজশাহী কারাগারে রাখে। খাপড়া ওয়ার্ডে ওই বর্বর আক্রমণে আহত হয়েছিলেন কমরেড আশু ভরদ্বাজ, প্রসাদ রায়, আমিনুল ইসলাম বাদশা, ফটিক রায়, শ্যামাপদ সেন, সত্য ভট্টাচার্য, সৈয়দ মনসুর হাবিব, খবির শেখ, ডোমারাম সিং, অভরন সিং, কালী সরকার, ভূপেন পালিত, প্রিয়ব্রত দাশ, অনন্ত দেব, অনিমেষ ভট্টাচার্য, আবদুল হক, নুরুন্নবী, আবদুস শহীদ, রশিদউদ্দিন, নাসিরউদ্দিন আহমদ, সিতাংশু মৈত্র, পরিতোষ দাশগুপ্ত, গরিবুল্লাহ সরদার, বাবর আলী, হিরেন সেনগুপ্ত, মাধব দত্ত, ডা. গণেশ সরকার, মো. ইলিয়াস প্রমুখ। এই বীরদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম বাদশা ও প্রসাদ রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সেই বীরত্বগাথা সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি। এ দুজনই প্রয়াত। তাঁদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।