২য় পর্ব-

– আচ্ছা আয়েশা, আপনার বাবার মতো আপনিও তো অন্ধবিশ্বাসী, তাই না?
– কী রকম?
– জিব্রাইলকে নাকি আপনি স্বশরীরে দেখেছেন?
– আমি এমন কথা কোনোদিন বলিনি।
– শুনা যায় জিব্রাইল একরাতে ওহি নিয়ে আপনার বিছানায় এসেছিলেন, যা নবির আর কোন স্ত্রীর ভাগ্যে কোনোদিন জুটেনি?
– ও আচ্ছা সেই ঘটনা! শুনুন, দিনান্তে ক্লান্তি অবসানে একখানি ছোট্ট কম্বলের নিচে আমরা দুজন শুয়ে আছি। হঠাৎ উনি (মুহাম্মদ) বললেন, ‘দেখো আয়েশা জিব্রাইল এসেছেন, তোমাকে সালাম জানিয়েছেন’। আমি বললাম, হুঁ, নবি যা দেখতে পান আমি তা পাইনা। তাঁর প্রতিও আমার সালাম।
– আপনি সরাসরি জিব্রাইলের সালামের জবাব না দিয়ে নবিকে মাধ্যম ধরলেন কেনো?
– জিব্রাইল তো সরাসরি আমাকে সালাম দেন নি, তাঁর সালামের আওয়াজও আমি শুনিনি। নবি যেভাবে বলেছেন আমিও সেভাবেই উত্তর দিলাম। নবি তাঁর স্ত্রীদের বিছানায় আসেন বাই-রটেশন। আমার বিছানায় আর আসবেন ১২/১৩ দিন পরে। অলস রাতের এমন আনন্দঘন মুহুর্তে কোন্ নারীর দায় ঠেকেছে, উষ্ণ-কম্বলখানি দূরে সরিয়ে পাশফিরে তাকিয়ে দেখে কে আসলো আর কে গেলো? হায়া শরম ত্যাগ করে কেউ যদি দাঁড়িয়েই থাকে, একজন নারীর তাতে কী’বা আসে আর যায়? আমি ইচ্ছে করলে স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, কোথায় জিব্রাইল, আমি তো তার সালাম শুনলাম না, তাকে দেখিওনা।
– কেনো জিজ্ঞেস করলেন না?
– কারণ, উত্তরটা যে আমার জানা।
– কী রকম?
– নবি যা দেখতে পান, শুনতে পান, অন্যরা তা দেখতে পায় না, শুনতে পায় না।
– কিন্তু অন্যরা তো দেখেছেন। নবিজি তাঁর সাহাবিদের নিয়ে যখন বসতেন তখন নাকি মাঝে মাঝে মানুষের রূপে জিব্রাইল এসে ঈমান শিক্ষা দিয়ে যেতেন।
– হ্যাঁ, হাদিসে আরো উল্লেখ আছে, খন্দকের যুদ্ধের সময় এক পর্যায়ে জিব্রাইল কাদা-মাটি মাখা গায়ে, দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে নবিকে বলেছিলেন ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আর আমি এখনও খোলা তলোয়ার হাতে দৌড়াচ্ছি’।
– আচ্ছা! খন্দকের যুদ্ধে জিব্রাইল বুঝি ফ্রন্টলাইনে ছিলেন? শুনেছি জিব্রাইল নাকি খুব বড় সাইজের ফেরেস্তা?
– হ্যাঁ, তাঁর ছয়শো’টি বিশালাকারের ডানা আছে।
– আশ্চর্য ব্যাপার! এতোবড় ফেরেস্তা আপনার ঘরে আসলেন, আর আপনি দেখলেন না। তবে বিবি মরিয়ম, অর্থাৎ ঈসা নবির মা জিব্রাইলকে দেখেছিলেন তা নিশ্চয়ই সত্য। এতোবড় ফেরেস্তাকে দেখে বিবি মরিয়ম কি ভয় পেয়েছিলেন?
– হ্যাঁ, কোরানে ঈসা নবির জন্ম-কাহিনিতে তা উল্লেখ আছে। তবে মরিয়মও জিব্রাইলকে মানুষরূপেই দেখেছিলেন।
– ও আচ্ছা, মানুষরূপে দেখলে তো ভয়ের কিছু নেই। আয়েশা, আজিকার দিনের মানুষেরা বাবা আদমের পাঁজড় থেকে মা হাওয়ার জন্ম, আর ভায়রজিন মেরির পেট থেকে পিতাহীন ঈসার জন্ম, তা বিশ্বাসই করতে চায় না। আপনি নিশ্চয়ই বিষয়টা ভাল জানেন।
– আমি যেভাবে শুনেছি, আমাকে যেভাবে বলা হয়েছে, আমি সেভাবেই জানি। ঈসা নবিকে পিতাহীন করে সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আল্লাহপাক বহু বছর আগে মরিয়মের স্বামী তৈরি করে রেখেছিলেন।
– এ্যাঁ, বলেন কী! মেরির স্বামী ছিলেন?
– এতো উত্তেজিত হলেন কেনো সাহেব? এ এক বিরাট লম্বা কাহিনি।
– শর্টকার্ট করে বলা যায় না?
– ঠিক আছে বলবো, তবে এ কাহিনি বলতে গেলে আমার একটি কন্ডিশন আছে।
– কী কন্ডিশন?
– আপনি এভ্যুলুশন থিওরি টেনে আমাকে ডিস্টার্ব করতে পারবেন না। মানুষ কল্পনায় কতোজনকেই দেখে। আজ রাতে আপনি আমাকে দেখেছেন, কাল রাতে যে ডারউইন সাহেবকে দেখবেন না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
– আরে না না, আমি সেদিকে মোটেই যাবো না। বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী আমার কিছু বন্ধু বান্ধবই আমার কাছে ওহি পাঠিয়েছেন এই বলে যে, আমি যেন আপনাকে সহজে ছেড়ে না দেই। একরাতে যতটুকু সম্ভব আমি যেন আপনার কাছ থেকে জেনে নিই, এমন রাত আর কোনোদিন না’ও আসতে পারে।
– ওকে। বাট রিমেম্বার, আমি যা বলবো তা আমার মুখের কথা নয়, এসব হাদিস ও তাফসির কিতাব সমুহে পৃথিবীর বহু দেশে, আপনাদের ভাষা সহ বহু ভাষায় লেখা আছে। কাহিনির শুরুটা হয়েছিল এ ভাবে- হঠাৎ একদিন আল্লাহ পাকের মনে ইচ্ছে জাগলো, নূরে মুহাম্মাদি সৃষ্টি করার ——
এই তো সমস্যা, আপনি আমার কাছে কাহিনি শুনতে চাইবেন, আবার বিশ্বাসও করবেন না, হাসাহাসি করবেন। আপনি হাসলেন কেনো?
– স্যরি আয়েশা, আমরা বিজ্ঞানের যুগের মানুষ তো, তাই সব কিছুর পেছনে কারণ খোঁজার অভ্যেস হয়ে গেছে। ঐ যে বললেন, ‘হঠাৎ একদিন’- আমার জনতে ইচ্ছে করে, এ কোন্ দিন, কতোদিন আগে, এর আগে আল্লাহর বয়স কতো ছিল বা কতোদিন আল্লাহ একাএকা ছিলেন?
– আপনার এ প্রশ্নের উত্তর জগতের কোনো মানুষ কোনোদিন দিতে পারবে? শুনুন, আজেবাজে প্রশ্ন না করে কাহিনিটা মনযোগ দিয়ে শুনুন, – হঠাৎ একদিন আল্লাহ পাকের মনে ইচ্ছে জাগলো, নূরে মুহাম্মদি সৃষ্টি করার। এই নূরে মুহাম্মদি সৃষ্টি করার আগে আল্লাহর আরশ-কুরসি, বেহেস্ত-দোজখ, আকাশ-পাতাল, চন্দ্র-সূর্য, রাত-দিন, গ্রহ-নক্ষত্র, বৃক্ষ-লতা, জীব-জন্তু কোন প্রকারের জলীয়-বায়বীয় বস্তু বা পদার্থের অস্থিত্ব ছিল না। নূরে মুহাম্মদি সৃষ্টি করে আল্লাহ তাঁর কুদরতি হাতের তালুতে রেখে এক নাগাড়ে চল্লিশ হাজার বৎসর মুহাম্মদ নামের তাসবিহ জপ করলেন। শুরু হলো আশিক আর মাশুকের লুকোচুরি খেলা। একবার আল্লাহ লুকান, মুহাম্মদ আল্লাহকে খুঁজেন আর একবার মুহাম্মদ লুকান, আল্লাহ মুহাম্মদকে খুঁজেন। হঠাৎ একবার মুহাম্মদ চালাকি করে লুকিয়ে গেলেন আল্লাহর পায়ের নিচে। চল্লিশ বছর গত হয়ে যায় আল্লাহ আর মুহাম্মদকে খুঁজে পান না। চল্লিশ বছর পর আল্লাহ নিজের বুকের বাম দিকে একটু বিরহের ব্যথা অনুভব করলেন, আর তখনই তাঁর চোখ থেকে একফুটো জল গাল বেয়ে ঝরে পড়লো। সাথে সাথে নূরে মুহাম্মদিতে ইশকের তুফান শুরু হয়ে যায়। নূরে মুহাম্মদি আল্লাহ নামের জিকির করলো কয়েক হাজার বছর। আল্লাহ খুব খুশি হলেন। আহ্লাদে খুশিতে আটখানা আল্লাহ এবার মনস্ত করলেন নিজের মালিকানায়, নিজে পরিশ্রম করে কিছু সম্পদ সৃষ্টি করবেন। মাত্র ছয় দিনে তৈরি করলেন সাত আসমান সাত জমিন, ফেরেস্তা, বাগান সহ স্বর্গ, আগুন ভর্তি নরক। বিরাট আকারের এক ফেরেস্তার স্কন্ধে আল্লাহ তাঁর সিংহাসন আরশ তৈরি করলেন। ঐ ফেরেস্তার এক কান থেকে অপর কানের দূরত্ব হলো পাঁচশো বছরের রাস্তা। সাত জমিনের এক জমিনে আল্লাহ বড় বড় পাহাড়ের শক্ত খুঁটি দিলেন, তারপর সেই জমিন স্থাপন করলেন একটি বিগ সাইজের ষাঁড়ের শিঙ্গের উপর। একনাগাড়ে বিরামহীন ছয় দিন পরিশ্রম করে সপ্তম দিনে ক্লান্ত আল্লাহ গিয়ে বসলেন তাঁর সিংহাসনে। পাহাড়ের খুঁটিযুক্ত জমিনের ঠিক মাঝখানের নাম দিলেন মক্কা, আর কিছুদিন বিশ্রামের পর এই মক্কায় একখানা ঘর তৈরি করে তার নাম রাখলেন কা’বা শরিফ। কা’বা ঘর তৈরির চল্লিশ হাজার বৎসর পর আল্লাহর মনে ইচ্ছে জাগলো এই জমিন মানুষ নামের জীব দিয়ে আবাদ করাবেন। সকল ফেরেস্তাদের নিয়ে বৈঠকে আল্লাহ তার প্রস্তাব পেশ করলেন। একবাক্যে সকল ফেরেস্তা আল্লাহর প্রস্তাব রিজেক্ট করে দিলেন। আল্লাহ বললেন, ‘আমি যা জানি তোমরা তা জানোনা’। আজরাইল ফেরেস্তাকে মানুষ সৃষ্টির মাটি সংগ্রহের জন্যে দুনিয়ায় পাঠানো হলো। শক্তিধর আজরাইল এক থাবায় তার মুষ্টিতে চল্লিশ মণ মাটি তুলে নিলেন। মানুষের নকশা আল্লাহ আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। নকশা অনুযায়ী ৪০মণ মাটি দিয়ে ৮০গজ লম্বা আদম নামের মানুষ সৃষ্টি করে, আরবের শ্যাম দেশের এক প্রান্থে শুইয়ে রাখা হলো ৪০দিন। ৪০ দিন পর জিব্রাইল ফেরেস্তার ডাক পড়লো। আল্লাহ বললেন, ‘হে জিব্রাইল, পৃথিবীতে যাও, আমার আদমকে বেহেস্তে নিয়ে এসো, আমি তার দেহে প্রাণ সঞ্চার করবো’। জিব্রাইল আদমের দেহ দুনিয়া থেকে উঠিয়ে বেহেস্তে নিয়ে আসলেন। কয়েকদিন প্রাণহীন আদমের দেহ আল্লাহর উঠোনে পড়ে রইলো। একদিন জিব্রাইলের হাতে আল্লাহ নিজের রুহ থেকে একটু রুহ দিয়ে বললেন- ‘জিব্রাইল, এই রুহ আদমের মাথার তালু দিয়ে ঢুকিয়ে দাও’। একবার দুইবার তিনবার চেষ্টা করেও জিব্রাইল আদমের ভেতরে রুহ ঢুকাতে পারলেন না। রুহ বারবার আদমের দেহ থেকে বেরিয়ে আসে। আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে রুহ, তুমি আমার নির্দেশ অমান্য করছো কেনো’? রুহ উত্তর দিল, ‘হে আল্লাহ, হে মালিক আদমের অন্ধকার মাটির খাঁচায় আমার থাকতে ভালো লাগে না’। আল্লাহ জিব্রাইলকে বললেন, ‘জিব্রাইল বেহেস্তের দিকে তাকাও, ঐ দেখো একটি উজ্জল তারকা (নূরে মুহাম্মদি) দেখা যাচ্ছে। ঐ তারকা আদমের কপালে ঘষে দাও’। জিব্রাইল তা’ই করলেন। আবার রুহ ঢুকানো হলো, এবার আদমের দেহ থেকে রুহ আর বেরিয়ে আসলো না। একটা ঝাকুনি দিয়ে আদম জেগে উঠে নড়ে চড়ে বসলেন, আর সাথে সাথে একটা হাঁচি দিলেন। সেই হাঁচির সাথে আদমের নাক থেকে এক প্রকার তরল পদার্থ বেরিয়ে এলো। আল্লাহ জিব্রাইলকে আদেশ দিলেন, ‘জিব্রাইল, আদমের নাক থেকে নিঃসৃত তরল পদার্থ একটি বেহেস্তি পেয়ালায় স্বযতনে ভরে রাখো, আমি তা দিয়ে একদিন ঈসা নবির মাতা মরিয়মের স্বামী বানাবো’।

– আচ্ছা আচ্ছা, এই বুঝি মরিয়মের স্বামী? উহ, আয়েশা আমি তো শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে অধীর অপেক্ষায় ছিলাম, আপনি মরিয়মের স্বামী হিসেবে জুসেফের মতো কোনো পুরুষের নাম বলবেন।
– কেনো? শুধু ফিমেইল থেকে যে প্রজনন সম্ভব, তা তো আপনাদেরই শিক্ষা। আপনারা যে বলেন, পার্থেনোজেনিসিস (Parthenogenesis) বা asexual reproduction পুরুষ ছাড়াই হয়, তাহলে পিতাহীন ঈসার জন্ম মানতে বাধা কোথায়? তারপর ক্লোনিং করে যদি মানুষ ডলি দ্যা শিপ বানাতে পারে, তাহলে আল্লাহ কেনো আদম থেকে হাওয়াকে বানাতে পারবেন না?
– আয়েশা আমাকে নিষেধ করে এবার আপনি নিজেই জীববিজ্ঞান নিয়ে আসলেন? কিন্তু আপনি যে মারাত্বক ভুল করছেন তা কি জানেন? প্রশ্ন যেহেতু করেছেন, সংক্ষেপে বলে দেই, Parthenogenesis বা asexual reproduction কোনোটাই মানুষের মাঝে হয়না, আর আদমকে ক্লোনিং করতে হলে হাওয়ার ডিম্বাকোষ আগে তৈ্রি করে রাখতে হবে। সেদিকে আমাদের না যাওয়াটাই ভাল কারণ আপনার সমসাময়ীক ইতিহাস থেকে আরো জরুরি বেশ কিছু বিষয় আপনার কাছ থেকে জানার আছে।
– আচ্ছা ঠিক আছে, ইতিহাসে যাওয়ার আগে আদমের কাহিনিটা শেষ করে নিই- একদিন আদম দেখলেন, বেহেস্তের এক কোণে তাঁরই মতো কিন্তু তাঁর চেয়ে সুন্দর একটি মানুষ বসে আছেন। বেহেস্তের আয়নায় নিজেকে দেখে আদমের মনে হিংসা ও দুঃখের উদ্রেক হলো। আদমের মন খারাপ দেখে আল্লাহ পাক তার গালে দাঁড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। আদম তা দেখে বেজায় খুশি হলেন। তাঁর মনে সুন্দর মানুষটিকে ছুঁয়ে দেখার বাসনা জাগ্রত হলো। অমনি আল্লাহর কাছ থেকে নিষেধ আসলো, ‘হে আদম, খবরদার হাওয়াকে ছুঁইওনা, হাওয়ার গায়ে হাত দেয়ার আগে মোহরানা আদায় করতে হবে’। আদম বললেন হে প্রভু, এখানে মোহরানা দেয়ার মতো কিছু যে আমার নাই’। আল্লাহ বললেন, ‘আদম, বেহেস্তের চারিদিকে চেয়ে দেখো’। আদম বললেন, ‘প্রভু দয়াময়, বেহেস্তের চারিদিকে, উপরে নিচে, ডানে বামে, গাছের পাতায় পাতায়, তোরণে তোরণে আপনার নামের পাশে একটা নাম দেখছি, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। আল্লাহ বললেন, ‘আদম, ঐ নামে দশবার দরুদ শরিফ পড়ো, তোমার মোহরানা আদায় হয়ে যাবে’। আদম তা’ই করলেন, আদম হাওয়ার বিয়ে হয়ে গেলো। আল্লাহ, আদম ও হাওয়াকে গন্ধম বৃক্ষের নিকটে যেতে নিষেধ করলেন। একদিন ইবলিস শয়তান মা হাওয়াকে বললো, ‘দেখো এখান থেকে বহু দূরে আল্লাহ একটি দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে সেখানে পাঠিয়ে দিবেন, সেখানে বেহেস্তের সুযোগ সুবিধে নেই। বেহেস্তে থাকতে হলে তোমাদেরকে গন্ধম বৃক্ষের ফল খেতে হবে’। বেহেস্তে সুখের লোভে বিবি হাওয়া আল্লাহর কথা অমান্য করলেন এবং ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। হাওয়া লক্ষ্য করলেন, ফলগুলো তাঁর হাতের নাগালের সামান্য বাইরে। তিনি দু পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর ভর করে দাঁড়ালেন, অমনি তাঁর পায়ের গোড়ালী থেকে কিছুটা কাপড় উপরে উঠে যায়। হাওয়া মুখ তুলে উপরের দিকে তাকালেন, অমনি তাঁর মুখের ও মাথার কিছুটা কাপড় খোলে যায়। তিনি দুহাত উঁচু করে ফলের দিকে হাত বাড়ালেন, অমনি হাতের কাপড় কনুই পর্যন্ত অনাবৃত হয়ে যায়। সেদিন মা হাওয়ার শরীরের চার জায়গা অনাবৃত হয়েছিল, এ জন্যে সেদিন থেকে জগতের মানুষের জন্যে ওজুর চার ফরজ নির্ধারিত হয়ে যায়। আল্লাহর আদেশ অমান্য করায় বাবা আদম, মা হাওয়ার উপর ভীষণ রাগান্বিত হলেন এবং হাওয়াকে তাঁর অপরাধের শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে পাশের জয়তুন গাছের একটি ডাল ভেঙ্গে নিয়ে এলেন। এই ভাঙ্গা জয়তুনের ডালটাই ছিল হজরত মুসা নবির হাতের আশা বা লাঠি, যে লাঠি সর্প হয়ে ফেরাউনের ১২ হাজার বিষাক্ত সাপকে একশ্বাসে গ্রাস করেছিল। সেদিন মুসা নবির সেই লাঠি ৪০মাইল লম্বা অজগর হয়েছিল, যা দেখে ভয়ে ফেরাউন একদিনে ২০০বার টয়লেট করেছিল। এদিকে যেইমাত্র আদম ও হাওয়া গন্ধম খেলেন, সাথে সাথে তাদের শরীর থেকে বেহেস্তি রেশমী কাপড়গুলো বাতাসে উড়ে যায়। তারা দুজনে বিবস্ত্র হয়ে বেহেস্তের চতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেনো আর বৃক্ষাদির কাছে মিনতি করতে থাকেনো ‘হে বৃক্ষাদি একটু দয়া করো, কিছু পাতা দাও ইজ্জত ঢাকি’। গাছ উত্তর দেয় ‘হে আদম, পাতা দেয়া যাবে না কারণ তোমরা প্রভুর আদেশ অমান্য করেছো’। আল্লাহ জিব্রাইলকে ডেকে বলেন ‘হে জিব্রাইল, তাড়াতাড়ি এসো, আমার আদম বিপদে পড়ে গেছে, শীঘ্র জয়তুন গাছ থেকে ৮টি পাতা আমার আদমের কাছে নিয়ে যাও। ৫টি পাতা হাওয়াকে দিও আর ৩টি পাতা আদমকে’। সেদিন থেকে পৃথিবীর মানুষের মৃত্যুর পর মহিলাদের জন্যে কাফনের ৫কাপড় আর পুরুষের জন্যে ৩কাপড় নির্ধারিত হয়ে যায়। আল্লাহর আদেশ অমান্য করার অপরাধের শাস্তি স্বরুপ আদম-হাওয়াকে আল্লাহ বেহেস্ত থেকে তাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। জিব্রাইলকে অর্ডার দেয়া হলো তাদেরকে দুনিয়ায় নিয়ে যেতে। জিব্রাইল বললেন, ‘হে প্রভু, আদম-হাওয়াকে পৃথিবীর কোন জায়গায় রেখে আসবো’? আল্লাহ বললেন, ‘হাওয়াকে মক্কা থেকে ৪০মাইল দূরে জেদ্দা নদীর পাড়ে পূর্ব-মূখী করে, আর আদমকে আরবের সীমানা থেকে ৬০০মাইল পূর্বদিকে সড়ং-দ্বীপের কিনারে পশ্চিম-মূখী করে রেখে আসবে’। হাওয়া, আদমের সন্ধানে হাঁটতে শুরু করলেন পূর্বদিকে আর আদম হাওয়ার সন্ধানে পশ্চিম দিকে। একনাগাড়ে ৩৬০ বৎসর একাএকা কেঁদে কেঁদে হাঁটতে হাঁটতে জিলহাজ মাসের ৯ তারিখ শুক্রবার আরাফাতের মাঠে বাবা আদম ও মা হাওয়ার পুনর্মিলন হয়। দুনিয়ায় বাবা আদম ১হাজার বছর হায়াত পেয়েছিলেন। মা হাওয়া ১৪০বার হামেলা (গর্ভবতী) হয়ে প্রতিবারই জোড়ায় জোড়ায় একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তান প্রসব করেছিলেন। ১৪১বার এর সময় একটিমাত্র ছেলে সন্তান জন্ম দেন, তিনিই জগতের দ্বিতীয় নবি হজরত শীষ (আঃ)। এভাবে নূরে মুহাম্মদি বাবা আদমের কপাল বেয়ে বেয়ে দুই লক্ষ তেইশ হাজার নয় শো নিরান্নবইজন নবির পর যেদিন আব্দুল্লাহর কপাল থেকে মা আমেনার গর্ভে চলে আসে, সেদিন থেকে শয়তানের জন্যে আকাশের সাতটি দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ঐ দিন থেকে শয়তান আর প্রথম আকশের উপরে উঠতে পারে না।

এই হলো বাবা আদম, মা হাওয়া আর ঈসা নবির জন্ম বৃত্তান্ত। এবার বলুন ইতিহাস থেকে কী জানতে চাইছিলেন?
– মা হাওয়াকে কী ভাবে ক্লোন করা হলো তা তো বললেন না। আচ্ছা থাক, আপনার কাছ থেকে এবার জানতে চাইবো, একজন বুদ্ধিমতি নারী হয়ে আপনি হজরত আলির বিরোদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেন কেনো? কমপক্ষে দশ হাজার নিরপরাধ মুসলমানের গলা কাটা হলো, কতো অসহায় নারী জানলোইনা কেনো তারা বিধবা হলো, পিতৃহারা শিশুরা বুঝলোইনা কেনো তাদের বাবা গৃহে ফিরলো না।
– আমি জেনে বুঝে আরো অন্যান্য গন্য-মান্য সাহাবিদের সাথে আলাপ আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ভুল হয়েছিল সেদিন আলির খেলাফত অস্বীকার করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন না করা। ইসলাম রক্ষা ও প্রচারে আমার দুই দুলাভাই সাহাবি হজরত তালহা (রাঃ) ও হজরত জুবায়ের (রাঃ) এর অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তারা সহ বেশিরভাগ মুসলমান আমার পক্ষেই ছিলেন। প্রমাণ, জামাল যুদ্ধে আমার সৈ্ন্য-সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার আর আলির পক্ষে ছিল বিশ হাজার।
– কিন্তু আয়েশা, বোন হয়ে ভাইয়ের বিরোদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। আপনার ভাই মুহাম্মদ তো আলির পক্ষে ছিলেন। ঠিক না?
– হ্যাঁ তা ঠিক। যুদ্ধের কৌশলগত কারণে আরো কিছুটা সময় নেয়া আমার উচিৎ ছিল। শুধু আমার ভাই নয়, আমার আরো কিছু আপনজন না বুঝে সেদিন আমার বিপক্ষে গিয়েছিলেন।
– শোনা যায় হজরত আলি পত্র মারফত আপনার সাথে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন?
– কিসের সমঝোতা? ক্ষমতা আর সমঝোতা একসাথে চলতে পারে না। আলি, সাহাবি উসমানকে হত্যা করায়ে জোর পূর্বক অগণতান্ত্রীক ভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন।
– আলি তো খলিফা উসমানকে হত্যা করেন নি, করেছিলেন আপনার ভাই মুহাম্মদ। এর শাস্তি হিসেবে মুয়াবিয়া আপনার ভাইকে বস্তায় পুরে, তাতে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিলেন। কিন্তু এজন্যে আপনি নবির স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে ‘বেশ্যা নারীর মেয়ে’ বলাটা কি ঠিক হলো?
– বলেছি তো। আবু সুফিয়ানের সন্তানদের বাবার কোন ঠায়-ঠিকানা আছে? মুয়াবিয়া নিজেই জানতেন না, তার বাবা কয়জন। মুয়াবিয়া আমার ভাইকে খুন করার পর তার বোন উম্মে হাবিবা আমাকে একটা আস্ত ছাগল ভুনে পাঠিয়ে দিয়ে খবর দিলেন, ‘আয়েশাকে বলো এ তার ভাইয়ের সদকা’। উম্মে হাবিবা আমার কাঁটা গায়ে লবন ছিটাবেন আর আমি মুখ বন্ধ করে থাকবো, তা তো হয়না।
চলবে-

১ম পর্ব-

৩য় পর্ব-