দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘যুক্তি’ ম্যাগাজিন(সংখ্যা ৩)-এর রিভিউ এখানে তুলে দেয়া হল। লিংক

মার্চ ৫, ২০১০, শুক্রবারঃ ২১ ফাল্গুন ১৪১৬

তিনটি লিটল ম্যাগাজিন

অঞ্জন আচার্য

যুক্তি

প্রগতিশীল যুক্তিবাদী সাহসী মানুষ অনন্ত বিজয় দাশ। তার সম্পাদনায় ‘যুক্তি’ পত্রিকাটি অনন্যসাধারণ এক শাণিত যুক্তি ও মুক্তচেতনার পথে যেন এক নিরলস প্রয়াস। সম্পাদকীয় লেখায় সম্পাদক তার চেতনাগত স্বপ্ন, লক্ষ্য ও দর্শন স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করেছেন- “আমরা চাই চিন্তার চর্চা ও প্রকাশের স্বাধীনতা। ঘটাতে চাই মুক্তচিন্তার বিপ্লব; সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চাই এই বেনিয়াবাজির সমাজ পরিবর্তন। আমাদের দর্শনে বিজ্ঞানমনস্কতা আর যুক্তিবাদিতা। আমরা মনে করি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার আর চিরাচরিত প্রথার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যই মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। আরো মনে করি , এই প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন বিশ্বাস আর সংস্কারাবদ্ধ জীবনাচরণ কাটিয়ে ওঠার একমাত্র পথ হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের প্রসার।” ‘যুক্তি’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় সিলেট থেকে। এর সদ্য প্রকাশিত সংকলনটি (সংখ্যা ৩; জানুয়ারি ২০১০)-তে আছে মুক্তচেতনাভিত্তিক নানা প্রবন্ধ। এবারের সংস্করণটি সাজানো হয়েছে মূলত চার্লস ডারউইন ও তাঁর বিবর্তনবাদকে কেন্দ্র করে। যেমন: দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন ‘শেষ-অধিনায়ক: চার্লস ডারউইন; শহিদুল ইসলাম ‘বিবর্তন তত্ত্বের দর্শন; আসিফ ‘সুদূর অতীতে গেলে আমরা একই পূর্বপুরুষ দেখবো; অভিজিৎ রায় ‘বিবর্তনের সহজ পাঠ’ বিরঞ্জন রায় ‘বিবর্তন তত্ত্ব গ্রহণে বাধা কোথায়; বন্যা আহমেদের রচনা ‘আর্ডি-আমাদের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল; দিগন্ত সরকারের রচনা ‘ডারউইন থেকে ডাবল হেলিক্স; শিক্ষানবিসের রচনা ‘প্রসঙ্গ বিবর্তন’: জাকির নায়েকের ‘মিথ্যাচার’ ইত্যাকার লেখাগুলো বিবর্তনবাদকে পাঠকের কাছে সহজভাবে উপস্থাপন করেছে। আছে আমেরিকার উইসকন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান এবং বংশগতিবিদ্যার অধ্যাপক সন বি. ক্যারল ও ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক প্রবীর ঘোষের ভিন্ন প্রেক্ষাপটের ওপর দুটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার। অনূবাদিত হয়েছে চার্লস সুল্লিভান ও ক্যামেরন ম্যাকফেরসন স্মিথের ‘বিবর্তন নিয়ে চারটি ভ্রান্ত ধারণা’ ও ড্যান বার্কারের ‘ঈশ্বরবাদ খণ্ডন’ নামে অসাধারণ দুটি প্রবন্ধ। আরও আছে রণজিৎ করের লেখা ‘নারী জাগৃতির প্রান্তিক সমীক্ষায় রোকেয়া ও তসলিমা’ এবং সৈকত চৌধুরী ও অনন্ত বিজয় দাশের ‘মিরাকল ১৯’- এর উনিশ-বিশ!’ নামে চমৎকার দুটি নিবন্ধ। এমন জ্ঞানগর্ভ সংকলনটি পাঠ করে পাঠকমাত্রই তাদের প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তি পাবেন। এরকম একটি পত্রিকার জন্য সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশকে তার সাহসী, সময় উপযোগী ও বস্তুনিষ্ঠ সংকলনের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না।

পর্ব

মজিদ মাহমুদ সম্পাদিত সাহিত্য-চিন্তার কাগজ ‘পর্ব’। তেমনই এক অধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের ডিসেম্বর’২০০৯ সংখ্যা প্রকাশ করলো। চলতি সংখ্যাটিতে প্রবন্ধ লিখেছেন আহমেদ কামাল ‘গ্রামসি ও আধিপত্যের ধারণা’; সলিমুল্লাহ খান ‘বাংলা গদ্যে অর্থশাস্ত্র’; আশিষ নন্দী ‘ফ্রয়েড, আধুনিকতা ও উত্তর-উপনিবেশিক সন্ত্রাস (ভাষান্তর: ইকতিজা আহসান); মজিদ মাহমুদ ‘কবিতার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে’; মোহাম্মদ আজম ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও জনসংস্কৃতির লড়াই’; মাদল হাসান ‘ বাংলা কবিতার ভাষা ও ঔপনিবেশিক ঊর্নাজাল: আলিফ-লাম-মীম’; রণজিৎ মল্লিক ‘ট্র্যাজেডির নতুন সংজ্ঞায় আর্থার মিলার’; ফকরুল চৌধুরী ‘জলবর্তী ভাঙার আখ্যান’; সাখাওয়াত টিপু, ‘ আহমদ ছফার ইউটোপিয়া’; শরীফ আলম ‘তেলেগু কবিতা’। গল্প লিখেছেন মনির জামান ‘সোমা বিবাহিত না অবিবাহিত’; মাজুল হাসান ‘কাঁকড়ার সতীন’; রাফিক হারিরি ‘তাহারা’। গ্রন্থ আলোচনা পর্বে মজিদ মাহমুদের ‘উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্য ও অন্যান্য’ বইটি আজিজুল রাসেল ‘উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য পাঠ’ শিরোনামে, আমিনুল ইসলামের ‘কুয়াশার বর্ণমালা’ বইটি মোহাম্মদ নুরুল হক ‘আমিনুল ইসলামের কুয়াশার বর্ণমালা’ শিরোনামে এবং তৌহিদুল আলমের ‘জন্মেই কেঁদেছি ভীষণ’ বইটি আজাদ কালাম ‘স্বাদেশ প্রেমের উজ্জ্বল কবি ও কবিতা’ শিরোনামে আলোচনা করেছেন। এছাড়া শাহামান মৈশানের একটি সম্পূর্ণ নাটক ‘অশেষকৃত্য’ সংকলিত হয়েছে। কবিতা লিখেছেন- মজিদ মাহমুদ, জাহিদ হাসান, কাজী নাসির মামুন, মুক্তি মণ্ডল, ইকতিজা আহসান, মাদল হাসান, ফেরদৌস মাহমুদ, বিজয় আহমেদ, মাসুদ পথিক, মোস্তফা হামেদী, আশিক আকবর, আন্দালীব, আজিজুল রাসেল, শুভ, ইলিয়াস কমল, মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান, আল্লাইয়ার, রাশেদ শাহরিয়ার, তুহিন তৌহিদ, আহমেদ রাসেল, নাজমুস সুলতান, নেয়ামত ইমাম, সেঁজুতি, লতিফ জোয়ার্দার, রোজেন হাসান। এক কথায় সংখ্যাটি অনন্যসাধারণ হয়েছে।

বইয়ের জগৎ

বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো কেবলমাত্র গ্রন্থ সমালোচনাকেন্দ্রিক কোনো লিটল ম্যাগাজিনের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। আহমাদ মাযহার সম্পাদিত এই লিটল ম্যাগাজিনটির নাম ‘বইয়ের জগৎ’। এর ১ম সংকলন (সূচনা সংখ্যা)টি সাজানো হয়েছে ২২টি বিভিন্ন বিষয়ক বইয়ের উপর আলোচনা দিয়ে। প্রবন্ধ: খান সারওয়ার মুরশিদ রচিত ‘কালের কথা’ বইটি বিশ্লেষণে সংশ্লেষণে ঋদ্ধ একটি বই শিরোনামে আবদুল মান্নান সৈয়দ; শামসুজ্জামান খান রচিত ‘বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও বর্তমান বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইটি ‘বঙ্গবন্ধু চর্চায় শামসুজ্জামান খানের ইতিহাস চেতনা’ শিরোনামে তপন বাগচী; সালাউদ্দীন আহমেদ রচিত ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইটি ‘ইতিহাস ঐতিহ্য আধুনিকতা’ শিরোনামে মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম; যতীন সরকার রচিত ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূত ভবিষ্যৎ’ বইটি ‘যতীন সরকারের ধর্মচিন্তা’ শিরোনামে রাজীব সরকার আলোচনা করেছেন। কবিতা: আবিদ আনোয়ারের বই ‘স্বৈরিণীর ঘর সংসার’, পিয়াস মজিদের ‘নাচপ্রতিমার লাশ’, আলোচনা করেছেন যথাক্রমে জাকারিয়া শিরাজী ও অদিতি ফাল্গুনী। উপন্যাস: স্বকৃত নোমানের ‘ধুপকুশী’; সৈয়দ আনওয়ারুল হাফিজের ‘তিন বিঘা জমি’; শেখ আলমামুনের ‘নুহূলের মানচিত্র’; জাকির তালুকদারের ‘মুসলমানমঙ্গল’ আলোচনা করেছেন যথাক্রমে লুৎফর রহমান, মারুফ রায়হান, সুব্রত কুমার দাস, স্বকৃত নোমান। লুৎফর রহমান রিটনের ‘ধিতাং ধিতাং’ ও আমীরুল ইসলামের ‘ছড়া আমাকে আদর দিও’ ছড়ার বই দুটি আলোচনা করেছেন আহমাদ মাযহার। দিলওয়ার হোসেন অনুবাদিত সরোজিনী সাহুর ‘মিথ্যা গেরস্থালি’ বই দুটি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে আমিনুল ইসলাম বেদু ও রাখাল রাহা। সংকলন: ‘সংস্কৃতি-সাধক মোতাহের হোসেন চৌধুরী’, সম্পাদনায় মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও ‘তাজউদ্দীন আহমদ:আলোকের অনন্তধারা’, গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় সিমিন হোসেন রিমি, বই দুটি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে সেলিম রুশদী ও শুভ কিবরিয়া। ইসরাইল খানের গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘মুসলিম সম্পাদিত ও প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য পত্রিকা (১৯৩১-৪৭)’; মুহম্মদ খসরুর চলচ্চিত্র বিষয়ক সাক্ষাৎকারধর্মী বই ‘সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়’; নজরুল ইসলামের ললিতকলা বিষয়ক গ্রন্থ ‘সমকালীন শিল্প ও শিল্পী’; আমিরুল আলম খানের নিসর্গ বিষয়ক গ্রন্থ ‘পারুলের সন্ধানে’; আবদুল মান্নান সৈয়দের দিনলিপি ‘ডায়েরি: ১৯৭৮-২০০৮’ ও বন্যা আহমেদের বিজ্ঞানধর্মী বই ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইগুলি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে সিদ্দিক মাহমুদ, মাহবুব সেলিম, মোস্তফা জামান, মোকারম হোসেন, পিয়াস মজিদ ও সাজিদ রাজজাক।

প্রকাশিত বইয়ের ওপর আলোচনাভিত্তিক এমন একটি সংকলন প্রকাশ করার জন্য আহমাদ মাযহার অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এমন একটি মহৎ উদ্যোগের ফলে পুস্তক পরিচিতি, লেখক স্বীকৃতি, বইয়ের সারবস্তুসহ আনুষঙ্গিক যাবতীয় বিষয়বস্তু পাঠক সমাজে বিধৃত করবে, এমনটাই আশা করা যায়।