একুশে নিয়ে নতুন কিছু লেখার ক্ষমতা আমি রাখিনা। আসলে যে মহাকাব্য একবার লেখা হয়ে গেছে,তার আর নতুন করে লেখার কিছুই নেই। আমরা শুধু মহাকাব্য থেকে শিখতেই পারি, আর পারি উদ্ধৃতি দিতে। তাই আমিও একুশের মহাকাব্যকেই লিখে দিচ্ছি, অন্তর্জালীয় মহা সমুদ্রে।

ঘটনা পরম্পরা:

২০ ফেব্রুয়ারী:
২০ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা নাগাদ সরকার হতে ঘোষণা দেয়া হয় যে পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারী সরকারের পক্ষ হতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল মূলত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারীতে পূর্ব ঘোষিত হরতাল বানচাল করার উদ্দেশ্যে। ১লা ফেব্রুয়ারী থেকেই এই সর্বব্যাপি হরতালের জন্য পুর্বপ্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে, যার ফলে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা জারিতে হতাশ হয়ে পড়ে। এমন কি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের ভোটাভুটির সিদ্ধান্তে সে সময় হরতাল বাতিল ও ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এবং রাত ১০টা নাগাদ এ সিদ্ধান্ত মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু সেদিন রাত ১০টার সময়ই আবার সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সদস্য নন এমন কয়েকজন নেতাকে অনতিবিলম্বে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ঢাকা হলের পুকুরের পূর্ব ধারের সিঁড়িতে জরুরী গোপন বৈঠক হবে। এই বৈঠকে রাত ১২টার সময় যে ১১ জন ছাত্র নেতা উপস্থিত হন তারা হলেন:
১- গাজীউল হক(আইনজীবী),
২- হাবিবুর রহমান(বিচারপতি),
৩- মোহাম্মদ সুলতানা,
৪- এম আর আখতার মুকুল,
৫- জিল্লুর রহমান,
৬- আব্দুল মোমিন,
৭- এস এ বারী এটি,
৮- সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ,
৯- আনোয়ারুল হক খান,
১০- মঞ্জুর হোসেন,
১১- আনোয়ার হোসেন।

বৈঠকে স্থির করা হয় যে গাজিউল হক পরের দিন আমতলায় অনুষ্ঠিত সভার সভাপতিত্ব করবেন। যদি তিনি গ্রেফতার হন তবে সভাপতি হবেন এম আর আখতার মুকুল এবং তাকেও যদি গ্রেফতার করা হয় তবে সভাপতিত্ব করবেন কামরুদ্দিন শহুদ। এবং আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে সভাপতি হিসাবে গাজিউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখবেন এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত জানিয়ে সভার কাজ শেষ করবেন। সে রাতে আরো সিদ্ধান্ত হল যে আন্দোলনকে ভবিষ্যতে গতিশীল রাখতে একমাত্র হাবিবুর রহমান ছাড়া পারতপক্ষে আর কোন নেতা গ্রেফতার হতে পারবেন না।

২১শে ফেব্রুয়ারী:
এই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার,১৯৫২ সাল। আগের দিন রাতে হরতাল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়া ও প্রচারিত হয়ে যাবার ফলে সবকিছুই ছিল মোটামুটি স্বাভাবিক। শুধুমাত্র বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামের মাঠটিতে সকাল থেকে কয়েক হাজার পুলিশ জমায়েত হতে থাকে। সাথে থাকে পুলিশের স্পেশাল টিয়ার গ্যস স্কোয়াড।

বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ ছাত্রদের ছোট ছোট মিছিল এসে জমা হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে। তখনো পর্যন্ত পুলিশ কোন বাধা প্রদান করেনি। চারপাশের বিভিন্ন হলের ছাত্ররা ধীরে ধীরে জমায়েত হতে থাকল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় দশ হাজার। চারিদিকে ছাত্রছাত্রীদের “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগান। পুলিশ তাদের নিজস্ব অবস্থানে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষমান।

এসবের মধ্যেই গাজিউল হককে সভাপতি করে সভা শুরু করা হয়। প্রথমে বক্তৃতা করেন সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের শামসুল হক, তিনি ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। যদিও তিনি বক্তব্যের শেষে আন্দোলনের প্রতি পূর্ন সমর্থন ব্যক্ত করেন। এরই মাঝে সংবাদ এসে পৌছায় যে, লালবাগ এলাকায় পুলিশ একটা স্কুলের ছাত্র মিছিলের উপর টিয়ার গ্যস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করেছে। ফলে উত্তেজনা তখন চরমে উঠে। এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল মতিন এবং সভাপতি গাজিউল হক উভয়েই ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখেন, এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিতও হয়। চতুর্দিক কাঁপিয়ে স্লোগান ওঠে “১৪৪ ধারা মানিনা, মানবো না”। এইসব হৈচৈ এর মাঝে আবদুস সামাদ আজাদ কিভাবে ১৪৪ধারা ভাঙা হবে তার একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাব কে বলা হয় বিখ্যাত “১০ জনী মিছিল”-এর প্রোগ্রাম। তার মতে এত হাজার হাজার ছাত্র একত্রে মিছিলে নামলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই প্রতি দফায় ১০ জন করে রাস্তায় মিছিল বের করাটা যুক্তিযুক্ত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালিন প্রোক্টর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী এই বক্তব্য সমর্থন করেন এবং কলাভবনের গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন।

এরপর শুরু হয় ছাত্রদের দশজনী মিছিল। প্রথম দলের নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান (বিচারপতি)। দ্বিতীয় দলে আবদুস সামাদ আজাদ এবং ইব্রাহীম তাহা। তৃতীয় দলে আনোয়ারুল হক খান এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান। এই দশ জনী মিছিলে যারা গ্রেফতার হচ্ছিলেন তাদের তালিকা তৈরির দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান এবং কাজী আজহার। চতুর্থ দফায় মেয়েদের একটি মিছিল স্বেচ্ছায় কারাবরণের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে আসার পরপরই ছাত্রদের আরো অনেকগুলো মিছিল একের পর এক বের হয়ে আসতে লাগলো। এ এক অভূতপুর্ব দৃশ্য!! এমন সময় আকস্মিক ভাবে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ ও অবিরাম টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে লাগলো। চারিদিকে কাঁদানে গ্যসের ধোয়া। ছাত্ররা দৌড়ে কলাভবনের পুকুরে এসে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছে আবার মিছিলে গেল। এমনি সময়ে একটি টিয়ারশেল সরাসরি গাজিউল হকের বুকে এসে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাকে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলায় মেয়েদের কমন রুমে রেখে আসা হয়। প্রায় বেলা দুটো পর্যন্ত কলা ভবন এলাকায় ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ চলতে থাকে। তখনও পর্যন্ত ঢাকার অন্যান্য স্থানে সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। একদিকে পুলিশের লাঠি চার্জ আর অন্যদিকে ছাত্রদের ইট পাটকেল নিক্ষেপ। ছাত্ররা যাতায়াতের সুবিধার জন্য কলা ভবন ও মেডিকেল হাসপাতালের মধ্যবর্তী দেয়াল ভেঙে দেয়। ফলে কিছুক্ষনের মধ্যেও পুলিশের সাথে যুদ্ধের দিক পরিবর্তিত হল। চারিদিকে ছড়িয়ে পরল সংঘর্ষ। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের কারনে বহু ছাত্র আহত হল। যেহেতু জগন্নাথ হলই ছিল তৎকালীন প্রাদেশিক ভবন, তাই পুলিশ এর সামনের রাস্তা পরিস্কার রাখতে চাইছিল আর ছাত্ররাও একই কারনে এই রাস্তা দখলে রাখতে চাইছিল।

এমনই অবস্থায় কোন রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই একদল সশস্ত্র পুলিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশির নির্দেশে দৌড়ে এসে হোস্টেল প্রাঙ্গনে অবস্থান নিয়ে “ওয়ালী ফায়ার” করল। চারিদিকে টিয়ার গ্যাসের ধোয়ার ভেতর কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিছু তাজাপ্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, অনেকে আহত হল, বাকিরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। সময় তখন ২১শে ফেব্রুয়ারী রোজ বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা ১০ মিনিট।

একটি লাশের মাথার অর্ধেকটাই গুলিতে উড়ে গেছে। ইনিই হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র শহীদ আবুল বরকত। সে সময় পর্যন্ত ঘটনাস্থলে নিহতের সংখ্যা ২ এবং আহত ৯৬। সন্ধ্যায় অপারেশন থিয়েটারে আরো দুজন মারা যায়।
২১শে ফেব্রুয়ারীর গুলি বর্ষণে শহীদ হওয়া তিনজন ছাত্র হলেন আবুল বরকত, জব্বার এবং রফিক উদ্দিন। চতুর্থ জন ছিলেন শহীদ সালাম যিনি বাদামতলীর একটি প্রেসের কর্মচারী ছিলেন। এছাড়া রাস্তায় পড়ে থাকা আরো কিছু লাশ সম্ভবত পুলিশ ট্রাকে করে নিয়ে যায়। যাদের পরিচয় আর জানা সম্ভব্ হয়নি।
_____________________________________________

আসলে আমি গুছিয়ে লিখতে পারি না। সুপাঠ্য হয়না আমার লেখা। তবে এমন মহাকাব্যের ইতিহাস কি নিজেই সুপাঠ্য নয়? প্রশ্ন রইল আপনাদের কাছে। :rose2: (শহীদদের প্রতি)

(এখানে উল্লেখিত সকল ঘটনা পরম্পরা এম আর আখতার মুকুল রচিত “একুশের দলিল” বই হতে গৃহিত)