নাস্তিকতা / আস্তিকতা নিয়ে বহুদিন ধরে বিতর্ক চলছে। এই কিছুদিন আগে মুক্তমনা ব্লগেই এক প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়ে গেল। ঐ বিতর্কে আমি আমার শেষ মন্তব্যে বলেছিলাম ইশ্বরের সংজ্ঞা নিয়ে কিছু লিখব। আমি যে বিষয়ের উপর যোর দেব সেটা হল ইশ্বরের সংজ্ঞায়নের ব্যাপারটা। এখানে যুক্তির নিয়মের বিশেষ ভূমিকা আছে। অনেক কিছুর সংজ্ঞা যে যার খুশিমত দিতে পারেন, কারণ সেই সব কিছু আছে কি না সেটা নিয়ে বিতর্ক হয় না। প্রেম, সৌন্দর্য, ভাল মন্দ (লোক), ইত্যাদি একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞা দেন। সেখানে যুক্তির নিয়ম বা ব্যাকরণ পালিত হল কি না সেটা নিয়ে মাথা ঘামানর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ইশ্বরের সংজ্ঞায়নের ব্যাপারে অতটা ঢিলেমি মানা যায় না কারন ইশ্বর আছেন কিনা সেটা নিয়ে সিরিয়াস বিতর্ক হয়। আর বিতর্ক মানেই ত প্রতিপক্ষের কোন মত বা সিদ্ধান্তকে মিথ্যা আর নিজের কোন মত বা সিদ্ধান্তকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস। যে কোন মত বা সিদ্ধান্ত এক বা একাধিক বাক্যেরই সমষ্টি। যুক্তির নিয়মে কোন বাক্যের সত্যতা মিথ্যাত্ব যাচাইয়ের জন্য বাক্যগুলিকে বচন বাক্য হতে হবে। তা নাহলে সেই বাক্য বা বাক্যগুলি সত্যি না মিথ্যা সেটা যুক্তির দ্বারা নিরূপণ করা যায়না আর তাই সেই বাক্য সত্য বলা যেমন অর্থহীন তেমনি মিথ্যা বলাও অর্থহীন। বচনবাক্যের সংজ্ঞা যে কোন যুক্তির মৌলিক বই এ পাওয়া যাবে। আমি আমার “যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি” প্রবন্ধে সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি। যুক্তির নিয়মকে অনেকে তাচ্ছিল্য বা হেয় করেন। কেউ একে বস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন বলে উড়িয়ে দেন। অথচ মুক্ত-মনার মূল মন্ত্রই হল যুক্তিতে মুক্তি। যুক্তির নিয়মই যদি মানা না হল তাহলে যুক্তির আলোচনা করাটা প্রহসনেই ছাড়া আর কিছু নয়। যুক্তির নিয়মের আওতায় না থাকলে যে যার খুশিমত যুক্তি দিয়ে নিজেকে সঠিক আর অন্যকে ভুল বলতে পারেন। পুরো বিতর্ক টাই বিশৃংখলায় পর্যবসিত হয়, যেমনটি হয় কোন খেলা নিয়ম না মেনে খেললে। বচন বাক্যের একটা শর্ত হল এতে অসংজ্ঞায়িত বা অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত, অজানা বা অপরিচিত কোন শব্দ থাকতে পারবে না।
ধর্মবাদীদের ইশ্বরের সংজ্ঞার প্রথম অংশে বলা হয় ইশ্বর হলেন বিশ্বের স্রষ্টা । কিন্তু এক্ষেত্রে স্রষ্টা বা Creator দর্শনসম্মত অর্থাৎ যৌক্তিক কোন ধারণা নয়। দর্শনে কার্য ও কারণ এর ধারণা স্বীকৃত । কার্য কারণ হল দুইটি সুসংজ্ঞায়িত বস্তু বা ক্রিয়ার (মনে করি ক আর খ) মধ্যকার এক অপ্নিবার্য্য সম্পর্ক। যখন খ এর অস্তিত্ব ক এর অবর্তমানে কখনই ঘটতে না পারলে আমরা ক কে খ এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করি আর সেক্ষেত্রে ক কে খ এর স্রষ্টা হিসেবে সংজ্ঞা দেয়া যায়। কিন্তু ক কে আবিষ্কার বা চিহ্নিত করা না পর্যন্ত “ক খ এর স্রষ্টা” বলাটা অর্থহীন। যেমন বলা যায় রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলীর স্রষ্টা, দ্য ভিঞ্চি মোনালিসার স্রষ্টা। কিন্তু পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে কেউ যদি দ্য ভিঞ্চির নাম না শুনেও মোনালিসার চিত্র দেখেন তিনি কি বলতে পারেন না যে ঐ চিত্রের একজন স্রষ্টা (যিদিও এখন ও অজানা) আছেন? অবশ্যই পারেন। এখানেই যুক্তির সূক্ষ্ণ দিকের প্রয়োজন দেখা দেয়। তিনি যদিও দ্য ভিঞ্চির নাম শুনেননি কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন যে চিত্র মাত্রই কোন না কোন মানুষের সৃষ্টি। মানুষ ত সবার কাছে এক সুস্পষ্ট জানা এক বস্তু। সে ক্ষেত্রে তিনি চিত্রের স্রষ্টা দ্য ভিঞ্চি না বলে বলবেন এই চিত্রের স্রষ্টা আছেন, যিনি একজন মানুষ, কারণ চিত্রের উদাহরণ অনেক আছে এবং সর্বখেত্রে চিত্রের একজন মানুষ স্রষ্টা থাকে। তিনি তার নাম দিলেন ভ্য দিঞ্চি । চাইলে তিনি আর এক ধাপ এগিয়ে ভ্য দিঞ্চির কিছু গুণের বর্ণনাও দিতে পারেন। তাঁর এই ভ্য দিঞ্চির সংজ্ঞা ও গুণাবলির বর্ণনা যৌক্তিক বিচারে শুদ্ধ, এবং তার সত্যতা মিথ্যাত্ব যাচাই করা যেতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কোন ক্রিয়া বা বস্তুর স্রষ্টা আছে (অর্থাৎ স্রষ্টা শব্দটির ব্যবহার) বলাটা তখনই যুক্তিসিদ্ধ হয় যখন হয় সে ক্রিয়া বা বস্তুর কারণ ইতোমধ্যেই চিহ্নিত হয়ে গেছে অথবা আরোহ পদ্ধতির মাধ্যমে (Induction) যখন একই রকম অন্য সব বস্তু বা ক্রিয়ার স্রষ্টা সবসময় চিহ্নিত হতে দেখা গেছে । আরও দেখা যাচ্ছে যে এই দুটো ক্ষেত্রেই স্রষ্টার স্বরূপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা স্রষ্টা চিহ্নিত হবার আগেই করা যায়। ভ্য দিঞ্চি কে জানা বা চেনার আগেই তিনি জানেন যে ভ্য দিঞ্চি একজন মানুষ (দুটো হাত, দুটো পা ইত্যাদি)। একই রূপ উদাহরণ দেয়া যায় মৌচাক আর মৌমাছি নিয়ে। স্রষ্টা যে শুধু প্রাণীই হতে হবে তা নয়। বৃষ্টির স্রষ্টা (অর্থাৎ কারণ) হিসেবে মেঘ কে চিহ্নিত করা যায়। এর সবটাতেই একটা সাধারণ গুণক হল যে স্রষ্টার সব উদাহরণেই স্রষ্টা এক সুস্পষ্ট, পরিচিত জানা বস্তু বা ক্রিয়া । এখন পর্যন্ত এমন কোন ক্ষেত্রে স্রষ্টা কথাটা আরোপ করা হয়নি যা অজানা, অপিরিচিত অস্পষ্ট এবং যা বিতর্কিত নয় । এখন আসা যাক মূল কথায়। যদি এমন এক বস্তু বা ক্রিয়ার সন্ধান মেলে যার কোন কারণ এখনও চিহ্নিত হয় নি এবং যার অন্য কোন উদাহরণও নেই। সেই ক্ষেত্রে সেই বস্তু বা ক্রিয়ার স্রষ্টা বলাটা যৌক্তিকভাবে ভুল। কারণ স্রষ্টা শব্দটাই উদ্ভাবিত হয়েছে সৃষ্ট বস্তুর জানা কারণের ক্ষেত্রে, যেখানে কারণ থাকাটাও আরোহ পদ্ধতির দ্বারা অনুমিত। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিশেষ বস্তু বা ক্রিয়াটির কোন কারণ থাকাটা আরোহ পদ্ধতির দ্বারা নিশ্চিত করা যায় না। থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। এখানে কারণের ধারণাটা যুক্তিসিদ্ধ ঠিকই কিন্তু কারণ আছে কি নেই সে ব্যাপারে কোন সহায়ক ইঙ্গিত নেই। এই ক্ষেত্রে তাই স্রষ্টা শব্দটা ব্যবহার করাটাই ব্যকরণগত ভুল ও দর্শনসিদ্ধ নয়। অনেকে বলবেন কারণ আর স্রষ্টা, কি আসে যায় কোনটা বলা হয়, ব্যাপারটা ত একই। না একই নয়। স্রষ্টা বলার মধ্যেই অনিবার্যভাবে তার স্বরূপ জানা আছে এই ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন থাকে, যা ঠিক নয়। কিন্তু কারণ বললে কারণের স্বরূপ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়না, যেটা ঠিক, কারণ আসলেই ত স্বরূপটা অজানা । কারণ শব্দটা একটা সাধারণ বা সামান্যীকৃত শব্দ (General) , স্রষ্টা শব্দটা কারণের এক বিশেষ ক্ষেত্রে প্রজোয্য, যেখানে কারণটা চিহ্নিত হওয়া এক জানা বস্তু বা ক্রিয়া। এইটুকু বলার পর আর হয়ত বলে দিতে হবে না যে এই বিশেষ বস্তু বা ক্রিয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরন হল সমগ্র মহাবিশ্ব বা সৃষ্টি। তাই ধর্মবাদীদের ইশ্বর মহাবিশ্বের স্রষ্টা বলাটা গোড়াতেই এক যৌক্তিক ও ব্যকরণগত ভুল। তাঁরা যদি বলতেন মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ আছে তাখলে সেটা ভুল হত না (যদিও সেটা সত্যি না ম ইথ্যা সেটা অপ্রমাণিতই থাকবে)। ধর্মবাদীদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ আছে না বলে ইশ্বর মহাবিশ্বের স্রষ্টা বলাটার কারণটা স্পষ্ট। স্রষ্টাকে এক মহামানব হিসেবে চিন্তা করে মানবসুলভ কতগুলি মহাগুন দিয়ে ধর্মের বাণী প্রচার করতে আর শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয় করতে খুবই সুবিধা হয় আর নিজেকে প্রবোধ দিতে সুবিধা হয়, মৃত্যু আর বিপদ আপদের চিন্তা থেকে। ইশ্বরের যে সংজ্ঞায়ক গুণের বর্ণনা দেয় ধর্মবাদীরা যেমন সর্বশক্তিমত্তা, সর্ব্বুদ্ধিমত্তা, সর্বদয়ালুতা সবই ত মানুষ থেকে লব্ধ গুণাবলী, শুধু সীমিতের জায়গায় অসীম বলা। আর ধর্মীয় গ্রন্থে ত আরও একধাপ এগিয়ে স্রষ্টার ক্রোধ, হিংসাপরায়নতা, বিচার করা, ভয় দেখান, সিনহাসনে আসীন হওয়া ইত্যাদির কথা বলা হয়, যা সবই মানুষ থেকে লব্ধ । এমন কোন গুণএর বর্ণনা নেই যা মানুষের মধ্যে চিন্তা করা যায় না। তাই ধর্মের ইশ্বরকে নরাত্মক (Anthropomorphic) বলা হয়। ধর্মের ইশ্বর হলেন এমন এক মানব যার সেই মহাগুণ গুলো আছে অথচ তারঁ দেহ নেই, মগজও নেই। যে সব গুনগুলি মানুষ থেকে লব্ধ তা মানুষ নয় এমন কিছুর উপর আরোপ করা ব্যকরণ ও যুক্তির বিচ্যুতি। ধর্মবাদীরা যদি ইশ্বরকে সংজ্ঞা দিতেন যে ইশ্বর উক্ত মহাগুণসম্পন্ন এক মহামানব (মানুষের সব দৈহিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ) যিনি মহাবিশ্বের অজানা কোন এক স্থানে থাকেন তাহলে সেটা যুক্তির আর ব্যকরণের আলোকে অসঙ্গত হত না। সে ক্ষেত্রে সেই মহামানব আসলেই আছেন কিনা সেটা নিয় তর্ক, কল্পনা ইত্যাদি করা যেত, যেমনটি করা যায় ভিন কোন তারার কোন গ্রহ আছে কিনা যেটা পৃথিবীর মত প্রাণে ভরপুর, বা পক্ষীরাজ ঘোড়া (যা ব্যকরণগত ভাবে সুসংজ্ঞায়িত) আছে কিনা ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা হল যে দেহমান কোন অতিমানব/ মহামানব ই হোক বা যুক্তি ও ব্যকরণ পরিপন্থী নির্দেহ কোন অতিমানব হোক, ধর্মবাদীদের দেয়া তাঁর গুণাবলীগুলি কিন্তু পরস্পর বিরোধী। এর সবগুলি একসঙ্গে সত্য হওয়াটা যুক্তিকে লঙ্ঘন করে। এটা অনেক দার্শনিক অনেক দিন ধরেই প্রমাণ করে আসছেন। ডকিন্স, স্টেঙ্গার ও নতুন করে এই স্ববিরোধিতাটাই তুলে ধরেছেন সাধারণ পাঠকদের কাছে। আমিও আমার লেখা “স্বাধীন ইচ্ছা, মন্দ ও ইশ্বরের অস্তিত্ব” সেই একই চেষ্টা করেছি। সেই অর্থে বলা যায় যে ধর্মবাদীদের ইশ্বর (তা সেটা দেহমান অতিমানব/ মহামানব ই হোক বা যুক্তি ও ব্যকরণ পরিপন্থী নির্দেহ কোন অতিমানব ই হোক) বলে কিছু নেই। কারণ সংজ্ঞায়ক ধর্মই যদি না থাকতে পারে তা হলে সংজ্ঞার বস্তু থাকাটাও অযৌক্তিক হয়ে পড়ে। ডকিন্স ও স্টেঙ্গার হয়ত সেই অর্থেই ধর্মবাদীদের ইশ্বর নেই বলেছেন। কিন্তু ধর্মবাদীদের ইশ্বরের সংজ্ঞা (গুণাবলী বাদে, অর্থাৎ ইশ্বর বিশ্বের স্রষ্টা আর ইশ্বর মানবিক গুণের অধিকারী কিন্তু নির্দেহ এই অংশটি) যে যুক্তিসিদ্ধ বা ব্যকরণসিদ্ধ সেটা বলাটা ভুল হবে। সেটা ডকিন্স ই বলুন আর স্টেঙ্গারই বলুন বা স্বয়ং ইশ্বরই বলুন। ধর্মবাদীরা যদি ইশ্বরকে দেহমান অতিমানব হিসেবে সংজ্ঞা দিত আর এমন কতগুলি গুণাবলীর বর্ণনা দিত, যা পরস্পর বিরোধী নয় তাহলে সেই ইশ্বরে নেই বলে নাকচ করা যেত না শুধু যুক্তি দিয়ে। যেমন পক্ষীরাজ় ঘোড়া নেই তা শুধু যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না, যদি না পক্ষীরাজ ঘোড়া বায়ুগতিবিজ্ঞানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ না হয়।
ইশ্বরের এমন কোন সংজ্ঞা যদি দেয়া যায় যা যুক্তি বা দর্শনসিদ্ধ তাহলে সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী ঈশ্বর আছেন বা নেই দুটো বলাটাও যুক্তিসিদ্ধ হবে এবং সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে দুটোই বিশ্বাস হিসবে গণ্য করা যেতে পারে। যেমন ইশ্বরকে কে যদি কেউ বিশ্ব সৃষ্টির কারণ (কারণের স্বরূপ অনুক্ত রেখে) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন তাহলে সেই কারণ আছে বা নেই দুটোই বলাটা গ্রহণযোগ্য অবস্থান। এর প্রথমটিকে দার্শনিক অর্থে আস্তিক আর দ্বিতীয়টিকে দার্শনিক অর্থে নাস্তিক বলা চলে। এর কোনটাকেই যুক্তি বা বিজ্ঞান দিয়ে ভুল বা সত্য প্রমাণ করা যায় না। এই ক্ষেত্রে নাস্তিকতাও একটা বিশ্বাস, যেমনট আস্তিকতা। আরও একটা কথা বলা দরকার। এটা বেশ কিছুদিন ধরেই জানা আছে যে শুধু পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মের অভিব্যক্তির কারণেই পর্যবেক্ষিত মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। পদার্থ বিজ্ঞানের নতুনতম গবেষণার দ্বারা এই সম্ভাবনা আরও জোরদারই হচ্ছে। কাজেই বিশ্ব সৃষ্টির কারণ না বলে ইশ্বরকে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের কারণ বলে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। এই কারণ সদা অজানাই থেকে যাবে। কাজেই এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আস্তিক, নাস্তিক ও এক valid বিশ্বাসে বিশ্বাসী। শুধু এই সংজ্ঞার অজ্ঞেয়বাদীদের বিশ্বাসী বলা যায় না কারণ অজ্ঞতা স্বীকার করেই তাঁরা ইস্তফা দেন। বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটার বস্তুনির্ভর কোন কারণ নেই বলে কোনটাই তারা গ্রহণ করতে পারেন না । তবে এই তিন অবস্থানের মধ্যে স্থান পরিবর্তন অবশ্যই করা যায় যুক্তি বা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে না গিয়ে, নিছক ব্যক্তিগত অনুভূতির তাগিদে।
অপার্থিব,
আপনার লেখাটার সাথে বিভিন্ন জায়গায়ই দ্বিমত পোষণ করছি। কিন্তু সময়ের অভাব এতই যে প্রকট যে সেই বিতর্কে না গিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করি, আশা করি তা তে আর কারও হোক বা না হোক, আমার আপনার কথাগুলো বুঝতে সুবিধা হবে। আমার কঠিন বাংলা ( এবং অবশ্যই কঠিন ইংলিশ) বুঝতে খুব কষ্ট হয়, যুক্তির পিছনের কঠিন দর্শন এবং জ্ঞানতত্ত্বগুলো দেখলে ভয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে, তাই কয়েকটা সোজা ( বোকার মতও বলতে পারেন) প্রশ্ন করি, আশা করি, ধৈর্য সহকারে উত্তর দিবেন।
১) আচ্ছা ধরুন, কেউ আমাকে বললো, সে ভুতে বিশ্বাস করে, আমি বললাম ভুতপ্রেত বলে কিছু যে আছে তার কোন প্রমাণ নেই, এটা নিতান্তই একটা কুসংস্কার। তাহলে কি আমি ভুতে বিশ্বাসীদের মতই বিশ্বাসী হয়ে গেলাম? এখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি, ভুতের সংজ্ঞা দিন আগে, তারপর বলবো আমি কি মনে করি। সমস্যাটা হল, ভুতের তেমন কোন সলিড সংজ্ঞা নেই, আর যাও বা আছে সেটা আবার জায়গা ভেদে বদলে যায় (অথবা সব সংজ্ঞাই কেবল “ভুতবিশ্বাসী”দের দেয়া সংজ্ঞাই)। যেমন, আমাদের দেশের কঙ্কালসদৃশ, শেওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা খারাপ ভুত, মামদো ভুত, পেত্নী, শাকচুন্নী বা পশ্চিমের ক্যাস্পারের মত সাদা মোটাসোটা আর হাসিখুশি ভালো ভুত, ইত্যাদি…। তাহলে আমি এখন কি করবো, ভুতে বিশ্বাস করিনা বা ভুত বলে কিছু নেই এর মত ‘যৌক্তিক’ কথা বললে যদি আমি ‘বিশ্বাসী’ র সাথে একই কাতারে পরে যাই, তাহলে আমার সেক্ষেত্রে করনীয় কি?
২) আমার তো মনে হয়, ‘আস্তিক আর নাস্তিক উভয়েই বিশ্বাসী ছাড়া আর কিছুই নয়’, এই কথাটা অনেককেই সীমাহীন আনন্দ দিলেও ব্যাপারটা এত সোজা নয়। বরং বেশীরভাগ নাস্তিকই আসলে আংশিকভাবে অজ্ঞেয়বাদী, অন্ততপক্ষে যারা বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। কিন্তু ধর্মীয় সংস্কারে ভরা এই পৃথিবীতে খুব সহজভাবে নিজেদের ‘নাস্তিক’ বলেই থাকেন। আমি যত নাস্তিক জানি, তাদের বেশীরভাগই বলেন যে, তারা কেউ অরগানাইজড ধর্মের কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু আর অন্য কিছু আছে কি না সেটা সম্পর্কে ১০০ ভাগ নিশ্চিত না। আপনি যদি দেখেন ঐ ঈশ্বর বিশ্বাসের পরিমাপের লেখাটায় যারা মন্তব্য করেছেন তাদের বেশীরভাগই তাই বলেছেন, নিজেদেরকে ৭ এ ৭ না দিয়ে ৬ দশমিক কিছু একটা দিয়েছেন। তাহলে তারা আপনার দৃষ্টিতে কোন ক্যাটাগরীতে পড়বে?
বন্যাদি ঠিক বলেছেন। নাস্তিকতার ইংরেজী প্রতিশব্দ atheism. -ism একটি suffix এক্ষেত্রে যার অর্থ “doctrine, system of beliefs”. কিন্তু প্রথাগত system of belief এর ভিতর নাস্তিকদের ফেলা যায় এটা মনে করলে খুব ভুল হবে। আমি জানি না কেন নাস্তিকতাকে একটি “ism” বলা হয় কিন্তু নাস্তিকতা যেহেতু কোনো সংগঠন না এবং প্রতিটি নাস্তিকের স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা ভিন্ন তাই শুধু সংজ্ঞা দিয়ে নাস্তিকদের মধ্যে জেনারেলাইজেশন ঠিক না।
@বন্যা আহমেদ,
বন্যা,
আমার মনে হয় কঠিন বাংলা বা যুক্তির পিছনে কঠিন দর্শন (নাকি দর্শনের পেছনে কঠিন যুক্তি?) যাই বল এর প্রতি ভয় পাওয়ার কারণ এই নয় যে এগুলো আসলেই কঠিন। কত এভারেজ লোক ও ত দেখি PhD করে বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়ে। আসলে আমার থিওরী হল যে যুক্তির মাধ্যমে অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখী হওয়া বা নিজের ভুলকে স্বীকার করার ভয় থেকেই একে কঠিন মনে করার অনুভূতি বা কারণ জন্মায়।
যাহোক চমৎকার প্রশ্ন করেছ ভূত নিয়ে। এ ব্যাপারটা নিয়ে আমিও বেশ চিন্তা করেছি। মোটেই বোকা প্রশ্ন নয় আমার মতে। একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে ঈশ্বর আছেন কি নেই বা ঈশ্বর কি, ভূতের ব্যাপারেও প্রায়ই একই প্রশ্নই ওঠে । আমি ঈশ্বরের সংজ্ঞা নিয়ে যা যা বলেছি তার অনেকটাই ভূতের ব্যাপারেও প্রযোজ্য। ভূতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস ভূতের যৌক্তিক সংজ্ঞায়ন(যা সর্বগৃহীত/সর্বসম্মত) এর উপর নির্ভর করে, যা সত্যি বলতে নেই । সঠিক সংজ্ঞা না থাকলেও কতকগুলি সাধারণ যুক্তি দিতে পারি আমরা। যেমন তুমি প্রশ্ন করেছঃ
কোন এক বিশেষ কিছুর অস্তিত্বের প্রমাণ নেই বলা, আর সেই বিশেষ কিছু যে নেই সেটা বলা, দুটো কিন্তু এক নয়। প্রথমটা হল একটা denial, আর দ্বিতীয়টি হল এক positive assertion, প্রথমটি বিশ্বাস নয়, দ্বিতীয়টি বিশ্বাস হবে যদি ভূতের যৌক্তিক সংজ্ঞায়ন দেয়া যায় আর সেই সংজ্ঞায়িত ভূত না থাকার পক্ষে কোন বস্তুগত সাক্ষ্য প্রমান না দেয়া যায়। কাজেই শুধু তোমার উপরের উত্তরের কারণে তুমি ভূতে বিশ্বাসীদের মতই বিশ্বাসী হয়ে যাবে না আমার মতে। ভূতের সঠিক সংজ্ঞা থাকুক আর না থাকুক ভূত আছে বলে কেউ দাবি করলে তার উত্তরে ভূত যে আছে তার কোন প্রমাণ নেই বলাটা যুক্তিসিদ্ধ এবং বিশ্বাসের কাতারে পড়ে না। তোমার অন্য প্রশ্ন:
তার উত্তরেও একই ভাবে বলব যে “ভুতে বিশ্বাস করিনা বা” বলাটা বিশ্বাস নয়, এটা “ভূত যে আছে তার কোন প্রমাণ নেই” কে ঘুরিয়ে বলা। আর যখন তুমি বল “ভুত বলে কিছু নেই”
তখন তুমি যদি মীন করে থাক যে ভুতের কোন অর্থবহ সংজ্ঞা নেই (যার সংজ্ঞা নেই সেটা নেই বলাটা সমার্থক) তাহলেও তুমি বিশ্বাসীর কাতারে পড়ছ না । আমার মতে অনেকে ঈশ্বর বলে কিছু নেই বা ভূত বলে কিছু নেই (“বলে” কথাটা এখানে খুব ইঙ্গিতবহ) যখন বলে তখন অবচেতনভাবে এদের সঠিক সংজ্ঞা নেই বোঝাতে চায়। কিন্তু যদি তুমি মীন করে থাক যে ভূতের অর্থবহ সংজ্ঞা আছে কিন্তু সেই সংজ্ঞায়িত ভূত নেই, এই দাবীই করছ তাহলে সেটা বিশ্বাসের শ্রেণীতে পড়বে । অবশ্য তোমার এই বিশ্বাস আর এই সংজ্ঞামতে ভূতে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস এক কাতারে পড়ে না। তোমার বিশ্বাসটা বাস্তবের নিরীখে বেশী সম্ভাব্য। কারণ আসলেই ত বাস্তবে ভুত আছে বলে কোন নৈর্ব্যক্তিক সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সেটা যে সংজ্ঞাই হোক না কেন যেমন শেওড়া গাছে পা ঝুলান বসে থাকা ভুত, মামদো ভুত, পেত্নী, শাকচুন্নী ইত্যাদি। এগুলোর স্পষ্ট চিত্র আর বৈশিষ্ট্য দেয়া আছে রূপকথায়। যেমনটি বলা যায় পক্ষীরাজ ঘোড়ার বেলায়ও। কিন্তু হনেস্টলি এই সংজ্ঞাগুলো নিয়ে ত সিরিইয়াস কোন ডিবেট করা যায় না, বা ভূত আছে বলে যারা সিরিয়াসলী দাবী করে তারা এই সংজ্ঞাগুলি মেনে ত আর বিশ্বাস করে না । যুক্তির সুবিধার্থে ঊপমা হিসেবে এগুলোর ব্যবহার । ভূত আছে বলে যারা দাবী করে তারা ভূতের কোন সঠিক সংজ্ঞা না দিয়েই ভূতে বিশ্বাস করে শুধু ব্যক্তিগত কিছু সাক্ষ্য(Testimomny) বা অভিজ্ঞতার (নিজের বা অন্যের) কারণে, যা যুক্তি বা বিজ্ঞানে মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য নয়। এরকম সাক্ষ্য বা অভিজ্ঞতা অনেক যুক্তিবান লোকের জীবনেও ঘটতে দেখা গেছে। এগুলোকে অব্যাখ্যায়িত প্রপঞ্চ (Unexplained Phenomena) নামে শ্রেণীভুক্ত। ডিস্কভারী চ্যানেলে এরকম অনেক ব্যক্তিগত সাক্ষ্যের উদাহরণ দেখান হয়েছে। এখানে বলা দরকার যে এই সব ক্ষেত্রে ভূতের কোন সঠিক সংজ্ঞা মুখ্য নয়, কতগুলি effects বা Phenomena যার কোন জানা কারণ খুঁজে পাওয়া যায়না তার সাক্ষ্যটাই মুখ্য। কারণ অজানা থাকলে সেই অজানা কারণের একটা নামকরণ করে তার অস্তিত্বের দাবী করা এক চিরাচরিত প্রবণতা মানুষের, যার আরেক উদাহরণ বিশ্ব সৃষ্টির অজানা কারণ কে ঈশ্বর নামকরণ করে তার অস্তিত্বের দাবী করা। তফাৎ শুধু এই যে মহাবিশ্ব একটা নৈর্ব্যক্তিক সাক্ষ্য, সবাই এর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেন। অব্যাখ্যায়িত প্রপঞ্চ ব্যক্তিগত সাক্ষ্যের পর্যায়ই আছে এখনো, যা সবাই প্রত্যক্ষ বা স্বীকার করেন না।
আমার মতে ভূতে বিশ্বাস না বলে অশরীরি ভয় বলাটা বেশি অর্থবহ। ভুতের কোন সংজ্ঞা না দিয়েও বা সেই সংজ্ঞার ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করলেও অশরীরি ভয় পাওয়া সম্ভব। একজন যুক্তিবাদী লোক ও গভীর রাতে একা শ্মশান বা গোরস্থান দিয়ে হেঁটে যেতে ভয় পেতে পারেন। এটা বিবর্তন জনিত এক প্রবৃত্তির কারণে। অন্ধকার অ নির্জনতা কে কে ভয় পাওয়া বিবর্তনজনিত এক আদিম প্রবৃত্তি। কারণে। আদিম যুগে অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদকে দেখতে না পেয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে অনেককে যারা উত্তরসূরী রেখে যেতে পারেনি । কাজেই যারা অন্ধকারকে ভয় করত তারাই উত্তরসূরী রেখে গেছে। একই কথা বলা যায় “একাকীত্ব কে ভয় পাওয়ার ব্যাপারে। আদিম যুগে হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণ থেক রক্ষা পেতে দলে থাকাটা খুবই জরুরী ছিল, একা হলে মারা যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। আর গোরস্থান বা শ্মশান বা পোড়বাড়ী নিয়ে এত অশরীরী প্রপঞ্চের সাক্ষ্য লোক কাহিণী, জনশ্রুতি আর ডকুমেন্টারীতে পাওয়া যায় যে সেটাও মানুষের মনে কালচারাল কন্ডিশনিং এর কাজ করে ভয় সৃষ্টিতে।
এবার আসি তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নে ।
‘আস্তিক আর নাস্তিক উভয়েই বিশ্বাসী ছাড়া আর কিছুই নয়’ কথাটা শুধু উপরিউপরি বিচার করলে ভুল হবে। আমার আলোচনায় আমি বলেছি কখন বা কোন বিশেষ ক্ষেত্রে নাস্তিকতা বিশ্বাসের শ্রেনীভুক্ত হবে (আবার পড় প্লীজ, নাহলে পুনরুক্তি করতে হবে, যেটা বাঞ্ছণীয় নয়)। ইশ্বরকে পদার্থ বিজ্ঞানের কারন হিসেবে সংজ্ঞা দিলে উভয়ই বিশ্বাসীদের সত্য মিথ্যা হবার সভাবনা সমান, অন্তত একটা কম আর অন্যটা বেশি সম্ভাব্য বলার কোন কারণ নেই। কিন্তু ঈশ্বরকে এক অতিমানব (মানুষের সব দৈহিক বৈশিষ্ট্য সহ) যার অসীম ক্ষমতা, যিনি মহাবিশ্বের কোন অজানা স্থানে অবস্থান করেন,সেই সুসংজ্ঞায়িত ইশ্বরের সংজ্ঞা অনুযায়ী যারা আস্তিক বা নাস্তিক, তারা উভয়ই বিশ্বাসী হলেও ঐ দুই বিশ্বাসী এক কাতারে পড়ে না । ভূতের আলোচনার মতই এখানেও এই সংজ্ঞামতে নাস্তিকের বিশ্বাস অনেক বেশী বাস্তবসম্মত আস্তিকদের বিশ্বাসের চেয়ে। আর ঈশ্বর বিশ্বাসের পরিমাপে যারা ৬ থেকে ৭ এর মধ্যে তারা আমার দৃষ্টিতে কোন ক্যাটাগরীতে পড়ে জিজ্ঞেস করেছ। প্রথমত ক্যাটাগরীটা ত আমার সৃষ্টি নয় আর যে সংজ্ঞাকে ভিত্তি করে এই ক্যাটাগরীটা করা হয়েছে সেটা ধর্মবাদীদের সংজ্ঞা যা ডকিন্স ও মেনে নিয়েছেন, যদিও আমি এই সংজ্ঞাকে যুক্তিসিদ্ধ বলে মানি না। কেন সেটার ব্যাখ্যা ত দিয়েইছি আমার লেখায়। যাহোক যিনি ৬ থেকে ৭ এর মধ্যে নিজকে বলছেন (৬.৫ ই বলি), আমার পালটা প্রশ্ন হবে তিনি কিভাবে এই দশমিক অংশটি স্থির করলেন? এটা ত খুব ঘোলা এক সংখ্যায়ন। এমনিতেই ৬ এর সংজ্ঞা (আবার সেই সংজ্ঞা ) বেশ ধূসর, যেমন (৬) এর সংজ্ঞা হল :
“খুবই কম”, “কার্যক্ষেত্রে” এগুলিত খুব ঢিলাভাবে সংজ্ঞায়িত, এবং ব্যক্তিনির্ভর। এখানে ৬ থেকে ৬.৫ এর মধ্যে তফাৎ তিনি কি ভাবে টানলেন? যদি টানাই যেত তাহলেত ৬.৫ কেই ৭ বলে ৭ কে ৮ নং ক্যাটেগরী বলা ঠিক হত। আমার কাছেত যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্নই দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা। নয় কি?
আমি যদি ইশ্বরকে সংজ্ঞায়ন(বিশ্বাস নয়) করতাম তাহলে আমি ইশ্বরকে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের কারণ সংজ্ঞা দিয়ে তিনটা কাটেগরী করতাম, আস্তিক, নাস্তিক আর অজ্ঞেয়বাদী। এই তিন কাটেগরীর মাঝামাঝি বা বাইরে থাকা অর্থহীন হত এই সংজ্ঞা অনুযায়ী (সেট থিওরীর মৌলিক ধারণা) ।
@অপার্থিব,
প্রায় চার বৎসর পূর্বে আমাদের শ্রদ্ধেয় মিজান ভাই তার এক প্রবন্ধে বলেছিলেন- বিশ্বাস না করাও এক প্রকারের বিশ্বাস।
http://www.mukto-mona.com/Articles/mizan_rahman/out_of_context.pdf
একটা গোলক ধাঁধায় পড়া গেল যেন।
বাঁচা গেল। আমি যদি একই ভাবে বলি “আল্লাহ বলে কিছু নেই”
তাহলে আমিও বিশ্বাসীর কাতারে পড়ছি না। কারণ- আল্লাহর কোন অর্থবহ সংজ্ঞা নেই, আর আল্লাহ আছে বলে কোন নৈর্ব্যক্তিক সাক্ষ্য প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
শেওড়া গাছে পা ঝুলান বসে থাকা ভুত, আর আমার কাঁধে কলম হাতে চড়ে বসা দুই ফেরেস্তা, কথাটা তো সমানই।
তাহলে কি আমরা উপসংহার টানতে পারি- নাস্তিকতাও এক প্রকারের বিশ্বাস নয়?
@আকাশ মালিক,
বাঁচতে গিয়ে শেষ রক্ষা হল না :laugh: , “আর আল্লাহ আছে বলে কোন নৈর্ব্যক্তিক সাক্ষ্য প্রমাণও পাওয়া যায়নি” কথাটা যোগ করার জন্য। যদি “আল্লাহ বলে কিছু নেই” বলতে সত্যি মীন করে থাকেন যে আল্লাহর কোন অর্থবহ সংজ্ঞা নেই, (“বলে” কথা দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে ওটাই মীন করা হচ্ছে) তাহলে নৈর্ব্যক্তিক সাক্ষ্য প্রমাণ অর্থহীন হয়ে পড়ে। নৈর্ব্যক্তিক সাক্ষ্য প্রমাণের প্রশ্ন ওঠে যদি আল্লাহ যুক্তিসিদ্ধ ভাবে সংজ্ঞায়িত হয়।
আমই ত মনে করি আমি খুব পরিস্কার ভাবেই বুঝিয়েছি নাস্তিকতা কখন বিশ্বাস হতেও পারে। কাজেই ঢালাও ভাবে কি করে উপরের উক্তি করা যায়? নাস্তিকতা কেবল তখনি বিশ্বাস হবে না যখন ঃ
(১) কেউ ঈশ্বর আছেন এর জবাবে ্সেই নাস্তিক ঈশ্বর “বলে” কিছু নেই বলেন, ঈশ্বরের যুক্তিসিদ্ধ সংজ্ঞা নেই কারণ দেখিয়ে।
(২) ঈশ্বরের যুক্তিসিদ্ধ সংজ্ঞা আছে মেনে নিয়ে সেই নাস্তিক সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করেন যে তেমন ঈশ্বর থাকাটা অসম্ভব।
হ্যাঁ, যদি ফেরেশ্তাকে পক্ষীরাজ মানুষ হিসেবে সংজ্ঞা দেয়া হয় আর যার বাকী সব বৈশিষ্ট্য হয় বই এর বর্ণনামত। আমি ধরে নিয়েছি শেওড়া গাছে পা ঝুলান বসে থাকা ভুত সুসংজ্ঞায়িত, দেখতে কেমন, মানুষের মত দেহ এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক গুণাবলী (বা দোষাবলীগুলো :laugh: ) ইত্যাদি। দেহহীন কোন মানবকে (তা সে মানবের গুণের পরিমান সসীম বা অসীম হোক) কল্পনা করা এক গোল চ্তুর্ভুজ বলার সামিল।
@অপার্থিব,
ভূতের যৌক্তিক সংজ্ঞায়ন আপনি দিবেন কি করে, জানার আগ্রহ রইলো। তবে বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা সম্ভব নয়, এটা আমি এখনই বলতে পারি। কোনকিছুর বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞার মূলে পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। পর্যবেক্ষণ-ব্যতিরেকে কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা বিজ্ঞানের দর্শনের দৃষ্টিতে অর্থহীন। ভূতে অবিশ্বাস কিন্তু একশভাগ বিজ্ঞানসম্মত অবস্থান। আসলে, বিশ্বাস কথাটাই বৈজ্ঞানিক আলোচনায় আনা উচিত নয়। অন্য প্রমিত শব্দ ব্যবহার করা উচিত। যেমন, E=mc^2 এ আমি বিশ্বাস করি, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই কথার কোনো মানে নেই। আমি বিশ্বাস করি কি করি না সেটা বিজ্ঞান-সম্মত আলোচনাও নয়। আমরা আলোচনা করতে পারি, সূত্রটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কিনা? বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কথাটিকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি, যেটা আমি মনে করি ইতোমধ্যে সংজ্ঞায়িত: যা পর্যবেক্ষণগতভাবে বারংবার যাচাইযোগ্য, তাই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।
আর থাকে অন্যসব বিষয়ের আলোচনা, যার কোনো পর্যবেক্ষণ নেই, যাচাইয়ের প্রশ্নতো পরে। যেমন, ভূত, প্রেত, লিলিপুট মানুষ, অশ্বের ডিম্ব। এগুলোর সংজ্ঞার মূলে পর্যবেক্ষণ নেই। কোনো পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যার জন্যও এগুলোর প্রয়োজন পড়বে না কোনোকালে। এগুলো বিজ্ঞানের আলোচ্যই নয় (তথাপি বিজ্ঞানের আলোচ্য নয় এমন অনেক বিষয় নিয়ে অনেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করার চেষ্টা করেন, যা বিজ্ঞানের দর্শনের বিপরীতে যায়)।
আমি এগুলোতে বিশ্বাস করি কি করি না, নাকি অজ্ঞেয়বাদী, সেই তর্ক অনর্থক। কারণ, বিষয়টিই বিজ্ঞানের আলোচনায় অনর্থক বিষয়। ফলে, কেউ যদি বলেন, ভূত বলে কিছু নেই, সেটা এক অর্থে ভূত বলে কিছু আছে এই কথাটির মতই অনর্থক। শুদ্ধ কথাটি সম্ভবত, ভূত সংক্রান্ত তর্ক অনর্থক। তবে, অধিকাংশ-ক্ষেত্রে আমরা ভূত বলে কিছু নেই বলতে ভূত সংক্রান্ত তর্ক অনর্থক জাতীয় মতই প্রকাশ করি। সেই অর্থে, ভূত বলে কিছু নেই যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য একটি বক্তব্য।
@ধ্রুব, দর্শনের ক্লাসে আপনি কিংবা আমি হয়তো অপার্থিবের মত ভালো নাম্বার পেয়ে পাশ করতে পারবো না , কিন্তু ভুত নিয়ে আমাদের কনসেপ্টট যে একেবারে পরিষ্কার এবং এর উপরে “ভুতোলজি” বলে কোন কোর্স থাকলে যে সেটাতে বেশ ভালো করবো এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই 🙂
@ধ্রুব,
ভূত, ঈশ্বর, আত্মা, এ সবই যে বিজ্ঞানের নিরীখে অর্থহীন বা অমেয় সেটা একটা truism ই বটে। কারণ বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণ এর বাইরে বা Falsifiable নয় এমন কোন ধারণার স্থান নেই। সে জন্যই string theory কে অনেকে mainstream বিজ্ঞান বলে না। কিন্তু তাই বলে পর্যবেক্ষণযোগ্য বা Falsifiable নয় এমন সব ধারণার আলোচনা ত থেমে যাবেনা। দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা ত আছেই এই কারণে। আসলে ভূত, প্রেত, এদের ধারণার জন্মই হয়েছে কিছু কথিত কার্য (effects) থেকে কারণের কল্পনা থেকে। সেই effects গুলি পর্যবেক্ষণযোগ্য, কিন্তু controlled environment এ ঐ effects গুলি repeatable নয় বলে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের শর্ত মেটায় না। ছায়ামূর্তি প্রত্যক্ষ, দরজা নিজ থেকে খুলা, ইত্যাদি ভৌতিক effects গুলি ব্যক্তিগত সাক্ষ্য হিসেবে ভূতের ধারণার জন্ম দিয়েছে। যে নিজে ওগুলো প্রত্যক্ষ্য করেছে এবং সে নিশ্চিত যে সে মাদক এর প্রভাব বা কোন ঘোরের মধ্যে ছিলনা, তাহলে সেই কার্য গুলির এক কারণ আছে বলে প্রকল্প দেয়াটা অযৌক্তিক হবে না। কিন্তু আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সে কথিত কারণের গুণাবলির বর্ণনা দেয়াটা, সেটা অযৌকতিক হবে।
ধন্যবাদ আমার মনের কথাটিই গুছিয়ে বলার জন্য।
কেউ কেউ ‘প্রমান’-এর কথা বলেন। প্রমানিত হয়ে গেলে আর বিশ্বাসের প্রয়োজন পড়েনা। তখন আস্তিক/নাস্তিক আর অজ্ঞেয়বাদী সবাই প্রমানিত বিষয়েরই অনুসরন করেন।
সংজ্ঞা নিয়ে কথা হচ্ছে, সুসংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমি আমার সম্প্রতি লেখায় আলোচনা করেছি। আমার মতে সকল জ্ঞানের উত্স হলো পর্যবেক্ষণ; পর্যবেক্ষণ দিয়ে যে জ্ঞানকে যাচাই করা যায় না, তা অর্থহীন। এর নিরিখে এই আলোচনাটা করা যায়।
[img]http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/f/fc/Sivakempfort.jpg/275px-Sivakempfort.jpg[/img]
তাহলে এই গড আপনার জন্য পারফেক্ট, তাতে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন তর্ক করতে পারবেন কারন তা ব্যকরণগত ভাবে সুসংজ্ঞায়িত।
তবে মুসলিমরা ঐ দিকে যায় না, তা আমাদের মুসলিম৫৫ এর কথা-ই ফুটে উঠে,
যারা Karen Armstrong-এর History of God বইটি পড়েছেন বা অন্তত দেখেছেন, তারা হয়তো দেখেছেন যে, ঐ বইয়ের প্রচ্ছদে এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর আঁকা একটা চিত্র রয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে যে, শূন্যে ভাসমান বিশাল দাড়ীওয়ালা এক পক্ককেশ বৃদ্ধ এক তরুণের দিকে হাত বড়িয়ে আছেন, আর মনে হচ্ছে যে তরুণটি তাকে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য এই ছবির ঐ বৃদ্ধকে চিত্রকর ঈশ্বর বলে বোঝাতে চেয়েছেন, আর, তরুণটি হচ্ছে মানবসন্তান। গ্রেকো-রোমান “দর্শন” দ্বারা প্রভাবিত এবং নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া খৃষ্টধর্মের ঈশ্বরের ধারণা “নরত্ব আরোপ” বা anthropomorphism-এর সীমা ছাড়িয়ে বেশীদূর যেতে পারেনি। এছাড়া ঈশ্বরের সাথে যীশুর বাপ-ছেলে সম্পর্ক হয়তো এ ব্যাপারে সহায়ক হয়ে থাকবে। ঈশ্বরকে কল্পনা করার চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ যখনই নিজের আবেগ, ভয়, আশা, নিরাশা ইত্যাদি সহ তার অত্যন্ত সীমিত মেধার উপর নির্ভর করেছে, তখনই সে তার পরিচিত জগত থেকে কোন একটা বা একাধিক চেহারার মিশ্রণকে ঈশ্বরের চেহারা বলে জ্ঞান করেছে। গ্রেকো-রোমান, মিশরীয় বা অন্যান্য পুরাতন সভ্যতা থেকে নিয়ে এপর্যন্ত ব্যাপারটা তাই থেকেছে।
এ ব্যাপারে ইসলাম প্রায় সকল ধর্মের চেয়ে আলাদা। গত লেখাটায় যেমন বলেছি, “আর কিছুই আল্লাহর মত নয়” – এটা হচ্ছে আল্লাহ্ সংক্রান্ত ইসলামী ধারণার এক অবিচ্ছেদ্য মূলনীতি। আবু বক্বর (রা.)-এর একটা বিখ্যাত বাণী রয়েছে এই প্রসঙ্গে, যার সারমর্ম হচ্ছে এরকম যে, “তোমার মনে আল্লাহ্ সম্বন্ধে যে ধারণাই আসবে, আল্লাহ্ তার সবকয়টির চেয়ে আলাদা।” সোজা বাংলায় বলতে গেলে যে কোন মানুষ আল্লাহ্ সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে, আল্লাহকে যা কিছুর মত ভাববে – আল্লাহ্ তার কোনটির মতই নন। এছাড়া ইসলামী ধর্মতত্ত্ব পড়াতে গিয়ে স্কলাররা বলেন যে, Deification of humans অথবা Humanization of the Deity এ দু’টোই হচ্ছে শিরকের মত অমার্জনীয় পাপের দু’টো প্রধান উৎস। উদাহরণস্বরূপ শ্রদ্ধা করতে করতে রবীন্দ্রনাথকে কিছু মানুষ এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন যেটাকে অনায়াসে Deification of humans বলা যায় – আর তারাও তাই তাকে “গুরুদেব” বলে ডাকতে পারেন নিঃসঙ্কোচে।
যাহোক, আল্লাহর পরিচয় জানার ব্যাপারে ইসলামী ধর্মতত্ত্বের আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে, আল্লাহ্ সংক্রান্ত আক্বীদাহ্ [বা সাধারণভাবে সকল আক্বীদাই] কেবল অহী বা প্রত্যদেশ থেকে গ্রহণ করতে হবে – তাতে নিজস্ব “মনের মাধুরী” মেশানো যাবেনা।
@ফুয়াদ,
ছবি বাংলা ওকিপিডিয়া থেকে দেওয়া হয়েছে।
আমি ‘অপার্থিব’ এর একজন ভক্ত। মুক্তমনায় লেখা তাঁর সবগুলো লেখাই আমি বিস্ময়মাখা আনন্দের সাথে পড়েছি। আবার আগের মত তাঁকে ফিরে পেয়ে কি যে আনন্দ হচ্ছে! আশা করি তিনি আমাদের জন্য নিয়মিত লেখা উপহার দিবেন।
এ লেখাটিও বেশ ভালো লাগল, দুয়েক জায়গায় যদিও আমার কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে।
@সৈকত চৌধুরী,
সৈকত, মনের কথা বলেছেন একেবারে। ভিন্নমতগুলো নাই উল্লেখ করি, পূর্বতন বিতর্কের রেশ যায় নাই। 🙂 তার চেয়ে বরং অপার্থিবের নতুন ভাবে আগমন এবং নতুন লেখা উপলক্ষে সেলিব্রেশন হোক!
অপার্থিবের লেখায় তার যুক্তিবিদ্যা পরিচিতির লিঙ্কটা যোগ করে দিলাম। এভাবে লিঙ্ক করে দিলে নতুন পাঠকদের জন্য সুবিধা হয়।
আচ্ছা – ঈশ্বর বানান টা ঈশ্বর না লিখে ইশ্বর লেখার কি আলাদা কোন কারণ আছে?
@অভিজিৎ,
না নেই। নিছক টাইপো। তবে কারণ না থাকলেও একটা বের যায় বটেhttp://blog.mukto-mona.com/wp-content/plugins/tango-smileys-extended/tango/smile.gif। একটা কিস্ট্রোক ত বাঁচে। যেমন আমেরিকানরা colour কে color লেখে। লিখে ফেলো কে “লিখা ফালাও”
বলা যায়, যেখানে কোন কিস্ট্রোক বাচল না, তাহলে ঈশ্বর কে ইশ্বর বলতে দোষ কোথায়http://blog.mukto-mona.com/wp-content/plugins/tango-smileys-extended/tango/laugh.gif। তাছাড়া ঈশ্বর কে উচ্চারণ করলে তা ইশ্বর উচ্চারণ করা থেকে খুব তফাৎ হয় কি? ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ অবশ্যই।
@অপার্থিব,
স্মাইলি চিহ্ন দিতে হলে http://blog.mukto-mona.com/wp-content/plugins/tango-smileys-extended/tango/smile.gif এত বড় লিঙ্ক দেবার দরকার নেই। লিঙ্ক দিলে হবে না। : ) টাইপ করলেই হবে। অথবা নীচে তো স্মাইলির একগাদা ছবি আছেই – ওগুলোতে ক্লিক করুন। 😀
আসলে আগে “স্মাইলীর” সংজ্ঞা ক্লিয়ার না করে লিখা শুরু করলে এমনি হয় :laugh: