s-fdaughter1

(১)
মনজু সাহেব সদ্য রংপুর বদলি হইয়া আসিয়াছেন। পেশায় সরকারি গোয়েন্দা পুলিশ বলিয়া প্রথম প্রথম পাবলিকের নিকট হইতে ব্যাপক সমীহ পাইলেও ইদানিং পরিস্থিতি কী রকম যেন বদলাইয়া গেছে ! সন্দেহের টোটকা ফুকিয়া অপরাধী ধরিবার কলা-কৌশলও আর কাজ করিতেছে না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় কতোরকমের অপরাধ কাহিনী প্রকাশ পাইতেছে, অথচ তিনি এইসব কিছুই টের পাইতেছেন না। আর ওইসব বিচ্ছু সাংবাদিকগুলা কী করিয়া যেন আগেভাগেই টের পাইয়া যায়। নিশ্চয়ই তাহাদেরও যোগসাজশ রহিয়াছে! তাহাদের প্রতি তিনি একটু একটু করিয়া নাখোশ হইতে লাগিলেন। এবং হঠাৎ করিয়া আবিষ্কার করিলেন, নালায়েক পাবলিকই উল্টা তাহাকে সন্দেহ করিতে লাগিয়াছে। ইহা যে এইহাত-ওইহাত বাণিজ্যের জন্য কিছুতেই শুভ ঘটনা নয় তাহা বুঝিতে পারিয়া তিনি আকুল হইয়া পড়িলেন। ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করিতে এইবার মরিয়া হইয়া উঠিলেন, কিছু একটা তাহাকে করিতেই হইবে। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত লইলেন, তিনি ভালো হইয়া যাইবেন।

জীবনে বহুৎ খারাপ কাজ করিয়াছেন তিনি। দেনদরবারে বনিবনা না হইলে নির্দোষকে অপরাধী সাজাইয়া নির্দ্বিধায় চালান করিয়া দিয়াছেন। বাণিজ্যে সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর দর্শন পাইয়া ভয়ঙ্কর ক্রিমিনালকেও নিরেট আল্লাহওয়ালা ধার্মিক প্রমাণ করাইতে কসুর করেন নাই। কিংবা জীবিত লোককে অনায়াসে মৃত বানাইয়া ফেলিতেও তাহার জুড়ি ছিলো না। ইত্যাদি বহু ঘটনার সফল নায়ক মনজু সাহেবের চাকচিক্যেও আল্লাহর রহমতে কোন কমতি থাকে নাই। বাকি জীবন আল্লাহ-রসুলের ঈমান-আকিদায় নির্বিঘ্নে কাটাইয়া দিতে কোন সমস্যা হইবে না। অতএব তিনি সিদ্ধান্ত লইয়াই ফেলিলেন- এইবার সত্যি সত্যি ভালো হইয়া যাইবেন।

ভালো হইতে পয়সা লাগে না ইহা তিনি ভালো করিয়াই জানেন। কিন্তু পাবলিক বুঝিবে কী করিয়া যে সরকারি গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মনজু সাহেব ভালো হইয়া গেছেন! ভাবিয়া দেখিলেন এইজন্য তাহাকে দ্বীন ও আখেরাতের পথে মনোনিবেশ করিতে হইবে। নামাযের সময় মসজিদে যাওয়ার চেষ্টা করেন নিয়মিতই। কিন্তু মুসল্লিদের চোখের ভাষা পড়িয়া তিনি আগেই হতাশ হইয়া আছেন। নিন্দুকেরা এইখানেও তাহার কুমতলবের গন্ধ খুঁজিয়া পায়। এইসব ভাবিতে ভাবিতে হাঁফাইয়া উঠিয়া হঠাৎ কী মনে করিয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। তিনি যে দ্বীনের পথে পুরোপুরি ঈমানদার হইয়া উঠিয়াছেন তাহা পাবলিককে বুঝাইতেই হইবে।

ঈমানদার হইলে তো আর চিকন বুদ্ধিতে ভাটা পড়ে না। সোজাসুজি রংপুর চিড়িয়াখানায় গিয়া হাজির হইলেন। যাহা ভাবিয়াছিলেন তাহাই দেখিতে পাইলেন তিনি। আস্তাগফিরুল্লাহ্ ! একটা মডারেট মুসলিম রাষ্ট্রে বেহায়া বেলাজ যুবতি তরুণীরা এইরকম বেপর্দা হইয়া ঘোরাঘুরি করিবে, হাসাহাসি করিবে ! ইহা তো মানিয়া নেওয়া যায় না ! না হয় ধর্মনিরপেক্ষ একটা সরকার ক্ষমতায় রহিয়াছে, তাই বলিয়া ধর্মীয় বিধি-বিধান তো আর বদলাইয়া যায় নাই ! ইসলাম পরিপন্থী, ধর্মীয় আইনবিরোধী ও পর্দানশীন অবস্থায় চলাফেরা না করিবার অপরাধে সরকার বাহাদুরের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চিড়িয়াখানা ও সুরভী উদ্যান হইতে একে একে বেশ কয়েকজন তরুণীকে হাতেনাতে আটক করিয়া ফেলিলেন তিনি। মুহূর্তকালের মধ্যেই চতুর্দিকে সাড়া পড়িয়া গেলো। হুড়মুড় করিয়া আশেপাশের অন্যান্য বেপর্দা ও পর্দানশীন মহিলারাও আগত পুরুষসঙ্গিসহ অজানা আতঙ্কে পলায়নপর হইয়া এদিকওদিক ছুটিয়া বাহির হইয়া যাইতে লাগিলো। সঙ্গে আসা বাচ্চাকাচ্চাগুলি তাহাদের আনন্দভ্রমণে আকস্মিক ছেদ পড়িয়া যাওয়ায় হাউকাউ করিতে লাগিলেও ঈমান-আকিদাসম্পন্ন শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখাবয়বগুলিতে ধর্মরক্ষা করিবার এইরকম জোশনে-জোশ তরিকায় সন্তোষ ফুটিয়া উঠিতে লাগিল- আহা! রহমের মালিক আল্লাহ!

খবর পাইয়া কোথা হইতে কিভাবে যেন এক দঙ্গল সাংবাদিক আসিয়া হাজির হইয়া গেলো। তাহাদের সম্মুখেই মনজু সাহেব এইসব নাবাল তরুণীদের অপরাধ গুরুতর হইলেও অসীম দয়া প্রদর্শনপূর্বক এইবারের মতো মুচলেকা লইয়া তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিলেন।

(২)
গভীর রাত্রিতে ঘুমাইতে গেলেও আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙিয়া গেলো। ঝট করিয়া উঠিয়াই টেবিলে রাখা পত্রিকাগুলি একে একে টানিয়া লইয়া পাতা উল্টাইতে লাগিলেন। সবগুলি পত্রিকাতেই ফলাও করিয়া খবর হইয়া গিয়াছে। ড্রয়ার হইতে বেনসনের প্যাকেটখানা বাহির করিলেন। আজ তিনি জিহাদি জোশে ভাসিয়া সারাদিন বাসায় কাটাইবেন। এইরকম একটা সিদ্ধান্ত লওয়ামাত্রই দেহেমনে কী চমৎকার একটা ঢিলাঢালা ভাব ফুটিয়া উঠিলো। ফস করিয়া একখানা সিগারেটে আগুন ধরাইয়া পরম সন্তোষের সহিত বাথরুমে প্রবেশ করিলেন।

বিকালে ঝনঝন করিয়া টেলিফোনটি বাজিয়া উঠিল। রিসিভারটি তুলিয়া কানে ঠেকাইতেই মনজু সাহেবের নুরানী মুখখানা ক্রমশ শক্ত হইয়া উঠিতে লাগিল। রিসিভার নামাইয়া রাখিয়াই নিজে নিজেই গর্জাইয়া উঠিলেন- কেয়ামতের আর বাকি নাই ! ওই মুর্দা কাফের ব্যারিস্টারগুলাই দ্বীন ইসলামের আসল শত্রু ! এইগুলারে না ঠেকাইলে ইসলাম বরবাদ হইয়া যাইবে ! আদালতে রিট করেছে ! রুল জারি হয়েছে ! তার বিরুদ্ধে তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ ! দ্বীন-ই-জিহাদ ছাড়া দ্বীন-ইসলাম রক্ষা অসম্ভব !…
অতঃপর জেহাদী জোশে ভাটা পড়িলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে মনজু সাহেবের মুখ দেখিয়া মনে হইলো তিনি ক্রমেই চুপসাইয়া যাইতে লাগিলেন।

দ্রষ্টব্য: কাল্পনিক এই রচনার সাথে ‘বোরকা না পরলে গ্রেপ্তার হয়রানি করা যাবে না- হাইকোর্টের নির্দেশ’ সংক্রান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও সংশ্লিষ্ট ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।

হাইকোর্টের নির্দেশবোরকা না পরলে গ্রেপ্তার হয়রানি করা যাবে না
নিজস্ব প্রতিবেদক (কালের কণ্ঠ, বুধবার, ০৩ মার্চ ২০১০)

বোরকা না পরার কারণে কোনো নারী বা বালিকাকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন বা হয়রানি না করতে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রংপুরের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিদর্শক গোলাম মিনহাজকে ৪ এপ্রিল সশরীরে হাইকোর্টে হাজির হতে বলেছেন আদালত।
বোরকা না পরার কারণে রংপুরে চিড়িয়াখানা ও সুরভী উদ্যান থেকে কয়েক তরুণীকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এরপর তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইসলাম পরিপন্থী, ধর্মীয় আইনবিরোধী ও পর্দানশীন অবস্থায় চলাফেরা না করার অপরাধে তাদের আটক করা হয়। বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের ছেলে ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক, অ্যাডভোকেট কে এম হাফিজুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার ইমতাজুল হাই একটি রিট করেন।
তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম ফজলে কবীরের বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এ নির্দেশ দেন।
প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালত রংপুরে চিড়িয়াখানা ও সুরভী উদ্যান থেকে তরুণ-তরুণীদের আটকের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং তদন্তের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
রিটকারীদের পক্ষে ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক নিজেই শুনানি করেন।