তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
আজ ট্রেনিং রুমে তিল ধারণের জায়গা নেই। অন্য সময়ে ইন সার্ভিস ট্রেনিং এর কথা আসলেই কর্মীদের ওই দিনটিতেই নানান কাজ পড়ে যায়। যে যে ভাবে পারে এড়ানোর চেষ্টা করে। আজ চিত্র পুরো উলটো। কারণ আজকের প্রেযেন্টার একজন ট্র্যান্সজেন্ডার ভদ্র মহিলা। বিষয় জেন্ডার এন্ড ডিসক্রিমিনেশন”। ঔৎসুক্য ক্রমেই বাড়ছে। কেউ এসেছে কিছু শেখার জন্যে, কেউ নেহায়েত তামাশা দেখতে এবং এদের দলই ভারী। আর কেউ ট্রেনিং রুমের বাইরে জটলা পাকাচ্ছে যেন চরম পাপাক্রান্ত কিছু ঘটতে চলেছে।
নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম “কেয়া রোজারিও তুমি কোন দলে পড়ো? প্রশ্নটা করে স্বভাবসিদ্ধভাবে নিজেকে খুঁড়তে প্রস্তুত হলাম। নিজেকে খুঁড়ে আমি ব্যাপক আনন্দ পাই। আজকে ভয় হলো আমার না জানা কোন কেয়া বেরিয়ে আসতে পারে। তাই পরক্ষণে সামাল দিলাম এই ভেবে যে, আমার স্টাফ ট্রেনিং আমি না থাকলে কি চলে?”
জনা পঞ্চাশেক মানুষ চরম উত্তেজনায় সময় কাটাচ্ছে। কেননা ভদ্রমহিলা এখনো এসে পৌঁছোননি। তার সহকর্মী আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সবাই ঘড়ি দেখতে ব্যস্ত। যেনো এক্ষনি কোন সার্কাস শুরু হবে। ঝলমলে কাপড় পড়ে কেউ গলায় ঢুকিয়ে দেবে চকচকে তলোয়ার অথবা মুখে পুরে দেবে জ্বলন্ত অগ্নি শলাকা।
না তেমন কিছুই ঘটলো না। সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভদ্রমহিলা রুমে ঢুকলেন। এক নজরে মনে হলো একজন সুঠাম দেহী পুরষ গালে আর চিবুকে কিছুটা মাংস সংযোজন করেছেন। অত্যন্ত উত্তেজক কাপড় পরা, ঘাড় বেয়ে নেমে এসেছে ইনপ্ল্যান্ট করা খয়েরী বাদামী চুল। ভদ্রমহিলার চোখে এক গাদা মাশকারা মাখা। না কিছুতেই আমার দেখা কোন মহিলার সাথে এনার মিল খুঁজে পাচ্ছি না। নিজকে প্রশ্ন করি, “কেয়া, কেনো তোমার এনাকে মহিলা মনে হচ্ছে না? তোমার দেখা কোন মহিলার সাথে মিল পাচ্ছো না বলেই কি?”
ভদ্রমহিলা এসেই একটা খাম্বার পেছনে জড়োসড় হয়ে বসলেন। উনি কি নিজেকে নিয়ে বিব্রত? জানি , এতোগুলো জোড়া জোড়া কৌ্তুহলী চোখের সামনে যে কেউই তো বিব্রত বোধ করতেই পারে। নাকি ধনুকের টানটান উত্তেজনার মুহুর্তে হঠাৎ বেরিয়ে এসে করতালি চাইছেন?
ভদ্রমহিলা এবারে উঠে এসে সবার সামনে বসলেন। বললেন “আমার নাম রাজিন্দর”। নাহঃ মোটেও মেয়েলী কোন কন্ঠস্বর নয়। তিনি শুরু করলেন তার জীবনের গল্প , বললেন তার শারীরিক গঠন পুরুষের হয়ে জন্মালেও তার মন সর্বদাই নারীদের মত ভেবেছে, আচরণ করেছে।
সে কারনেই প্রাইমারী স্কুল থেকেই সহপাঠীরা ঠাট্টা করেছে, অনেক নামে ডেকেছে। আমাদের বোধ হয় ধারণাই নেই কত ছোট বয়স থেকেই এধরণের নানা ঠাট্টা মশকরা করে বাচ্চারা। রাজিন্দর কিছু উপাত্ত দিলেন যে কত বাচ্চা এ ধরনের আচরণের স্বীকার হয়, উপাত্ত দিলেন স্কুল শুটিং এর সাথে এই ঠাট্টা বা বুলিং এর কি সম্পর্ক রয়েছে।
এর মাঝে আমাদের একজন সহকারী বললেন তাদের পরিবারে একটি শিশুর জন্ম হয় পুরুষ মহিলার শারীরিক উভয় অঙ্গ নিয়ে। বাবা মা সিদ্ধান্ত নেয় নারী অঙ্গের অপসারণের। বাচ্চাটির বয়স এখন দশ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে জানতে চায় কবে সে মেয়েতে রুপান্তরিত হবে? তার শরীরের পরিচয় ভিন্ন হলেও তার মনের পরিচয় ভিন্ন।। বাবা মা যতই শরীরের অঙ্গ অপসারণ করুক না কেনো বাচ্চাটি মেয়ে হয়েই জন্মেছিলো।
রাজিন্দর এ সময়ে উল্লেখ করেন সিএনএনএদেখানো ৬০ মিনিটের একটি পর্বের কথা, যেখানে পুরুষ পরিচয়ে জন্মানো একটি বাচ্চা কথা বলা শুরু থেকেই মা কে জানিয়ে দেয় সে একটি মেয়ে। সে নিজেকে মেয়ে হিসেবেই সনাক্ত করে। আমার আবারো মিশ্র অনুভুতি হয়, একটা দুবছরের বাচ্চা মাকে বললো সে মেয়ে আর মা বাবা ও তাই মেনে নিলো।পরক্ষণে মনে হলো তবে কি আগের ঘটনার মত বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত যা পরবর্তীতে বাচ্চার জন্যে ভালো নাও হতে পারে?
রাজিন্দর এবার বলা শুরু করলেন তার পরিবারের কথা। বাবা বিশাল দেহী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, মা বেশ কিছু রেসের সংমিশ্রন। মা তার এই জীবনকে মেনে নিয়েছেন কিনা বোঝা যায় না। কারণ, মা এ নিয়ে কোন কথা বলেননি। কিন্তু বাবা তাকে ত্যাজ্য করেছিলেন। ওর বাবা ক্যান্সার আক্রান্ত হবার পর শেষ তিন মাস ফোনে কথা বলেছে, বাবার নানা আকুতির সাড়া দিতে পারে নি রাজিন্দর। মৃত্যু শয্যায় বাবা ছেলেকে দেখতে চেয়েছে। রাজিন্দর পরিবর্তিত মুখাবয়ব, পরিবর্তিত দেহ নিয়ে বাবার সামনে যেতে সংকোচ বোধ করেছে। ততদিনে রাজিন্দর মেয়েদের মত গলা খাদে নামিয়ে কথা বলা রপ্ত করে নিয়েছিলো। কিন্তু বাবার সাথে পুরুষালী কন্ঠেই কথা বলেছে। এতটুকু বলে রাজিন্দর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এবারে ওর সেই নিকষ কালো মাশকারা চোখের জলে গলে গাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে। সহকর্মীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই সহকর্মী রুমাল এগিয়ে দিলেন। সবার চোখ অশ্রুসিক্ত। আমারো মন খারাপ হলো এই দুঃখী মানুষটার জন্যে। কিন্তু সাথে সাথে এও মনে হোল তবে কি গাঢ় করে মাশকারা পড়ার কারণ এটাই ? এটাও কি আজকের প্রেযেন্টেশনের মহড়া দেয়া কোন অংশ?
রাজিন্দরকে বার বার হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে নির্মম ক্রোধে, পৈশাচিক উল্লাসে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে, সাবওয়ের নিচে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে, রাজিন্দর মরতে মরতে বেঁচে গেছেন – তবু বেঁচে আছেন।
ওর চাকরী পাওয়ার ঘটনাটা বলতে শুরু করলেন রাজিন্দর। কর্ম জীবনের শুরুটা খুব কষ্টের, কেউ চাকরী দূরে থাক, ইটারভিউতে ডাকে নি কারন ড্রাইভার লাইসেন্সে তার পুরুষ পরিচয় আর এপ্লিকেশনে নারী পরিচয় খটকা বাঁধিয়েছিলো। এক বন্ধু শেষে পরামর্শ দিলো “এক কাজ কর না কেনো, টেলিফোনে উত্তেজক কথা বলার একটা চাকরী নাও না কেনো? এর পরের ছ’বছর রাজিন্দর বন্ধুর পরামর্শ মত চাকরীই করেছে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এমন একটা চাকরী এতো সহজে কেনো ও নিলো? ও পথে পা বাড়ালো কেনো? রাজিন্দর বলে চলেছে ক্ষিদের কষ্ট কি তা সে জানে, আজকে যেমন আলাদা ওয়েবসাইট আছে ট্র্যান্সজেন্ডারদের চাকরীর জন্যে, আগে এমন ছিলো না । এরা সাধারণত টেলিফোনে কাস্টমার সার্ভিস অথবা রাতে সবার চোখের আড়ালে ব্যাংকে বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে ডাটা এন্ট্রির চাকরী পেয়ে থাকে।
এর পর এমনি একটি ব্যাংকে রাজিন্দরের চাকরী হয়। সমস্যা বাধে ও কোন টয়লেট ব্যবহার করবেন তা নিয়ে। পুরুষ অথবা মহিলা সহকর্মী কেউই স্বাছন্দ্যবোধ করে না তার উপস্থিতিতে।
পলিটিকালি কারেক্টেড সিদ্ধান্ত নেয়া হলো রাজিন্দর লবিতে ফ্যামিলি টয়লেট ব্যাবহার করবে। মজার কথা হলো রাজিন্দরের ডিউটি ছটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত আর লবি বন্ধ হয়ে যায় পাঁচটায়। এক বছর একটানা ও কাজে টয়লেট ব্যাবহার করতে পারে নি। তৃষ্ণায় কাতর হলেও ভুলে গলা ভেজায়নি জলে, পাছে টয়লেটে যেতে হয়। একবছর পর টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠান “কল মি হাওয়ার্ড” এ ফোন করে তার সমস্যার কথা জানায়। পরদিনই কর্তৃপক্ষ মহিলাদের টয়লেট ব্যবহারের নির্দেশ দেয়। হয়তো বা ডিসক্রিমিনেশনের কেস এড়াতেই।
কাজের ওখানে ওকে ইচ্ছে করে স্যার বলে সম্বোধন করেছে কেউ কেউ। রাজিন্দর মেনে নিয়েছেন এই তাচ্ছিল্য। আমি এবার নিজেকে প্রশ্ন করি আবার, রাজিন্দর আমার সহকর্মী হলে আমি কি বলতাম? এমন মেয়েলী কাপড় পড়া পুরুষ কে আমি কি বলে সম্বোধন করতাম?
টেনিং এ যে পুরুষরা উপস্থিত ছিলেন সেদিন, দেখলাম তারা মোটেও রাজিন্দরকে নিজেদের একজন ভাবছেন না। যারা অন্য পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন তারাও না। মহিলারা তো নয়ই। তাহলে রাজিন্দরের অবস্থান কোথায়? রাজিন্দর ক্রসড্রেসার নয় যে শুধু মাত্র ঝোঁকের কারনেই মহিলাদের পোষাকের প্রতি ই তার আকর্ষন। সে নিজেকে একজন পুরুষ দেহে বাস করা নারী হিসেবে দেখেন।ভাবলাম তোমার মাঝে বাস করে কোন জনা -তুমি জানো না। এবারে আমি রশুনের খোসা ছাড়াতে বসলাম। দেখলাম আমার নারী পুরুষের প্রথাগত সমস্ত ধারণা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমি কি প্রস্তুত?
রাজিন্দর এবারে একেবারে ব্যাক্তিগত কথা শুরু করলেন। বললেন মেয়েদের পোষাক পরার সুবিধে হলো পুরুষ বন্ধুরা ওদের সাথে লুকিয়ে সম্পর্ক করে না বরং রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যায়। তাই রাজিন্দরও নিজেকে “দ্বিতীয় “ ভাবে না বা “মিসট্রেস সিন্ড্রমে “ ভোগে না।
আমি মনে মনে বললাম রাজিন্দর তুমি এমন ভাবে কথা বলছো যেনো তুমি কোন মহিলা -আমাদের চোখে তো তুমি নারীর পোষাকে পুরুষই।
পরক্ষণে বোঝালাম নিজেকে এই জন্যেই তো আজকের এই ট্রেনিং। আমার চোখে রাজিন্দর পুরুষ কিন্তু ওর মন? ওর মনতো জন্মাবধি নারীর । biological sex assignment is not gender identity” বারবার বলে চলেছে ও।
একজন সহকর্মী বলে বসলো- রাজিন্দর এত্তো উত্তেজক কাপড় পড়েছো কেন? চেয়ে দেখো এই রুমের কেউ তো তোমার মত কাপড় পরেনি”। রাজিন্দরের চোখে অপ্রস্তুতি, মুখে রক্তের ছোটাছুটি লক্ষ্য করলাম। হাসতে হাসতে হড়হড় করে যে রসিকতা বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে তাতে কানে আঙ্গুল দিতে হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ”পুরুষরা এভাবে দেখতে পছন্দ করে তাই পরি”।
এবার আমার অবাক হবার পালা। আবার সেই পুরোন কথা। পুরুষরা যেমন করে দেখতে চাইবে তেমন করেই সাজতে হবে!! তাহলে তুমি আলাদা হলে কীভাবে রাজিন্দর?
নিজেকে বোঝালাম -ওর মন তো মেয়েলী মনই, ভাবতেই পারে ও অন্য মেয়েদের মত একই ভাবনা।
ট্রেনিং দু’ঘন্টার জায়গায় তিন ঘন্টায় ঠেকলো। সবার কৌ্তুহলের পর্ব যেনো কাটতেই চাইছে না। টেনিং শেষ করে যখন বেরিয়ে আসছি খেয়াল করলাম আমি নিজে থেকে রাজিন্দরের সাথে কথা বললাম না। বরং ওর পুরুষ সহকর্মীর সাথে কথা বললাম। আমি ওদের সমস্যা জানতে চাইছি কিন্তু ওকে মেনে নিতে কি আমার কষ্ট হচ্ছে? আমি এর তাত্ত্বিক দিকটায় আগ্রহ দেখাচ্ছি কিন্তু সামাজিক দিকটা এড়িয়ে যাচ্ছি। হয়তো ব্যাপারটার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারছি না বলেই আমার এই পালিয়ে যাওয়া।
কেয়া রোজারিও,
আপনার সহজ করে লেখা গভীরতর লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। :rose:
শেষ পর্যন্ত রাজিন্দরকে আমি ভাগ্যবানই বলবো। কারণ তার অন্তত জীবনযাত্রার মানটুকু উন্নত। বাংলাদেশের রূপান্তরিত মানুষ, যারা চলতি বাংলায় হিজড়ে বলে পরিচিত, তাদের মতো রাজিন্দরকে জীবিকার তাড়নায় অন্তত বিকৃত বেশ্যাবৃত্তির পথ বেছে নিতে বাধ্য হতে হয়নি।
ঢাকার ‘বাঁধন’ সংগঠনের সূত্রে বেশ আগে ধামরাইয়ের কথিত হিজড়ে পল্লীতে গিয়ে সুযোগ হয়েছিল, তাদের বিচিত্র সব জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতার কথা জানার। …সমাজ যে কবে আরেকটু মানবিক হবে! 😕
পুনশ্চ: লেখাটির শিরোনাম প্রসঙ্গে অনেক দেরীতে হলেও বলছি। এই শিরোনামটি যে গান থেকে নেওয়া হয়েছে, তার লেখক জাহিদ হাসান পাপ্পু আমার ঘনিষ্টজন। তিনি ছিলেন আমার কবিতার মাস্টার। জাহিদ ভাই চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছেন, অনেক বছর, একটু একটু করে…এ নিয়ে আলাদা একটি লেখা লিখবো ভাবছি। …
আসলেই খুবই কঠিন অপ্রীতিকর সত্যের সামনে দাঁড় করিয়েছেন কেয়া।
আমরা রাজিন্দরের মত মানূষদের মেনে নিতে কতটুকু প্রস্তুত? এখনো মনে হয় মানসিকতার পরিবর্তন হতে সময় লাগবে।
সামাজিক দিকটা আমরা এড়িয়ে যেতে চাই, সামাজিক কারণেই। সমাজ এখনো অতটা অগ্রসর নয়। এমন কি এই আমেরিকাতেও নয়। আমি আশা করতে পছন্দ করি, হয়তো আমার জন্মে নয়, কিন্তু একদিন আমরা রাজিন্দরদের, তাঁদের সব ‘ভিন্নতা’ আর ‘অস্বাভাবিকতা’ সত্বেও সমাজের স্বাভাবিক সদস্য মনে করবো। সেদিন রাজিন্দরেরাও এমন কোন কাজ বা আচরণ করতে বাধ্য হবে না যা সমাজের অন্য সদস্যদের চোখে কুরুচিপূর্ণ মনে হবে। রাজিন্দরদের বাবারাও তাঁদের সন্তানদের ‘অস্বাভাবাকিতা’ মেনে নিতে পারবেন নির্দ্বিধায়, কোন রকম সঙ্কোচ বা মনোবেদনা ছাড়াই। রাজিন্দরদেরও একবার পুরুষের গলায় আরেকবার মেয়েলী কন্ঠে কথা বলা রপ্ত করতে হবে না। আমাদেরও পালিয়ে বেড়াতে হবে না রাজিন্দরদের মতো মানুষদের কাছ থেকে, প্রসঙ্গ পাল্টাতে হবে না তাঁদের কথা উঠলে।
আমার মনে হয় না সেদিন খুব দূরে। অভিজিতের ‘সমকামিতার’ ওপরে লেখা সদ্য প্রকাশিত বই (তাঁর ওপরের মন্তব্যে উল্লেখিত) রাজিন্দরদের মতো মানুষদের সম্পর্কে আমাদের জানতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। সত্য আমরা যত জানতে পারবো, ততই কাটবে আমাদের দ্বিধা আর সঙ্কোচ।
কেয়াকে ধন্যবাদ আবারো আমাদের কিছু কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য। এ ধরণের বিষয় নিয়ে লেখা সহজ কাজ নয়। কিন্তু কঠিন বিষয় নিয়ে কেয়া লেখেন অনায়াসে, গল্পচ্ছলে। এই লেখাটাও ব্যতিক্রম নয়।
খুব ভাল লাগল । আপনার রচনা শৈ্লী অবশ্যি প্রশংসার দাবীদার ভাল লাগল আরো এই কথা টা
আরো লিখুন আরো পড়ি ।
কেয়া,
কঠিন ও বাস্তব সত্য।
কেয়া,
অনেকদিন পর নীরবতা ভাঙলো তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা লিখে। লেখাটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম।
কেমন লাগলো?
আসলে বুঝতে পারছি না, ভাষায় প্রকাশ করতেও পারছি না। ।
ঢাকায় এমন গ্রুপ আছে, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। হিজড়ারা তা ও বাঁধন নামে সংগঠন করে তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার।
এদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
@গীতাদি,
আসলে রাজিন্দরদের মত ব্যক্তিদের সমাজ উপেক্ষা করাতেই অভ্যস্ত ছিলো এতোদিন। এখন সময় পাল্টাচ্ছে। ইংরেজীতে এদের একটা বিশেষনাম আছে – ট্রান্সেক্সুয়াল। বাংলা পরিভাষায় এ সংক্রান্ত কোন শব্দ নেই। আমি আমার সর্বশেষ সমকামিতা বিষয়ক বইয়ে শব্দচয়ন করেছি রূপান্তরকামিতা হিসেবে। আমি লিখেছিলাম –
রূপান্তরকামিতার ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে ট্রান্সেক্সুয়ালিটি (Transexuality)। ট্রান্সেক্সুয়াল মানুষেরা ছেলে হয়ে (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে) জন্মানো সত্ত্বেও মনমানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবেন (কিংবা কখনো আবার উল্টোটি- নারী হিসেবে জন্মানোর পরও মানসিক জগতে থাকেন পুরুষসুলভ)। এদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোষাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় (ট্রান্সভেস্টিজম / ক্রসড্রেস), আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত মানবে (Transexual)পরিণত হন। এরা সকলেই বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের (Transgender) অংশ হিসেবে বিবেচিত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রূপান্তরকামিতার অস্তিত্ব আছে কেন? আমি লিখেছিলাম –
যৌনতার শরীরবৃত্তিয় বিভাজন মেনে নিয়েও বলা যায়, সামাজিক অবস্থার (চাপের) মধ্য দিয়েই আসলে এখানে একজন নারী ‘নারী’ হয়ে উঠে, আর পুরুষ হয়ে ওঠে ‘পুরুষ’। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ নারী আর পুরুষের জন্য জন্মের পর থেকেই দুই ধরনের দাওয়াই বাৎলে দেয়। নানা রকম বিধি-নিষেধ ও অনুশাসন আরোপ করে। পোশাক আষাক থেকে শুরু করে কথা বলার স্টাইল পর্যন্ত সবকিছুই এখানে লৈঙ্গিক বৈষম্যে নির্ধারিত হয়। এর বাইরে পা ফেলা মানেই যেন নিজ লিঙ্গের অমর্যাদা। কোন ছেলে একটু নরমভাবে কথা বললেই তাকে খোঁটা দেওয়া হয় ‘মেয়েলী’ বলে, আর নারীর উপর হাজারো রকম বিধি-নিষেধ আর নিয়মের পাহাড় তো আছেই। ফলে দুই লিঙ্গকে আশ্রয় করে তৈরি হয় দু’টি ভিন্ন বলয়। কিন্তু সমস্যা হয় রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে। এরা আরোপিত বলয়কে অতিক্রম করতে চায়। তারা কেবল ‘যৌনাঙ্গের গঠন অনুযায়ী’ লিঙ্গ নির্ধারনের সনাতনী প্রচলিত ধারনাকে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। তারা শারীরিক লিঙ্গকে অস্বীকার করে বিপরীত সাংস্কৃতিক বা মানসিক লিঙ্গের সদস্য হতে চায়। তারা মনে করে দেহ নামক বাহ্যিক কাঠামোটি তাদের জন্য সঠিক লৈঙ্গিক পরিচয় তুলে ধরছে না; মনে করে সেক্স নয়, আসলে জেন্ডার অনুযায়ী তাদের লিঙ্গ নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর পর থেকে (বস্তুতঃ বিগত কয়েক দশকে) পশ্চিমা বিশ্বে জেন্ডার সম্পর্কিত ধারণা যত ঋদ্ধ হয়েছে ততই লৈঙ্গিক বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে পড়ছে।
আসলে এ বিষয়টি খুব ভাল ভাবে বুঝতে হলে আমাদের ‘সেক্স’ এবং ‘জেন্ডার’ শব্দদুটির অর্থ এবং ব্যাঞ্জনা আলাদা করে বুঝতে হবে। সেক্স এবং জেন্ডার কিন্তু সমার্থক নয়। বাংলা ভাষায় শব্দদুটির আলাদা কোন অর্থ নেই, এদের সঠিক প্রতিশব্দও আমাদের ভাষায় অনুপস্থিত। আমি আমার বইয়ে সেক্স বলতে জৈবলিঙ্গ আর জেন্ডার বলতে সাংস্কৃতিক লিঙ্গ বুঝিয়েছি। জানিনা বাংলাদেশে যারা জেন্ডার নিয়ে কাজ কর্ম করছেন তারা আমার দেওয়া প্রস্তাব আর পরিভাষাগুলো মেনে নেবেন কিনা।
এবারে কেয়ার লেখার একটা গুরুত্বপুর্ণ অংশের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক –
আমিও আমার বইয়ে ডেভিড রেইমার নামে এক দুর্ভাগা শিশুর উদাহরণ উল্লেখ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম -কিছুদিন আগেও এমনকি পশ্চিমের হাসপাতালে উভলিঙ্গ মানব শিশু (অর্থাৎ, একই দেহে নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সন্তান) জন্মালে ডাক্তারের একটাই কাজ ছিল– অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের এই ‘বার্থ ডিফেক্ট’ অবহিত করে ‘সেক্স চেঞ্জ’ (চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘সেক্স রিএসাইনমেন্ট’) অপারেশন করে হয় ছেলে নয়ত মেয়ে বানিয়ে ছেড়ে দেয়া। অভিভাবকেরাও যেহেতু উভলিঙ্গ সন্তান নিয়ে সমাজে ঝামেলা পোহাতে চেতেন না, তাদের কাছেও এটা একটা সবসমইয়ই খুবই আকর্ষনীয় একটা সমাধান হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু আমেরিকায় ডেভিড রেইমার নামে এক রোগীর বিয়োগান্তক পরিনতি সেক্সচেঞ্জ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সময়ের ধ্যান ধারণা চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকটাই পালটে দিয়েছে। ডেভিড রেইমারের ঘটনা পড়া যাবে এখান থেকে।
আমি আমার বইয়ে নর্থ আমেরিকান ইন্টারসেক্স সোসাইটি র বক্তব্য হাজির করেছি। তারা মনে করেন – ডেভিড রেইমারের বিয়োগান্তক দৃষ্টান্ত থেকে সামাজিক জটিলতাগুলো বুঝতে ডাক্তারদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ। তাদের মতে, একটি শিশু বড় হয়ে যখন নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটি সচেতন হয়ে উঠে, তার আগে ‘সেক্স অপারেশন’ করা আসলে শিশু নিপীড়নের সমতুল্য। যৌনতা পরিবর্তনের চেয়ে যেটা আরো বেশী দরকার সেটা হল – নারী-পুরুষের বাইরেও অন্যান্য লৈঙ্গিক পরিচয় এবং যৌনতাগুলো সম্পর্কে জনসচেততনা এবং এগুলোর সামাজিক স্বীকৃতি।
জানি বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে যেখানে সংখ্যালঘুদেরই কোন নিরাপত্তা নেই, সেখানে এ ধরণের জেন্ডার সচেতনতা তো সুদূরপরাহত। তারপরেও আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে এ সংক্রান্ত ব্যাপারে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া কঠিন হবে না।
বিদ্রঃ আজকের একটা খবরে দেখলাম – অস্ট্রেলিয়ায় লৈঙ্গিক পরিচয় হিসেবে ছেলে বা মেয়ে- কিছু না লেখার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। দেখুন এ সংক্রান্ত খবর –
Australia is first to recognise ‘non-specified’ gender
@অভিজিৎ,
ট্রান্সেক্সুয়ালিটি (Transexuality) বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন রূপান্তরকামিতা। চমৎকার বাংলা। । বছর কয়েক আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একজনার সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম একটি টিভি চ্যানেলে। পেশাগত জীবনে তিনি একজন অধ্যাপক। উনারাও নিজেদের রূপান্তরকামিতা হিসেবেই দেখেন। তবে উনাদের একটি পত্রিকার নাম দিয়েছেন অপমানব। উনি বলেছিলেন—( যতদূর মনে পড়ছে), সমাজ তো আমাদের মানব হিসেবেই স্বীকার করতে চায় না। তাই পত্রিকার নাম দিয়েছি অপমানব।
যাই হোক, বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আপনি দেশে আসলেন, অথচ খবর পেলাম না। আপনার দেশে আসার খবর জানালে এ বিষয়ে মুক্ত ফোরামের আয়োজন করে আপনার বক্তব্য থেকে লাভবান হতে পারতাম।
ভবিষ্যতে আশা করি সে সুযোগ দেবেন।