.
১। পার্বত্য শান্তিচুক্তি [লিংক] বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমেক্রেটিক ফ্রণ্ট — ইউপিডিএফ হঠাৎ করে ভোল পাল্টেছে। ঘোষণা করেছে, তারা নাকি চুক্তি বাস্তবায়নে প্রয়োজনে সরকারকে সহায়তা দেবে! [লিংক]

এ যেনো ভূতের মুখে রাম নাম! অথবা সেই ‘বিলাই কয় মাছ খামু না, ধর্ম কর্ছি, গয়ায় যামু!’ …

১৯৯৮ সালে এই গ্রুপটির জন্মই হয়েছে শান্তিচুক্তির বিরোধীতার মধ্যে দিয়ে। সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির গেরিলা দল শান্তিবাহিনীর অস্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে (একই বছর ১০ ফেব্রুয়ারি) চুক্তি বিরোধী ব্যানার ও কালো পতাকা দেখিয়ে ইউপিডিএফ প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন করে। তবে তখনও এর সাংগঠিক রূপ ছিল না। এটি পরিচিত ছিল প্রসিত-সঞ্চয় গ্রুপ হিসবে। শান্তিচুক্তির বিপরীতে তারা প্রচার করতে থাকে হাওয়াই এক পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার কথা। ইউপিডিএফ-এর শীর্ষ নেতা প্রসিত বিকাশ খীসা, রবিশংকর চাকমা, সচিব চাকমা, ধ্রুব জ্যোতি চাকমা, উজ্জল স্মৃতি চাকমা, সমারি চাকমাসহ অসংখ্য নেতার সঙ্গে ব্যাক্তিগত পরিচয়ের সূত্র ধরে আমি জনে জনে জিজ্ঞাসা করেছি, পূর্ণ সায়ত্বশাসন! ইহা হয় কী বস্তু? ইহা কী রূপে ধরাধামে প্রতিষ্ঠিত হইবে? …তারা কেউই আমাকে সদুত্তোর দিতে পারেননি। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও নিম্ন-সারির নেতাকর্মীদের কথা না হয় বাদই দিলাম!
.
আমার প্রথম বই ‘রিপোর্টারের ডায়েরি: পাহাড়ের পথে পথে’ [লিংক] প্রকাশ হয় ২০০৯ সালের বই মেলায়। সেখানে একটি লেখার ফুটনোটে এ রকম একটি কথা আছে: শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরেও চুক্তিবিরোধী নাবালক বিপ্লবীদের গ্রুপ ইউপিডিএফ’র অস্ত্রের আঘাতে এখনো রক্ত ঝরছে পাহাড়ে। …

বই মেলাতেই আমার এক সময়ের ঘনিষ্ট বন্ধু সমারি চাকমার সঙ্গে দেখা। আমি তখন কাঠ বেকার। আর সে ইউপিডিএফ’র কেন্দ্রীয় নেত্রী, আগের মতোই উজ্জ্বল ও মস্তিস্কশুন্য। তার সঙ্গী হেনরীয়েটা সুখ খাগড়াছড়ির সাংবাদিক। হেনরী আমাকে দেখে খলবল করে কিছু বলে…আমার চমক ভাঙে সমারির কথায়। সে হেনরীর হাত ধরে টান দিয়ে বলে, চলে আয় হেনরী, আমরা তো আবার নাবালক বিপ্লবীদের দল! [লিংক]

২। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সহায়তা দানের বিষয়ে ইউপিডিএফ যে প্রস্তাব দিয়েছ, সে প্রসঙ্গে আমি জনসংহতি সমিতির শীর্ষ স্থানীয় নেতা ঊষাতন তালুকদারের মতামত জানতে চেয়েছিলাম।

রাঙামাটি থেকে টেলিফোনে সাবেক গেরিলা নেতা ঊষতন তালুকদার আমাকে বলেন, দেখুন, বরাবরই ইউপিডিএফ ‘ধান্ধাবাজী’র রাজনীতি করে আসছে। কাজেই চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে তারা মিথ্যা কথা বলতে পারে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গত ১২ বছর ধরে যেভাবে তারা শান্তিচুক্তিকে বাধাগ্রস্থ করে আসছে, তা না করা হলে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ অনেক এগিয়ে যেতো। তারা আসলে জনগণের চাপের মুখে দিশেহারা হয়ে এসব আবোল-তাবোল কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে তারা এখন মিথ্যের বেসাতি করছে।
.
ইউপিডিএফ’কে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ উল্লেখ করে সাবেক সাবেক গেরিলা নেতা ঊষাতন তালুকদার বলেন, বাঘাইহাট – খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য ইউপিডিএফ-ও অনেকাংশে দায়ী। তাদের সৃষ্টিকারী প্রভুরাই সেদিনের সহিংসতায় তাদের মাঠে নামিয়েছিল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একটি বিশেষ মহল অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে তাদের সহযোগিতা করছে।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে ইউপিডিএফ দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজী করে আসছে। মুখে ‘স্বায়ত্বশাসন’ প্রতিষ্ঠার কথা বললেও তারা কোনোদিনই এর আদর্শিক বাস্তবভিত্তি দেখাতে পারেনি। জনগণকে জিম্মী করে অস্ত্রের মুখে চাঁদাবাজী ও অপহরণ করায় পার্বত্যাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এটি করার কোনো অধিকার তাদের নেই। তাছাড়া তাদের সঙ্গে মৌলবাদী ও জঙ্গিদলগুলোর যোগ-সাজস রয়েছে। তাই কোনোভাবেই তাদের গণতান্ত্রিক শক্তি বলা যায় না। এসব কারণেই ইউপিডিএফ’কে আমরা নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি।

পাঠক, এ পর্যায়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে ইউপিডিএফ’র উত্থানের মূলমন্ত্র কী?

এক কথায় চুক্তি ঠেকাও! সন্তু লারমা ঠেকাও! এ জন্য ব্যাক-আপ ফোর্স হিসেবে তাদের রয়েছে কিছু বিপ্লবী বোলচাল, চাঁদাবাজীর অর্থ ও অস্ত্র। এর প্রতিটি নেতাকর্মী এতোটাই উগ্র যে…

উপরন্তু শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার সুযোগে গত ১২ বছরে পাহাড়ে যে দীর্ঘ ও নিরব হতাশা দেখা দিয়েছে, সেটাকেই পুঁজি করে এগুচ্ছে তারা। তাদের চুক্তি বিরোধীতা, উগ্রতা ও অন্ধত্ব ওয়েব সাইট ও নথি-পত্রেও প্রকাশ্য। [লিংক]

পাহাড়ের জীবন্ত কিংবদন্তি, জুম্ম (পাহাড়ি) জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত এমএন লারমা’র প্রশ্নে আশ্চর্যজনকভাবে নিরব থাকে এই গ্রুপটি। এমন কি তারা এই মহান নেতার মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করে না! [লিংক]
.
৩। পাহাড়ের একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে গত একযুগে পাহাড়ে চুক্তির সমর্থকদের ওপর সশস্ত্র হামলা, অপহরণ, গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়েছে ইউপিডিএফ। এ দীর্ঘ সময়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে নিহত হয়েছেন শতাধিক, অপহৃত হয়েছেন তিন শতাধিক, আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনী দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ইউপিডিএফের একাধিক ক্যাডারকে হাতেনাতে আটক করেছে। সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা ও শান্তিচুক্তির বিরোধিতা এবং পাহাড়ে কথিত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মতানৈক্যের জের ধরে এরই মধ্যে গ্রুপটির শীর্ষনেতারা দল ছেড়েছেন।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) একটি অংশ চুক্তির বিরোধিতা শুরু করে। পিসিপির সাবেক নেতা প্রসিত খীসা ও সঞ্জয় চাকমা এ অংশটির নেতৃত্ব দেন বলে সেটি তখন চুক্তিবিরোধী প্রসিত-সঞ্জয় গ্রুপ নামে পরিচিতি পায়। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে কড়া নিরাপত্তার ভেতর গ্রুপটির কর্মীরা প্রথমবারের মতো ’পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ এর দাবি করে ব্যানার প্রদর্শন করে। এটিই ছিল তাদের প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচি। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এক বৈঠকে তারা সাংগঠনিকভাবে আত্নপ্রকাশ করে ’ইউপিডিএফ’ নামে।

প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে গ্রুপটির প্রথম আহ্বায়ক কমিটিতে ছিলেন সঞ্জয় চাকমা, রবি শংকর চাকমা, দীপ্তি শংকর চাকমা ও ধ্রুব জ্যোতি চাকমা। তবে মতবিরোধের কারণে বছর চারেকের মধ্যে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা সঞ্জয় চাকমা, দীপ্তি শংকর চাকমা, দীপায়ন খীসা, অভিলাষ চাকমা, অনিল চাকমা গোর্কিসহ বেশ কয়েকজন পুরনো নেতা দল ত্যাগ করেন।

বর্তমানে এর সভাপতি হিসেবে প্রসিত খীসা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রবি শংকর চাকমা দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা থেকেই তাদের প্রধান নেতারা টেলিফোনে পাহাড়ের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। বছর খানেক আগেও শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তিন তলায় গ্রুপটির সমর্থিত ’হিল লিটারেচার ফোরাম’ নামে সংগঠনের একটি অফিসও ছিল।

২০০৬ সালের ৫ জানুয়ারি কথিত গণতান্ত্রিক দল — ইউপিডিএফ ঢাকা থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে চার মাসের জন্য জনসংহতি সমিতির প্রতি ’সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার ঔদ্ধত্ব দেখায়! [লিংক]

২০০১ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের তিনটি নির্বাচনী আসনে ’তীর-ধনুক’ মার্কা নিয়ে তারা সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির বিপরীতে প্রার্থী দেয়। এর ফলে পার্বত্য আসনগুলোতে ভাগ হয়ে যায় পাহাড়িদের ভোট।

অর্থাৎ সবমিলিয়ে ’ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ — লেফট-রাইট, লেফট!…

আরো পড়ুন: পাহাড়ে কেনো এতো সহিংসতা? [লিংক], পাহাড়ে প্রশ্নবিদ্ধ ইউপিডিএফ [লিংক], একটি ইত্তেফাকীয় রম্য রচনা [লিংক]।



ছবি: ১। বগা লেক, বান্দরবান, লেখক, ২। শান্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফ’র প্রথম কর্মসূচি, সংগৃহিত, ৩। এমএন লারমার প্রতিকৃতির সঙ্গে সাবেক গেরিলা নেতা ঊষাতন তালুকদার, লেখক, ৪। বাঘাইছড়ির পোড়া ভিটায় সতর্ক সেনা প্রহরা, কালের কণ্ঠ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০।