নাসরীন আছে আমাদের আকাশ জুড়ে
(আজ নাসরীন হকের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁকে স্মরণ করে এ লেখাটি )
নাসরীন হকের মা কবি জাহেদা খানম ‘আমার মেয়ে আছে সারা আকাশ জুড়ে’ নামক কবিতায় তাঁর মেয়েকে উদ্দ্যেশ করে লিখেছেন—
‘সন্ধ্যা তারার ঔজ্জ্বল্যকে ম্রিয়মান করে
সমগ্র নক্ষত্রমন্ডলীর মাঝে
উজ্জ্বলতর হয়ে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে
———————–
রাত্রি শেষের শুকতারা হয়ে জ্বলবে,
প্রভাতের প্রত্যাশায়’

কবিতার পক্তির মত আমরা— নারীপক্ষ’র সদস্যরাও মনে করি আমাদের নাসরীন উজ্জ্বলতর হয়ে আছে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে।
মা কবি জাহেদা খানম ও প্রকৌশলী বাবা মোহাম্মদ রফিকুল হককের চতুর্থ সন্তান নাসরীন পারভিন হকের জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৭ নভেম্বর দিনগত রাত বারটার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর মৃত্যু ২৪ এপ্রিল ২০০৬ সন্ধ্যা ৭ঃ৪৫ মিনিটে ঢাকাস্থ সামরিক হাসপাতালে। তাঁর জন্মের সঠিক ক্ষণটি যেমন জানা যায়নি তেমনি তার মৃত্যুর সঠিক কারণটি আজও জানা যায়নি।
ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তে জন্ম আর উত্তর প্রান্তে মৃত্যু। জীবনের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর প্রান্তে যেতে মাত্র ৪৮ বছর সময় লাগিয়েছে। ৪৮ বছর একটা জীবনের জন্যে অত্যন্ত কম সময় হলেও নাসরীন তাঁর হাঁটা পথে রোপন করে গেছে অজস্র মূল্যবান বৃক্ষ ; এর ফল ভোগ করছে এ দেশের নারী সমাজসহ বৃহত্তর অবহেলিত জনগোষ্ঠী।

মাতৃমৃত্যু রোধ,নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, তামাকবিরোধী আন্দোলন, স্তন ক্যান্সারের সচেতনতা বৃদ্ধি,এসিড আক্রান্ত মানুষের জন্যে চিকিৎসা, আশ্রয় ,
মানসিক সমর্থন ও আইন প্রণয়নের উদ্যোগ,প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যে কাজ , আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ, যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার, রাষ্ট্র ধর্ম বি্রোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সহ উল্লেখ করার মত রয়েছে তাঁর অসংখ্য কীর্তি।
নাসরীন মাধ্যমিক পাশ করেছে ঢাকার হলিক্রস স্কুল থেকে, বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হকাডে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। স্নাতক হন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এবং বার্কলি থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন ১৯৮৮ সালের শুরুতে।
চাকরি জীবনও ছিল বৈচিত্র্যময়। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক এর গবেষণা বিভাগে চাকরি দিয়ে শুরু ,পরে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে ছিলেন সিনিয়র পলিসি এ্যাডভাইজার। সর্বশেষে এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর থাকা অবস্থায় নিজে বাসার গাড়ি পার্কে নিজের অফিসের গাড়ি দিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। নাসরীন হককে হত্যা করা হয়েছে না এটা নিছক দুর্ঘটনা তা আজও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। তার চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর বন্ধুরা – সহযোদ্ধারা সরকারের কাছে এ রহস্য উদঘাটনের জোর দাবী করছি।

নাসরীন হকের ডাক নাম ছিল হ্যাপী। তাঁর সাথে যারাই মিশেছে তারাই উপলদ্ধি করেছে তাঁর নামের সার্থকতা। নিজের নামের মত অন্যকে সুখী করতে, অন্যকে স্বস্থি দিতে – শান্তিতে রাখতে নিজের ভেতরে অনুভব করত এক স্বতঃস্ফূর্ত আর্তি। তাঁর বন্ধুত্ব বিস্তৃত ছিল বাংলাদেশের পাথরঘাটা থেকে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত। তাঁর বন্ধুত্বের উষ্ণতা অতিক্রম করেছিল ভৌগোলিক সীমানা। যেমন বুকে তুলে নিতেন এসিড অক্রমণের শিকার নারীকে তেমনি পারদর্শী ছিলেন নীতি নির্ধারনীদের সাথে একই টেবিলে বসে নারী ইস্যুতে সমঝোতা বৈঠক পরিচালনায়। তাই তাঁর অকাল মৃত্যুতে কান্নার রোল উঠেছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
যে কোন সভা বা ঘরোয়া আড্ডায় নাসরীন হক প্রসঙ্গ উঠলে আন্দোলন ইস্যুতে যেমন উজ্জীবিত হই তেমন তাঁর অনুপস্থিতিতে অনুভব করি শূন্যতা।

আজকের বাংলাদেশে ঈভটিজিং এর প্রাবাল্যে কিশোরীদের আত্মহত্যা বা জলবায়ূ পরিবর্তনে নারীর উপর ক্ষতিকর প্রভাবসহ আরও অন্যান্য বিষয়ে একজন নাসরীন হকের প্রয়োজন বড়ো বেশি অনুভব করি।
নাসরীন হকের কাজ, চিন্তা চেতনা আবর্তিত হতো মানুষের মঙ্গল কামনায়। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ছিল কীভাবে মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা যায়। তাঁর সংস্পর্শ অসহায়কে দিয়েছে ভরসা।

নাসরীন হকের কর্মময় জীবন, তাঁর জীবনের ব্রত, তাঁর আদর্শ ও কর্মকৌশল বৃহত্তর পরিসরে আলোচনা হওয়া উচিত, যা আরও নাসরীন হক তৈরিতে প্রেরণা দিবে ও সাহস যোগাবে।