পূর্ব থেকে পশ্চিম

 

পর্ব১০

 

নিউইয়র্ক সিটিমজার ব্যাপার হচ্ছে, এটি নিউইয়র্ক স্টেটের রাজধানী নয়, তার ধারেকাছের কিছুও নয়নিউইয়র্ক স্টেটের বর্তমান রাজধানী আলবেনীঅথচ ১৭৮৫ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত পুরো যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ছিলো এই নিউইয়র্ক শহরসাধারণের কাছে আলবেনীখুব একটা পরিচিত নাম নয়, কিন্তু সারা বিশ্বে একনামে পরিচিত নিউইয়র্ক শহরব্রঙ্কস্, ম্যানহাটন, ক্যুইন্স্, ব্রুক্‌লিন এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড এই পাঁচটি প্রশাসনিক এলাকায় বিভক্ত এই শহরের জনসংখ্যার পরিমাণ জানতে কোনো পরিসংখ্যানের দরকার পড়ে নাপাবলিক বাস কিংবা ট্রেনে উঠতে গেলেই টের পেয়ে যাবেননানা বর্ণের, নানা গোত্রের, নানা পেশার মানুষের সন্মিলনস্থল এই শহরের নামের আগে কি বিশেষণ দেয়া যায় সেটাই রীতিমত এক ভাবনার বিষয়অথবা বলতে পারেন নিউইয়র্কশব্দটা নিজেই এখন একটা বিশেষণ

 

ইউএসএর অন্য শহরগুলিতে যত ভালো করেই ইংরেজি বলার চেষ্টা করেন না কেন, তাদের বুঝতে একটু না একটু সমস্যা হবেইকিন্তু এই শহরে যা-কে যা-ই বলেন, দেখবেন সহজে বুঝে ফেলছেসম্ভবত এদেরকে এত বেশি পরিমাণ উপমহাদেশীয় ইংরেজী শুনতে হয় যে, এরা নিজদের ইংলিশ ভুলে গিয়ে উপমহাদেশীয় ইংলিশে অভ্যস্ত হয়ে গেছেতবে সে যাই হোক, এখানে এসে সবচেয়ে যেটা ভালো লাগবে, সেটা হলো দেশের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষপ্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশি এখানে আছেঅনেক বাংলাদেশী তথাকথিত ভদ্রলোককে অনেক সময় বলতে শুনেছি, বাংগালিদের যন্ত্রণায় নিউইয়র্ক শহরে হাঁটাচলায় করা যায় নাকিন্তু মুখে যতই বলুক না কেন, অন্তরের গভীরেতো তাদের সেই বাংলাদেশ আর বাংঙ্গালিতাই যতই যন্ত্রণাই করুকনা কেন, ঘুরেফিরে সবাই ফিরে ফিরে আসে সেই নিউইয়র্ক শহরেইজাতীয়তার টান উপেক্ষা করবে, ততটুকু বিবর্তন মনে হয় মানব মনে এখনো ঘটে উঠেনি

 

এখানে বাংলা আছে, আছে বাঙ্গালি, আছে সিঙ্গাড়া, সমুচা, বেগুনী, পেয়াজু, ভাত, ডাল, আলুর ভর্তা; আর যেটি না থাকলেই নয়, সবার আগে আছে বিখ্যাত আওয়ামীলীগ-বিএনপিএদের জীবনধারার সাথে একাকার হয়ে মিশে গেছে হাসিনা-খালেদাএখানকার সবচেয়ে সাধারণ মানুষটিকেও দেখেছি নিউইয়র্কের মাটিতে বসে নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ছেন, আবার সবচেয়ে অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটিকে দেখেছি জাতির পিতামাতাদের দেখা স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের পিছনে নিজের জীবন বিলিয়ে দেবার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে আছেনসম্ভবত এর নামই গণতন্ত্রকোন একটা বিষয় নিয়ে মাঠ গরম করে ফেলতে আমাদের তুলনা নেইতাই পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও নিউইয়র্কের বাঙ্গালিপাড়াগুলো থাকে উত্তপ্ত

 

বেশিরভাগ বাংলাদেশি এখানে যে-কাজ করেন সে-কাজ তারা নিজেরাই পছদ করেন নাকষ্টকর কাজ, নিজের অপছন্দে বাধ্য হয়ে করা কাজসত্যি বলতে গেলে, একটা কথা অনেককেই বলতে শুনেছি, কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সবাই বলছেন, ‘আমাদের আর জীবননিউইয়র্কের আকাশ্চুম্বী ভবনের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি, ‘হায় জীবন! কোনটা যে জীবন, কি যে সেই জীবনের অর্থতারা বলে, ‘এখানে ভালো লাগে না, একদম ভালো লাগে না, দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে, দেশে গিয়ে কিছু করব, এখানে আর নাকপালে অস্বস্তির ছাপ রেখে যখন তারা আরো বলে, ‘আর কতদিন এখানে অর্থহীনভাবে জীবন চালিয়ে যাবো?’ তখন তাদের সাথে আমিও হয়তো ভাবি, ‘এমনটাই যদি হবে, তবে কেন এই জীবন? কেন এখানে পড়ে থাকা?’ উত্তর খুঁজে পেতেও আমার দেরী হয় নাপালানোর কিংবা সান্ত্বনা খুঁজে পাবার সেই পুরোনো অজুহাতযে-লোকট এতক্ষণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে দেশে ফেরবার কথা বলছিলো, সেই একই লোক এখন কি এক অপূর্ব স্বর্গীয় হাসি হেসে বলছে, বলছে তার আট বছরের সন্তানের কথা, বলছে তার স্কুলে পড়বার কথাএকটু আগের বলা কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলছে, ‘না দেশে যাবো নাএখানে যত কষ্টই হোক, অন্তত আমার সন্তানের ভবিষ্যততো অনিশ্চিত নাআমি আবারো বুঝতে চেষ্টা করি জীবন আর সেই জীবনের অর্থ?’

 

নিউইয়র্কের বিখ্যাত সব ভবন আর অফিসগুলো রয়েছে ম্যানহাটনেম্যানহাটনের জাতিসংঘের ভবণ প্রাঙ্গণে গিয়ে কিছুটা অস্থির হয়েই খুঁজতে থাকলাম; আর সব পতাকার ভীড়ে খুঁজতে থাকলাম আমার দেশের পতাকাদেশের রাস্তায়, দোকানে, টি-শার্টের পিছনে কত দেখেছি এই পতাকাকিন্তু এমনটাতো কখনো মনে হয়নি, এমনটাতো লাগেনি কখনোবুঝতে পারি, এই পতাকাই কত বড় সম্বলএকটা স্বাধীন দেশ যে কি বিশাল পাওয়া, বুঝতে পারি আবারোবুঝতে পারি, ‘মাতৃগর্ভে থেকে মাকে কখনোই চেনা যায় না, মাকে চিনতে হলে সত্যিই মাতৃগর্ভের বাইরে আসতে হয়রাত-দিন দুবেলাতে দুরকম দেখতে এই ম্যানহাটনদিনের বেলা সুউচ্চ সব ভবনের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে, গভীর রাত্তিরে একটু দূর থেকে ম্যানহাটনের দিকে তাকাতে গেলে মনে হয়, এই বুঝি কোন স্বপ্নের দেশে চলে এলাম, এই বুঝি ঘুম ভেঙ্গে গেলোমনে হয় কোন  সিনেমা হলে বসে থ্রি-ডি কিংবা অ্যানিমেশান ম্যুভি দেখছিযত যান্ত্রিক আর যত কৃত্রিমই হোক না কেন, ম্যানহাটনের চোখ ধাঁধানো এই সব স্থাপত্য আর ঝলমলে সাজ আপনাকে আপ্লুত করবেইবিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, ভিন গ্রহের কোনো প্রাণি এসে তৈরী করেনি এই শহরমানুষই তৈরী করেছে, আমরা মানুষরাই নির্মাণ করেছি এই শহর, এই নগর

 

এই ছোট্ট পরিসরে নিউইয়র্ক শহরের বর্ণনা দেয়া আসলে বৃথা চেষ্টানিউইয়র্ক নিজেই একটা সভ্যতা, তাই সেই সভ্যতার বর্ণনা এখানে দেয়ার চেষ্টা না করাই ভালোশিকাগো ফেরার দিন বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার সময় রাহাত খান বলে যায়, বলে যায় তার জীবনের কথাবলে যায়, তাঁর ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাংলাদেশে, এখানে তিনি স্থায়ীভাবে থাকবেন না, চলে যাবেন বাংলাদেশেআমি স্তব্দ হয়ে ভাবতে থাকি, সত্তোরোর্ধ্ব রাহাত খান, আজো তিঁনি করেন ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, ভবিষ্যতে তিনি ফিরে যাবেন দেশেসত্তর বছর বয়স এখনো একটা মানুষের বর্তমানআমি জানি রাহাত খানদের সেই ভবিষ্যত কোনো দিনও আসবে নাউন্নত জীবনের লোভও মানুষের একটা বিশেষ লোভতাই মানুষ জীবনকে অস্বীকার করে ছুটে চলে, ছুটে যায় আরেক জীবনের কাছে, তথাকথিত উন্নত জীবনের কাছেযেখান থেকে ফিরে আসা অনেক অনেক কঠিন

 

প্লেনের জানালায় তাকিয়ে, আমি দূরে চেয়ে থাকিএমনি করে একদিন আমি ফিরে যাব আমার নিজের দেশের পথেযে-দেশকে আমি নিজের বলে ভাবতে পারি, জানতে পারি, মানতে পারিফিরে যাবো পদ্মা-মেঘনার কাছে; সাদা বকের কাছে, বাঁশঝাড়, আলু-পটলের খেত, সরিষার মাঠের কাছে; ফিরে যাবো রোদ-বৃষ্টি-মেঘের কাছে, শাপলার শালুকের বাতাবির কাছে; ঝিঙ্গে সীম নারিকেল, পুকুরের কাছে; জোনাকির কাছে, তারা ভরা রাতের কাছে, কোকিলের কাছে, দোয়েলের কাছে, শীত বসন্তের কাছেকোথা থেকে যেন হঠাৎ কিছু শুনতে পাই, আমি শুনতে পাই, ডাক শুনতে পাইমনের ভেতর বেজে বেজে উঠে – ‘বুকে তোমার, বুকে তোমার ঘুমিয়ে গেলে, জাগিয়ে দিয়ে নাকো আমায়, জাগিয়ে দিয়ে নাকো, মাগো, এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো; জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো

 

(সমাপ্ত)

*সবাই ভালো থাকুন আর ভালো থাকুক আমার শব্দগুলি; অন্তর্জালের মহাসমুদ্রে আজ থেকে যারা সম্পূর্ণ একা

 

পরশপাথর

জানুয়ারী ২১, ২০১০

[email protected]