জগদীশচন্দ্র বসু
প্রদীপ দেব

৩০ নভেম্বর, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্মদিন। বিজ্ঞানীদের স্মরণ শুধুমাত্র জন্মদিন বা মৃত্যুদিনের মত বিশেষ দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে না। আমাদের অজান্তেই জগদীশ চন্দ্র বসু প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে স্মরণীয় – তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের জন্য। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না তাঁর উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের অনেকগুলো দিক।

১৯০৯ সালের শেষের দিকে ইতালির গুগ্লিয়েল্‌মো মার্কনি আর জার্মানির কার্ল ফার্ডিন্যান্ড ব্রোনকে যখন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো – সারাবিশ্ব জানলো যে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুও প্রায় একই সময়ে বেতার তরঙ্গ নিয়ে মৌলিক গবেষণা শুরু করেন এবং ১৮৯৫ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম কৃত্রিম মাইক্রোওয়েভ উৎপাদনে সাফল্য লাভ করেন। উদ্ভিদও যে উদ্দীপনায় সাড়া দেয় – এ তথ্য জগদীশ বসুর আগে কেউ উপলব্ধি করেন নি, প্রমাণ করতে পারেন নি। পদার্থবিজ্ঞানে জগদীশ বসুর অনেক মৌলিক অবদান থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু আমাদের কাছে উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী হিসেবেই বেশি পরিচিত।

জগদীশ বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, ময়মনসিংহে। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার রাঢ়িখালে। তাঁর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। টাকা পয়সার অভাব ছিল না তাঁর। কিন্তু তখন ফরিদপুরের সেই গ্রামে কোন স্কুল ছিল না। ছেলেকে কোথায় পড়াবেন ভাবতে ভাবতে ভগবানচন্দ্র মায়ের নামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। জগদীশচন্দ্রের পড়াশোনা শুরু হয় সেই স্কুলে। পরে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৭৫ সালে ষোল বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হলো জগদীশ বসুর। সে সময় ফাদার লাঁফো ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্সের নামকরা ফিজিক্স প্রফেসর। প্রবীণ এই অধ্যাপকের আকর্ষণীয় ক্লাস জগদীশ বসুকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। তিনি ক্রমশঃ পদার্থবিদ্যার প্রতি গভীর আগ্রহ অনুভব করতে শুরু করেন। ১৮৭৭ সালে জগদীশ চন্দ্র এফ-এ পাশ করেন এবং ১৮৮০ সালে বি-এ। উভয় পরীক্ষাতেই পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি ল্যাটিন ভাষা ছিল তাঁর অন্যতম বিষয়। শুরুতে লক্ষ্য ছিল ডাক্তারী পড়বেন। কিন্তু ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেলো। বিলেতে গিয়ে ডাক্তারীতে ভর্তি হয়েও স্বাস্থ্যগত কারণে পড়া হলো না। ন্যাচারাল সায়েন্সে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন কেমব্রিজে। ১৮৮২ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে অনার্স সহ বি-এ পাশ করেন এবং ১৮৮৪ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে বি-এসসি পাশ করেন।

লন্ডন থেকে ফিরে সেই বছরেই প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্সের প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন তিনি। জগদীশ চন্দ্র বসুর ছাত্রাবস্থাতেই ১৮৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দ্যা কালটিভেশান অব সায়েন্স”। ভারতীয় জনসমাজকে বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার এই এসোসিয়েশান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা জাগানোর পক্ষে এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই সময়ের বাঙালি বিজ্ঞানী হিসেবে যারা স্বীকৃতি লাভ করেছেন তাঁদের অনেকেই এই এসোসিয়েশানের সঙ্গে কোন না কোন সময়ে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৫ সালে জগদীশ বসু এই এসোসিয়েশানে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। এখান থেকেই তাঁর পদার্থবিদ্যার মৌলিক গবেষণা শুরু হয়।

জগদীশ বসুর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। বিদ্যুৎ তরঙ্গ সম্পর্কীত পদার্থবিদা, জড় ও জীবের সাড়ার ঐক্য, এবং উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কিত গবেষণায় পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ। ১৮৯৫ সালে উইলহেল্‌ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের পর পদার্থিবিজ্ঞানে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পথ খুলে যায়। পরমাণু বিজ্ঞান, বেতারে বার্তা পরিবহন, তেজষ্ক্রিয়তা, এটমিক নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত যুগান্তকারী আবিষ্কার এসময় বৈজ্ঞানিক মহলে বিরাট প্রভাব ফেলে। এ সময় জগদীশ বসু অদৃশ্য বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মাধ্যমে সংকেত বার্তা প্রেরণের গবেষণায় বেশ সাফল্য লাভ করেন। হেন্‌রিখ হার্ট্‌জ, ও গুগ্লিয়েল্‌মো মার্কনির সমসাময়িক জগদীশ বসুই হলেন বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি ১৮৯৫ সালে সর্বপ্রথম সাফল্যের সাথে মাইক্রোওয়েভ উৎপাদন করেন এবং তার ধর্মাবলীও নির্ধারণ করেন। রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের রিমোট সেন্সিং সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেন আমাদের জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে। এর ক’দিন পরে জগদীশ বসু কলকাতার টাউন হলে ৭৫ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তুপে আগুন জ্বালাতে সমর্থ হন নিজের উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশানের সাহায্যে।

একই বছর ইতালির গুগ্লিয়েল্‌মো মার্কনি দুই কিলোমিটার দূর থেকে বেতার তরঙ্গ রিসিভ করতে সমর্থ হন। মার্কনির আবিষ্কারের কথা যতটা প্রচার পায় – একই রকম আবিষ্কার হলেও জগদীশ বসুর আবিষ্কারের কথা তদানীন্তন ভারতের বাইরে তেমন একটা প্রচারিত হয় না। এর পেছনে তদানীন্তন ভারতের ইংরেজ শাসকদের একটা প্রকাশ্য ভূমিকা ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে (১৯৩৫) রেডার আবিষ্কারের পর ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘের বেতার তরঙ্গের নানামুখী প্রয়োগের দিকে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। জগদীশ চন্দ্রের আবিষ্কার একটা নতুন মাত্রা লাভ করে। কিন্তু এর অনেক আগেই জগদীশ বসুর গবেষণা অন্যদিকে মোড় নেয়। পদার্থবিদ্যা থেকে উদ্ভিদের প্রাণ ও সংবেদনশীলতা নিয়ে কাজ শুরু করেন জগদীশ বসু।

অবশ্য এর আগে সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং দেশীয় উপাদানে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে জগদীশ বসু একটা বৈদ্যুতিক সংবেনশীল যন্ত্রের মডেল তৈরি করেন যা অনেকটা কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মত। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সংবেদনশীলতা মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এই যন্ত্র।

জগদীশ বসু ছিলেন পৃথিবীর প্রথম বায়োফিজিসিস্ট। তিনি উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কে গবেষণা করেছেন পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়ে। এই পদ্ধতির বিস্তৃত প্রয়োগে উদ্ভিদের প্রাণচক্র ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা জগদীশ বসুকে চিনলাম উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে।

বিজ্ঞানে একটা কথা আছে – পাবলিশ অর পেরিশ। বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা ছাড়া বিজ্ঞানের জগতে টিকে থাকার আর কোন রাস্তা নেই। একই গবেষণা হয়তো পৃথিবীর নানা দেশের নানা ল্যাবোরেটরিতে আলাদা আলাদা ভাবে অনেকেই করছে। যার ফলাফল আগে প্রকাশিত হচ্ছে আবিষ্কারের স্বীকৃতি জুটছে তার। আবিষ্কারের স্বত্ব বা প্যাটেন্ট পাবার জন্যও কত রকমের সংগ্রাম করতে হয়। এ একটা বিরাট প্রতিযোগিতা এবং এই প্রতিযোগিতা সবসময় যে সুস্থ প্রতিযোগিতা তা বলার সুযোগ নেই। জগদীশ বসু যে বেতার তরঙ্গ আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাননি তার একটা কারণ হলো তিনি তাঁর গবেষণার ফল নির্দিষ্ট জায়গায় যথাসময়ে প্রকাশ করতে পারেন নি বা তাঁর ইচ্ছেও ছিল না। তবে এটাও ঠিক যে পরাধীন ভারতে ইংরেজদের সাহায্য ব্যতীত শুধুমাত্র নিজেদের চেষ্টায় বেশি কিছু করার উপায় ছিল না। তাঁর গবেষণার প্রচার যৎসামান্য যা হয়েছে এবং স্বীকৃতি যতটুকু মিলেছে – তার জন্য সহযোগিতা করেছিলেন তাঁর শিক্ষক ফাদার লাঁফো আর বিজ্ঞানী লর্ড রেইলে।

১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে জগদীশচন্দ্র বসু প্রথম বৈজ্ঞানিক সফরে যান ইউরোপে। সেখানে তাঁর বক্তৃতা বৈজ্ঞানিক মহলে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরাধীন ভারতের বাদামী মানুষ সম্পর্কে ইংরেজদের তাচ্ছিল্যবোধ ও অবজ্ঞা জগদীশের সাফল্যকে অবদমিত করে রাখতে পারেনি। এ বছরই লন্ডন ইউনিভার্সিটি জগদীশ বসুকে ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান করে।

ইউরোপ সফরের সাফল্য জগদীশ বসুকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। বিদ্যুৎ তরঙ্গ নিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে গবেষণা শুরু করেন ১৮৯৯ সালে। গবেষণায় তিনি জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণস্পন্দনের অনুরূপ সাড়া প্রত্যক্ষ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন প্রাণীদের মত জড়বস্তুও বাইরের উত্তেজনায় সংবেদনশীল। জড় ও জীবের এই গোপন ঐক্য সম্পর্কে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের কাছে প্রকাশের একটা সুযোগ এসে পড়লো।

১৯০০ সালে প্যারিসে আয়োজিত পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হলেন জগদীশ। আমন্ত্রণ পেলেও জগদীশের যাওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তদানীন্তন শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে এতসব বাধার মুখেও জগদীশ বসুকে সহযোগিতা করেছিলেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্ন। উডবার্নের সহযোগিতায় ১৯০০ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জগদীশ বসু দ্বিতীয় বারের মত ইউরোপে গেলেন। বাংলা ও ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্যারিসে পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জড়বস্তুর সংবেদনশীলতা বিষয়ে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করেন।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলে সাড়া মিললেও তেমন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি জগদীশ বসু। পশ্চিমাদের একটা ধারণা ছিল ‘বাঙালি আর কী বিজ্ঞান জানে!” নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জগদীশ বসু ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার অফার পান। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সুযোগ মানে গবেষণার ব্যাপক সূযোগ হাতে পাওয়া। কিন্তু স্বদেশের সাথে, প্রেসিডেন্সি কলেজের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকা জগদীশ বসুর পক্ষে সম্ভব হলো না। তিনি তাঁর দেশকে হয়তো তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার চেয়েও বেশি ভালবাসতেন।

লন্ডন প্রবাস কালে ১৯০০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯০২ সালের ২০ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লেখা অনেকগুলো চিঠিতে জগদীশ বসু তাঁর প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বার বার তাঁর স্বদেশ প্রেমের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমাদের হৃদয়ের মূল ভারতবর্ষে। যদি সেখানে থাকিয়া কিছু করিতে পারি, তাহা হইলেই জীবন ধন্য হইবে। দেশে ফিরিয়া আসিলে যেসব বাধা পড়িবে তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। যদি আমার অভীষ্ট অপূর্ণ থাকিয়া যায়, তাহাও সহ্য করিব”। রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রকে প্রেরণা জুগিয়েছেন, শুনিয়েছেন অভয়মন্ত্র।

জগদীশচন্দ্র ফিরে এসেছেন ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষেই অধ্যাপনার সাথে সাথে নিজের চেষ্টায় গবেষণা। বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় উদ্ভিদের সাড়া মাপার জন্য নিজের ওয়ার্কশপেই তৈরি করেছেন স্ফিগমোগ্রাফ, ফটোমিটার, ফটোসিন্থেটিক বাব্‌লার প্রভৃতি যন্ত্র। এ সব যন্ত্রপাতি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাধারণ বাঙালি মিস্ত্রিরাই। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের উপাদান হিসেবে তিনি শজারুর কাঁটা পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।

জগদীশ বসু বৃটিশদের কোন অন্যায়ের সাথেই আপোষ করেন নি কখনো। তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন তখন একজন ইংরেজ অধ্যাপককে যে বেতন দেয়া হতো, একজন ভারতীয় অধ্যাপককে দেয়া হতো তার দুই তৃতীয়াংশ। আর চাকরি স্থায়ী না হলে ভারতীয়দের বেতন ছিল সমমর্যাদার ইংরেজদের বেতনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ। জগদীশ চন্দ্র এই বৈষম্যের প্রতিবাদ করলেন। ইংরেজ ও ভারতীয়দের বেতন-বৈষম্য না ঘুচলে বেতন নেবেন না ঘোষণা দিলেন। বিনাবেতনে পড়ালেন অনেক দিন। ইংরেজ অধ্যক্ষ বাধ্য হলেন বেতন বৈষম্য ঘোচাতে। এতে সব ভারতীয় অধ্যাপক উপকৃত হলেন, কিন্তু ক্ষতি হলো জগদীশের। তিনি ইংরেজ কর্তৃপক্ষের চক্ষুশূলে পরিণত হলেন। এজন্য অনেক অপমান সইতে হয়েছে তাঁকে।

প্রথম ইউরোপ সফর শেষে কলেজে ফিরে এসে একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা তো দূরে থাক – পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের কাজের একটা ল্যাব দাঁড় করিয়েছিলেন। সরকারের কাছে কিছু অনুদানের জন্য লেখার পর যে উত্তর পেলেন এরকমঃ “ডক্টর বসু এখন মাসে পাঁচশ টাকা মাইনে পান। কোন নেটিভ সরকারি চাকুরের মাসে পাঁচশ টাকায় পোষাচ্ছে না বলাটা নেহায়েৎ বোকামি”। পদে পদে অপমানের উদাহরণ আরো অনেক আছে।

১৮৯৭ সালে কলকাতায় এসেছেন বিজ্ঞানী লর্ড রেইলে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্যাভেন্ডিজ ল্যাবের এই বিখ্যাত অধ্যাপকের কাছে পড়াশোনা করেছেন জগদীশ বসু। কাজেই প্রিয় স্যারকে নিজের কলেজে পেয়ে নিজের গবেষণা, ল্যাব ঘুরিয়ে দেখালেন জগদীশ। এত সীমিত সুযোগের মধ্যেও জগদীশ যে এত কাজ করছেন – দেখে খুব খুশি হলেন লর্ড রেইলে। তিনি জগদীশের অনেক প্রশংসা করলেন কলেজের ইংরেজ প্রিন্সিপালের কাছে। হিতে বিপরীত হলো। লর্ড রেইলে চলে যাবার পর প্রিন্সিপালের কাছ থেকে শো-কজ নোটিশ পেলেন জগদীশ বসু। কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে “কলেজের অধ্যাপনায় ফাঁকি দিয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিজের ইচ্ছেমত গবেষণা করাটা কেন অপরাধের পর্যায়ে পড়বে না?” ল্যাবের যন্ত্রপাতি চুরির অপবাদও সইতে হয়েছে জগদীশ বসুকে।

টাকার অভাবে গবেষণা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে জগদীশ বসুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে তিনি জগদীশ বসুর গবেষণার টাকা জুগিয়েছেন। ১৯১৫ সালে অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে জগদীশ বসু প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। ক্রমে বসু বিজ্ঞান মন্দির হয়ে ওঠে একটা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কেন্দ্র। ১৯২০ সালে জগদীশ বসু রয়েল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯২৭ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করেন। ১৯২৮ সালে ভিয়েনার একাডেমি অব সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন।

জগদীশচন্দ্র ছিলেন মাতৃভাষা ও স্বদেশী ভাবধারার বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ। ১৮৯১ সাল থেকে তিনি বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। ‘মুকুল’, ‘দাসী’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন। তাঁর ‘অব্যক্ত’ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশ বসু মারা যান। মানুষের স্মৃতিশক্তি মাপার সর্বপ্রথম যান্ত্রিক মডেল তৈরি করেছিলেন জগদীশ বসু। আজ আমরা ঠিক সেই মডেল ব্যবহার না করলেও বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা যতদিন থাকবে – বেঁচে থাকবে জগদীশ বসুর কীর্তি, জাগরুক থাকবে তাঁর জীবন-স্মৃতি।