ধর্মানুভূতির ধর্মকথা
“একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় আজকাল, কথাটি হচ্ছে ‘ধর্মানুভূতি’। কথাটি সাধারনত একলা উচ্চারিত হয় না, সাথে জড়িয়ে থাকে ‘আহত’ বা ‘আঘাত’ কথা দু’টি; শোনা যায় ‘ধর্মানুভুতি আহত’ হওয়ার বা ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’ লাগার কথা। আজকাল নিরন্তর আহত আর আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে মানুষের একটি অসাধারণ অনুভূতি যার নাম ‘ধর্মানুভূতি’।“ –হুমায়ুন আজাদ।
হঠাৎ করেই দেখা যাচ্ছে জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলোর রঙ্গ-ব্যাঙ্গ সাময়িকী আলপিনে প্রকাশিত আপাতত দৃষ্টিতে নিরিহ ধরনের একটি কার্টুনের কারণে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের অত্যন্ত সংবেদনশীল ধর্মীয় অনুভূতিতে দারুনভাবে আঘাত লেগেছে। আঘাতের ব্যথায় দেশের সব আলেম উলামারা একযোগে হুক্কা হুয়া রব তুলে ধর্ম গেলো ধর্ম গেলো বলে শোরগোল শুরু করে দিয়েছেন। আর সেই ব্যথায় সমব্যথী হয়ে আমাদের ধর্মপ্রেমী সরকারও সাথে সাথেই হাক ডাক আরম্ভ করে দিয়েছে। আলপিনতো নিষিদ্ধ করা হয়েছেই। সেই সাথে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ন মাত্র বিশ বছর বয়সী তরুন কার্টুনিষ্ট আরিফুর রহমানকে। সরকারের মহা বুদ্ধিমান করিৎকর্মা বাক্যবাগীশ তথ্য উপদেষ্টা মহোদয় সাথে সাথেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন যে এটা দেশের বিরুদ্ধে সুগভীর চক্রান্তের অংশ। ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ভাগ্য ভাল যে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হয়েছে। তা না হলে কি ভয়াবহ পরিণতি হতো তা ভেবে তিনি শিউরে উঠেছেন। এই মাত্র কদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ছাত্রদের ষড়যন্ত্র থামাতে না থামাতেই আবার আরেক ষড়যন্ত্র। লোকজনেরও যে কি সমস্যা। এতো সুখে রাখার পরও খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই সারাদিন বসে বসে দেশের বিরুদ্ধে শুধু ষড়যন্ত্র করছে। এইতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষড়যন্ত্রে আশি হাজার লোক যুক্ত ছিল। পরে অবশ্য মান সম্মান বাঁচাতে তাড়াতাড়ি ওই সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়েছিল। কারন কিছু অকর্মন্য লোক এই নিয়ে এমন হাসাহাসি শুরু করলো শেষে মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। বাঁকা চোখে টিটকারী দিয়ে তারা বলে যে আশি হাজার লোক যদি কোন কাজে যুক্ত থাকে তাহলে সেটা আবার ষড়যন্ত্র হয় কি করে। ষড়যন্ত্রতো হয় দশ বারোজন উপদেষ্টা আর সেনাপ্রধান মিলে গোপনে বসে দেশের বারোটা বাজানো যায় কিভাবে সেই আলোচনা করলে। এই যে চারপাশের এত সব ষড়যন্ত্র এগুলো ব্যর্থ করতে তাদের মত দেশপ্রেমিক মানুষেদের দিনরাত যে কি প্রানান্তকর পরিশ্রম করতে হচ্ছে তা যদি দেশের লোকেরা বুঝতো। গোদের উপর বিষ ফোড়ার মত সাপ্তাহিক ২০০০ আবার ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার মত একটা আর্টিকেল ছেপে বসে আছে। যন্ত্রনা আর কাকে বলে! সেটাকেও ব্যারিষ্টার মহোদয়কে হুকুম জারি করে নিষিদ্ধ করতে হলো শেষ পর্যন্ত।
এমনিতে আমাদের দেশের আলেম জালেমরা হচ্ছে নাচুনি বুড়ি, তার উপর এই ঢাকের বাড়ি পেয়েতো তাদের পোয়া বারো। ধিং তা ধিন বলে হাত পা ছুড়ে বিকট নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে তারা। কবে কোন যুগে সরকার এরকম জামাই আদর করে তাদের কাছে শলাপরামর্শ চেয়েছে। উপদেষ্টা মহোদয় যেভাবে কাঁচুমাঁচু হয়ে তাদের সাহায্য সহযোগিতা চেয়েছেন তাতেই তারা বুঝে গেছে যে দেশ এখন থেকে তারাই চালাবে। তাদের হুকুমেই চলবে সবকিছু।
এদিকে হুজুরদের এই নাচানাচি দেখে মহা ধুরন্ধর প্রথম আলোর সম্পাদক মহাশয়ও বেশ ভালভাবেই ঘাবড়ে গিয়েছেন। এমনিতেই অনেকদিন ধরে উপদেষ্টা মহোদয়ের ভাবগতিক তেমন সুবিধার মনে হয়নি মতি ভাইয়ের কাছে। উপদেষ্টা মহোদয় ঠারে ঠারে প্রথম আলোর সার্কুলেশন দেখেন আর মাথার চুল ছেড়েন। তার পত্রিকাতো এখন চাকরী প্রার্থী বেকার পোলাপান ছাড়া আর কেউ কেনে না। এই চান্সে যদি প্রথম আলোকে শেষ অন্ধকার করে দেওয়া যায় তাহলে তো দারুণ হয়। এই সরকারকে গদিতে বসানো থেকে বিপদে আপদে কত সহযোগিতাই না দিয়ে আসছেন মতি ভাই। তারপরও মানিক মিয়ার এই গুণধর ছেলের যে কেন এতো খাই খাই ভাব তা তিনি বুঝতে পারছেন না ঠিকমত। তবে ব্যারিষ্টার সাহেবের মতিগতি ্মতি ভাই ঠিকমত না বুঝলেও বিপদটা ঠিকই বুঝেছেন। আর বুঝেছেন বলেই এর মধ্যেই তিন তিনবার ঘটা করে মাফ চেয়ে বসে আছেন তিনি। তৃতীয়বার অবশ্য বেশ খাসা ভাবেই মাফ চেয়েছেন তিনি। এক সময়কার কঠিন বামপন্থী মতি ভাই তার মতই আরো একপাল তথাকথিত প্রগতির ঝান্ডাধারী সম্পাদক আর তথ্য উপদেষ্টা সমবিহারে টুপি মাথায় বায়তুল মোকাররমে হুজুরদের সাথে ইফতারী করে আর নামাজ পরে একেবারে খাস দিলে আল্লাহর কাছে তওবা করে করজোরে মাফ চেয়ে এসেছেন। সেই সাথে বলে এসেছেন যে প্রথম আলো শুরু থেকেই পবিত্র ইসলাম ধর্মের সাথে ছিল এবং আজীবন থাকবেই। শুধু মতি ভাই একা নন অন্যান্য সম্পাদক মহাশয়রাও এটা যে কত বড় গর্হিত কাজ হয়েছে সে বিষয়ে একমত হয়েছেন এবং এটা যে সংগতভাবেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হেনেছে সে বিষয়ে দেশবাসীকে জ্ঞাত করেছেন। তবে মতি ভাই যেহেতু নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন তাই তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য আহবান জানিয়েছেন তারা। একেই বলে কাকের মাংস কাক খায় না।
এক সময়কার আল্লাহ খোদা না মানা কমিউনিষ্ট মতি ভাই এবং তার বন্ধুদের এই ধর্মপ্রীতি দেখে বড়ই প্রীত হয়েছেন বায়তুল মোকাররমের খতিব সহ আরো কিছু বিশিষ্ট আলেম ওলামারা। কাজেই খাস দিলে তারা মতি ভাইকে মাফ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খতিব উবায়দুল হক বলেছেন যে, যেহেতু প্রথম আলো সম্পাদক তার গর্হিত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন, ক্ষমা চেয়েছেন এবং তওবা করেছেন কাজেই তার ক্ষমার বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা জানেন। আমাদের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে আর কোন ক্ষোভ নেই।
খতিবের মত অবশ্য সবারই যে ক্ষোভ দূরীভূত হয়েছে তা কিন্তু না। এই যেমন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতী ফজলুল হক আমিনী ও খেলাফত মজলিশের আমির শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক মতি ভাইয়ের ক্ষমা প্রার্থনাকে প্রতারণা ও ভাওতাবাজী বলে প্রত্যাখান করেছে। শায়খুল হাদীস তো বিকট হুংকার দিয়ে বলেছেন যে, কার্টুন প্রকাশে জড়িতরা সব মুরতাদ। এর জন্য মানুষ ক্ষমা করলে হবে না। তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। তিনি আবেগে আক্রান্ত হয়ে হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আরো বলেছেন যে, আমাদের ঈমান-আকিদার উপর যারা এরকম আঘাত হেনেছে তাদেরকে দুনিয়াতেই থাকতে দেওয়া হবে না। ঈমান আকিদা বলে কথা। মতি ভাইয়ের পরপারে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো কিনা কে জানে।
ধর্মানুভূতি এই ঘোড়ার ডিম জিনিষটা আসলে কি? খায় না পিন্দে কে জানে। মানুষের কত রাজ্যের অনুভূতি আছে সেগুলোতে তো আঘাতের কথা শোনা যায় না কখনো। আহত হওয়ার কথা কস্মিন কালেও শুনবেন না আপনি। যত গ্যাঞ্জাম, হট্টগোল, চিৎকার চেচামেচি এই এক বিদিকিচ্ছিরি অনুভূতিকেই নিয়ে। হাটতে চলতে ফিরতে সব কিছুতেই আঘাত লাগে এর। আর সেই আঘাতে পলে পলে আহত হয় সে। সারাক্ষণই ব্যথায় কো কো করছে বেচারী ধর্মানুভূতি। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই আঘাতে আঘাতে আহত হয়ে এর জান প্রায় যায় যায় অবস্থা। সেই কবে কোন কালে দাউদ হায়দার এক কবিতা লিখলো তো সে বুকে ভীষন আঘাত পেয়ে গেলো। তসলিমা নাসরিন এক উপন্যাস লিখলো, আর অনুভূতি মিয়া একেবারে মহা আহত হয়ে পড়লো। আরিফ এক কার্টুন আঁকলো তো সে একেবারে সটান শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো। এই যে আমি এই লেখাটি লিখছি আমি নিশ্চিত এতেও এই নচ্ছার ব্যাটা দাবী করে বসবে যে তার দিলে ভয়ানক চোট লেগেছে। যে অনুভূতি এতো ঠুনকো, টোকা লাগলেই শুয়ে পড়তে চায়, তার কি টিকে থাকার আদৌ কোন দরকার আছে। যে অনুভূতিতে এতো সামান্যতেই আঘাত লাগে তাকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়াটাই কি যুক্তি সঙ্গত নয়। তা না আজগুবি এই মহা নাজুক অনুভূতিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র উঠে পড়ে লেগে বসে থাক সারাক্ষণ। আর তার সুযোগ নিয়েই এই অনুভূতির ধারকেরাও প্রতি পদে পদে তাদের অনুভুতিতে আঘাত লাগছে, অনুভূতিতে আঘাত লাগছে বলে হইচই করে হুটহাট নালিশ জানাতে থাকে।
এমনিতেই তো দেশের বারোটা বেজে গিয়েছিল সেই কবেই। মতি ভাই আর তার সম্পাদক বন্ধুদের কল্যানে এখন বারোটা থেকে চৌদ্দটা বাজার উপক্রম। দেশের চিন্তা করা আসলে এখন ছেড়ে দিয়েছিই বলা চলে। ওই দেশের চিন্তা করার জন্য এখন স্বয়ং আল্লাহ তালা আর তার ঈমানদার সৈনিকেরা আছে। আমাদের মত তুচ্ছ মানুষদের আর দরকার নেই। কাজেই আগডুম বাগডুম সেই চিন্তা আপাতত মাথা থেকে বাদই দিচ্ছি। আমার চিন্তা শুধুমাত্র ওই বাচ্চা ছেলেটার জন্য। সম্পূর্ন বিনা কারনে এই সমস্ত মহা ধড়িবাজ পাকা খেলোয়াড়দের নিষ্ঠুর খেলার বলি হয়ে গেল সে। কোন দোষ না করেই জীবন শুরু হওয়ার আগেই জীবনটাই শেষ হয়ে গেল বোধ হয় ছেলেটার।
Leave A Comment