একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান দেই। ২০০৫ সালে শুধু মাত্র আমেরিকাতে ১২.৮ বিলিয়ন ডলারের উপহার সামগ্রী কেনা হয়েছে ভালবাসা দিবসে। ২০০৭ সালে তা ছিল আগের চেয়ে অন্তত ৭% বেশী। সংখ্যায় যা দাঁড়ায় প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ১৪.৭ বিলিয়ন ডলার। এতো গেল শুধুমাত্র আমেরিকার কথা। যদি সারা বিশ্বের হিসাব তুলি তাহলে তা বোধ করি কয়েকশত ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে।

এবারে আরেকটি ছোট্ট পরিসংখ্যান। প্রতিদিন সারা বিশ্বে ৮৫০ মিলয়ন মানুষ খালি পেটে ঘুম যায়। যা প্রতি বছর ৫ মিলয়ন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা বাড়ার দরুন। প্রতিদিন সারা বিশ্বে ১৮,০০০ শিশু ক্ষুধা এবং অপুষ্টিজনিত কারনে মৃত্যুবরন করে। এটি ২০০৭ সালে জাতিসঙ্ঘ কতৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে।

যাই হোক এবার আমরা আমাদের আলোচ্য বিষয়ে ঢুকে যাই। ভালবাসা দিবস। ভালবাসা দিবস আসলে কি? কেন এই ভালবাসা দিবস? আর কেনোইবা এই ভালবাসা দিবস নিয়ে মানুষের এত দাপাদাপি, লাফালাফি?

ভালবাসা দিবসের ইতিহাস যদি খুজতে যাই তাহলে আমরা দেখব যে এর ইতিহাস খুবই
ধোয়াশাপুর্ন। যে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা বলা হয়, সে কি আসলেই ছিল, থাকলে একজন নাকি একাধিক, তার সাথে ভালবাসা দিবসের সম্পর্ক কি তা কোনো শক্ত তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমান করা যায় না। ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে যে কাহিনী প্রচলিত আছে তাকে আমরা শুধুমাত্র কল্পকাহিনীই বলতে পারি।

ক্যাথলিক চার্চের মাধ্যমে আমরা তিন জন ভিন্ন ভিন্ন ভ্যালেন্টাইনের কথা জানতে পারি যারা প্রত্যেকেই শহীদ হয়েছিল।
একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী ভ্যালেন্টাইন ছিল একজন খ্রীষ্টান ধর্মযাজক। যখন কিনা রোমান শাসক দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের শাসনামল। অবিবাহিত সৈনিক বিবাহিত সৈনিক হতে বেশি কার্যকর, এই ধারনার বশবর্তি হয়ে তিনি যুবকদের বিয়ে করা অবৈধ ঘোষনা করেন। ভ্যালেন্টাইন এই ঘোষনার বিরোধিতা করে গোপনে যুবক যুবতীর বিয়ে দিতে লাগলেন। স্বাভাবিক ভাবেই কিছু দিন পরে এই কথা রাজার কানে পৌছুল এবং তিনি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলেন। বলা হয়ে থাকে এই মৃত্যুদন্ড ১৪ ফেব্রুয়ারী কার্যকর হয়।

আরেকটি কিংবদন্তি মতে, ভ্যালেন্টাইন খ্রীষ্টান কয়েদিদের রোমান কারাগার থেকে পালাতে সাহায্য করে, যেখানে তাদের অমানবিক ভাবে অত্যাচার করা হত। এই অভিযোগে তাকে কারাগারে প্রেরন করা হয়। সেখানে সে কারাপ্রধানের অন্ধ তরুনি মেয়েকে অলৌকিক (!) ভাবে সারিয়ে তোলে এবং তার সাথে খুব ভাল একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখানে একটি কথা বলা দরকার, ক্যাথলিকরা এই সম্পর্ককে প্রেমের সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং প্রোট্যাসণ্টরা এটিকে শুধু মাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করেছে। যাই হোক কারাগারে অবস্থানকালে ক্লডিয়াস তাকে রোমান দেব দেবীকে মেনে নিয়ে যীশুকে অস্বীকার করতে বললে ভ্যালেন্টাইন তাতে রাজি হয় নি। যার জন্য ২৭০ A.D অন্যমতে ২৮০ A.D সালে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কথিত আছে দন্ড প্রয়োগের আগ মূহুর্তে সে কারা প্রধানের কাছে কাগজ ও কলম চেয়ে নিয়ে একটি বিদায় সম্ভাষন লিখেছিল তার মেয়ের জন্য। যাতে লেখা ছিল From Your Valentine।

এখন আমরা দেখব কিংবদন্তির সত্যতা। আমরা যদি দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের জীবনী আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাব ২য় ক্লডিয়াস সর্বসাকুল্যে দুই বছরেরও কম সময় শাসন করতে পেরেছিলেন। আধুনিক ইতিহাসবিদগন কিংবদন্তিতে ক্লডিয়াসেরসের যে চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে কিংবদন্তিতে উল্লেখিত তথ্য সমর্থন করার মত পর্যাপ্ত দলিল ইতিহাসে নেই।

বরঞ্চ ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা যা পাই তা হলো, ফেব্রুয়ারী মাসে প্রাচীন রোমে বসন্ত শুরু হত। তারা এই মাসটিকে পবিত্রতা ও শুদ্ধতার মাস মনে করত। ঐ সময়ে তারা ধর্মীয়ভাবে তাদের বাড়ি ঘর পরিষ্কার করত। এই মাসের ১৫ তারিখে তারা লুপারকেলিয়া নামে একটি ভোজের আয়োজন করত যা তাদের কৃষি দেবতা “ ফাউনাস” এবং রোম প্রতিষ্ঠাতা “রমিওলাস” ও “ রেমাস” এর নামে উতসর্গ করা হত। এই ভোজ অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষন ছিল একটি লটারি। এই লটারির মাধ্যমে পরবর্তি বছরের জন্য রোমান যুবকরা তাদের নারীসঙ্গী পেত।
পরবর্তিতে পোপ গেলাসিয়াস এই লটারি প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন এবং এই দিবস কে খ্রীষ্টিয় ফ্লেভার দিতে ভ্যালেন্টাইন ডে নামের মোড়ক দিয়ে আবৃত করেন। মজার কথা হল এই ১৪ শতকের আগেও ভ্যালেন্টাইন দিবসের সাথে ভালবাসার কোন সম্পর্ক ছিল না।
বিখ্যাত ইংরেজ লেখক জেওফ্রে সসার ( Geoffery Chaucer ) তার কবিতা The Parliament Of Fowls – এ পাখিকে প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবে কল্পনা করেছেন। মধ্যযুগে ফ্রান্সে এবং ইংল্যন্ডে বিশ্বাস করা হত যে ফেব্রুয়ারী মাস হল পাখির প্রজনন কাল। সসার তার কবিতায় লিখেছেনঃ
“For this was on St. valentine’s day, when every fowl cometh there to choose his mate.”
বস্তুত সসারের এই কবিতার মাধ্যমেই ভ্যালেন্টাইন ডের মধ্যে ভালবাসা জিনিসটি ঢুকে যায় এবং আস্তে আস্তে ব্যাপকতা লাভ করে। লেখক Henry Ansgar Kelly তার Chaucer and cult of Saint Valentine বইতে এই ব্যপারটি ভাল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

এতক্ষনে আমরা মনে হয় এটুকু বুঝতে পেরেছি যে আজকের ভালবাসা দিবসের উতপত্তি ভালবাসা দিবস হিসেবে হয় নি। কেননা আমরা যদি প্রথম কিংবদন্তিটি আলোচনা করি তাহলে ভ্যালেন্টাইন ডে কে ভালবাসা দিবস হিসেবে পালন করার কোন যুক্তিই নাই। নুন্যতম আমরা যা করতে পারি তাহল ভ্যালেন্টাইনস ডে কে ‘কাজি দিবস” হিসেবে পালন করতে পারি। কারন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন প্রেমের জন্য মারা যান নি। তিনি মারা গেছেন বিয়ে করানোর দায়ে।
আর যদি দ্বিতীয়টি নিয়ে আলোচনা করি তাহলে দেখব সেখানেও ভালবাসার কোন জায়গা নেই। তাকে হত্যা করা হয়েছিল রোমান দেবতা না মানার জন্য।

সব কিছুর পরেও আমরা যদি ভালবাসা দিবসকে মেনে নেই, আমরা কিভাবে মানবো এই দিবসকে কেন্দ্র করে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের অপচয়কে, যা কিনা শুধুমাত্র চকলেট, কার্ড, অলংকার আর জন্মনিয়ন্ত্রিকরন সিস্টেম কিনতেই চলে যায়? যখন পৃথিবীর একটি বিরাট সংখ্যক মানুষ না খেয়ে থাকে, যখন আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কান্ডারী শিশুরা ক্ষুধায়, অপুষ্টিতে ভুগে মারা যায়?

শুধু ভ্যালেন্টাইন ডে না, মানব কল্যানে কাজে লাগেনা এমন সব দিবস পালন করাকেই আমি ঘৃনা করি। এই দিবসগুলো আমার বমির উদ্দ্রেক করে। আমরা এইসব ফালতু দিবসে অপচয় করা অর্থগুলোকে যদি মানব কল্যানে কাজে লাগাতে পারি তাহলে এই পৃথিবীর দরিদ্র মানুষের কিছুটা হলেও উপকার হবে আর আমরা আমাদের দায়িত্বের কিছুটা হলেও পুরন করতে পারব। কি বলেন আপনারা ??