প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতূর্থ পর্ব
মূল ডায়েরির কপি এখানে দেখা যাবে।

সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি প্রথম পর্বের শুরতে দেওয়া হল।

২৫ শে ফেব্রুয়ারী। প্রতি ভোরে মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলে অগণিত লোক জমা হয়। যেন এটা একটা জাতীয় তীর্থভূমি। ঘুম ভেংগে ভক্তদের যেন এখানে একবার না আসলেই নয়। খুব ভোরে ঘুম ভেংগে শিশির ভেজা দুর্বাদল খালি পায়ে মাড়িয়ে মেডিকেল হোষ্টেল প্রাংগনে গিয়ে বিস্ময় আর আনন্দে হতবাক হয়ে গেলুম। বিশ্বেস হতে চাইছিল না প্রথমে। কালকের সে শূণ্যস্থানে দেখলুম প্ল্যান অনুযায়ী স্মৃতিস্তম্ভ উঠে গেছে। শুনে অবাক হলুম – এ স্মৃতিস্তম্ভ গড়তে নাকি কোন রাজমিস্ত্রির দরকার হয়নি। রাতারাতি ছাত্ররাই নাকি গড়ে তুলেছে নিজেদের হাতে এ স্মৃতিস্তম্ভ। কাঁচা হাতের গড়া এ স্মৃতিস্তম্ভের চারদিকে রক্তের অক্ষরে লেখা নানারূপ শপথবাণী – শহীদদের প্রতি নানারুপ তর্পন। দেখতে দেখতে স্মৃতিস্তম্ভ ফুলে ফুলে ভরে উঠল। ইট সিমেন্ট আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না – ফুল আর মালা স্তুপাকৃতি হয়ে আছে। হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা জানাচ্ছে শহীদানদেরকে তাদেরই ভক্তবৃন্দ! শুধু ফুলই নয় – নানারকম উপহার পড়তে লাগল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের বেদীমূলে। টাকা, পয়সা, ঘড়ি, আংটি, কলম ইত্যাদী যার কাছে যা ছিল সবই পড়ছে স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে। এক ভদ্রমহিলা বহুমূল্য হীরক হার খুলে ছুড়ে দিলেন। এ স্মৃতিকে অম্লান করার জন্য – এ স্তম্ভকে আরো সুদৃঢ় করে গড়ে তুলবার জন্য কারো যেন কিছু আর অদেয় নাই। অনাবৃত পায়ে মর্সিয়া গাইতে গাইতে দলে দলে নারী পুরুষ এগিয়ে আসছে শহীদ স্মৃতিতে তর্পন দিতে। হৃদয়ে তাদের অপরিসীম ভক্তি – মুখে তাদের মর্সিয়া – “ভুলবনা ভুলবনা, একুশে ফেব্রুয়ারী ভুলব না”।….সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য….

বেলা এগারোটার সময় পুলিশ আর মিলিটারী মুসলিম হলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। মাইক, লাউড স্পীকার যেখানে যা ছিল সব কিছু তারা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়। তদুপরি প্রতি রুমে রুমে খানতল্লাশী করে “সন্দেহজনক” যা কিছু তাদের নজরে পড়েছে, সব নিয়ে গেছে। কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আজ সব দিকেই নিস্তব্ধ। সব মাইকের কন্ঠ রোধ করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন পথে বেরিয়ে দেখলাম; দোকানপাট, যানবাহন, এখনো সব কিছু বন্ধ। অথচ এসব বন্ধ করতে কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে – এ আন্দোলন আর ছাত্র আন্দোলন নয়। এটা গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে।

সব মাইক আজ বন্ধ। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা মিলে কলেজ থেকে কলেজের নিজস্ব মাইকটা কোনরকমে জোগাড় করে মেন হোষ্টেলের ওপরে বসিয়েছে। এ মাইকটা তেমন শক্তিশালী নয়। তবুও কোনরকমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার পক্ষে এটাই যথেষ্ট। বিকেলের দিকে পলাশী ব্যারাকের মাঠের মধ্যে গিয়ে দেখি, এলাহি কান্ড। মাইক শোনবার জন্য সেখানেও বিপুল জনসমাবেশ হয়েছে। শোনা যাচ্ছে না কিছুই, তবুও অনেক কষ্ট করে মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে তাই শুনছে। মানুষের উদ্যম আর নিষ্ঠা দেখে সেদিন আশ্চর্য না হয়ে পারিনি।

বিকেলের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছিলেম। সেক্রেটারিয়েট রোড ধরে মেডিকেল কলেজের কোন পর্যন্ত এসে দেখি রাস্তা বন্ধ। মিলিটারী গায়ে গা লাগিয়ে ফুলার রোড বন্ধ করে আছে। তখন সন্ধ্যা হয় হয় – আবছা আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। ঠিক অনুরূপ ভাবে এসেমব্লি হলের কোনটাও বন্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এসেম্বলির কোন হতে মেডিকেল কলেজের কোন পর্যন্ত ফুলার রোডের অংশটা No man’s land পরিনত হয়েছে। ব্যাপার কি? ব্যাপার হচ্ছে, যে স্মৃতিস্তম্ভ তুলেছিল ছাত্ররা নিজেদের হাতে – মিলিটারী তাকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। চিহ্নমাত্র রাখলো না। যেখানে যত রক্তের দাগ ছিল – সব কিছু তারা ধুয়ে মুছে একেবারে সাফ করে দিয়েছে। চারদিন আগে যে এখানে একটা হত্যাযজ্ঞ হয়েছে তার সমস্ত চিহ্ন এরা মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু মানুষের মনের নাগাল পাবে কোথায় এরা? সেখানে যা দাগ পড়েছে এ দাগ মুছবার নয় – উজ্জ্বল প্রোজ্জ্বল হয়ে এ দাগ বিরাজ করবে চিরকাল মানুষের সিংহাসনে।

“পরিশিষ্ট”

হিংসার যে নরমেধযজ্ঞ চলল গত কয়টা দিন; এর ফলাফল সুদুর প্রসারী হতে বাধ্য (নোটঃ এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমান হতে ২০ বছরও লাগেনি)। ক্ষমতাসীন দলকে এর প্রতিফল ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে – কারন মানুষ তাদেরকে কোনদিন ক্ষমা করবে না (নোটঃ হয়েছেও তাই, এককালের বাঘা মুসলিম লীগ অচিরেই পরিনত হয়েছে কাগুজে দলে)!

এ ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র ছাত্র আন্দোলন নয়। প্রথমদিন হয়তো এটা ছাত্র আন্দোলন ছিল কিন্তু তার পরই এটা দিগন্ত প্রসারী হয়ে পড়ে। এটা শুধু সরকারের অবিমৃষ্যকারীতারই ফল। ছাত্ররা ভুল করবে এটা স্বাভাবিক, কারন তারা চপলমতি – কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের এ চপলমতিত্বে ইন্ধন যুগিয়ে এক অনল জ্বালিয়ে তুললেন, কবে নিভবে এ আগুন জানে শুধুই কারুনিক। এ আগুনে পুড়ে কত মায়ের বুক খালি হল, কত স্ত্রী হলেন বিধবা [সদ্য বিবাহিত বরকত – দুসন্তানের পিতা শফিক] কত ছেলেমেয়ে হল অনাথ।

এ আন্দোলনে দেশবাসী জনতা ছাত্রদেরকে পুরোধা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের নির্দেশ তারা মাথা পেতে নিয়েছিল আন্দোলনের প্রতিটি কাজে। ছাত্রদের ওপর নেতৃত্বের ভার দিয়ে দেশবাসী ছিল নিশ্চিন্ত। তাদের উপর তাদের ছিল অসীম আস্থা। মুটে, মজুর, রিক্সাওয়ালা, কোচম্যান, সবাই তাকিয়েছিল ছাত্রদের নির্দেশের প্রতি। ছাত্ররা আছে বলে তাদের কত বড় সাহস ছিল – নিম্নলিখিত ঘটনা থেকে তা পরিষ্ফুট হবে।

২৭ তারিখে সরকারী নির্দেশ এলো – সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হোষ্টেল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। ছাত্রদের অবিলম্বে যার যার বাড়িতে রওনা করতে হবে। তাই আমিও রওনা দিলাম বাড়ির দিকে। রিক্সাওয়ালা নিতান্ত হতাশভাবে রিক্সা টানতে টানতে বলল – “সাহেব আপনারো তো চললেন, আমাদেরকে কার হাতে রেখে গেলেন। আমাদেরকে এবার ধরে ঠেংগাবে”। এই একটা মাত্র বাক্য থেকে তাদের নির্ভরশীলতার প্রমান প্রকৃষ্ঠ হয়ে ওঠে।

এ কয়দিনে ঢাকায় আইন শৃংখলা বলে কিছু ছিল না। মাঝে মাঝে গুলি চলেছে – কিন্তু এতে করে আইন শৃংখলা ভংগের আরো ইন্ধন জুগিয়েছে মাত্র। মনে হচ্ছে মুসলিম লীগ ইচ্ছা করে নিজের হাতে নিজে কবর রচণা করল।

(সমাপ্ত)

– ২৮ শে ফেব্রুয়ারী