বাল্যকালে একটা ছোট ঘটনা আমার জীবনে একটা গভীর দাগ ফেলে দিয়েছিল। আমরা মফস্বল শহরে থাকতে যে পাড়ায় থাকতাম ওখানে অধিকাংশই হিন্দু পরিবার বাস করত।এই কারনে বোধকরি পাড়াটার নাম ছিল “হিন্দুপাড়া “। খেলা ধুলার সাথী যারা ছিল তারা অধিকাংশই ছিল হিন্দু। কিন্তু ,ঐ বয়সে হিন্দু,মুসলমান বোঝার মতো কোনো ক্ষমতা আমার ছিলনা।
একদিন খেলা ধুলার মধ্যে ভীষণ পানির পিপাসা লাগল। তো বান্ধবী,নাকি (বন্ধু ?) খুব নিকটে তাদের বাড়ী ছিল। সে আমাকে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকল পানি দেবার জন্য। ঐ মুহুর্তে আমার ভালই মনে আছে তার মা অগ্নিমুর্তি হয়ে তেড়ে আসেন আমাদের দিকে।
-গেল –গেল সব অশৌচ হয়ে গেল “ এই বলে চেঁচিয়ে বাড়ী মাথায় করে করলেন । আমি প্রান ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে এলাম। এই ঘটনা জীবনে গভীর ছাপ ফেলে দিয়েছিল। পরিবার রক্ষনশীল না থাকায় অনেক কিছুই বুঝতাম না।
পরে বড়ো হতে লাগলে বুঝলাম হিন্দু, মুসলিম, খ্রীষ্টান, বৌ্দ্ধ ইত্যাদি মানুষের ধর্ম আলাদা।
তখন থেকেই মনে প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ম কী?
যে শিশুটি হাত,পা, দুই চক্ষু,নাসিকা, কর্ণ নিয়ে জন্ম গ্রহন করে ,সে তো জানেনা তার ধর্ম ।তার স্বভাব সুলভ ধর্মে সে বেড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা শিশু জানতে পারে তারা এই ধর্মের বা ঐ ধর্মের।
প্রশ্ন ধর্ম কী?
(আরজ আলি মাতুব্বর “সত্যের সন্ধান “প্রথম খন্ড পৃ; ৫১ প্রকাশক সাহিদুল ইসলাম বিজু )

সাধারনত আমরা যাহাকে ধর্ম বলি তাহা হইল মানুষের কল্পিত ধর্ম। যুগে যুগে মহাজ্ঞানীগন এই কথা বিশ্বসংসারে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারন করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। স্রষ্টার প্রতি মানুষের কি কোন কর্তব্য নাই? নিশ্চয় আছে—এই রূপ চিন্তা করিয়া তাহারা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারন করিয়া দিলেন। অধিকন্তু, মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও দেখাইয়া দিলেন সেই মহাজ্ঞানীগন।
এই রূপে হইল কল্পিত ধর্মের আবির্ভাব। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মনীষী বা ধর্মগুরুদের মতবাদ হইল ভিন্ন ভিন্ন।
এই কল্পিত ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল উহাতে মতভেদ। ফলে পিতাপুত্র, ভাইয়ে ভাইয়ে ,এমন কি স্বামী স্ত্রীতেও মতভেদ শোনা যায়।
বর্তমান যুগে পৃ্থিবীর প্রায় সকল ধর্মই আস্তিক বিশেষত একেশ্বরবাদী। হিন্দু ধর্ম মুলতঃ একেশ্বরবাদী। তাহাই যদি হয়, অর্থাৎ জগতের সকল লোকই যদি একেশ্বরবাদী হয়, তবে তাহাদের মধ্যে একটি ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত।
কিন্তু ,আছে কী ? আছে যত রকম হিংসা ,ঘৃ্না, কলহ ও বিদ্বেষ। সম্প্রদায়বিশেষে ভুক্ত থাকিয়া মানুষে মানুষ কে এত অধিক ঘৃনা করে যে, তদ্রুপ ইতর প্রাণীকেও করেনা।
হিন্দুদের নিকট গোময় (গোবর) পবিত্র ,অথচ অহিন্দু মানুষ মাত্রেই অপবিত্র। পক্ষান্তরে মুসলমানদের নিকট কবুতরের বিষ্ঠাও পাক, অথচ অমুসলমান মাত্রেই নাপাক। পুকুরে সাপ,ব্যাং বিচ্ছু, মরিয়া পচিলেও জল নষ্ট হয়না, কিন্তু বিধর্মী মানুষে ছুঁইলেই উহা হয় অপবিত্র। কেহ কেহ এ কথাও বলেন যে, অমুসলমানী পর্ব উপলক্ষে কলা,কচু, পাঁঠা বিক্রী পাপ। এই কি ধর্ম? না ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা ?

আরজ আলীর উপরক্ত মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে সারা পৃ্থিবী আজ যে সন্ত্রাস,নৈ্রাজ্য, যে পরিমান অনুপরমাণু শৌর্যে ,বীর্যের প্রতিযোগিতা চলছে তার জন্য মানুষের তৈ্রি “ধর্ম” এবং তা থেকে যে অন্ধ বিশ্বাস জন্মেছে তারাই দায়ী।
একটা উদাহরণে কিছুটা হলেও আমরা সুত্র পাব। দেখুন, আল্লাহ্‌পাক কি লিখেছেন কোরআনে:

আর তোমরা মুশরেক নারীদেরকে বিয়ে করনা, যতক্ষন না তারা ঈমান গ্রহন করে। অবশ্য মুসলমান ক্রীতদাসী মুশরেক নারী অপেক্ষা উত্তম, যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে। এবং তোমরা (নারীরা) কোন মুশরেকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যে পর্যন্ত সে ঈমান না আনে। একজন মুসলমান ক্রীতদাসও একজন মুশরেকের তুলনায় অনেক ভাল, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও। তারা দোযখের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ্‌ নিজের হুকুমের মাধ্যমে আহ্বান করেন জান্নাত ও ক্ষমার দিকে। আর তিনি মানুষকে নিজের নির্দেশ বাতলে দেন যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (মারেফুল কোরআন, সূরা আল বাক্কারাহ্‌ ২:২২১, অনূবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দিন খান)

তাই আরজ আলী মাতুব্বর লিখেছেন:

মানবতার মাপকাঠিতে মানূষ একে অন্যের ভাই,ভালবাসা পাত্র ,দয়া –মায়ার যোগ্য ,সুখ দুঃখের ভাগী। এক কথায় একান্তই আপন।কিন্তু ধর্মে বানাইল পর ( আরজ আলী মাতুব্বর সত্যের সন্ধানে “ ১ খন্ড পৃ;৫২- “ ৫৩।)
স্বভাবতঃই মানুষ সত্যকে কামনা করে মিথ্যে কে নয় ,তাই আবহমানকাল হইতেই মানুষ “সত্যের সন্ধান করিয়া আসিতেছে। দর্শন, বিজ্ঞান, ভুগোল,ইতিহাস,গণিত প্রভৃতি জ্ঞানাঅনুশীলনের বিভিন্ন বিভাগ সর্বদাই চায় মিথ্যেকে পরিহার করিতে। তাই দার্শনিক না বৈজ্ঞানিক, কোন ঐতিহাসিক সজ্ঞানে তাহাদের গ্রন্থে মিথ্যার সন্নিবেশ করেন না। বিশেষতঃ তাঁহারা তাঁহাদের গ্রন্থের ভূমিকায় এমন প্রতিজ্ঞা করেনা না যে তাহাদের গ্রন্থের কোথাও ভুল ভ্রান্তি নাই। অথবা থাকিলেও তাঁহারা সংশোধন করিবেন না। পক্ষান্তরে যদি কাহারো ভুল ত্রুটি প্রমানিত হয়, তবে তিনি তাহা অম্লান বদনে স্বীকার করেন ,এবং উহা সংশোধনের প্রয়াস পাইয়া থাকেন।
এই রূপ পরবর্তি সমাজ পূর্ববর্তি সমাজের ভুলত্রুটি সংশোধন করিয়া থাকে ।এই রুপ যুগে যুগে যখনই অতীত জ্ঞানের মধ্যে ভুল ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়, তখনি উহা সংশোধন হইয়া থাকে। এক যুগের বৈজ্ঞানিক সত্য আরেক যুগে মিথ্যা প্রমানিত হইয়া যায়,তখনই বৈজ্ঞানিক সমাজ উহাকে জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করেন ও প্রমানিত করেন নতুন সত্যকে সাদরে গ্রহণ করেন।
ধর্ম জগতে ঐ রূপ নিয়ম পরিলক্ষিত হয়না।
তৌ্রত, জব্বুর, ইনজিল, কোরান, বেদ, পুরাণ, জেড-আভেস্তা ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ সমুহের প্রত্যেকটি অপৌ্রুষেয় বা ঐশ্বরিক পুঁথি কিনা তাহা জানিনা কিন্তু ইহাদের প্রত্যেকটি গ্রন্থ এই কথাই বলিয়া থাকে, যে এই গ্রন্থই সত্য, যে বলিবে ইহা মিথ্যা সে নিজে মিথ্যাবাদী,অবিশ্বাসী,পাপী অর্থাৎ নারকী।
ধর্ম শাস্ত্র সমুহের এইরুপ নির্দেশ হেতু কে যাইবে ধর্মশাস্ত্র সমুহের বিরুদ্ধে কথা বলিয়া নারকী হইতে?
আর বলিয়াই বা লাভ কি ? অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থই গ্রন্থকার বিহীন, অর্থাৎ ঐশ্বরিক বা অপৌ্রুষেয়, সুতরাং উহা সংশোধন করিবে কে?
প্রাগৈতিহাসিক হইতে শতশত রাষ্ট্রের উত্থান হইয়াছে এবং পরস্পর কলহ বিবাদের ফলে তাহাদের পতন হইয়াছে।
কিন্তু ধর্মে যতই কলহ –বিবাদ থাকুক না কেনো , জগতে যতগুলি ধর্মের আবির্ভাব ঘটিয়াছে তাহার একটিও আজ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়নাই। ইহার প্রথম কারন হইল যে ,রাস্ট্রের ন্যায় ধর্ম সমূহের আয়ত্তে তোপ, কামান, ডিনামাইট বা এটম বোম নাই যে তাহা দ্বারা একে অন্যের ধ্বংস সাধন করিতে পারে। ধর্মের হাতে আছে দুইটি অস্ত্র—আশীর্বাদ ও অভিশাপ।

অর্থাৎ আমরা চারিদিক দিয়ে রুদ্ধ। যতো প্রমান করার চেষ্টা চলুকনা কেন এই অস্ত্রের সম্মুখে আমরা কেউ দাঁড়াতে পারছিনা। এখন সব চাইতে মুখ্য বিষয় হল এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি?
গুটি কয়জন লিখে গেলে কি করে প্রমানিত করে মানুষের সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যাবে,যে এই কল্পিত ধর্ম একেবারেই ভিত্তিহীন। মানুষের আসল ধর্ম মানবতা।