সামরিক বুটের নিচে পিষ্ট আমার দেশ
আবারো সামরিক বুটের নিচে পিষ্ট হচ্ছে আমার দেশ। আবারো জলপাই রঙ এর সাজোয়া বাহিনীর অশ্লীল তান্ডব শুরু হয়েছে বাংলাদেশের বুকে। সবুজ কোমল এই দেশকে তার জন্মের বহু আগে থেকেই নিয়মিত নানা অছিলায় ধর্ষণ করেছে পাকিস্তান আর্মি। রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত করেছে একে তারা, চিড়ে চিপ্টে নিঃস্ব করেছে দিনের পর দিন। স্বাধীনতার পর মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল এই ভেবে যে, যাক বর্বরদের হাত থেকে বাঁচা গেলো। কিন্তু কিসের কি! পাকিস্তান আর্মির দেখানো পথ ধরে নিজেদের সেনাবাহিনীই তার ভয়াবহ কামুক চেহারা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্বদেশের কোমল বুকের উপর বার বার। লোমশ কর্কশ হাত দিয়ে নষ্টভ্রষ্ট করে দিয়েছে সবকিছু তারা। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কোমল তার উপরই প্রচন্ড আক্রোশ এদের। কদর্য নখ আর হিংস্র দাত বের করে বার বার প্রবল বিক্রমে তারা আক্রমণ চালিয়েছে সমস্ত সৌন্দর্যের উপর । লন্ডভন্ড করে দিয়েছে আমাদের সব সাজানো বাগানকে, সব সুন্দর স্বপ্নকে। অতি নিষ্ঠুরভাবে কেটে দিয়েছে আমাদের মুক্ত বিহঙ্গের পাখা।। প্রমান করেছে যে সেনাবাহিনীর কোন জাতপাত নেই, নেই কোন দেশজ পরিচয়। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পাকিস্তান আর্মিও যা, বাংলাদেশ আর্মিও তাই। নামেই শুধু আলাদা।
গত দু’ তিন দিনে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তাতে বিস্মিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। এরকম যে ঘটবে সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিষ্ট হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। যারা সামান্যতম বোধ বুদ্ধি রাখেন তারা এরকম গণ বিস্ফোরনের জন্য প্রস্তুত হয়ে বসেই ছিলেন অনেকদিন ধরে। গত জানুয়ারী মাসে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই অতি ধূর্ত এই গোষ্ঠী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেছে তাদের নিজস্ব মতলব হাসিলের দিকে। মুখে অবশ্য সেকথা স্বীকার করেনি তারা। দেশদরদী সাজার আপ্রাণ অক্ষম চেষ্টা করে গেছে সারাক্ষণ। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য যত ধরনের ফন্দি ফিকির আছে তার কোন কিছুই করতে বাদ রাখেনি তারা। হরিণের পোশাক পরে যে নেকড়ে এসেছিলো তাকে শুরুতে সবাই চিনতে না পারলেও অচিরেই লোকজন বুঝে নিয়েছে তার আসল পরিচয়। আর সেজন্যে দাবানলের মত আজ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবাদের আগুন সারা দেশে। ছলাকলা আর ভয়-ভীতি দেখিয়ে এই গোষ্ঠী ভেবে নিয়েছিল যে বেশ দিব্যি রাজত্ব করা যাবে এবার। রক্তলোলুপ নেকড়ের খেয়ালই ছিল না যে এর থেকেও বড় মানুষখেকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এই দেশের সাধারণ মানুষ। এতো সহজে বোকা বানানো সম্ভব নয় সবাইকে। সবাইকে বোকা ভাবা এই গর্ধভ গোষ্ঠীর নিজেদেরই হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেছে এবার। তাইতো হরিণের ছদ্মবেশ খুলে এবার স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে তারা। অত্যাচার, নির্যাতন আর আতংক সৃষ্টি করে ক্ষমতায় থাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর আর কোন দেশের অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় ইতিহাসে এরকম কৃতিত্বপূর্ন ভুমিকা আছে কিনা আমার জানা নেই। শাসকদের সমস্ত জুলুম অত্যাচারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সূত্রপাত এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব সেই পাকিস্তান আমল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই দিয়ে এসেছে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনেক বাঘা বাঘা পন্ডিতকে অবশ্য পত্রপত্রিকায় দেখছি খুব অবাক হওয়ার ভান করছেন এই বলে যে সামান্য একটা ‘তুচ্ছ’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কি করে এতো তুলকালাম কান্ড ঘটলো। সরকারের ‘মৃদু’ সমালোচনাও করছে তারা সময়মতো এটাকে সামলানো কেনো গেলো না এই ভেবে। এই সমস্ত বকধার্মিকদের উদ্দেশ্য বুঝতে অবশ্য খুব একটা কষ্ট হয় না। সেনাবাহিনীর একজন সেপাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মারধোর করবে, শিক্ষককে লাঞ্ছিত করবে এটাতো তাদের কাছে ‘তুচ্ছ’ ঘটনা বলে মনে হবে। জানেই যে মেরে ফেলেনি তাতেইতো ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা ছাত্রদের।
তবে যতই ‘তুচ্ছ’ ঘটনা বলে হইচই করা হোক না কেন যাদের চোখ কান খোলা আছে তারা ঠিকই বুঝে নিয়েছে যা বোঝার। ভয়ংকর কোন অন্যায় যখন ঘটতে থাকে, মানুষের হাত পা যখন বেধে ফেলা হয় ফালতু সব আইনের শিকলে, প্রতিবাদের সকল রাস্তাগুলোকে যখন বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন তার প্রাথমিক বিস্ফোরণ এরকমই হওয়ার কথা। স্বতস্ফূর্ত এই বিক্ষোভ আন্দোলনে ছাত্রদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমাজের নিম্ন শ্রেনীর অবহেলিত মানুষেরা। শাসক কি সুশাসক না দুঃশাসক সেটা বাংলাদেশে যদি কেউ সবচেয়ে ভাল বুঝে থাকে তবে সেটা হচ্ছে আমাদের খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী। নষ্টভ্রষ্ট উচ্চবিত্ত আর সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তের মতো চোখে ঠুলি পরে থাকে না তারা। এই ছদ্মবেশী সামরিক শাসকদের প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মত অহেতুক কোন ভাবালুতা বা আচ্ছন্নতায় ভোগেনি তারা। সাপকে তারা সাপ হিসাবেই দেখেছে। মালা ভেবে গলায় তুলে নেওয়ার অহেতুক বিলাসিতায় যায়নি তারা।
আন্দোলনের প্রথম ধাক্কাতেই মূলতঃ কেঁপে উঠেছে এই অবৈধ সরকার। কেঁপে না উঠারও কোন কারণ নেই। টিকে থাকার জন্য যে সৎ সাহস থাকার দরকার তাতো তাদের নেই। নৈতিকতার ভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারনে নির্যাতনের মাত্রাও বেশি পরিমাণে হচ্ছে এখন। আজকেই বিভিন্ন উৎস থেকে যেটুকু খবর পেলাম তাতে দেখতে পাচ্ছি যে, আর্মি-বিডিয়ারের লোকেরা শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের উপরে বসবাস করা ছাত্রদেরকে জড়ো করে বেদম মারধোর করেছে। কার্ফ্যুর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন যায়গায় বিচ্ছিন্ন ছাত্রদের উপর মনের সুখ মিটিয়ে নিচ্ছে তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ঢুকে ছাত্র কর্মচারীদেরকে পাইকারী হারে ধোলাইও দিয়েছে। সাংবাদিকদেরকেও পিটিয়ে তক্তা করে দিচ্ছে। সমকাল সম্পাদক তার পাঠকদেরকে পত্রিকা পূর্নাঙ্গ কলেবরে বের করতে না পারার ব্যাখ্যা হিসাবে তার পনেরো জন সাংবাদিকের আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। বিডি নিউজে দেখলাম বেসরকারী এক টিভিতে কর্মরত একটা মেয়েকে প্যান্ট ফতুয়া পরার অপরাধে অশ্লীলভাবে অপদস্থ করেছে সেনারা। একাত্তরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন সিনিয়র শিক্ষককেও রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অজ্ঞাত কোন স্থানে। তবে এখানে শেষ নয়। নির্যাতনের মাত্রা যে দিন দিন আরো তীব্র হবে, আরো ভয়াবহ হবে, সেটা না বললেই চলে।
আমার মাঝে মাঝেই চিন্তা জাগে, আচ্ছা, আমাদের যদি সামরিক বাহিনী না থাকতো তাহলে কি তেমন কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হতো। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কোন ভালো কাজের নমুনা চোখে পড়েছে বলেতো মনে পড়ে না আমার। নারী, শিশুসহ দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের উপর পাকিস্তান বাহিনীর মতো চরম বর্বরতায় ঝাপিয়ে পড়া, পাহাড়ী মেয়েদের নির্বিচারে ধর্ষণ করা, বিনা বিচারে লোকজনকে খুন করা, নিজেদের দেশকে দুই চারবার দখল করা ছাড়া আর কোন ‘কৃতিত্বের’ কাজ করেছে বলে তারা নিজেরাও বোধহয় দাবী করতে পারবে না। অথচ যেখানে দেশের অধিকাংশ লোকের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য, সেখানে তারা দুই আনা চার আনায় চাল, ডাল, তেল, নুন, দুধ, মাখন খেয়ে দেশের মানুষের উপর দিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছে বেশ দিব্যি। বন্দুকের নলের জোরে ধরাকে সরা জ্ঞান করে আসছে। যাদের রক্ত ঘামের পয়সা দিয়ে এতো পোদ্দারি করছে সেই সব সাধারণ মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই এইসব উর্দিওয়ালাদের। যত্রতত্র নসিহত করে বেড়াতে চায় সকলকে। নিজেরাই নিজেদেরকে ফেরেশতা টেরেশতা ভেবে বসে থাকে। বাকী সবাইকেই চোর চোট্টা মনে হয় তাদের কাছে। কথায় কথায় ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ বলে দেশের লোকজনকে গালমন্দ করে চরম আনন্দ পায় তারা।
এরশাদের পতনের পর আমার ধারণা হয়েছিল যে, আর্মি বোধহয় আর কখনোই ক্ষমতা দখলের কু মতলব করবে না। কিন্তু কুকুরের লেজ যেমন হাজার টানলেও সোজা হয় না, তেমনি বার বার কঠিন শিক্ষা হওয়ার পরও ক্ষমতার মসনদে বসার গোপন খায়েশ সামরিক বাহিনীর মন থেকে মুছে যায়নি কখনোই। সুযোগ আসামাত্রই তা আবার লুফে নিয়েছে লুটেরারা। তবে এইবার ভাগ্যটা একটু খারাপ বলতেই হবে। ‘ব্লাডি সিভিলিয়ানরা’ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন এখন। মিডিয়ার সরব উপস্থিতিও তাদের জন্য বড্ড বেশি বাধা হয়ে দাড়িয়েছে আজকাল। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আলোর গতিতে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে তাদের কুকর্মের সব কাহিনী। ফেরেশতা সাজাটা বড় বেশি কষ্টের কাজ হয়ে দাড়িয়েছে উর্দিওয়ালাদের জন্য এখন। ক্ষমতার চকচকে চেয়ারে ঠিকমতো বসার আগেই যে এতো বড় ধাক্কা খেতে হবে তা একেবারেই বুঝতে পারেনি ফেরেশতারা। সেজন্যেই এখন কিছুটা দিশেহারা দেখাচ্ছে তাদের।
আকস্মিক এই ধাক্কায় কিছুটা নড়বড়ে হলেও এতো সহজেই যে তারা ক্ষান্ত দেবে না সেটা নিশ্চিত করেই বলে দিতে পারি। রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘকে এতো সহজে হটানো যাবে না কিছুতেই। প্রাথমিক নড়বড়ে অবস্থাটাটা কোন রকমে কাটিয়ে উঠতে পারলেই অত্যন্ত নির্দয় হাতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রন তুলে নেবে তারা। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দেবে আমাদের সব গান আর কবিতাকে। ভারী বুটের তলায় পিষ্ট করে দেবে আমাদের ভালবাসার সব লাল গোলাপকে।
বিশ্ববেহায়াখ্যাত এক অসুন্দরকে সরাতেই আমাদের কৈশোর ও তারুণ্যের একটা বিরাট সময় চলে গেছে কালের গর্ভে। আরো এক অসুন্দরের হাতছানি এখন। এ যুগের তরুণদেরকেও তাদের সোনালী বর্তমানকে সপে দিতে হবে অসুন্দরের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া এই লড়াইয়ে। যে হাতে লেখার কথা কবিতা, সেই হাতে তুলে নিতে হবে বাঁশের লাঠি। যে কন্ঠে থাকার কথা প্রেমিকার জন্য আবেগঘন প্রেমের কথা, সেই কন্ঠেই উচ্চকিত হবে জ্বলন্ত শ্লোগান।
সেটা যে তারা বেশ ভালভাবেই শুরু করেছে সে বিষয়ে বোধহয় কোন সন্দেহ নেই কারো। মাত্র দু‘দিনেই অমিত শক্তি দিয়ে তারা ঘুরিয়ে দিয়েছে সব বর্বরদের মুন্ডু।
আমার বুকের সবটুকু ভালবাসা এই বিদ্রোহী তারুণ্যের জন্য।
এ যেন অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে আমার স্বদেশ /