প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্সফোর্ডপ্রবাসী তপন রায়চৌধুরীর “ বাঙালনামার” নতুন সংস্করণে কবিগুরুর একটি গান ব্যবহার নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন—

“আমি একটু অন্যরকম করে লিখে সংযোজন করব ঠিক করেছি। এই গানটিকে আমি জাতীয় সংগীত করা হোক বলে প্রস্তাব দিয়েছি। বন্দে মাতরমে আপত্তি থাকলেও এতে কারো আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না। ভাষাটা এই –

আমরা সবাই ছ্যাঁচোড়
আমাদের এই চোরের রাজত্বে,
নইলে মোরা চোরের সাথে
মিলবো কী সত্ত্বে।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে এখনকার কথা ভেবে এই গীতি রূপান্তর করেছি।”

আমি তাঁর এ সাক্ষাৎকারটি পড়ার বছর দেড়েক আগেই আমার ধারণাটি খসড়া করেছিলাম, যা আজ সবার সাথে বিনিময় করছি।
কোন এক সময় পাঠ্য বইয়ে পদ্য বা কবিতার লাইন পরিবর্তন করে ছাপানো হতো। যেমনঃ কাজী নজরুল ইসলামের “সংকল্প” কবিতার –

“সজীব করিব মহাশ্মশান” লাইনের পরিবর্তন করে “সজীব করিব গোরস্থান” ছাপিয়েছিল। হিন্দুদের জীবনের শেষ স্থানটি পরিবর্তন করে মুসলমানদের জীবনের শেষ স্থানের উল্লেখ। নজরুল ইসলাম হয়ত হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় বিবেচনা না করে ছন্দের কথা ভেবে মহাশ্মশান শব্দটি চয়ন করেছিলেন। অথবা নজরুলের মননে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় আলাদাভাবে বিশেষ অস্তিত্ব বহন করত না।

অন্য আরেকটি পদ্য —-

“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”

পরিবর্তন করে লেখা হয়েছিল —

“ফজরে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”

সকালের পরিবর্তে ফজরে শব্দটি পদ্যটিকে ইসলামীকরনের প্রয়াস। পদ্যকার তাঁর পদ্যে শত চাপেও আরবী ফজরে শব্দটি ব্যবহার করতেন কি না তা জানি না। হয়ত করতেন হয়ত বা করতেন না।

তবে কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে যেহেতু অনেক আরবী ফারসী শব্দের ব্যবহার রয়েছে, তাই অনুমান করি তিনি ভাব ঠিক রেখে এবং ছন্দপতন না ঘটলে মহাশ্মশান শব্দটির পরিবর্তে গোরস্থান শব্দটি কবিতার জন্মলগ্নে লিখতেই পারতেন। তবে কবির মূল কবিতার ভাব ঠিক রেখেও অন্য কেউ শব্দ পালটানো কোন কবিই মানবেন না।এতে কবিতার দ্যোতনাও থাকে না এবং এ অপপ্রয়াস কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য তো নয়ই, বরং প্রতিবাদযোগ্য।

যাহোক,আমি উপরোক্ত ভূমিকার পরও এখন একটি বিপরীত প্রস্তাব দিব। আমার ধারণা কাজী নজরুল ইসলাম সজ্ঞানে বেঁচে থাকলে আমার প্রস্তাব সানন্দে মেনে নিতেন। তাঁর “নারী” ও “বীরাঙ্গনা” এর মত কবিতাই এর প্রমাণ। এবার আসি মূল কথায়।
নারীকে কবিতা, গানে বা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় কে কীভাবে রূপায়িত করেছে তা নিয়ে নতুন করে অনেকেই বিশ্লেষণ করছেন । ব্যাখ্যা করছেন নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। কী সেই নারীবাদী দৃষ্টিকোণ? অনেক নারীবাদীরা সচেতনভাবে নিজেদের কর্মসূচিতে বিভিন্ন সাহিত্যিকদের রচনা খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করান।যেমনঃ নারীপক্ষ (বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী নারী সংগঠন) ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বা ২৫ নভেম্বর নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবসে ‘’জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’’ গানটি গান না। কারণ এতে রয়েছে ধর্ষিতা শব্দটি।

“ জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টীকা।
দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা,
নেচে চলে উন্মাদিনী দিগবসনা,
জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।”

ধর্ষিতা শব্দটি সচেতন নারী মাত্রই মেনে নিবে না। প্রতিবাদ করবে। ছন্দের প্রয়োজনে ধর্ষিতা মিলে, নজরুলের ভাবেও নিশ্চয়ই তখন মিল ছিল; কিন্তু এখন আর নারীবাদীরা তা মেনে নেয় না। নেওয়া সম্ভবও নয়। ভাবেও মিলে না। তখনকার ভাব ও চেতনার সাথে যে এখনকার ভাব ও চেতনার বিস্তর পার্থক্য। নারীবাদী চেতনায় যে আঘাত লাগে — নারীবাদী কানে ধর্ষিতা শব্দটি বিষের ফলার মত বিঁধে।

নারীপক্ষ মনে করে ধর্ষনের শিকার নারীটিকে আমরা একটি অপমানজনক পরিচয়ে সমাজে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তার গায়ে গেঁথে দিচ্ছি ধর্ষিতার মত কলঙ্কময় শব্দের পরিচয়। যে পরিচয় সমাজে তাকে বিশেষভাবে আজীবন আলাদা করে রাখে — ঘৃণার সাথে — করুণার সাথে। কাজেই এখানে যে কোন একটি দুর্ঘটনার জন্য নারীকে দায়ী করে তাকে চিহ্নিত করা উচিত নয়। যে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে অর্থাৎ ধর্ষককে চিহ্নিত করা — ঘৃণার সাথে আলাদা করে রাখা অতীব জরুরী।

আমার প্রস্তাব গানটিতে ধর্ষিতা শব্দটির পরিবর্তে সংগ্রামী শব্দটি ব্যবহার করা, যদিও আমার জানা নেই নজরুলের অবর্তমানে কার কাছ থেকে এজন্য অনুমতি নিতে হবে। লাইনগুলো হবে —

“ জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টীকা।
দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা,
নেচে চলে উন্মাদিনী দিগবসনা,
জাগো হতভাগিনী সংগ্রামী নাগিনী
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।”

নারীপক্ষ বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে একবার

“আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে” —

না গেয়ে, গানটি একটু সংস্কারের মাধ্যমে গেয়েছিল। লাইনটি ছিল —

“আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত মেয়ে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি
ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।
মাগো —– ”

কারণ মেয়েরাও এ প্রতিবাদের অংশ। নারীপক্ষ একটি নারীবাদী সংগঠন হিসেবে জানে নিজের স্বীকৃতি এভাবেই আদায় করে নিতে হয়।

তখনের চেতনা আর এখনের চেতনায় তো পার্থক্য থাকবেই।

“আমাদের দেশে হবে
সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে
কাজে বড় হবে।”

ছেলেকেই কথার চেয়ে কাজে বড়ো হতে হবে, মেয়ের কাছে এমন কোন প্রত্যাশা নেই কেন? ।
শুধু এ পদ্যের পদ্যকার জীবনানন্দ দাশের মা কুসুনকুমারী দেবীর নয় — মেয়ের কাছে সমাজের কোন প্রত্যাশা নেই। খোকার মনোরঞ্জনের জন্য প্রচুর লোকছড়া, খুকুর জন্য সে তুলনায় নগণ্য।

খোকন খোকন ডাক পাড়ি

অথবা

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো

তাইতো আমি আমার মেয়েকে তার ছোটবেলায় জেন্ডার সংবেদনশীল স্বরচিত ছড়া শুনাতাম। যদিও তা প্রায়শঃই ছন্দের ধার ধারত না। প্যারোডিও বানাতাম।

“আমাদের দেশে হবে
সেই মেয়ে কবে
লেখাপড়ার সাথে সাথে
ডাকুও হবে।”

ডাকু শব্দটি সাহসী অর্থে ব্যবহার করতাম। ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই বলতাম।

কালের দাবি— সাহিত্যে শব্দ চয়ন হতে হবে লিঙ্গ নিরপেক্ষ। তথাকথিত পৌরষিকতার দম্ভে নারীকে উপেক্ষার দিন শেষ। তখন নারী শুধু শয়নের সহচরী ছিল। আর ছিল প্রেম প্রেম খেলার সাথী। এখন নারী সব কিছুতেই সমান অংশদারিত্বের দাবীদার। সাহিত্যে – সংসারে—-সন্তানে—- সম্পদে—-সংগ্রামে—সংসদে।