ভূমিকা – অনেক পিড়াপিড়ির পর স্ত্রীর কাছে পরাজয় বরণ করে দুটো শর্তে মেয়ে তিনটিকে মসজিদে মিয়াসাবের (ওস্তাদের) কাছে আরবী শিখাতে রাজী হয়ে গেলাম। শর্ত দুটো ছিলো- (১) মেয়েদের গায়ে মিয়াসাব কোনদিন হাত তুলতে পারবেনা, মেয়েদেরকে হুমকি ধমকি দেয়া চলবেনা। (২) শুধু শনি ও রবিবার মসজিদে যেতে পারবে, অন্যান্য শিশুদের মত স্কুলের হোম-ওয়ার্ক ফেলে সপ্তাহে সাত দিন যেতে দেয়া হবেনা।

স্ত্রী খুশী মনে সান্তনার বাণী শুনালেন- ‘ইংল্যান্ডে মিয়াসাবরা শিশুদের মারধোর করবে কী ভাবে এটা তো বাংলাদেশ নয়’। আমি তার কথায় আশ্বস্ত হতে পারলাম না। এই মাদ্রাসা মসজিদের ওস্তাদ প্রজাতির সাথে আমার ভাল পরিচয় আছে। আমার বাল্যকাল ওস্তাদের বেত্রাঘাত আর চোখের জলেই গড়া। ইচ্ছে ছিল স্ত্রীকে বলি, কোরাণ তো আরবে, ইরানে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে যা, ইংল্যান্ডেও তা। সাহসে কুলায় নাই, তবে স্ত্রীকে রিমাইন্ডার দিলাম- আমি সবকিছু সইতে পারবো, আমার কোন মেয়ের চোখের জল সইতে পারবো না। মাত্র তিন দিনের মাথায় অঘটন ঘটে গেল। সন্ধ্যা সাতটায় পড়া শেষে আমার অপেক্ষায় মেয়ে তিনটি মসজিদের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেহারা দেখেই আনুমান করতে পেরেছিলাম কিছু একটা ঘটেছে। মেজো মেয়ে তাহমিনার (৯) গাল দুটো রক্তলাল, চোখের পাতা তখনো জলে ভেজা। গাড়িতে উঠেই ছোট মেয়ে রোমানা (৫) বললো-

– Abbu, I don’t like that man.
– Who?
– That bearded man.
– Why?
– He hurt my Mejo Apu

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ডাইনিং টেবিলে আলাপ উঠলো। বড় মেয়ে ফারহানা (১১) ঘটনার বর্ণনা দিল-

Ustadji was beating a young child with a bamboo stick because he, the young child, was late. Tahmina whispered to me,

“Apa Moni look, what is he doing? He can’t do that.”

Ustadji came to us and squeezed Tahmina’s right chick so strongly with his two fingers that left red marks on her chick. At the same time he said to her, “What’s the matter with you little fatty?” Tahmina burst in to tears.

সেদিন আমি তাদেরকে মুক্তমনায় প্রকাশিত শবনম নাদিয়ার ইংরেজি লেখাটি পড়তে দিয়েছিলাম। আজ তার অনুবাদ করলাম এই আশায় যে লেখাটি হয়তো বাংলাভাষী কোন বাবা মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও পারে। সরাসরি অনুবাদ নয় বরং লেখাটির মূল থিমটাই ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করেছি।

:line:

আমি যে কারণে নাস্তিক থেকে গেলাম

শবনম নাদিয়া(অনুবাদ- আকাশ মালিক)

কিশোর বয়সের প্রথম দিকেই আমার বিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙ্গে একটি একটি করে ইট খসে পড়তে থাকে। বিভিন্ন বিষয়াদী নিয়ে আমি নিজেকে ক্রমাগত প্রশ্ন করতাম, আর এভাবেই একদিন আবিষ্কার করি, মানব সৃষ্ট ধর্মের আসাড়তা। শিশুকালে আল্লাহ বা ধর্ম নিয়ে তেমন ভাবতাম না, আন্যান্য বিশ্বাসীদের মত আমিও মনে করতাম ধর্ম হচ্ছে অকল্পণীয় ভাবনাতীত বিরাট কিছু যার আস্তিত্ব চিরকালই বিদ্যমান ছিল। সেই বয়সে আমি জানতাম, মুসলমানদের আরবী ভাষা শিখতে হয় যেহেতু কোরাণ আরবী ভাষায় লিখা, সকলকে নামাজ পড়তে হয় (যদিও মনে করতাম নামাজ শুধু, মা, বাবা, দাদা, দাদীর মত বড়দের জন্যে, আর বিশেষ করে পুরুষদের সপ্তাহে একবার জুম্মার নামাজ পড়লেই যথেষ্ঠ)।

একজন মুসলমান শিশু হিসেবে আমি মনে করতাম যে, মুসলমান মানেই ঈদ, শবেবরাত, সুস্বাদু খাদ্য, মেহদী-রাঙ্গা হাত, চোখ ঝলসানো সুন্দর চাকচিক্য পোষাক আর কটকট শব্দের নতুন জুতা। অবশ্যই আরো কিছু বিষয়াদীও আছে যেমন, মক্তবে সুরা-হাদীস শিক্ষা, নবীর জীবন চরিত জানা, ভাল-মন্দের পার্থক্য জানা, হালাল-হারাম, পাপ পুণ্য, পাক-নাপাক সম্মন্ধে জ্ঞান অর্জন করা। ব্যস, এভাবেই জগত চলে, আর আমি একদিন বড় হবো, সব কিছু জানতে পারবো যেমন আজ আমার মা বাবা জানেন। আমি বিশ্বাস করতাম, আল্লাহ একজন আছেন এবং সর্বদা থাকবেন, আমি ভাল মানুষ হয়ে বড় হলে তিনি প্রয়োজনে আমার ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু যখন সময় এলো, চেয়ে দেখি তিনি কোথাও নেই।

তবে এসব পরের ঘটনা। সন্দেহে বিশ্বাসে দুদুল্যমান আমি নিজেকে বাহ্যত বিশ্বাসীদের দলেরই ভাবতাম, যেন কখনো সমাজ বিচ্যুত বা নিঃসঙ্গ একা হয়ে না যাই। কোন কিছু প্রশ্নাতীত ভাবে বিশ্বাস বা গ্রহণ না করা শুরু হয়েছিল সেই হেমন্তের এক প্রভাতের ঘটনা থেকে, যখন আমি ১১/১২ বৎসরের সদ্য কিশোরী।

মা-বাবা বহুমূখী শিক্ষার্জনের লক্ষ্যে আমার ভাই ও আমাকে নিকটতম একটি মক্তবে ভর্তি করালেন। অসহ্য প্রত্যুষে ঘুম থেকে জেগে উঠে কায়দা হাতে ছুটতে হতো মক্তবের দিকে। ফ্রক পরা কিশোর বয়সেও মক্তবের ছাত্রী হিসেবে আমাকে পরতে হতো শেলয়ার-কামিজ আর মাথায় জড়াতে হতো ওড়না। একদিন সকালে দেরী হয়ে যাচ্ছিল দেখে, মা আমার মাথায় ওড়না চাপিয়ে লম্বা গাউন পরিয়ে মক্তবে পাঠিয়ে দিলেন। মা ভেবেছিলেন, শেলয়ারের পরিবর্তে আপাদমস্তক শরীর ঢাকা গাউন নিশ্চয়ই মক্তবে গ্রহনযোগ্য হবে। আর হবারই তো কথা, কারণ শরীর ঢেকে রাখাটাই যদি শর্ত হয়, সেই অর্থে আমার শরীর তো অনাবৃত ছিলনা। যখন মক্তবে পৌছুলাম, হুজুর (ওস্তাদ) আমাকে ডেকে নিয়ে সকলের সামনে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমার জামার নিচে কী’? তারপর উচ্চস্বরে, চিৎকার করে বলতে থাকেন, ইউনিভার্সিটির ছাত্র শিক্ষক ও তাদের ছেলে-মেয়েদের অশ্লীল পোশাক পরিচ্ছদের কথা। তিনি তাতক্ষণিক ভাবে আমাকে মক্তব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দেন, আর বলে দেন ভাল কাপড় না পরে আমি যেন কোনদিন মক্তবে না আসি। সেদিন আমার দেহে অনুভব করেছিলাম লজ্জা আর অপমানের আগুন, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম সহপাঠিদের গুঞ্জন, আর স্পষ্ঠই মনে আছে উর্ধশ্বাসে এক দৌড়ে সে দিনের বাড়ি ফেরার কথা।

বাস্তবে আমি মনে করি এ অপমানের দুটো রূপ আছে। প্রথমত, হুজুর আমার সহপাঠি সকল বন্ধু-বান্ধবীর সম্মুখে আমাকে অপমান করেছেন। দ্বিতীয়ত, আমার জামা নয়, হুজুরের ঐ ‘তোমার জামার নিচে কী’ ধরণের কুৎসিৎ প্রশ্নের মাঝেই সত্যিকার অশ্লীলতা লুকিয়ে আছে। সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম, তবে একজন জেদী মেয়ে হিসেবে মাকে বলে দিয়েছিলাম যে, আমি আর মক্তবে যাবো না। মাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই যে তিনি আমার মনের বেদনা বুঝতে পেরেছিলেন, এরপর কোনদিন মক্তবে যেতে আমাকে বাধ্য করেন নি।

ঐ ঘটনা আমার জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। দুটো কারণে ঐ ঘটনা আমার কাছে স্বরণীয় হয়ে রয়েছে। একটি হলো, আমি যতদূর বুঝতাম, অনাবৃত দেহে মক্তবে যেতে নেই। মায়ের দেয়া কাপড় পরে এই শর্ত পুরণ করেই আমি মক্তবে গিয়েছিলাম। তাহলে হুজুর আমাকে এভাবে অপমান করলেন কেন? এ প্রশ্নের কোন যৌক্তিক উত্তর কেউ আমাকে দিতে পারেন নি। অপমানের দুঃসহ যাতনা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমার বাবাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। পেশায় একজন শিক্ষক হিসেবে বাবার একটা অভ্যেস ছিলো, কোন ব্যাপারে প্রশ্ন করলে দীর্ঘ একটা বক্তৃতা দেয়া। তিনি বললেন যে, ‘দুরদর্শিতার অভাবে মানুষ এমন করে থাকে, সকল মানুষ ঘটনার সুদুর প্রসারী প্রতিক্রীয়া অনুমান করতে পারেনা। হুজুরের দৃষ্টিতে যেহেতু আমি একটি বালিকা তাই আমার উচিৎ ছিল শেলোয়ার পরা। হুজুর সম্ভবত ইচ্ছাকৃত ভাবে অশালীন কটুক্তি করেন নি, এ শুধু হুজুরের সীমিত জ্ঞানের কারণ, আর দুর্ভাগ্য তার, যে তিনি বিকল্প সঠিক ভাষা ব্যবহার করতে পারেন নি। হুজুরের ধারণায় মেয়েদের শেলোয়ার না পরা অন্যায়, তিনি শুধু এটাই বুঝাতে চেয়েছিলেন’। আমি বাবাকে বললাম- কিন্তু আমার মাথা থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত তো কাপড়েই ঢাকা ছিল। বাবা বললেন- হাঁ, তাত্বিক অর্থে তোমার কথাই ঠিক, কিন্তু হুজুর সেই বিচারে, সেই দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখেন নি, অনেকেই তা দেখতে পারেনা। হুজুরের চোখে মেয়েদের গুটি কয় নির্দিষ্ট পোশাকই একমাত্র গ্রহনযোগ্য পরিধেয় বস্ত্র।

যে সকল বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন সমুহ আমাকে সর্বদা ভাবাতো, এই ঘটনার মাধ্যমে সেই সব ভাবনাগুলো দানা বাঁধতে শুরু করে। শুরু হয় ঘটনার ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ। সম্পূর্ণ শরীর-ঢাকা লম্বা কাপড় যদি পর্দার শর্ত পুরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমার ফ্রক সেই শর্ত পূরণ করে কীভাবে? আমার বয়সের সকল মেয়েরাই ফ্রক (যা পা ঢেকে রাখেনা) পরে, কিন্তু এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। অথচ আমার প্যান্ট (যা আমার পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত ঢেকে রেখেছিল) হলো সকলের মাথা ব্যথার কারণ। এ সবের কোন যৌক্তিক কারণ আছে, কোন অর্থ হয়? আমার চোখে ভেসে উঠে প্রথাগত আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালনের যুক্তিহীন দিকগুলো, তথাপি তখনও আমার মন থেকে ধর্ম-বিশ্বাস সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায়নি।

দ্বিতীয় কারণ হলো, মক্তবের ঐ দিনের ঘ্টনার মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি এই ধর্মগুরুদের মন কতো সংকীর্ণ, যাদের একজন হচ্ছেন আমার মক্তবের হুজুর। এ ছাড়াও অনেকেই আছেন যাদের মধ্যে কেউ প্রহার করবেন নারীকে কেউ দেবেন শিশুকে শাস্তি। আমি মনে করি নারীকে অনেকে অন্যান্য উপায়েও শাস্তি দিয়ে থাকেন, (যেমন বাংলায় একটি কথা আছে- হাতে না মেরে ভাতে মারা) যারা মনে করেন প্রহারকারী স্বামীর চেয়ে তারা ভাল স্বামী। আর সমাজে সবল কর্তৃক দুর্বলের প্রতি প্রাধান্য বিস্তার বা ভয় দেখানোর প্রবণতা ধর্মগুরুদের দৃষ্টিগোচর হয়না, হলেও এ যেন ধর্তব্য কোন অন্যায়ই নয়। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, এই শিক্ষা গুরুদের কেন আমরা সম্মান করবো? কারণ তারা আমাদেরকে ঈশ্বরের বাণী শুনান? নিম্নমনের এই স্বল্প জ্ঞাণী, স্বল্পবুদ্ধির মানুষগুলো ঈশ্বর প্রদত্ত জীবনের গৌরব সৌন্দর্য মলিন করে দিয়েছে, তাদের মনগড়া কুৎসিত ও কিছু দূর্বোধ্য অন্ধ আইনের মাধ্যমে।

আমার বোধ হয় মক্তবের ঐ হুজুরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাই উচিৎ, কারণ তারই অদূরদর্শীতা, এবং শালীন ও অশালীনতার মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যর্থতার সুত্র ধরে আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে শিখেছি, যার ফলশ্রুতিতে ১৪ বৎসর বয়সেই আমি হয়েছি একজন অজ্ঞেয়বাদী কিশোরী। তখনও কিন্তু শান্তির ধর্মে আমার বিশ্বাস অটুট ছিল।

ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ বা যে সন্দেহের পথ ধরে ঈশ্বরে বিশ্বাসহীনতা আসে, সময়ের প্রেক্ষিতে আমার জন্যে সে পথটা খুবই স্বল্প ছিল, তবে সহজ বা মসৃন ছিলনা। আমি দেখেছি তথাকথিত বুদ্ধিমান বা যুক্তিবাদী লোকেরাও ইসলামের মৌলিক বিষয়াদী নিয়ে প্রশ্ন করাকে প্রসন্নচিত্তে মেনে নিতে পারেন না। তারপর এমন লোকও আছেন যারা তাদের পছন্দসই প্রশ্ন সহ্য করতে পারেন কিন্তু উত্তরটা দেবেন তাদের মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়ে মনগড়া পদ্ধতিতে। আবার একদল লোক আছেন যারা নিজেকে শিক্ষিত আধুনিক মুসলিম বলে দাবী করেন, তারা সকল প্রকার প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজী তবে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত। সব সময়ই প্রশ্নের একটি পর্যায়ে এসে অবধারিতভাবে উত্তরটা হবে, ‘ঈমান বা ধর্মে যুক্তির কোন স্থান নেই, এ শুধু বিশ্বাসের ব্যাপার’।

এ পর্যন্ত এসে আমার বিশ্বাসের ঘরের ভীত বড় নড়বড়ে হয়ে যায়। আমি একটি সিদ্ধান্তে উপণীত হই, যে সিদ্ধান্তের বেশীরভাগ উপাদান পেয়েছি তৃতীয় দলের লোকদের কাছ থেকে, অর্থাৎ ইসলাম দেড় হাজার বৎসরের পুরনো ধর্ম বলেই আজ তাতে অনেক অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয় ও ইসলামের অনেক কিছু অমানবিক মনে হয়। নবী মুহাম্মদের আচার-আচরণ, কথা-বক্তব্য, (বহু বিবাহ, বাল্য বিবাহ, নারীকে গণীমতের মাল ঘোষণা) আরবের ততকালীন সমাজ বাস্তবতা দিয়ে বিচার করা উচিৎ। তাদের ভাষায়, মুহাম্মদ অন্যান্য মানুষের মত সেই সময়েরই একজন মানুষ ছিলেন।

এবারে ইসলামে স্পষ্ঠ দৃশ্যমান ত্রুটি-অসঙ্গতি দেখে আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে, আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে ইসলামের কিছু বিধি-বিধান একেবারেই সেকেলে এবং অমানবিক। ইসলাম ধর্ম  প্রাচীন আরবীয় ধর্ম বই কিছু নয়, আর  ইসলামের নবী মুহাম্মদও সেই সময়ের মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তবুও কেন  ইসলামকে ‘কালোত্তীর্ণ’ বলে দাবী করা হয়; আর বলা হয় – কোরাণ নাকি সকল সময়ের, সকল মানুষের জন্যে প্রযোজ্য, আরও বলে দেয়া হয় এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও  মুহাম্মদ কথিত প্রাচীন নিয়ম নীতিগুলো চোখ বুজে অনুসরণ বা তার সন্তুস্টি অর্জন সকল ভাল মুসলমানের কর্তব্য!!  আমার কাছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত লাগে।

যা কিছু মহৎ, যা কিছু ভাল বলে জেনেছি, (যার অনেক কিছু ধর্ম থেকেই শিখেছি) আর যা কিছু মিথ্যা ও মন্দ ধর্মের মধ্যে পেয়েছি, এই উভয়ের সাথে আমি হৃদ্যতা স্থাপন করি বা উভয়কে মেনে নেই কি ভাবে?

নারীসমাজকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গন্য করে ধর্মগ্রন্থে বর্ণীত শ্লোক পড়ে আমি কী ভাবে আমার মর্যাদা, গর্ব, আমার নারীসত্বা বজায় রাখতে পারি। আমি প্রথমে ধর্ম ত্যাগ করেছি এ জন্যেই যে, ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস রাখলে আমার ভাবনা, আমার কল্পনার এ বিশাল জগৎটা স্থবির হয়ে যায়। ধর্ম, আমার সীমাহীন কল্পনার, অসীম সম্ভাবনার জগৎটাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই ধর্মগ্রন্থ (কোরাণ) বলে দিয়েছে, আমার শিক্ষা, আমার জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভা, আমার সদাহাস্য চেহারা, মানুষের প্রতি আমার ভালবাসা, শ্রদ্ধা, আমার সমুহ মানবিক গুণাবলী থাকা সত্বেও, আমি একজন নিম্নমানের পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট। একটিই কারণ – আমি একজন নারী। আমি পুরুষের শষ্যক্ষেত্র, আমি রণাঙ্গনে বিজয়ী সৈনিকের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, ঋতুস্রাবকালে আমি অচ্ছুত অপবিত্র, আমি অবিশ্বস্ত, আমার সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য, আমি নরকের সম্মুখ পথ, আমি জাহান্নামের ফটকদ্বার, আমার দিকে তাকালে পুরুষের নরকবাস হয়।

এই যদি হয় আমার পরিচয়, তাহলে আমার জীবনের স্বার্থকতাটা কোথায়? আমি নাস্তিকতা বরণ করে নিই, এ ছাড়া বিকল্প পন্থাটাই বা কী ছিল? জানতে চান, বিশ্বাসহীনতা আমাকে কী দিতে পারে? অবিশ্বাস কী দিয়েছে, যা বিশ্বাস দিতে পারেনি? আমি বলবো – নাস্তিক্যবাদ মানুষকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে স্বিকৃতি দেয়, ধর্ম দেয় না। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস করে মানুষ সুখী সুন্দুর জীবন গড়তে সক্ষম, আর মানুষ সৎকর্ম বা ভাল কাজ করার ক্ষমতা রাখে, কারণ ভাল কাজ করা মানুষের স্বভাব-ধর্ম। ভাল মানুষ হওয়ার জন্যে, এই মানব প্রজাতিকে অনন্তকাল নরকে শাস্তির ভয়, অথবা চিরকাল স্বর্গীয় সুখ-সম্ভোগে বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। ধর্ম মানুষকে ভাল মানুষ হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ধর্ম বিশ্বাস করে একজন পুরুষ তার স্ত্রী, সন্তান, পরিবার বা আত্মীয় স্বজনকে সেই দৃষ্টিতে দেখবেনা, যে ভাবে দেখা উচিৎ, কিংবা একজন নারী সে নিজেকে অসম্মান বা অবমাননা করবে এবং তার পরিবারের সাথে প্রতারণা করবে যদি না তাদের মনে নরকের ভয় থাকে। নাস্তিক্যবাদ বা ধর্মহীনতা আমাকে যে আত্মমর্যাদা বা সম্মানবোধ শিখিয়েছে, কোন বিশ্বাস-পদ্ধতি বা ধর্মীয় বিধি-বিধান তা করতে পারবে? আমি ধার্মিক হলে একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে গণ্য হই। আমি সৃস্ট জীব হলে কেবলমাত্র এক স্বর্গীয় স্বত্বার সৃষ্টি হই, শুধুমাত্র উর্ধাকাশের তারার পানে চেয়ে তারই গুণ-কীর্তন করতে।

আমি মনঃস্থির করে নিলাম যে নাহ্- আমি একজন মানুষ, উচ্চ আমার শীর, অসীম আমার প্রাপ্তি আমার সম্ভাবনা, আমি সীমাহীন আকাশ, আমি সূর্য্যের অট্টহাসি। আমার জীবনতরীর আমিই হবো সুযোগ্য কান্ডারী। সৎকর্মে নিজেকে করবো উৎসর্গ, কারো অনিষ্ট করবোনা। তবে স্বর্গসুখের লোভে মহৎ কাজ করা নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে সত্য ও মিথ্যে, ভাল ও মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করে সঠীক সিদ্ধান্ত নেয়ার বিশেষ ক্ষমতা আমার আছে এবং সৎকর্মেই আছে মহত্ত তাই।

জীবনের এই স্বল্প সময়ে, বিশ্বাসের রিতিনীতি, ধরণ-প্রকৃতি নিয়ে আমি অনেক বিশ্বাসীদের সাথে আলোচনা করেছি। মনে হয় যেন একটি পর্যায়ে এসে তারা আমার বিশ্বাসহীনতায় লজ্জাবোধ করেন। বেশীরভাগ সময়েই তাদেরকে বলতে শুনা যায়, ইহজাগতিক এই জীবন কতই না মূল্যহীন ও ক্ষণস্থায়ী। তারা কেউ বুঝতেই চান না, কতকাল তীব্র আগ্রহ নিয়ে আমি চেষ্টা করেছি একজন বিশ্বাসী হয়ে বেঁচে থাকতে।

বিশ্বাস মানে’ই আমার উপর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, স্নেহকারী পিতাসদৃশ এক অদৃশ্য সত্তার নজরদারী। আমার সকল অমঙ্গলে, সকল দুঃখে-কষ্টে তিনিই আমার উদ্ধারকারী, যদি ইহজগতে কিছু না পাই, পরকালে আমি হবো পুরষ্কৃত। এর চেয়ে মহা শান্তনার আর কী বা আছে? জগতে নির্দোষের নিদারুণ ক্লেশে মন্দের বিজয় উল্লাস হয়, তারপরও স্বর্গের ঈশ্বরের নিরীক্ষণে মর্ত্যের সব ঠিকই আছে। সবকিছু ঈশ্বরের হাতে শপে দেয়ার কী বিশাল প্রলোভন।

আমি বিশ্বাসী হতে অনেক কিছু ত্যাগ করতে পারতাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে নাস্তিক্যবাদের দূর্গম, কণ্টকাকীর্ণ পথটাই বরণ করে নিতে হয়েছে। আমি স্বর্গের ছায়াতলে আশ্রয়ের আশা ত্যাগ করেছি, কিন্তু পেয়েছি এমন এক জীবন, যেখান থেকে আমি প্রশ্ন করতে পারি, আবিষ্কার করতে পারি বিশ্বজগতের সকল রহস্য। আমি ধর্ম প্রত্যাখ্যান করে নাস্তিক হয়েছি, কারণ ধর্মে বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলো আমার কৌতুহল নিবৃত্ত করতে পারেনি; ধর্ম আসলে আমার জীবনকে সংকীর্ণ বা নির্দিষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলো। আমি নাস্তিক হয়েই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ জন্যে যে, আমি জানি – আমি আমাকে চেনার জন্যে, ‘আমি কে’ তা জানার জন্যে ধর্মের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।

মূল লেখা ইংরেজীতে, এখানে