প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্সফোর্ডপ্রবাসী তপন রায়চৌধুরীর “ বাঙালনামার” নতুন সংস্করণে কবিগুরুর একটি গান ব্যবহার নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন—
“আমি একটু অন্যরকম করে লিখে সংযোজন করব ঠিক করেছি। এই গানটিকে আমি জাতীয় সংগীত করা হোক বলে প্রস্তাব দিয়েছি। বন্দে মাতরমে আপত্তি থাকলেও এতে কারো আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না। ভাষাটা এই –
আমরা সবাই ছ্যাঁচোড়
আমাদের এই চোরের রাজত্বে,
নইলে মোরা চোরের সাথে
মিলবো কী সত্ত্বে।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে এখনকার কথা ভেবে এই গীতি রূপান্তর করেছি।”
আমি তাঁর এ সাক্ষাৎকারটি পড়ার বছর দেড়েক আগেই আমার ধারণাটি খসড়া করেছিলাম, যা আজ সবার সাথে বিনিময় করছি।
কোন এক সময় পাঠ্য বইয়ে পদ্য বা কবিতার লাইন পরিবর্তন করে ছাপানো হতো। যেমনঃ কাজী নজরুল ইসলামের “সংকল্প” কবিতার –
“সজীব করিব মহাশ্মশান” লাইনের পরিবর্তন করে “সজীব করিব গোরস্থান” ছাপিয়েছিল। হিন্দুদের জীবনের শেষ স্থানটি পরিবর্তন করে মুসলমানদের জীবনের শেষ স্থানের উল্লেখ। নজরুল ইসলাম হয়ত হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় বিবেচনা না করে ছন্দের কথা ভেবে মহাশ্মশান শব্দটি চয়ন করেছিলেন। অথবা নজরুলের মননে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় আলাদাভাবে বিশেষ অস্তিত্ব বহন করত না।
অন্য আরেকটি পদ্য —-
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”
পরিবর্তন করে লেখা হয়েছিল —
“ফজরে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”
সকালের পরিবর্তে ফজরে শব্দটি পদ্যটিকে ইসলামীকরনের প্রয়াস। পদ্যকার তাঁর পদ্যে শত চাপেও আরবী ফজরে শব্দটি ব্যবহার করতেন কি না তা জানি না। হয়ত করতেন হয়ত বা করতেন না।
তবে কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে যেহেতু অনেক আরবী ফারসী শব্দের ব্যবহার রয়েছে, তাই অনুমান করি তিনি ভাব ঠিক রেখে এবং ছন্দপতন না ঘটলে মহাশ্মশান শব্দটির পরিবর্তে গোরস্থান শব্দটি কবিতার জন্মলগ্নে লিখতেই পারতেন। তবে কবির মূল কবিতার ভাব ঠিক রেখেও অন্য কেউ শব্দ পালটানো কোন কবিই মানবেন না।এতে কবিতার দ্যোতনাও থাকে না এবং এ অপপ্রয়াস কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য তো নয়ই, বরং প্রতিবাদযোগ্য।
যাহোক,আমি উপরোক্ত ভূমিকার পরও এখন একটি বিপরীত প্রস্তাব দিব। আমার ধারণা কাজী নজরুল ইসলাম সজ্ঞানে বেঁচে থাকলে আমার প্রস্তাব সানন্দে মেনে নিতেন। তাঁর “নারী” ও “বীরাঙ্গনা” এর মত কবিতাই এর প্রমাণ। এবার আসি মূল কথায়।
নারীকে কবিতা, গানে বা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় কে কীভাবে রূপায়িত করেছে তা নিয়ে নতুন করে অনেকেই বিশ্লেষণ করছেন । ব্যাখ্যা করছেন নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। কী সেই নারীবাদী দৃষ্টিকোণ? অনেক নারীবাদীরা সচেতনভাবে নিজেদের কর্মসূচিতে বিভিন্ন সাহিত্যিকদের রচনা খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করান।যেমনঃ নারীপক্ষ (বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী নারী সংগঠন) ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বা ২৫ নভেম্বর নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবসে ‘’জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’’ গানটি গান না। কারণ এতে রয়েছে ধর্ষিতা শব্দটি।
“ জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টীকা।
দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা,
নেচে চলে উন্মাদিনী দিগবসনা,
জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।”
ধর্ষিতা শব্দটি সচেতন নারী মাত্রই মেনে নিবে না। প্রতিবাদ করবে। ছন্দের প্রয়োজনে ধর্ষিতা মিলে, নজরুলের ভাবেও নিশ্চয়ই তখন মিল ছিল; কিন্তু এখন আর নারীবাদীরা তা মেনে নেয় না। নেওয়া সম্ভবও নয়। ভাবেও মিলে না। তখনকার ভাব ও চেতনার সাথে যে এখনকার ভাব ও চেতনার বিস্তর পার্থক্য। নারীবাদী চেতনায় যে আঘাত লাগে — নারীবাদী কানে ধর্ষিতা শব্দটি বিষের ফলার মত বিঁধে।
নারীপক্ষ মনে করে ধর্ষনের শিকার নারীটিকে আমরা একটি অপমানজনক পরিচয়ে সমাজে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তার গায়ে গেঁথে দিচ্ছি ধর্ষিতার মত কলঙ্কময় শব্দের পরিচয়। যে পরিচয় সমাজে তাকে বিশেষভাবে আজীবন আলাদা করে রাখে — ঘৃণার সাথে — করুণার সাথে। কাজেই এখানে যে কোন একটি দুর্ঘটনার জন্য নারীকে দায়ী করে তাকে চিহ্নিত করা উচিত নয়। যে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে অর্থাৎ ধর্ষককে চিহ্নিত করা — ঘৃণার সাথে আলাদা করে রাখা অতীব জরুরী।
আমার প্রস্তাব গানটিতে ধর্ষিতা শব্দটির পরিবর্তে সংগ্রামী শব্দটি ব্যবহার করা, যদিও আমার জানা নেই নজরুলের অবর্তমানে কার কাছ থেকে এজন্য অনুমতি নিতে হবে। লাইনগুলো হবে —
“ জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টীকা।
দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা,
নেচে চলে উন্মাদিনী দিগবসনা,
জাগো হতভাগিনী সংগ্রামী নাগিনী
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।”
নারীপক্ষ বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে একবার
“আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে” —
না গেয়ে, গানটি একটু সংস্কারের মাধ্যমে গেয়েছিল। লাইনটি ছিল —
“আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত মেয়ে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি
ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।
মাগো —– ”
কারণ মেয়েরাও এ প্রতিবাদের অংশ। নারীপক্ষ একটি নারীবাদী সংগঠন হিসেবে জানে নিজের স্বীকৃতি এভাবেই আদায় করে নিতে হয়।
তখনের চেতনা আর এখনের চেতনায় তো পার্থক্য থাকবেই।
“আমাদের দেশে হবে
সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে
কাজে বড় হবে।”
ছেলেকেই কথার চেয়ে কাজে বড়ো হতে হবে, মেয়ের কাছে এমন কোন প্রত্যাশা নেই কেন? ।
শুধু এ পদ্যের পদ্যকার জীবনানন্দ দাশের মা কুসুনকুমারী দেবীর নয় — মেয়ের কাছে সমাজের কোন প্রত্যাশা নেই। খোকার মনোরঞ্জনের জন্য প্রচুর লোকছড়া, খুকুর জন্য সে তুলনায় নগণ্য।
খোকন খোকন ডাক পাড়ি
অথবা
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
তাইতো আমি আমার মেয়েকে তার ছোটবেলায় জেন্ডার সংবেদনশীল স্বরচিত ছড়া শুনাতাম। যদিও তা প্রায়শঃই ছন্দের ধার ধারত না। প্যারোডিও বানাতাম।
“আমাদের দেশে হবে
সেই মেয়ে কবে
লেখাপড়ার সাথে সাথে
ডাকুও হবে।”
ডাকু শব্দটি সাহসী অর্থে ব্যবহার করতাম। ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই বলতাম।
কালের দাবি— সাহিত্যে শব্দ চয়ন হতে হবে লিঙ্গ নিরপেক্ষ। তথাকথিত পৌরষিকতার দম্ভে নারীকে উপেক্ষার দিন শেষ। তখন নারী শুধু শয়নের সহচরী ছিল। আর ছিল প্রেম প্রেম খেলার সাথী। এখন নারী সব কিছুতেই সমান অংশদারিত্বের দাবীদার। সাহিত্যে – সংসারে—-সন্তানে—- সম্পদে—-সংগ্রামে—সংসদে।
গীতাদি,
আপনার লেখাটি পড়লাম। নিঃসন্দেহে ভাবনা জাগানোর অনেক উপাদান আছে এতে। কিন্তু তারপরেও কিছু জায়গায় দ্বিমত না করে পারছি না। আসলে পুরুষবাচক অনেক শব্দই কিন্তু নারীবাদী লেখকেরা বদলে দিয়েছেন। এমনকি তসলিমা নাসরিনও তার আত্মজৈবনিক উপন্যাসের নাম দিয়েছিলেন – আমার মেয়েবেলা। কিন্তু তিনিও পূর্বেকার কবি লেখকদের লাইন বদলানোর পরামর্শ দেন নি। দেখুন, আগের কিছু কবিতার লাইন কিংবা শব্দ বদল করে ইসলামীকরণে যদি আপনার আপত্তি থাকে, সেই একই যুক্তি নারীকরণেও প্রযুক্ত হওয়া উচিৎ, নয় কি? FZ বোধ হয় সেটা উল্লেখ করেছিলেন।
আর নজরুল সেই সমইয়ের প্রেক্ষাপটেও অনেক প্রগতিশীল কবি। যিনি সেসময়ই লিখতে পারেছিলেন – কেবলে তকে বারাঙ্গণা মা, কে দেয় থুতু ও গায়ের …মত কবিতা, তার শব্দ বদলানোর কোন প্রয়োজন তো দেখিই না। নজরুলেরটা বদলাতে হলে, এর চেয়ে ঢের বেশি বদলাতে হবে তথাকথিত ‘রাবীন্দ্রিক নারী”র মূর্তি। কি বলেন?
ভাবনার উপাদানসমৃদ্ধ লেখা ।
তবে আমার ধারণা ভাষাকে পুরুষতান্ত্রিক বা নারীবাদী না করে মানববাদী করাটাই জরুরি এখন। সংস্কৃতিই যেহেতু ভাষার স্রষ্টা, তাই আমাদের প্রচলিত ভাষা এককালের পুরুষ-মানসিকতাই বহন করছে। এখন আবার এটাকে যদি নারীবাদী করে তোলা হয়, তাতেও মনে হয় লিঙ্গ-নিরপেক্ষতা আসে না।
তাই প্রয়োজনে আমাদেরকে নতুন শব্দের সৃজন করতে হবে। আসুন না আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সে চেষ্টাটা শুরু করি। মূলত ভাষাই সংস্কৃতির আয়না। এই আয়নায় আমরা আর পুরুষ বা নারী নই, (হিন্দু বা মুসলিমও নই) মানুষ হিসেবে আমাদের সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করার প্রচেষ্টা নেই। তাতে করে আমাদের মানসিকতারও উন্নয়ন ঘটতে থাকবে।
@গীতা দাস, আমার কাছে নারী আন্দোলনের বিষয়টা আসলে অনেক ব্যাপক মনে হয়। কে কোন গানে বা কবিতায় ‘ছেলে’ না ‘মেয়ে’ ব্যাবহার করলো তা তে আসলে কি এসে যায়, বিশেষ করে সেগুলো যদি বহু আগে লেখা হয়ে থাকে। আমার কাছে মনে হয়, সাহিত্য এক ধরণের ঐতিহাসিক দলিল, তাকে বদলানোর কি দরকার, বরং এখনকার সময়ের কবি সাহিত্যিকরা নতুন গল্প কবিতা গান লিখলেই তো পারে। আমরা অনেক সময়ই প্রাচীন সময়ের মানুষের চিন্তাধারা, সমাজব্যাবস্থা, সভ্যতা সংস্কৃতি বোঝার জন্য সে সময়ের সাহিত্যের কথা উল্লেখ করি এবং তাকে সে সময়ের সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন বলে ধরে নেই। নজরুল সে সময় যা লিখেছে সেটা সেভাবেই থাক না, আমরা আমাদের সময়ের মত করে সাহিত্য লিখে নিলেই তো পাড়ি, আর যাই হোক, বাংলাদেশে তো আর কবি সাহিত্যক এর অভাব নেই!
আর বাংলাদেশে যেখানে মেয়েদের বেসিক রাইট ই নেই, সেখানে এই সাংস্কৃতিক ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আমার মতে, প্রথমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া দরকার, তাহলে এর সাথে সাথে আরও অনেক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সাহিত্য-সংস্কৃতি সে অনুযায়ী প্রতিফলিত হবে, মেয়েরা নিজেরাই তখন নিজেদের গল্প কবিতা লিখতে পারবে। আমি একটা জিনিষ দেখে খুব অবাক হই – ছোটবেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন নারী সংগঠনকে খুব কাছের থেকে দেখে বড় হয়েছি আমি। এরা এত বড় বড় কথা বলে, কিন্তু কেউই এখনও সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকারের ব্যাপারটা নিয়ে আন্দোলন করতে সাহস পায় না। বুঝি এটা আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে খুবই বিপজ্জনক একটা দাবী, কিন্তু আমার মতে এখান থেকে শুরু না করলে কখনই মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।
@বন্যা আহমেদ,
সাহিত্যে নিঃসন্দেহে সমসাময়িক সমাজের প্রতিফলন এবং আমি কিন্তু গণহারে তা বদলাতে বলছি না। আমাদের প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহারের কথা বলছি। আর সাংস্কৃতিক বলয়ও নারী আন্দোলনের অংশ।
সবিনয়ে জানাতে চাই যে তা মোটেই সঠিক তথ্য নয়। সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার, ইউনিফর্ম পারিবারিক আইন, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, গৃহে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এমন অনেক ইস্যু নিয়ে নারী আন্দোলন কাজ করছে এবং জেনে খুশী হবেন যে সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার নিয়ে নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১০ এর খসড়া হচ্ছে— যা নারী আন্দোলনের ফসল।
নারী আন্দোলনের জন্যেই সিডও সনদের রিজার্ভেসন সরকার উঠিয়ে নিতে যাচ্ছে। নারী আন্দোলনই সুযোগ করে দিয়েছে নারীদের জন্যে সংরক্ষিত আসাঅনে সরাসরি নির্বাচনের।
যাহোক, দীর্ঘ তালিকা অন্য সময়ে দেওয়া যাবে।
আপনার মন্তব্যের উত্তরে নয়। এমনিতেই her story লেখা প্রয়োজন।
একটু তাড়াহুড়ার জন্যে আর বেশি কিছু লিখতে পারছি না। পরে কথা হবে বন্যা।
ফরিদ, উত্তর দিতে গিয়ে বিতর্কে জড়াতে চাই না। যার যার দৃষ্টভঙ্গির উপর নির্ভর করছে নারী শব্দটা কী লিঙ্গ নিরপেক্ষ না লিঙ্গ পক্ষপাতময়।
আর লিঙ্গ শব্দটিরও ব্যাখ্যা রয়েছে। Sex অর্থে নারীর biological অবস্থা যা প্রাকৃতিক, অপরিবর্তনীয় (সাধারণভাবে) এবং পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন অপ্রাসন্ঙ্গিক আর Gender অর্থে নারীর social ও cultural অবস্থান। পরিবার,সমাজ, দেশভেদে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট।
নারীপক্ষ লিঙ্গ নিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে এবং নারীরা সব কিছুতেই সমান অংশদারিত্বের দাবীদার প্রমাণ করতে গিয়ে পুরুষদের ভাগের পুরোটাই দেখি মেরে দেবার চেষ্টা করছে। নারীপক্ষের গাওয়া এই গানেতো ছেলেরা একেবারেই উপেক্ষিত। এতো মহা বৈষম্য, পুরুষের প্রতি প্রবল বৈষম্য। আগের গানেতো তবু মায়ের কথা বলা ছিল, মেয়েরা পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল না।
এই গানটা আমার মতে নীচের মত করে গাইলে একেবারে নিখুঁত সমতাযুক্ত হবে। নারী পুরুষ কারোরই কোন অনুযোগ বা অভিযোগ থাকবে না সেক্ষেত্রে।
“বাবাগো, আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত মেয়ে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি
ভয় নেই বাবা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।
বাবাগো —– ” 🙂
আমি কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিঙ্গ নিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার করি। যেমন, লেখক বা শিক্ষক শব্দটি ব্যবহার করি নারী পুরুষ উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই। আবার অনেক শব্দই আছে যেগুলোকে নারীদের জন্যই প্রযোজ্য মনে হয়। কিছুতেই পাল্টাতে পারি না। যেমন, সুন্দরী, রূপসী, অপরূপা, গুণবতী, রূপবতী বা কমনীয়। এগুলোকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করতে পারি না কোনভাবেই বা করতে চাই-ও না আসলে। আমার এরকম পুরুষবাদী আচরণের জন্য নারীবাদীরা আমাকে গালিগালাজ করলেও আমার কিছু করার নেই। আমার কাছে শব্দের চেয়েও মানুষ হিসাবে আমি একজন নারী যথোপযুক্ত সম্মান পাচ্ছে কিনা বা তার প্রাপ্য সে সঠিকভাবে পাচ্ছে কিনা সেটাই অনেক বেশি জরুরী বিষয়। কমনীয়, রমনীয় বলে আদর সোহাগ করলেই নারীর অবমাননা হয়ে গেল বা প্রেম প্রেম খেলা হল এটা অন্তত আমি মনে করি না।
দিদি, একটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল। নারী শব্দটা কী লিঙ্গ নিরপেক্ষ না লিঙ্গ পক্ষপাতময়? :-/
এবার, ঝাঁড়ু হাতে মেয়েরা রণরঙ্গিনী (এটারও কোন লিঙ্গ নিরপেক্ষ শব্দ খুঁজে পেলাম না) বেশে তেড়ে না এলেই বাঁচি। 😉
@ফরিদ আহমেদ,
:hahahee: :hahahee: :hahahee:
ভাই আপনি পারেনও। হাসি থামাতে পারলাম না।
আসলে আমার মনে হয়। নারী অধিকারকে আলাদা ভাবে না দেখে, একজন নারীকে; স্রেফ একজন মানুষ হিসাবে তার দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া উচিৎ।
@আতিক রাঢ়ী,
নারীর অধিকার যে মানবাধিকার এটাই তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে
( কেউ আবার পুরুষ বিদ্বেষ ভাববেন না যেন) প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলছে।
@ফরিদ আহমেদ,
মামারে আপনি তো মাইরা ফেলাইবেন দেখি। :hahahee: :hahahee: :hahahee:
“বাবাগো” দেখেই মনে হচ্ছে কে জানি পিছন থেকে বাঁশ নিয়া তাড়া করেছে, আর আমি বাঁশের বাড়ি খেয়ে “বাবাগো” করে চিৎকার দিচ্ছি!!!
যাই হোক, কোন এক নারীবাদি মহিলার একটা লেখায় একবার পড়েছিলাম যে নারীরা নিজেদেরকে পুরুষের সমকক্ষ/সম যোগ্যতা সম্পন্ন করতে গিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের কে পুরুষ বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে! ছেলেদের মত ছোট চুল, ছেলেদের মত পোশাক আশাক, ছেলেদের মত লাইফস্টাইল, ছেলেদের মত বদ্ধ পাগলামী!!! তো এসব করাতে কি উলটো ছেলেদের প্রাধান্য বেড়ে যাচ্ছেনা? কারন ছেলেদের উলটো গর্ব হবে যে মেয়েরা তাদেরকে নকল করছে!
এর চেয়ে ভালো যে মেয়েরা নিজেরাই খুঁজে নিক যে কোনটা তার জন্য উপযুক্ত। বিশ্বে মহীয়সি নারীর সংখ্যাতো আর কম না! তারাই সব মেয়ের উদাহরন হোক। মেয়েদের যোগ্যতার মাপকাঠি হতে হবে মানুষ । ছেলেদেরকেই যদি যোগ্যতার মাপকাঠি হিসাবে ধরা হয়, তবে মেয়েদের যোগ্যতার উর্ধ্বগতি বাড়বে না, বরং কমবে।
@তানভী,
খুব ভালভাবে বলেছেন। আমি এই ব্যাপারটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।
@তানভী,
নানা মুনির নানা মত। নানান পথ। নারী মুক্তির বিভিন্ন মতবাদের প্রচলন রয়েছে। আপনি যাদের কথা বললেন তারা এর একটা পথের পথিক। পরাধীন জাতি / মানুষ তাদের মুক্তির জন্যে যেমন বিভিন্ন পথে ঘুরে তেমনি আরকি।
আসলে ছেলেদের যোগ্যতার মাপকাঠি বলতে অনেকেই সমাজের মডেল মনে করে আর কি।
যাহোক, আপনার বক্তব্যের সারমর্ম আর আতিক রাঢ়ীর সহমত এর মতো সবাই হলে নারীদের সংগ্রাম কমে যেত।
@তানভী,
মহীয়সি নারীর definition কি? আমার মতে সমাজে নারীকে মহীয়সি করে তুলবার পিছনে একটা উদ্দেশ্য কাজ করে। সবাইকে মহীয়সি নারী হওয়ার দরকার নেই, ঐ যে বল্লেন্না “মেয়েদের যোগ্যতার মাপকাঠি হতে হবে মানুষ”, সেটা হলেই চলবে।
@ফরিদ ভাই, আমি আপনার কাছ থেকে এমন কিছু একটাই কিন্তু আশা করছিলাম, হাসতে হাসতে মরে গেলাম আপনার মন্তব্যটা পড়ে। আপনার মাথায় এগুলা আসে কেমনে?
@বন্যা আহমেদ,
আমার কোন কৃতিত্ব নেই এতে। সব কৃতিত্ব নারীপক্ষের। গান কবিতার শব্দ বদলের এই উদ্ভাবনী ক্ষমতা তারাই দেখিয়েছে। আমি শুধু তাদের প্রচেষ্টাতে আমার দুই পয়সা যোগ করেছি মাত্র।
পৃথিবী বলেছিলেন —
কাজেই ভাষা নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
নারী আন্দোলনের ক্ষেত্র শুধু ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে নয়। নারী ইস্যুতে পরিবারও অন্যরকম মৌলবাদীরূপ ধারণ করে। তাছাড়া কে কোন ইস্যু নিয়ে লড়বে বা লিখবে তা তো সে নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে। নয় কি!
এবং নারীপক্ষ শুধু শব্দ পরিবর্তনের আন্দোলন করে না। তাদের কাজের ক্ষেত্রগুলো হলোঃ
• নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ
• নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার
• নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন
• পরিবেশ ও উন্নয়নে নারীর অবস্থান
• সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
• সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমে নারীর অবস্থান।
আমার লেখাটি শেষোক্তটির সাথে সম্পৃক্ত।
@গীতা দাস,
একদম ঠিক কথা। আমি শুধু এই প্রসংগে নিজের view টা বুঝাতে চাচ্ছিলাম।
আমি মনে করি নজরুল ধর্ষিত শব্দটা real ধর্ষন অর্থে বুঝাননি, বরং সমাজে নারীরা যে প্রতিনিয়ত অবহেলিত হচ্ছে, সে নারীগনকেই বুঝানো হচ্ছে। শব্দ পরিবর্তনের থেকেও বেশী জরুরী হচ্ছে আমাদের লেখকদের সমাজে নারীদের যে অবস্হান, নির্ভীকভাবে (মৌলবাদির ভয়) তার কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা এবং কঠিনভাবে প্রতিবাদ করা। আমাদের দেশের লেখকদের অথবা নারীবাদীগনের মনে হয় এই ব্যাপারে কিছুটা পশ্চাৎপদতা রয়েছে।
@ব্রাইট স্মাইল্,
:yes: :yes: :yes:
her story তো লেখা শুরু করতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান খুঁজতে গিয়ে
“আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত মেয়ে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি
ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।
মাগো —– ”
বলাকে নিশ্চয়ই কেউ হাস্যকর বলবে না ।
নারীপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের দলিল দস্তাবেদে মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে লেখাটি উঠিয়ে দেওয়ার জন্যে কাজ করছে। দেশের জন্যে নারীর ত্যাগকে ইজ্জত গেল বলে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। এ ধরনের চেষ্টাকে ছুঁৎমার্গের পরিচয় বলে কেউ ব্যঙ্গ করলেও নারীপক্ষ এর ধার ধারে না।
ঠিক বুঝলাম না নারীপক্ষ এধরনের ছুঁৎমার্গের পরিচয় কেন দিল। ব্যাপারটা ভাল লাগলো না। আমি তো মনে করছি এটা করে বরং তারা ‘সুশীল’ মানসিকতার পরিচয় দিলেন।
আর, লেখার সুরে আর স্বরে কিছুটা হাস্যকর ব্যাপার মনে হল গড়পড়তা ছেলেদের জায়গায় মেয়েদের নাম বা সর্বনাম ব্যবহার। History-তে his বদলে her করার মতো ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না কি অনেকটা?
@ব্লাডি সিভিলিয়ান,
history, management, manufacture, manipulate এইসব শব্দকে বলা হয় words with nonsexist origin বা সেই সকল শব্দ যাদের উৎপত্তির সাথে লৈঙ্গিক সম্পর্ক নেই।
ধর্ষন শব্দটির পরিবর্তে ধর্ষনের শিকার নারী বলা হয়। নির্যাতিতা না বলে নির্যাতনের শিকার নারী বলতে সুপারিশ করা হচ্ছে। যেমনঃ যৌন কর্মীদের এখন আর পতিতা বলা হয় না। এমন অনেক শব্দগত বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছে রয়েছে।
ধন্যবাদ পৃথিবী আপনার মন্তব্যের জন্যে।
ভাষা্র ভেতরের লৈঙ্গিক রাজনীতি বোধকরি সবচেয়ে বিপদজনক। এই যেমন বোর্ডের মাধ্যমিক বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের কথাই ধরেন। “সৎপাত্রে কন্যা দান কর”- বাক্যটিকে সম্প্রদান কারকের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইমপ্রেশনেবল এই বয়সের শিক্ষার্থীরা কি শিক্ষা পাচ্ছে?
তবে “ধর্ষিতা” শব্দটির মধ্যে আমি কোন সমস্যা খুজে পেলাম না। ধর্ষিত হওয়া তো অপরাধ না, আমরাই একে অপরাধ করে তুলেছি। আমরাই ধর্ষকের থেকে ধর্ষিতার উপর মনযোগ আরোপ করেছি। নারীবাদিরা যদি এখন ধর্ষিতা শব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করেন, তবে কি তাঁরা পরোক্ষভাবে পুরুষতন্ত্রের কাছ হার মেনে নিচ্ছেন না? আমি মনে করি শব্দটি ছেড়ে দিয়ে বরং আমাদের মননে সংস্কার আনা প্রয়োজন। তাছাড়া ধর্ষন শব্দটি বাদ দিলে এর পরিবর্তে কিইবা ব্যবহার করবেন?
অন্যসব কিছুর সাথে একমত।
:clap2: :clap2: :clap2:
@আশিকুর রহমান,
সহমত পোষণের জন্যে ধন্যবাদ। :rose:
কবিতাটির নাম কি “সংকল্প” ছিলো?
‘সংগ্রামী নাগিনী’ খাঁপ খাচ্ছে না, অন্য কিছু হলে ভালো হয়। আর নজরুল সম্ভবত ভাবেন নি তাঁর কবিতা এভাবে কাজে লাগবে, যদি ভাবতেন তাহলে হয়ত অন্যভাবে লিখতেন 🙂 । যাই হোক, নজরুল ধর্ষিতা মেয়েকে জাগতে বলছেন তার মানে তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ষিতা মেয়েদের জাগতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে-এটি নজরুলের প্রগতিশীল মননের প্রতীক।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
@সৈকত চৌধুরী,
হ্যাঁ, কবিতাটির নাম সম্ভবত সংকল্প। থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখব এবার জগৎতাকে দিয়ে কবিতাটি শুরু।
সংগ্রামী নাগিনী’ খাঁপ না খেলে লাগসই শব্দ খোঁজা যেতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
বিশ্ব নারী দিবসের ১০০ বছর পূর্তিতে এসেও এ প্রশ্নের সমাধান হয়নি।
ধন্যবাদ পড়া এবং মন্তব্যের জন্যে।
@গীতা দাস,
কবিতাটি আমাদের রণসংগীত ‘চল চল চল’।
আমার মনে হয় কোন কবির অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁর কবিতার শব্দ বদলানো নিতান্তই অনুচিত। আর নজরুল প্রসঙ্গে আমার মনে হয় নজরুল সমকক্ষ প্রগতিশীল লেখক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এ বিরল। হয়তো তিনি বেঁচে থাকলে আপনার প্রস্তাব সানন্দে মেনে নিতেন। কিন্তু কবিতার শব্দ বদলানোর সিদ্ধান্ত, আমার মতে, কেবলমাত্র রচয়িতার, আর কারো নয়।
আর সাহিত্যে লিঙ্গ নিরপেক্ষ শব্দ চয়নের আহবানের সাথে সম্পূর্ণ একমত। এ ব্যপারে পুরনো লেখা ধরে টানাটানি না করে বরং বর্তমান লেখকদের উদ্বুদ্ধ করাই শ্রেয়। কারণ আজ যদি আমরা প্রগতিশীলতার খাতিরে পুরনো কবিতার শব্দ বদলানো শুরু করি, তাহলে ইসলামীকরণের খাতিরে শব্দ বদলানোর ঘৃণ্য প্রচেষ্টার প্রতিবাদের নৈতিক অধিকার আমাদের কিছুটা হলেও খর্ব হবে বলে আমার বিশ্বাস।
@FZ,
সহমত– :yes:
লেখাটিতে কমেন্ট করার অপশন বন্ধ ছিলো। ঠিক করে দেয়া হয়েছে।