আমি কেমন?

এথিস্টের বাংলা হিসেবে নাস্তিক শব্দটা পছন্দ না। আমি নিধার্মিক । আমার মতো মানুষের অভাব চারপাশে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার অনেক বন্ধুকেই আমি এই পথের পথিক দেখেছি, দেখেছি সামনা সামনি, দেখেছি বিভিন্ন ব্লগে। তারপরও দলভুক্ত অনেকের মানসিকতার সাথে আমি নিজের অমিল পাই। আমি সাধারণত ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পছন্দ করি। এখানে যুদ্ধ বলতে আমার পথে আসো বলে বোমা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া বোঝানো হচ্ছেনা। বোঝানো হচ্ছে হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম প্রচারিত মিথ্যা বক্তব্যকে বিজ্ঞানের আলোকে খন্ডন করাকে। এসব বক্তব্য বলার সময় অনেক ধর্ম বিশ্বাসীরা বলে থাকেন, ঈশ্বর যিনি কীনা, সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তাকে সৃষ্টির মাপকাঠিতে মাপা আর বালখিল্যতা একই কথা। এর বিপক্ষে আমার বক্তব্য হচ্ছে, ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, ভালো কথা, কিন্তু তার কাজ আমাদের পরিদর্শনযোগ্য। যেমন পৃথিবীর সৃষ্টি, প্রাণের সৃষ্টি, নুহের মহাপ্লাবন। যেহেতু এইসব ব্যাপার পরিদর্শনযোগ্য সুতরাং অবশ্যই একে বিজ্ঞানের ছুরির নীচে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পড়তে হবে। যদি সত্যতা যাচাই না করা যায়, তাহলে ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত মিথ্যাকে আমি মিথ্যাই বলবো (যেমন নূহের প্লাবন। আজ অবদি এর কোনও প্রমান পাওয়া যায়নি)। সোজা হিসাব।

এখানে সবাই আমাকে পার্টমারা পন্ডিত ভেবে বসতে পারেন। ধর্মকে বিজ্ঞান দিয়ে খন্ডন করার মতো তেমন কোনও লেখা আমি লিখি নাই। দুই একটি চেষ্টা করেছি সত্য, তবে তার বেশীরভাগেরই দৌড় অন্যের ধারণাকে নিজের ভাষায় লেখা পর্যন্ত। বিবর্তন নিয়েও আমার লেখালেখির একটা বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে বন্যা আহমেদ ও অভিজিৎ রায়ের লেখা। লেখা কম হলেও সেটা আমার মানসিকতার ধারণাকে হীনবল করে দেয়না। এই পথে যদি এককোটি মানুষ থেকে থাকেন, তাহলে লাইনের শেষে দাঁড়াতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি নিদেনপক্ষে সামনের সবার কাজটাকে এপ্রেশিয়েট করতে চাই।

তাহলে অন্য নিধার্মিকদের বৈশিষ্ট্য কী? তারা ধর্মের সাথে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চান। এই দলের বিজ্ঞানীরা ধর্ম নিয়ে বেশী তেড়িবেড়ি পছন্দ করেন না। মানুষজনকে আমরা বিজ্ঞানের পথে আনতে পারবোনা, বা সরকার থেকে অনুদান কমে যাবে এই ভয়ে তারা নিজেদের ধারণাটাকে সবসময় নিজের মধ্যে আড়াল করে রাখতেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন।

এই ব্যাপারটিকে সত্য বলে মানলেও আমি সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত নই। কারণ আমার মনে হয়, জোর গলায় বললে যে ক্ষতি হবে, না বলার ফলে, ধর্মের অযৌক্তিক চিন্তাধারা মানুষজনকে আরও অন্ধকারে নিয়ে যাবে। ভিক্টর যে স্টেংগরের নতুন বই পড়ছি- দ্য নিউ এইথিজম। বইটি মুহাম্মদকে উপহার দিয়েছেন অভিজিৎ দা। বইয়ের গঠন এবং ছোট ছোট হরফে অনেক অনেক লেখা দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম, প্রথম দেখায় পড়ার আগ্রহ পাই নাই। তারপর সেদিন উত্তরা থেকে আজিজ সুপার মার্কেটে আসার পথে ব্যাগের ভেতরে ফটোকপি করার জন্য রাখা বইটি উলটে পালটে দেখা শুরু করলাম। প্রথম পাতা থেকেই আটকে আছি বইয়ের ভেতর। এই বই আমার জন্যই লেখা হয়েছে।

পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভিক্টর যে স্টেংগর তার বন্ধু জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তন বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ডকিন্স, বিজ্ঞান লেখক ডেনেন্ট, হ্যারিসকে যেই গোত্রভুক্ত করেছেন অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমি সেই দলে পড়ি।

“Perhaps the most unique position of New Atheism is that faith, which is belief without supportive evidence, should not be given respect, even deference, it obtained in modern society. Faith is always foolish and leads to many of the evils of society. The theist argument that science and reason are also based in faith is suspicious. Faith is the belief in the absence of evidence. Science is the belief in the presence of evidence. And reason is just the procedure by which humans ensure that their conclusions are consistent with the theory that produced them and with the data that test those conclusion”

রিচার্ড ডকিন্স। নিউ এইথিস্ট বা নব্য নিধার্মিক। ১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া এই জীববিজ্ঞানী ১৯৭৬ সালে প্রকাশ করেন”The Selfish Gene” বইটি। বিবর্তন আলাদা আলাদা জীবসত্তায় কাজ করেনা, বরঞ্চ কাজ করে মানবকোষে থাকা জীনে- নিজের এই গবেষণালব্ধজ্ঞান প্রকাশের পর প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন এই গবেষক। ডকিন্স নিজে এই বইটি সম্পর্কে বলেছেন, সেলফিশ জিনে পরিচিত প্রাকৃতিক বিবর্তনের অপরিচিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে (Unfamiliar version of an familiar theory of natural selection)।

দেখা যাচ্ছে, ডকিন্স মনে করতেন সবাই ইতিমধ্যে বিবর্তন বুঝে গেছে। এখন তার কাজ হচ্ছে, এটার বিভিন্ন জটিল বিষয়গুলো আলোচনা করা। এই উদ্দেশ্যে থেকেই ১৯৮২ সালে তিনি প্রকাশ করেন “The Extended Phenotype”, ১৯৮৬ তে “The Blind Watchmaker”, ১৯৯৫ এ “River Out of Eden”, ১৯৯৬ এ “Climbing Mount Improbable”, ২০০৪ এ “The Ancestor’s Tale”।

প্রায় ত্রিশ বছর ধরে বিশাল বিশাল বই লিখে বিবর্তনের কঠিন কঠিন বিষয় বোঝাবার চেষ্টা করতে থাকা ডকিন্স যেদিন হারুন ইয়াহিয়ার ৭৬৪ পাতার “ATLAS OF CREATION” হাতে পেলেন তখন তার কেমন লেগেছিল? পাতায় পাতায় ছবি দিয়ে অলংকৃত এই বইটির মাধ্যমে হারুন ইয়াহিয়া বিবর্তন তত্ত্বকে ধুয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন মিথ্যার মুত্রসোত্রে। মিথ্যার কিছু নমুনা পাওয়া যাবে এখানে http://richarddawkins.net/articles/3239।

তবে হারুন ইয়াহিয়া বই লিখে বিবর্তনকে ধৌত করতে না পারলেও হয়তো রিচার্ড ডকিন্সের মাঝে একটি মারাত্মক উপলব্ধি জাগাতে পেরেছিলেন। বিবর্তন নিয়ে প্রচুর গভীর আলোচনা করলেও সাধারণ মানুষকে প্রমান সহকারে বিবর্তন বোঝাবার জন্য তিনি তেমন কিছু করেন নি

আর এই তেমন কিছুই করা হয়নি থেকে ২০০৯ সালে প্রকাশ হয়, “The Greatest Show On Earth”। এই বইটি আমাদের মতো নব্য বিবর্তন পাঠকদের ধরে ধরে বিবর্তন শেখাবার জন্য লেখা। বিবর্তন কী, বিবর্তন কীভাবে কাজ করে, ফসিল কী, ফসিল দেখে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, মিসিং লিংক কী, এইসব সাধারণ বিষয় ছাড়াও বর্তমানে বিবর্তন নিয়ে গবেষণা কতদূর, ডারউইনকে ছাড়িয়েও নতুন কী জিনিস জানতে পারলাম আমরা (এভোলিউশনারি ডেভলোপমেন্ট) ইত্যাদি সকল বিষয় এক করা হয়েছে করা হয়েছে।

রিচার্ড ডকিন্স তাড়াহুড়া করেননা। একটি নির্দিষ্টি বিষয়ে যেতে হলে তিনি প্যারাসুট দিয়ে সেখানে জাম্প না করে হেঁটে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সিদ্ধান্ত জানান। এর ফলে পাঠক হিসেবে অনেকসময় বিরক্ত লাগলেও আদতে লাভ হয়, বক্তব্য মাথায় গেথে যায়। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ আমার পড়া ডকিন্সের প্রথম বই, এবং আমার উপলদ্ধিটা এমন।

বইটিতে সর্বমোট বারোটি চ্যাপ্টার আছে-

1. Only a theory?
2. Dogs, cows and cabbages (artificial selection)
3. The primrose path to macro-evolution
4. Silence and slow time (discusses the age of the Earth and the geological time scale)
5. Before our very eyes (examples of evolution observed)
6. Missing link? What do you mean, ‘missing’? (the fossil record)
7. Missing persons? Missing no longer (human evolution)
8. You did it yourself in nine months (a statement attributed to J. B. S. Haldane; discusses developmental biology)
9. The ark of the continents (biogeography and plate tectonics)
10. The tree of cousinship (the tree of life, homology and analogy)
11. History written all over us (vestigiality and unintelligent design)
12. Arms races and ‘evolutionary theodicy’ (coevolution and evolutionary arms races)
13. There is grandeur in this view of life (based on the final passage of On the Origin of Species)

বিবর্তনে আগ্রহ আছে এমন সবার জানার জন্য একটি উপযুক্ত বই গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। বই সম্পর্কে ডকিন্সের একটি উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করা যাক-

“Evolution is a fact. Beyond reasonable doubt, beyond serious doubt, beyond sane, informed, intelligent doubt, beyond doubt evolution is fact. The evidence for evolution is as at least strong as the evidence for the Holocaust, even allowing eye witnesses to the Holocaust [[…]] We know this because a rising flood of evidence supports it. And this book will demonstrate it. No reputable scientist disputes it, and no unbiased reader will close the book doubting it. ”

কথা সত্যি। ডকিন্স ধর্মগুরুদের মতো আমি সত্যি, আমি সত্যি বলে শুধু চিৎকার করে ক্ষান্ত দেননি, কেন সত্যি তার পেছনে কারণ দেখিয়ে গিয়েছেন।

প্রাপ্তিস্থানঃ
১। আমাজন। মূল্য বিশডলার। বাংলাদেশে থাকলে অর্ডার দেবার পর হাতে আসতে মোটামুটি ২০ দিন সময় লাগে।
২। নীলক্ষেতের দুইতলায়, ফ্রেন্ডস।
৩। বন্যাপা। উনি আমারে গিফট দিসেন।

টিকাঃ

১। নিধার্মিক শব্দটা আমার তৈরী না। আবিষ্কারক, সংসারে এক সন্ন্যাসী।
২। দ্য নিউ এথিজম। পৃষ্ঠাঃ ১৩
৩। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ- প্রিফেইস।
৪। নিজের ধারণা। অন্য কারণেও হওয়া স্বাভাবিক। কারণ তাকে প্রায়ই প্রচুর অনভিজ্ঞ ক্রিয়েশনিস্টদের উদ্ভব প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়।