‘আমার হয়েছে ভাবের ব্যারাম
এই ব্যারামের নেই গো আরাম।’

এ ভাবের ব্যারাম আমাদের সবারই ছিল ছোটবেলায়। না, পদাবলীর ভাবার্থের ভাবে সিক্ত হয়ে নয়। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ভাবকে সম্প্রসারণ করতে ভাষার অভাব অনুভব করতাম না; তবে ভাব সংকোচনে বড্ড কষ্ট হতো।

দুই বা চার লাইনে ছন্দোবদ্ধ ভাব পড়ে বড়ই চমকিত হতাম। কে কে অর্থাৎ কোন কবি এতো সংক্ষেপে অথচ চমৎকারভাবে এতো কথা বলতে পারলো! অনার্সে পড়ার সময় বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ তার কণিকা কাব্যে সংক্ষেপে, নিঃসংকোচে কম শব্দে বলে গেছেন অনেক অনেক কথা। এক রবির আলোকই যথেষ্ঠ।এছাড়া তাঁর বড় বড় কবিতার মাঝখানের দুয়েক লাইন দিয়েও হয়েছে ভাব সম্প্রসারণ করার প্রশ্ন।যেমনঃ ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।’

স্কুল ও কলেজে ভাবকে সংকোচন করার চেয়ে সম্প্রসারন করা তুলনামূলকভাবে সহজ লাগতো। অনেক কথা যাও যে বলে বেশী কথা না বলে বড্ড কঠিন। আর বাঙালী আবেগ দিয়ে ভাবকে ইনিয়ে বিনিয়ে লম্বা করায় পারদর্শী। কাজেই ভাব সংকোচনের চেয়ে ভাব সম্প্রসারণে যে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিলাম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখনো কথা বলার সুযোগ পেলে সুখী হই। আড্ডা দেয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতে পাই না।আড্ডায় সময় বয়ে দেয়ার জন্যে এখন শারিরিক কোন অস্তিত্ব লাগে না। ডিজিটাল আড্ডা। ব্লগে মন্তব্য করা, বিভিন্ন জনের ই-মেইলের উত্তর দেয়া আর মাঝে সাঝে কথোপকথন (chat) তো রয়েছেই।

ছোটবেলায় এ আড্ডার জন্যে সোনা কাকার চোখরাঙানি দেখতে হতো। নিজে এখনও ইন্টারনেটে সময় ব্যয়কে উপভোগ করি। অথচ মেয়ের ইন্টারনেটে অধিক সময় ব্যস্ত থাকা মাঝে মাঝে আমার অস্বস্থির কারণ হয়।
সৎভাবে চিন্তা করে দেখেছি যে অচলায়তন সামাজিক বলয়ে থেকে আমিও গতানুগতিক ভাবধারায় ভাবিত। আমার এ অস্বস্থিকর অনুভূতি অনুচিত।আধুনিক মা হওয়া বাস্তবিকই কঠিন দায়িত্ব। মনের উপরিভাগে আধুনিকতার প্রলেপ প্রস্ফুটিত হলেও অতল তলে যেন সংস্কারের শিকলে বাঁধা এবং অস্বস্থিকর অনুভূতি তো এরই অনুধ্যান।

কলেজের বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় চরিত্র চিত্রণ ছিল একটি অনিবার্য প্রশ্ন এবং পাঠ্য কোন গল্প, উপন্যাস বা নাটকের নামকরণের সার্থকতা জাতীয় প্রশ্ন পরীক্ষায় থাকতই।নামকরণের সার্থকতা আমাদের মাথায় এতটাই গেঁথে আছে যে কয়েকজন পরিচিত পাঠক আমার তখন ও এখন এর প্রত্যেকটা খন্ডেই তা খুঁজেন এবং এ নিয়ে আমাকে অভিযোগও শুনতে হয়।আমি হাসতে হাসতে উত্তর দিই কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতো আর কি। নাম না মিললে আর কী করা। আসলে মাঝে মাঝে এতোটা আক্ষরিক নামকরণ হয়তো হয়েছে বা হয়নি।

চরিত্র চিত্রণ বা নামকরণের সার্থকতা বুঝে না বুঝে মুখস্ত করা ছিল আমাদের ছাত্রাণাং অধ্যয়ন তপঃ এর বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য। যেমন —মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর এর সখিনা বা শরৎচন্দ্রের বিলাসী চরিত্র। অনেক চরিত্রে সেই চরিত্রের উক্তিও জুড়ে দিতাম কায়দা করে; তাতে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যেত।
তবে সামাজিক প্রেক্ষাপটে আশে পাশের বাস্তব জীবনের সাথে সাহিত্যের চরিত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করার মতো বোধ ও বিবেচনা ছিল না।কিন্তু আজকের প্রজন্ম এ বিষয়ে সজাগ, সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর।

উদাহরণ হিসেবে আমার এক অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। ৩ ফেব্রুয়ারী,২০১০। নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার আমীরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পরিবীক্ষণে গেছি। পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল সাহেব কথা প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার এবং আমলাদের কথা বললেন। বললেন— উনার মতো অনেকেই চেয়ারম্যানগিরি করে বাপের সম্পত্তি কমাচ্ছেন।ইউনিয়ন পরিষদের কাজ চালানোর মতো পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্ধ নেই।লোকবলের অভাব।আর উনার পরিচিত শূন্য থেকে শুরু করা পরিবারের আমলা বনানীতে বাড়ি করেছেন। তবুও নাটকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চরিত্রকে খারাপভাবে দেখায়। এক নাটকে চেয়াম্যানকে দেখিয়েছে বিধবা ভাতা নিয়ে দুর্নীতি করতে আর তার নিজের প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও এক বিধবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে।

সে নাটকটি মোজাম্মেল সাহেবের ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মেয়ে না দেখেই রাগে টিভির সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। আর চেয়ারম্যান মোজাম্মেল সাহেব ঢাকায় গিয়ে এ নাট্যকারকে প্রশ্নও করেছিলেন— তিনি তো কোন নাট্যকার নিয়ে এমন নাটক লেখেন না? এক নাট্যকার তো নিজের মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেছে।কই?এমন কোন চরিত্র তো অন্য নাট্যকাররা সৃষ্টি করেন না? তবে চেয়ারম্যান মানেই বদ চরিত্র সৃষ্টি করা কেন?
নাট্যকার নাকি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
আমার কাছেও অবশ্য উত্তর নেই। বা তখনও ছিল না।
এখনকার চেয়ারম্যান সাহেবের ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। বাবার পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রজন্ম।

আমাদের সময়ে চেয়ারম্যানের মেয়ের বয়সে দস্যু বনহুর আর নীহার রঞ্জনের উপন্যাসে বিভোর হয়ে থাকতাম।চিরন্তন সাহিত্য পড়েছি আরও বড় হয়ে।তাছাড়া, সাহিত্যের জগতের সাথে বাস্তবতার তুলনামূলক জীবন চিত্র এখনকার প্রজন্মের মতো আসলে আমাদের ভাবাতো না। নিজেরা কঠিন বাস্তবতায় হাবুডুবু খেতাম বলেই কী এতো জটিল চিন্তার আবর্তে ঘুরপাক খেতে মন চাইতো না! কে জানে?