এ বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধু ভাবনা

 

অজয় রায়

 

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে বড় ও বিশ্লেষণমূলক লেখার অবকাশ এই প্রবন্ধে নেইতাছাড়া যে পরিমাণ মালমশলা ও ঐতিহাসিক তথ্য এর জন্য দরকার তা হাতের কাছে নেইএকটি পত্রিকার কর্তৃপক্ষ স্বল্প নোটিশে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে একবটি লেখা চেয়েছিলেন- তাদের অনুরোধকে মাথায় রেখেই এ প্রবন্ধের অবতারণাআর এর মধ্যদিয়ে আমি ৩৯তম বিজয় দিবসে আমাদেও স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবকে কৃতজ্ঞ চিত্তে ষ্মরণ করছি, আর স্মরণ করছি স্বাধীনতার শহীদদের, সম্মরণ করছি হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্যদের যারা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য শহীদ হয়েছেন একাত্তরের রণাঙ্গনে  

 

    আমার আপশোষ, জীবিতকালে এবং মৃত্যুর পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যে ভাবে সমালোচনা ও ধিক্কার জানানো হয়েছে, আমার মনে হয় না বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক নেতাকে তা সইতে হয়েছেআবার এও সত্য বাংলার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন তিনি পেয়েছেন তা অতুলনীয়তাই তিনি মানুষের বিচারের মানদণ্পে সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্হালীএ ছাড়া রাজনৈতিক নেতা ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি যতটা আলোচিত হয়েছেন বা হচ্ছেন তা উপমহাদেশের অনেক অনেক দেশ বরেণ্য নেতাদের ভাগ্যেও ঘটে নিএই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বঙ্গবন্ধু উঠে এসেছেন গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ…এঁদের কাতারেএমনকি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা বাঙ্গালীত্ব চেতনার গুরু শের-এ-বাংলা ফজলুল হকের ভাগ্যেও এতটা জোটে নিসেদিক থেকে তিনি অনন্য —তিনি সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালী কিনা তা নিয়ে বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক মহলে একাডেমিক মতপার্থক্য থাকতে পারে – কিন্তু শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী ব্যক্তিত্বের সম্মুখ সারিতে যে তাঁর অবস্থান এতে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়কিনতু এই কৃতিত্ব তাকে র্অন করতে হয়েছে নিজের প্রাণ দিয়েআমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম সুহৃদ, সাথী অনুপ্রেরণাদিনী সে সময়কার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী  ও বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তির চেতনার প্রধান পুরুষ ও ভাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধূ উভয়কেই আততায়ীর হতে প্রাণ দিতে হয়েছেআমি মনে করি এই অপঘটনা সে সময়কার নিক্সন-হেনরি কিসিংগার-ইয়াহিয়-মুস্তাকসহ সিআইএ চক্রের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফসল  এ ধরনের ঘটনা অবশ্য ইতিহাসে নতুন ঘটনা নয় প্রাণ দিতে হয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কনকে, মহাত্মা গাšধীকে  

 

প্রাচ্য জীবনাদর্শনের একটি দিক হল শয়তান সম ব্যক্তি হলেও মৃত্যুর পর তাঁকে ঘৃণা বা ধিক্কার জানানো একটি মানবতাবিরোধী আচরণ বলে গণ্য করা হয়কিন্তু বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমতাঁর জীবিতকালের সমালোচকরা মৃত্যুর পরও তাঁকে নিয়ে উকট ও বিরূপ মন্তব্য ও ঘৃণা উদগিরণ করতে পশ্চাপদ হন নাতাঁর প্রতিকৃতিকে অবমাননা করা হয়, তাঁর অবদানকে খাটো করে চিত্রিত করা হয় – তাঁকে অনেকসময় শয়তানরূপেও চিত্রিত করা হয়

 

বঙ্গবন্ধুর নানা শ্রেণীর শত্রছিল — ১৯৭১ পূর্ব সব ধরনের পাকিস্তানী সরকার ও তাদের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ছিল তার শত্রনম্বর একতিনটি উদাহরণ দিই:

 

আইউব শাহীর সামরিকতন্ত্র কর্তৃক তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা দায়ের যা কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিতএই মামলায় পাক-সরকার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় তা হল

 

গোপনসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের অনুসরণে এমন একটি ষড়যন্ত্র উদঘাটন করা হয় যার মাধ্যমে ভারত কর্ত্তৃক প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অর্থ ব্যবহার করে পাকিস্তানের একাংশে সামরিক বিদ্রোহের দ্বারা ভারতের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কতিপয় ব্যক্তিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় এবং কতিপয় ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চাকরির সাথে সম্পৃক্ত আইনের আওতায় গ্রেফতার করা হয়

 

অভিযুক্তদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং আসামী এবং কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে ২নং আসামী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়শেখ সাহেবের পরিচয় হিসেবে লেখা হয়:

 

মি: শেখ মুজিবুর রহমান পি: মৌ: শেখ লুফর রহমান গ্রাম টুঙ্গীপাড়া,গোপালগঞ্জ,ফরিদপুর

 

           

২৫শে কালরাত্রির পরদিন ২৬শে মার্চ (১৯৭১) সন্ধ্যেবেলায় পাকিস্তানে বেতারে সামরিক জান্তা প্রধান সেনাপতি ইয়াখানের ঘোষণা ছিল

:

Sheikh Mujibur Rahman’s action of starting non-cooperation movement is an act of reason. He and his parts defied the lawful authorities…have tried to run parallel government….The man and his party are enemies of Pakistan, …he has attacked the soliderity of Pakistan. …this crime will not go unpunished.

       

ইয়াহিয়ার সাধ কিন্তু অপূর্ণ থাকেনিরণক্ষেত্রে বাংলার সৈনিকদের বিজয় ঘটলেও – পাকিস্তানী আদর্শে উজ্জীবিত ও সেনাপতি ইয়াহিয়ার আদর্শিক এতদ্দেশীয় অনুচররা সেই কাজ সমাধা করে ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) সকালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেসেদিনও মোস্তাকের সূর্যসন্তানদের এক সন্তান মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতারে ঘোষণা দিয়েছিলেন : স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছেতাঁর স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছেবাংলাদেশ জিন্দাবাদ

 

       

অনেকে বিষয়টির গভীরে না গিয়ে বলে থাকেন শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারকে উখাত করা হয়েছে অপশাসন ও দুর্নীতির (পড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ) কারণেকিন্তু তা ঠিক নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তাঁর আদর্শের জন্য যে আদর্শ বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ [ংবপঁষধরংস] এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্র (ষরনবধষ ফবসড়পধপু) কে তুলে ধরেছেঅন্যদিকে তাঁর হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুরানো পাকিস্তানী ধ্যানধারণায় প্রবর্তন এবং বাংলাদেশকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক স্টেটে রূপান্তরিত করা এবং সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্থলে মুসলিম বাংলানামের আদর্শভিত্তিক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তনস্বঘোষিত হত্যাকারীদের একজন হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক কর্ণেল ফারুখ একটি সাক্ষাকারে স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন-

 

শেখ মুজিবকে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হতকারণ ঐ ব্যক্তিটি তার ধর্ম ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে — যে বিশ্বাস আমার (ফারুখ) জনগণের ধর্ম…”(ঞযব ঝঁহফধু ঃরসবং, গধু ৩০, ১৯৭১)হত্যাকাণ্ডের আর একজন নায়ক মেজর রশীদের ভাষ্যমতে ১৯৭৪এর গ্রীষ্মকালে ফারুখ ও রশীদ মুজিবকে উখাতের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা শুরু করে — যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক ইসলামিক রিপাবলিক রাষ্ট্রে পরিণত করা

 

পরবর্তীকালে ৭ই নভেম্বরে (১৯৭৫) ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ১৯৭২ সালের গণতন্ত্রের লিপিবদ্ধ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্যগুলিকে নস্যা করতেতিনি সামরিক ক্ষমতাবলে জনমত বা গণতান্ত্রিক বিধির তোয়াক্কা না রেখে তাঁর নিজস্ব চারনীতি প্রবর্তন করলেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ১৯৭৬ সালের এক ঘোষণার মাধ্যমে, যেমন :

 

আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, স্বনির্ভরতা, এবং সকল শ্রেণীর মানুষের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত প্রশাসন এবং বাংলাদেশীজাতীয়তাবাদ

    

লক্ষ্যণীয় যে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিস্থাপন করলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’, এবং সমাজতন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিলেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকাল আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে এসেছেনকিন্তু কি তাঁর আদর্শ ছিল ? কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অবশ্য সাদা চোখেই চিহ্নিত করা যায়প্রথমত: জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষাএই জনগণ ছিল ১৯৪৭ উত্তর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল যা তখন পূর্ববাংলা নামে পরিচিত ছিল সেই অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দএই জনগণের কথা তিনি প্রায়শ: একটি বাক্যে প্রকাশ করতেন – ‘বিশ্ব আজ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত,- শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের দলেদ্বিতীয়ত: বাঙালী জাতীয়তাবাদপূর্ববাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকেই তাঁর চিন্তাচেতনায় বাঙালীজাতীয়তাবাদের ধারণা ক্রমশ: দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়আর এ ধারণা থেকেই পূর্বপাকিস্তানকে ষাটের দশক থেকে বাংলাবা বাংলাদেশ নামে অভিহিত করতে থাকেনএ প্রসঙ্গে তাঁর একটি ঐতিহাসিক উক্তির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি:

    

এক সময়ে এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছেজনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি — আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ (হইবে)হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুবার্ষিকীতে ৫১২৬৬ তারিখে প্রদত্ত ভাষণদ্রষ্টব্য বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, বঙ্গবন্ধু গবেষণাকেন্দ্র প্রকাশনা, ঢাকা, ১৯৯৩)

 

এরও আগে ২৫৫৫ তারিখে তদকালীন পাকিস্তান গণপরিষদের স্পীকারকে উদ্দেশ্য করে যে বক্তৃতা করেছিলেন তার ঐতিহাসিকমূল্য আজও নি:শেষ হয়নিএর অংশবিশেষ হল:

    

Sir, you will see that they want to place the words ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have demanded so many times that you should name it Bengal (Pakistan). The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own.

 

অভিযোগ করা হয় শেখ মুজিব প্রথম জীবনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, পাকিস্তান-আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন ভারতীয় মুসলিমলীগের ছাত্রকর্মী হিসেবেতথ্য হিসেবে ঘটনাটি সত্যকিন্তু এটাও ছিল ব্রিটিশ যুগে অবহেলিত বৃহ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কল্যাণচেতনা থেকে উদ্ভূতঅনেকের মতে তখন তাঁরও মনে হয়েছিল পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠা হয়তো, বিশেষ করে, পশ্চাপদ পূর্ববঙ্গীয় সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন১৯৪৮ থেকেই গণবিরোধী মুসলিম লীগ শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীদের আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকেন — সেটি বিস্তৃত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী আদায়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মুসলিম লীগের বিপরীতে জনতার লীগ আওয়ামী মুসলিমপ্রতিষ্ঠায় তাঁর সক্রিয় ও অগ্রগামী ভূমিকার কথা নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই

 

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনাছাত্রাবস্থায় মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততা থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক চেতনা উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উন্নীত হয়আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে পরিণত করায় তাঁর ভূমিকা ছিল দৃঢ় ও সক্রিয়এর ফলে আওয়ামীলীগের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালীর জন্যদেশে সেক্যুলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাতাবরণ শুরু হলএরই পথ ধরে জন্ম নিল মৌওলানা ভাসানী মিঞা ইফ্তেকার, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি প্রভৃতি উদারপন্থী সেক্যুলার রাজনৈতিক দল সমূহএর আগে যুবকদের সংগঠন অসাম্প্রদায়িক যুবলীগ এবং পরে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিলছাত্রলীগের চরিত্রও বদলে গেল অসাম্প্রদায়িক বাঙালী চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি নতুন দলে রূপান্তরিত হল — যাদের ঠিকানা হয়ে দাড়াল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা

 

 শেখ মুজিবের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৬৪ সালে তদকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের ইঙ্গিতে সৃষ্ট হিন্দু বিরোধী সেই ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও

 

 শেখ মুজিবের জনগণের অধিকার আদায় বিশেষ করে পূর্ববঙ্গবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় স্বাধীকার আন্দোলনের পথ ধরেই এল ঐতিহাসিক ৬ দফার দাবী,—শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন আমাদের বাঁচার দাবীএর চুম্বক কথাগুলো হল পাকিস্তানে ফেডারেল ধাঁচের রাষ্ট্র কাঠামো Ñ এর ভিত্তি হবে জনগণের গণতন্ত্র,— সরকার হবে সংসদীয়, নির্বাচন পদ্ধতি সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার ভিত্তিক; ফেডারেল সরকার কেবল দেখাশুনা করবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়; বাংলাদেশ অঞ্চলে বাঙালীদের নিয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী মিলিশিয়া থাকবে যার দায়িত্ব হবে পূর্ববাংলায় প্রতিরক্ষাকতিপয় বিশেষ মহল ব্যতিরেকে এই দাবী বাঙালীদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যার ফলে আইউব সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েবঙ্গবন্ধু এই কর্মসূচীকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ব্যাপী জনসংযোগ-সভা-সমিতি করেন; তাঁর নিজের ভাষাতেই বলা যায়:“….. চোঙামুখে দিয়ে রাজনীতি করেছি।…বাংলাদেশের এমন কোন থানা নেই যেখানে আমি যাই নিআওয়ামীলীগ নেতৃত্ব, বিশেষ করে শেখ মুজিবের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের জুলুম ও নিপীড়নশঙ্কিত প্রেসিডেন্ট আইউব শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সতর্কবলী উচ্চারণ করলেন: “…বর্তমান সরকারের আমলে পূর্ব পাকিস্তান পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করিতেছে।…যাহারা প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে চেঁচামেচি করিতেছে তাহারা প্রকৃতপক্ষে দেশের দুইটি অংশের বিচ্ছিন্নতা করিতেছে”(২৯শে মার্চ,১৯৬৭)

 

 এই ৬ দফা ভিত্তিক সায়ত্তশাসন আন্দোলনের পথ ধরেই এল জনগণের স্বাধিকার আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন যার চূড়ান্ত পরিণতি বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধবাঙালীর নিজস্ব রাষ্ট্র – একটি পতাকাএই অর্জনের পশ্চাতে যার সবচাইতে বড় অবদান তাঁর নাম:বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান — একটি নতুন রাষ্ট্রের স্থপতি – যার নাম বাংলাদেশ’ –একটি নতুন জাতির জনক, যে জাতির নাম বাঙালীজাতি

 

    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের আর একটি স্তম্ভ হল পশ্চিমী ধাচের উদারনৈতিক গণতন্ত্র

 

সেই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ বেয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনে পরিবর্তন আসে ধাপে ধাপে এরই চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা থেকে উত্তীর্ণ হলেন বাংলাদেশের অসংবাদিত জাতীয় নেতায়আবির্ভূত হলেন পরিপূরক রাষ্ট্র নেতায় যে স্তরে অন্যকোন রাজনৈতিক নেতা উঠে আসতে পারেন নিপৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু স্থান করে নিলেন গান্ধী, নেহেরু, মাও সে তুং, সুকর্ণ, হোচি-মিন, নাসের-টিটো, মান্দেলা, ফিডেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ নেতাদের পংক্তিতেশেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনে শেষ পর্যায়ে, যখন তিনি উন্নীত হয়েছেন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে, যুক্ত হয়েছে সমাজতন্ত্রতাঁর এই সমাজতন্ত্র কিন্তু কট্টর মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র নয়এই সমাজতন্ত্র মিশ্র অর্থনৈতিক — এখানে স্থান পাবে রাষ্ট্রিয় আর্থ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান —পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পূরক সহাবস্থান

 

 বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামরিকতন্ত্রের কোন স্থান ছিল নাতিনি বিশ্বাস করতেন না বাংলাদেশের মত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ও অর্থ সম্পদে দুর্বল একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন ব্যয়বহুল শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনীএছাড়া শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী সবসময় দেশের গণতন্ত্রের সুষ্ঠুবিকাশের জন্য, বিশেষ করে, পশ্চাপদ উন্নয়নশীল দেশে- সবসময় হুমকি স্বরূপতিনি মনে করতেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত জনগণই বাংলাদেশের আসল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা — এছাড়া দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবে আমাদের সুরক্ষায়বঙ্গবন্ধু অনেকবার বলেছেন তিনি চান বাংলাদেশকে ইউরোপের ছোট রাষ্ট্র সুইজারল্যাণ্ডের মডেলে গড়ে তুলতেতার এই আদর্শই ডেকে আনে নিজের সর্বনাশ — সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট একটি অংশ তার হত্যার সাথে যুক্ত হওয়া কোন আকস্মিক ঘটনা হতে পারে না

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের চরমতম সাফল্য অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধিকার আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনতাই বাঙালীর দাবী একদফার কেন্দ্রীভূত হল — বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর

১৯৭১ সালের ১লা মার্চের ইয়াহিয়ার ঘোষণার জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে — বাঙালীর অন্তরের কামনাকে ভাষা দিলেন :

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

 

আমাদের ভবিষ্যত রণসঙ্গীতের বাণী রচিত হয়ে গেল ৭ই মার্চে (১৯৭১) সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির স্মৃতি আজও আমায় রোমাঞ্চিত করেলক্ষ মানুষের সাথে আমিও অপেক্ষা করছি কখন আসবেন ইতিহাসের মহানায়কসেই অপেক্ষার মুহূর্তগুলি কবি নির্মলেন্দু গুনের ভাষায় বলি:

 

একটি কবিতা লেখা হবে

তার জন্যে অপেক্ষা উত্তেজনা নিয়ে

লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা

বসে আছে

ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে

কখন আসবে কবি

…. …. ….

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন

…. …. ….

গণসূর্যের মঞ্চ কাপিয়ে কবি

শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি —

এবারের সংগ্রাম

আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

 

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের

 

কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞ বাংলার মানুষ স্বাধীনতার সেই অমর কবিকে হত্যা করলাম নিস্কম্প্রহাতেচাইলাম বঙ্গবন্ধু’-‘বাংলাদেশ’ ‘বাঙালীএই শব্দগুলিকে বাংলাদেশের হৃদয় হতে চিরতরে মুছে দিতেতাই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতেও স্তব্ধ হলাম না — যেখানেই বঙ্গবন্ধুর নাম, যেখানেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য —তার নামে প্রতিষ্ঠান সব ভেঙে দিতে চাইলাম উন্মত্ত হয়ে — কুসিত পন্থায়অশালীন অশ্রাব্য ভাষায় তাঁকে অব্যাহতভাবে আক্রমণ করে চলেছে মুস্তাক আহমেদের সূর্যসন্তানের দল আর জিয়ার আদর্শের সৈনিকরাকিন্তু তবুও কি বাংলাদেশের স্থপতির নাম মুছে ফেলা যাবে — দীর্ঘকায় মানুষটিকে খর্বকায় বামনে রূপান্তর করা যাবেবঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে — বাংলার সাধারণ মানুষের ভালবাসায়

 

আমাদের সেই মর্মবেদনাকেই ভাষা দিয়েছেন প্রয়াত কবি অন্নদাশঙ্কর ঃ

 

                                    যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা

                                                গৌরী যমুনা বহমান

                                    ততদিন রবে কীর্তি তোমার

                                                শেখ মুজিবুর রহমান

 

শোকাহত কবি মুহ্যমান বাঙালী সত্ত্বাকে আহ্বান জানিয়েছেন এই বলেঃ

                       

                        বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো না নীরব দর্শক 

                        ধিক্কারে মুখর হওহাত ধুয়ে এড়াও নরক

 

কিন্তু এত ধিক্কার সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে ক্রন্দনরত আমাদেরই সর্ব্বোচ্চ বিচারালয়ের চার দেওয়ালে আবদ্ধ — বন্দী লাল ফাইলের মধ্যেধিক শতধিক আমাদের বিচার ব্যবস্থা!

 

তবে সান্ত্বনার বিষয় সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে হলেও এই বিচারকার্য সমাপ্ত হযেছেশীর্ষ আদারত ঘাতকদের দোষী সাব্যস্ত করে প্রকৃত দোষীদের প্রাণ দণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেনআমি ব্যক্তিগতভাবে অ্যামনেস্টি ইস্টারন্যাশনালসহ অনেক মানবাধিকার সংগঠনের সাথে প্রাণ দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে, এ ব্যাপারে সতত ছিলাম উচ্চকণ্ঠকিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনীদের জন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুকম্পা নেই, তাই দেশবাসীর সাথে আমিও চাই এই দণ্ডাদেশ অনতিবিলম্বে কার্যকর হোকএই অপরাধীর দল তো শ্রধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব-শিশু রাসেলসহ পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করে নি, তারা আমাদের গণতন্দ্রকে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে, মুক্তিযুদ্ধেও চেতনাকে হত্য করেছেতারা সর্বোপরি আমাদের দেশ ও জাতিকে হত্যা করতে চেয়েছিলএই অপরাধের তো ক্ষমা নেই, ক্ষমা হয় নাকৃত কর্মের শাস্তি মুস্তাক-ফারুখ-রশীদ গংদের পেতেই হবে