052-prisutdelingen-2
| ১০ ডিসেম্বর ২০০৬ অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত নোবেল বক্তৃতা |

‘দারিদ্র্যকে আমরা জাদুঘরে পাঠাতে পারি’
-মুহাম্মদ ইউনূস

মান্যবর রাজা, রাজকীয় মান্যবর, নরওয়ের নোবেল কমিটির মাননীয় সদস্যবৃন্দ, সুধীমণ্ডলী, ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ!

গ্রামীণ ব্যাংক ও আমি নিজে সবচেয়ে মর্যাদাকর পুরস্কার গ্রহণ করতে আজ গভীর সম্মানিত বোধ করছি। এই সম্মানে সম্মানিত হয়ে আমি পরম রোমাঞ্চিত, অভিতূত ও আপ্লুত। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে সারাটা বিশ্ব থেকে অগুণতি বার্তা আসছে আমার কাছে। কিন্তু যা আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে, যখন প্রায় প্রতিদিন আমি টেলিফোন পাই গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রাহক, বাংলাদেশের সেই সুদূর পল্লীজনপদগুলির মানুষের কাছ থেকে, যারা আমাকে জানাতে চান এই মহৎ স্বীকৃতি পেয়ে তারা কতোখানি গৌরববোধ করছেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের ৭০ লাখ ঋণগ্রাহক-মালিক সদস্যদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ৯ নারী প্রতিনিধি এ পুরস্কার গ্রহণের জন্য আমার সাথে অসলোতে এসেছেন। আমি তাদের পক্ষ থেকে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক-কে মনোনীত করায় ধন্যবাদ জানাই। তাদের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাদায়ক পুরস্কার দিয়ে তাদেরকে আপনারা অতুলনীয় সম্মানের অধিকারী করেছেন। আপনাদের এ পুরস্কারের সুবাদে বাংলাদেশের ৯ জন গৌরবান্বিত পল্লীনারী এখানে নোবেল প্রাপকের মর্যাদায় আজকের এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে খোদ নোবেল শান্তি পুরস্কারে এক নতুন তাৎপর্য যোগ করেছেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের সব ঋণগ্রাহক আজকের দিনটি উদযাপন করছেন তাঁদের জীবনের মহত্তম দিবস হিসেবে। তাঁরা এ অনুষ্ঠান দেখার জন্য আর সবাইকে সাথে নিয়ে গোটা বাংলাদেশের নিজ নিজ গ্রামে তাদের নাগালের সবচে কাছের টিভি সেটটির চারপাশে জড়ো হয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে লাখো নারী যারা তাঁদের বেঁচে থাকার ও তাঁদের সন্তানসন্ততির উন্নততর জীবনের জন্য আশার আলো ফোটাতে নিত্য সংগ্রাম করে চলেছেন এ বছরের এ পুরস্কার তাদের সকলকে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদায় সমাসীন করেছে। তাই আজকের এ মুহূর্তটি তাদের জন্য এক ঐতিহাসিক মহামুহূর্ত নিঃসন্দেহে।

দারিদ্র্য শান্তির জন্য হুমকি

ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ!
শান্তির সাথে দারিদ্র্যের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে – এই ধারণার প্রতি নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটি আমাদেরকে এই পুরস্কার দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। দারিদ্র্য শান্তির জন্য হুমকি।

বিশ্বব্যাপী আয়ের বণ্টনের ছবি থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। বিশ্বের মোট আয়ের ৯৪ শতাংশ যায় বিশ্বের মাত্র শতকরা ৪০ জনের পকেটে। বাকি শতকরা ৬০ জন বিশ্ব আয়ের মাত্র ৬ শতাংশ দিয়ে জীবন নির্বাহ করে। বিশ্ব জনসমষ্টির অর্ধেকের দৈনিক গড় আয় ২ ডলার। আর প্রায় ১০০ কোটির মতো লোকের দৈনিক আয় এক ডলারেরও কম। এটি আর যা-ই হোক শান্তির জন্য কোনো ফর্মুলা হতে পারে না।

নতুন সহস্রাব্দের সূচনা হয়েছে বিশ্ব পর্যায়ে নতুন মহত্তম স্বপ্ন দিয়ে। ২০০০ সালে বিশ্বনেতারা জাতিসঙ্ঘে একত্রিত হয়ে অন্যান্য বিষযের সাথে ২০১৫ সাল নাগাদ দারিদ্র্য অর্ধেকে কমিযে আনার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মানবেতিহাসে আর কখনও গোটা বিশ্ব সমস্বরে এমন বলিষ্ঠ লক্ষ্য নির্ধারণ করেনি যে লক্ষ্য অর্জনের সময় ও আকার নির্ধারণ করে দেওয়া হযেছে। কিন্তু তারপরই এসেছে ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাস ও ইরাকের যুদ্ধ, আর বিশ্বও সেই সাথে তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের চলতি পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বিশ্ব নেতাদের মনযোগ সরে গেছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে। ইরাক যুদ্ধে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই খরচ হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার।

আমি বিশ্বাস করি, সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয় আর যা-ই হোক হবার নয়। সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভাষায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে হবে। আমাদের অবশ্যই একসাথে দাঁড়াতে হবে এর বিরুদ্ধে আর এর অবসানে সব রকমের উপায় আমাদের সন্ধান করতে হবে। সন্ত্রাসের চির অবসানের জন্য আমাদেরকে এর মূল কারণগুলি খুঁজে বের করতেই হবে। আমি বিশ্বাস করি, অস্ত্রের পেছনে অর্থ অপচয়ের চেয়ে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে সম্পদ নিয়োগ করাই অধিকতর উন্নত নীতিকৌশল।

দারিদ্র্যের অর্থ সকল মানবাধিকার থেকে বঞ্চনা

শান্তিকে উপলব্ধি করতে হবে মানবিক তাৎপর্যে — সুপরিসর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ন্যায়সঙ্গত না হলে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার না থাকলে পরিবেশের অবক্ষয় ঘটলে শান্তি হুমকির মুখে পড়ে।

কোনো রকম মানবাধিকার না থাকার অর্থই হলো দারিদ্র্য। চরম দারিদ্র্যজনিত হতাশা, বৈরিতা ও ক্ষোভে কোনো সমাজে শান্তি টেকসই হতে পারে না। তাই স্থায়ী শান্তির জন্য আমাদেরকে অবশ্যই মানুষ যাতে একটা সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য তাদের সুযোগ করে দিতে হবে।

দরিদ্রদ্রের নিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টি। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাই আমাদের সকল কাজের মর্ম বলেই গত ৩০ বছরে আমাদের সকল প্রয়াস সে কাজেই নিবেদিত রেখেছি।

গ্রামীণ ব্যাংক

নীতিপ্রণেতা কিংবা কোনো গবেষক নয়, আমার চারপাশ ঘেরা দারিদ্র্যের কারণেই আমি দারিদ্র্য ইস্যু নিয়ে কাজ করতে মাঠে নেমেছিলাম। তারপর সে কাজ থেকে আর ফেরা হয়নি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে তখন ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ ও আকাল চলছে। এ পটভূমিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে অর্থনীতিশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্বগুলি পড়ানো আমার কাছে কঠিন মনে হলো। হঠাৎ ধারণা হলো নিদারুণ
ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের মোকাবেলায় আমার কাছে অর্থনীতির এ সব তত্ত্ব নিতান্তই অন্তঃসারশূন্য। আমি আমার আশপাশের মানুষকে, এমনকি মাত্র একজনকে একটি দিনের জন্যও একটু স্বস্তি দিতে আশু সাহায্য করতে চাচ্ছিলাম। আর এরই ফলে আমি মুখোমুখি হলাম দরিদ্র মানুষগুলির সামান্যতম টাকাপয়সা দিয়ে সহায়তা করতে যারা কোনোও রকমে বেঁচে থাকার জন্য লড়ে চলেছে। গ্রামের এক নারীকে দেখলাম মহাজনের কাছ থেকে এক ডলারের কম পরিমাণ টাকা কর্জ করছে এই কঠিন শর্তে যে ঐ নারী হাতে যেসব পণ্য তৈরি করে সেগুলি মহাজন তার নিজের নির্ধারিত দামে কিনে নেবার অধিকারী হবে। আমি এটা লক্ষ্য করে মর্মাহত হলাম যে বাস্তবিকপক্ষেই এটাতো শ্রমদাস বা শ্রমদাসী কেনার মতো মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যবস্থা।

আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয ক্যাম্পাসের পাশের গ্রামেই এই মহাজনী কর্জ ব্যবসার শিকার সকলের একটা তালিকা তৈরি করলাম আমি।

তালিকাটা তৈরি হলো ৪২ জনকে নিয়ে। ওরা কর্জ নিয়েছে মোট ২৭ ডলারের সমান টাকা। আমি আমার নিজের পকেট থেকে ঐ টাকাটা ওদেরকে দিলাম যাতে ওরা মহাজনের কবল থেকে রক্ষা পায। আমার এই সামান্য কাজে তাদের মাঝে যে আলোড়ন আমি লক্ষ্য করলাম তাতে আমি এ কাজে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লাম। যদি এতো সামান্য অর্থ দিয়ে এতোগুলি মানুষকে এতো সুখী করতে পেরে থাকি তাহলে একাজটাই আরও বেশি করে কেন নয়?

এ কাজটাই আমি তখন থেকে করে আসছি। এ পর্যায়ে আমি প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একটা ব্যাংক-কে এই গরিব লোকগুলিকে ঋণ দেবার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। ব্যাংক বললো, দরিদ্ররা ঋণ দেবার মতো আস্থাযোগ্য নয়। কয়েক মাস ধরে সকল প্রয়াস ব্যর্থ হবার পর আমি ঐ গরিবলোকগুলি ব্যাংক থেকে যে টাকা ধার নেবে তার জামিনদার হবার প্রস্তাব দিতে টাকাটা অবশেষে পাওয়া গেলো। এরপর যে ফল পাওয়া গেলো তা একেবারেই অভাবিত, আমি রীতিমতো অবাক হলাম। ঐ গরিব লোকগুলি যতোবারই ঋণ নিক না কেন ততোবারই যথাসময়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করলো। এতোকিছুর পরেও কিন্তু ব্যাংকের মাধ্যমে এ কার্যক্রম সম্প্রসারণের কাজে নানা রকমের সমস্যা চলতেই থাকলো। আমি তাই তখন দরিদ্রদের জন্য আলাদা একটা ব্যাংক গড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর এতে শেষ পর্যন্ত সাফল্য এলো ১৯৮৩ সালে। আমি এ ব্যাংকের নাম দিলাম গ্রামীণ ব্যাংক।

আজ গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের ৭৩ হাজার গ্রামের প্রায় ৭০ লাখ দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিচ্ছে যাদের শতকরা ৯৭জনই নারী। গ্রামীণ ব্যাংক কোনোরকম বন্ধক/জামানত ছাড়াই গরিব পরিবারগুলিকে আয়বর্ধক, গৃহনির্মাণ, পড়াশোনা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে ঋণ দিয়ে থাকে। আর এর সাথে রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের জন্য সঞ্চয়, পেনশন তহবিল ও বীমার নানারকমের আকর্ষণীয সুযোগসুবিধা। ১৯৮৪ সালে প্রবর্তনের পর থেকে এ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের গৃহঋণের অর্থ কাজে লাগিয়ে ৬ লাখ ৪০ হাজার গৃহ নির্মাণ করা হযেছে। আর এসব বাড়ির আইনি মালিকানা হলো নারীদের। আমরা নারীদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছি এ কারণে যে আমরা দেখেছি নারীদের ঋণ দিলে তাতে সবসময় তাদের পরিবার সবচে বেশি উপকার পেয়েছে।

সামগ্রিকভাবে ব্যাংক মোট প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের সমমূল্যমানের ঋণ দিযেছে। এ ঋণ পরিশোধের হার ৯৯%। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়মিতভাবে মুনাফা করে থাকে। আর্থিক দিক থেকে এ ব্যাংক স্বনির্ভর, ১৯৯৫ থেকে একে কোনো দাতার টাকা নিতে হয়নি। এখন গ্রামীণ ব্যাংকের আমানত ও নিজ সম্পদের হার তার সকল বকেয়া ঋণের ১৪৩ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের ঋণগ্রাহকদের শতকরা ৫৮ জন দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করেছেন। অর্থাৎ আর তারা দরিদ্র হিসেবে গণ্য নন।

গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম একটা অতি ছোট্ট দেশজ প্রকল্প হিসেবে যার কর্মপরিচালনায় ছিল আমার কিছু ছাত্রছাত্রী। এরা সবাই স্থানীয় যাদের তিনজন এখনও গ্রামীণ ব্যাংকে আমার সাথেই রয়েছে এ কয় বছর যাবত। এ প্রতিষ্ঠানের এখন শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আমার সঙ্গে আজ এখানে উপস্থিত রয়েছে আপনারা আমাদেরকে যে সম্মাননায় সম্মানিত করেছেন তাতে অংশীদার হতে।

গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণার সূচনা বাংলাদেশের একটা ছোট্ট গ্রাম জোবরায়। আজ সে ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের চারদিকে। প্রায় প্রতিটি দেশেই এখন গ্রামীণ মডেলের কার্যক্রম রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রজন্ম

৩০ বছর আগে আমাদের যাত্রা শুরু। আমাদের যারা ঋণগ্রাহক তাদের সন্তানদের জীবনে আমাদের কাজের কী প্রভাব পড়েছে তা আমরা বরাবর পর্যবেক্ষণে রেখেছি। যে সব নারী আমাদের ঋণগ্রাহক তারা তাদের সন্তানদের বেলায় সবসময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। এই নারীরা ১৬টি সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করে অনুসরণ করে আসছে তাদের নিজ কল্যাণে। এ সব সিদ্ধান্তের একটি ছিল তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর। গ্রামীণ ব্যাংকের উৎসাহে অচিরেই এ সব নারীর সন্তানেরা বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করে। আর এ সব ছেলেমেয়েদের অনেকেই তাদের ক্লাসে সেরা ছাত্রছাত্রী হয়ে ওঠে। আমরা তাদের এ সাফল্য ও কৃতিত্ব উপযাপনের লক্ষ্যে প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমরা স্কলারশিপ প্রবর্তন করি। গ্রামীণ ব্যাংক এখন প্রতি বছর ৩০ হাজার স্কলারশিপ দেয়।

এসব ছাত্রছাত্রীর অনেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পেরিয়ে ডাক্তার, প্রকৌশলী, কলেজ শিক্ষক ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। গ্রামীণ ছাত্রছাত্রীরা যাতে তাদের উচ্চশিক্ষা স্বাচ্ছন্দ্যে সমাপ্ত করতে পারে সেজন্য ছাত্রঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। এদের অনেকে এখন পিএইচডিধারী। ১৩ হাজার ছাত্রছাত্রী এই ঋণের সুবিধে নিয়েছে। আর বছরে এ সংখ্যার সাথে যোগ হচ্ছে ৭০০০-এরও বেশি করে।

আমরা গড়ে তুলছি সম্পূর্ণ এক নতুন প্রজন্মের নাগরিক, যারা তাদের পরিবারকে দারিদ্রের নাগাল থেকে দূরে সরানোর মতো যোগ্যতার অধিকারী হবে। আমরা দারিদ্র্যের ঐতিহাসিক নিরবচ্ছিন্নতা ভাঙতে চাই।

ভিখারীরা হতে পারে ব্যবসায়ী

ক্ষুদ্রঋণ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের শতকরা ৮০টি দরিদ্র পরিবারের নাগালে পৌঁছে গেছে। আমরা আশা করছি ২০১০ সাল নাগাদ দেশের শতকরা ১০০টি পরিবারের কাছে পৌঁছে যাবে।

তিনবছর আগে আমরা প্রধানত ভিখারীদের নিয়ে একটা একান্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো বিধিবিধান এদের মানতে হয় না। তাদেরকে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। তারা তাদের সাধ্য অনুযায়ী যে কোনো অঙ্কের টাকা যখন তাদের সুবিধা হয় পরিশোধ করতে পারে। আমরা তাদের আইডিয়া দিয়েছিলাম : তারা বাড়ি বাড়ি তো ভিক্ষা করতে যায়ই। তাই যখন তারা ভিক্ষা করতে যায় সঙ্গে করে কিছু হালকা খাবার, খেলনা বা গৃহসামগ্রী নিয়ে যেতে পারে বিক্রির পণ্য হিসেবে। আইডিয়াটা বেশ কাজে লেগে যায়। আমাদের এই কার্যক্রমের আওতায় ৮৫ হাজার ভিখারী রয়েছে। এদের পাঁচ হাজার ইতিমধ্যেই ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের আর অন্তত ভিক্ষা করতে হয় না। এই ভিখারীদের গড়ে ১২ ডলারের সমান টাকার ঋণ দেওয়া হয়।

আমরা কল্পনাযোগ্য সকল উপায়ে দরিদ্রদেরকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে উৎসাহিত ও সাহায্য সহায়তা করে থাকি। আমরা অন্য সকল উপায়ের সাথে সবসময় ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে প্রচার করি এই যুক্তি দেখিয়ে যে অন্য যে সব উপায়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই চলে তাতে এটি আরও বেশি সুফল আনতে সহায়ক হয়।

দরিদ্রদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) গোটা দুনিয়াকে দ্রত বদলে দিচ্ছে। যোগাযোগে দূরত্ব লোপ পাচ্ছে, দেশ-বিদেশের সীমারেখা মুছে গিয়ে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের নতুন এক জগত গড়ে উঠছে। যোগাযোগের খরচ কমে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তি যদি দরিদ্রদের চাহিদা মেটাতে তাদের নাগালে আনা যায় আমার ধারণা তাদের জীবন বদলে ফেলার একটা সুযোগ মিলবে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে দরিদ্রদের নাগালে নিয়ে আসার পয়লা ধাপ হিসেবে আমরা একটা মোবাইল বা সেলফোন কোম্পানি গড়ে তুলি যার নাম গ্রামীণ ফোন। গ্রামে ফোন করার সেবা দিয়ে আয় করার জন্য আমরা দরিদ্র নারীদেরকে মোবাইল ফোন কেনার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাদেরকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। আমরা ক্ষুদ্রঋণ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মধ্যে সুন্দর একটা ফলদায়ক যোগাযোগ লক্ষ্য করেছি।

এই ফোনের ব্যবসাটা দারুণ সাফল্য লাভ করে। এ ব্যবসাটা গ্রামের যারা ক্ষুদ্রঋণ নেয় তাদের জন্য রীতিমতো লোভনীয় উদ্যোগ ব্যবসা হয়ে ওঠে। এ ভাবে পল্লী জনপদে যে সব নারী মোবাইল ফোনের সেবা দেওয়ার ব্যবসায় নেমেছে “টেলিফোন লেডি” হিসেবে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। এই টেলিফোন লেডিরা দ্রুত এ ব্যবসার নাড়ীনক্ষত্র আয়ত্ত্ব করে, নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রতিভার পরিচয় দেয় এই ব্যবসায়ে। এমনি করে টেলিফোন ব্যবসা দ্রুত দারিদ্র্য থেকে মুক্তি ও সমাজে মর্যাদা লাভের উপায় হয়ে ওঠে। আজকে বাংলাদেশে এরকম টেলিফোন লেডির সংখ্যা ৩ লাখ যারা বাংলাদেশের সকল গ্রামে টেলিফোন সার্ভিস দিচ্ছে। গ্রামীণ ফোনের গ্রাহক সংখ্যা এখন এক কোটির বেশি। দেশে এটিই বৃহত্তম মোবাইল টেলিফোন কোম্পানি। টেলিফোন লেডিরা গ্রামীণ ফোনের এই মোট গ্রাহক সংখ্যার একটা সামান্য অংশ হলেও তারা কিন্তু কোম্পানির মোট রাজস্বের ১৯ শতাংশের জোগানদার। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডের মোট নয় সদস্যের যে আট সদস্য আজকের এ মহতী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তাদের চারজনই টেলিফোন লেডিদেরই প্রতিনিধি।

গ্রামীণ ফোন নরওয়ের টেলিনর ও বাংলাদেশের গ্রামীণ টেলিকম-এর এক যৌথ উদ্যোগ কোম্পানি। টেলিনর এ কোম্পানির ৬২ শতাংশ শেয়ারের মালিক আর গ্রামীণ টেলিকমের মালিকানা হলো ৩৮ শতাংশের। আমাদের পরিকল্পনা ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র নারীদেরকে সিংহভাগের মালিকানা দিয়ে এ কোম্পানিকে একটা সামাজিক ব্যবসায়ে রূপান্তরিত করা হবে। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছি। কোনোও একদিন গ্রামীণ ফোন দরিদ্রদের মালিকানায় আরও এক বিরাট উদ্যোগ প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে যাবে।

মুক্তবাজার অর্থনীতি

মুক্তবাজার পুঁজিবাদে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। দাবি করা হয় মুক্তবাজার যতো মুক্ত হবে কি, কেমন করে ও কার জন্য – এ প্রশ্নগুলির সমাধানেও পুঁজিবাদের ফলও ততো ভালো হবে। আরও দাবি করা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে লাভের জন্য ব্যক্তির অন্বেষণ সমষ্টিপর্যায়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুফল নিয়ে আসবে।

আমি বাজারের স্বাধীনতা জোরদার করার পক্ষে। আর একই সময়ে আমি বাজারে যে সব শক্তি কাজ করে সে সবের ওপর ধারণামূলক বিধিনিষেধ আরোপের একান্ত বিরোধী। এর উৎপত্তি হলো এই অনুমানে যে উদ্যোক্তারা একমাত্রিক মানুষ বিশেষ যারা তাদের ব্যবসায় জীবনে একটিমাত্র মিশনে নিবেদিত। বলাবাহুল্য সেটি হলো মুনাফা সর্বাধিক করা। পুঁজিবাদের এই ব্যাখ্যা উদ্যোক্তাদেরকে তাদের জীবনের সকল রাজনৈতিক, আবেগীয়, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও পরিবেশগত দিকমাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সম্ভবত এটি করা হয় এক যুক্তিনির্ভর সরলীকরণ হিসেবে। কিন্তু তাতে মানব জীবনের একান্ত নির্যাসকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে।

মানুষ এক অপূর্ব সৃষ্টি যার সত্তায় মিশে আছে অনন্ত মানবীয় গুণ ও সামর্থ। আমাদের গড়া তত্ত্বগুলিতে তাই এসব মানবীয় গুণের কুসুমকলি ভাববাচ্যে দূরে না সরিয়ে রেখে প্রস্ফুটিত করার ব্যবস্থা অন্তর্ভূক্ত থাকা উচিত।

মুক্তবাজারে ভূমিকাপালকদের ওপর এ বিধিনিষেধই বিশ্বের বহু সমস্যার কারণ। পৃথিবীর মোট জনসমষ্টির অর্ধেকই হতদরিদ্র। কিন্তু তাদের এই সমস্যার সমাধান বিশ্ব করেনি। স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাগালে নেই। সবচে সমৃদ্ধ ও মুক্তবাজার রয়েছে এমন দেশও তাদের জনসংখ্যার পঞ্চমাংশের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা দিতে পারেনি।

মুক্তবাজারের সাফল্যে আমরা এতোই চমৎকৃত যে আমরা আমাদের মৌলিক ধারণাগুলির ব্যাপারে কোনোরকম সংশয় প্রকাশ করতেও কখনও সাহস পাইনি। ব্যাপারটা আরও জঘন্য করে তোলার জন্য আমরা বরং যতোটা পারা যায় আমাদের নিজেদেরকে তাত্ত্বিক নিরিখে একমাত্রিক মানুষে রূপান্তরিত করার জন্য বাড়তি খাটুনি খেটেছি যাতে করে মুক্তবাজার কার্যব্যবস্থা সাবলীল কাজ করতে পারে।

‘উদ্যোক্তা’র একটা বিস্তৃততর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে আমরা মুক্তবাজারের চৌহদ্দির মধ্যে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমরা বিশ্বের বহু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে পারি। মনে করুন, একজন উদ্যোক্তার প্রেরণার একক উৎসের (যেমন, সর্বাধিক মুনাফা করা) বদলে দুটি উৎস রয়েছে এবং এ দুই উৎস আবার পরস্পর বিরোধী অথচ সমান বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন — ক) সর্বাধিক মুনাফা করা ও খ) মানুষ ও জগতের কল্যাণ সাধন।

এখন এ দুয়ের প্রতিটি প্রেরণা একটি পৃথক ধরনের ব্যবসা অভিমুখী। আমরা প্রথম ধরনের প্রেরণাকে বলবো মুনাফা সর্বাধিকারক ব্যবসা আর দ্বিতীয় ধরনের ব্যবসাকে বলবো সামাজিক ব্যবসা।

এই সামাজিক ব্যবসা হবে বাজারে প্রবর্তিত নতুন একধরনের ব্যবসা যার উদ্দেশ্য পৃথিবীকে বদলে দেওয়া। এই সামাজিক ব্যবসায় বিনিযোগকারীরা তাদের বিনিয়োজিত পুঁজি ফিরে পেতে পারবে কিন্তু কোম্পানি থেকে কোনো মুনাফা নিতে পারবে না। বরং মুনাফা ফিরে যাবে কোম্পানিতে যা দিয়ে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে আরও দূরবর্তী এলাকায় আর সেই সাথে পণ্য বা সেবার মান আরও উন্নত হবে। এ ধরণের সামাজিক ব্যবসায় হবে লোকসান ও মুনাফাবিহীন কোম্পানি।

আমাদের প্রস্তাবিত সামাজিক ব্যবসা আইনে স্বীকৃত। বহু কোম্পানি রয়েছে যারা তাদের মূল ব্যবসায় তৎপরতা ছাড়াও সামাজিক ব্যবসা গড়তে এগিয়ে আসবে। মুনাফাবিহীন খাতের বহু কর্মীও এটিকে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করবেন। মুনাফাবিহীন খাতে যেখানে প্রতিষ্ঠানকে তার কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাবার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতে হয় সেখানে সামাজিক ব্যবসা হয় স্বনির্ভর আর সেই সাথে সম্প্রসারণের প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে কেননা, এটা মুনাফাবিহীন উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান। সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার পুঁজি সংগ্রহের জন্য তার নিজস্ব নতুন ধরনের মুলধন বাজারে যাবে।

বিশ্ব জুড়ে, বিশেষ করে বিত্তবান দেশগুলির যুবক-তরুণেরা সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে অত্যন্ত আবেদনময় বলেই দেখবেন এ কারণে যে এ ব্যবসা তাদেরকে তাদের সৃষ্টিধর্মী প্রতিভা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু বদলে দেবার চ্যালেঞ্জ নেবার আমন্ত্রণ জানায়। আজকের বহু তরুণ-তরুণী বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে কোনো অর্থবহ, রোমাঞ্চকর চ্যালেঞ্জ নেবার সুযোগ দেখতে পায় না বলে হতাশায় ভোগে। অথচ এর পাশাপাশি সমাজতন্ত্র তাদের লড়াই করার স্বপ্ন দেখায়। তরুণেরা তাদের একান্ত নিজের নিটোল, নিখুঁত এক বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখে।

সামাজিক ব্যবসা বিশ্বের প্রায় সকল আর্থসামাজিক সমস্যার প্রতিকার দেবে। কেবল চ্যালেঞ্জ হলো ব্যবসায়ের উদ্ভাবনীমূলক মডেল তৈরি করে তা সাশ্রয় ও কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়ে বাঞ্ছিত সামাজিক সুফল নিয়ে আসা। দরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা, তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, বিপণন ও নবায়নযোগ্য ইন্ধনশক্তি – এ সবই হলো সামাজিক ব্যবসার রোমাঞ্চকর কর্মক্ষেত্র।

সামাজিক ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এ ব্যবসা মানবজাতির অতীব গুরুত্ববহ বিষয়গুলির সুরাহা করে। বিশ্বের মোট জনসমষ্টির যে ৬০ শতাংশ দারিদ্র্যরেখার নিচে অবহেলিত রয়ে গেছে এ ব্যবসা তাদের জীবনের খোলনলচে বদলে দিতে পারে। তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সহাযতা করতে পারে।

গ্রামীণের সামাজিক ব্যবসা

এমনকি সর্বাধিক মুনাফাকারী কোম্পানিগুলিকে পরিকল্পিত উপায়ে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করা যায়। এটা করা যায় ঐ কোম্পানিতে গরিবদের পূর্ণ বা সিংহভাগের মালিকানা দিয়ে। এ হলো দ্বিতীয় ধরনের সামাজিক ব্যবসায় কোম্পানির দৃষ্টান্ত। গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক ব্যবসার এই শ্রেণীভুক্ত।

দরিদ্র মানুষ এসব কোম্পানির শেয়ার দাতাদের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পেতে পারে অথবা তারা তাদের নিজের টাকা দিয়ে এসব কোম্পানির শেযার কিনতে পারে। ঋণগ্রাহকরা তাদের নিজের টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার কিনেছে। তাদের এ শেয়ার যারা ঋণগ্রাহক নয় তাদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য নয়। পেশাদার ও নিবেদিতপ্রাণ একদল লোক এ ব্যাংকের দৈনন্দিন কর্মতৎপরতা পরিচালনার কাজ করে থাকে।

দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় দাতারা সহজেই এ ধরনের সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যখন কোনো দাতা কোনো গ্রহীতা দেশে কোনো সেতু নির্মাণের জন্য কোনো ঋণ বা মঞ্জুরি দেয় তখন ঐ দাতা স্থানীয় দরিদ্রদের মালিকানায একটা সেতু কোম্পানি গঠন করতে পারে। আর এ কোম্পানি পরিচালনার দাযিত্ব দিতে হবে একটি অঙ্গীকারাবদ্ধ কোনো ব্যবস্থাপনা কোম্পানিকে। এ কোম্পানির যে মুনাফা হবে তা স্থানীয় মালিক দরিদ্র মানুষগুলি মুনাফা হিসেবে ও আরও সেতু নির্মাণের অর্থ জোগানোর কাজে ব্যয় হবে। এভাবে বহু অবকাঠামো প্রকল্প যেমন, সড়ক, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, উপযোগ কোম্পানি এভাবে গড়ে তোলা যায়।

গ্রামীণ প্রথম ধরনের দুটি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলেছে। এর একটা হলো দই তৈরির কারখানা বা য়োগার্ট কারখানা। এ কারখানায় পুষ্টিমান যুক্ত দই তৈরি হবে অপুষ্টির শিকার দরিদ্র শিশুদের জন্য। এ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে ফ্রান্সের ডানোনের সাথে যৌথ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বাংলাদেশে অপুষ্টিপীড়িত সকল শিশুর কাছে এই দই না পৌঁছানো অবদি এই ফ্যাক্টরির সম্প্রসারণ চলবে। এই ব্যবস্থার আওতায় আরেকটি চেইন প্রতিষ্ঠান হবে চক্ষু হাসপাতাল। এ সব হাসপাতালের প্রতিটিতে বছরে ১০ হাজার চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করা হবে। তবে এর জন্য খরচ ধরা হবে ধনী-গরিব ভিত্তিতে বিভিন্ন অঙ্কে।

সামাজিক স্টকমার্কেট

সামাজিক ব্যবসাগুলির সাথে বিনিযোগকারীদের যোগাযোগ করিয়ে দেবার জন্য আমাদের দরকার সামাজিক স্টক বাজার গড়ে তোলা যেখানে কেবল সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির স্টক-শেয়ারের বেচাকেনা চলবে। এই স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগকারী আসবেন কোনো সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তহবিল জোগানোর স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। এক্সচেঞ্জেও অনুরূপ উদ্দেশ্য থাকবে। আর যদি কারও নিছক টাকা বানানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে তিনি এখনকার স্টক এক্সচেঞ্জে যাবেন।

সামাজিক স্টক এক্সচেঞ্জগুলির যথাকর্ম পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য আমদের কিছু রেটিং এজেন্সি স্থাপন করা, পরিভাষাসমূহ প্রমিত করা, সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা, প্রতিবেদন ফর্ম্যাট গড়ে তোলা এবং দ্য ওয়াল স্ট্রিট জর্নালের মতো নতুন অর্থনৈতিক প্রকাশনা প্রকাশের ব্যবস্থা করার দরকার হবে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিজনেস স্কুলের মতো বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার ওপর কোর্স ও ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে তরণ ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণের জন্য। শিক্ষার্থীরা এখানে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনা শিখবেন। সর্বোপরি, এ সব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের নিজেদেরকে একেক জন সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা হবার প্রেরণা দেবে।

বিশ্বায়নে সামাজিক ব্যবসায়ের ভূমিকা

আমি বিশ্বায়নের সমর্থক। আমি বিশ্বাস করি দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় বিশ্বায়ন গরিবদের বরং ঢের বেশি উপকার করতে পারে। তবে বিশ্বায়ন হতে হবে যথার্থ ধরনের বিশ্বায়ন। আমার ধারণায় বিশ্বায়ন হলো শত লেনযুক্ত একটা জনপথের মতো কিছু যা সারা বিশ্বের ওপর দিয়ে চলে গেছে। যদি আমরা ধরে নিই, এ সড়ক সকলের জন্য খোলা তাহলে এর লেনগুলির নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলির কাছ থেকে নেবে বিশাল আকারের ট্রাকসমূহ। এই মহাসড়ক থেকে বাংলাদেশী রিকশাগুলি তুলে দেওয়া হবে। আর সকলের জন্য লাভজনক বিশ্বায়নের লক্ষ্যে এ বিশ্ব মহাসড়কের জন্য আমাদের অবশ্যই ট্রাফিক আইন, ট্রাফিক পুলিশে ও ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে যা দরিদ্র্যদের জন্য এ ব্যবস্থায় একটা জায়গা ও কর্মতৎপরতার ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকবে যাতে তারা সবলদের কনুইয়ের ঠেলায় মহাসড়ক থেকে ছিটকে না পড়ে। বিশ্বায়নকে আর যা-ই হোক আর্থসাম্রাজ্যবাদে পর্যবসিত হওয়া চলবে না।

শক্তিশালী বহুজাতিক সামাজিক ব্যবসায়ও গড়ে তোলা যেতে পারে দরিদ্র মানুষ ও দেশগুলির জন্য বিশ্বায়নের সুবিধা নিশ্চিত করতে। সামাজিক ব্যবসা হয় গরিবদেরকে তাতে মালিকানা দেবে নয় এ ব্যবসায় লব্ধ মুনাফা দরিদ্র দেশের মধ্যেই রাখবে যেহেতু এ সব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য মুনাফা নেওয়া নয়। যদি বিদেশী সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সরাসরি অন্য কোনো দেশে পুঁজি বিনিযোগ করে তাহলে যে দেশে এই বিনিয়োগ হচ্ছে সে দেশটির জন্য রীতিমতো এক রোমাঞ্চকর সুসংবাদ। লুটেরা কোম্পানিগুলির কবলমুক্ত থেকে ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে দরিদ্রদেশগুলির মজবুত অর্থনীতি গড়া হবে সামাজিক ব্যবসার প্রধান আগ্রহের ক্ষেত্র।

আমরা যা চাই তা সৃষ্টি করি

আমরা যা চাই বা যা আমরা প্রত্যাখ্যান করি না তা আমরা পেয়ে থাকি। আমরা এ বাস্তবতা মেনে নিয়েছি যে সবসময়ই দারিদ্র্য আমাদের ঘিরে থাকবে, দারিদ্র্য মানব নিয়তিরই অঙ্গ। ঠিক এ কারণেই আমরা আমাদের চারপাশে দরিদ্রদের নিয়েই আছি, থাকি, থাকবো। আমরা যদি স্থির বিশ্বাসে মনে করে থাকি দারিদ্র্য আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, দারিদ্র্য কোনো সভ্যসমাজের অঙ্গ নয় তাহলে আমাদের উচিত ছিল দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা ও নীতি প্রণয়ন করা।

আমরা চাঁদে যেতে চেয়েছিলাম, মানুষ চাঁদে পা রেখেছে। আমরা যা চাই তা পেতে পারি। আমরা যদি কোনো কিছু অর্জন না করে থাকি তাহলে সেটা তা হয়নি এজন্য যে আমরা সে বিষয়ে মনোনিবেশ করিনি। আমরা যা চাই তা গড়ি।

আমাদের মানসিকতা কি তার ওপর নির্ভর করে আমরা যা চাই তা কেমন করে পাবো। মানসিকতার ছাঁচ একবার তৈরি হয়ে গেলে সেটা বদলানো খুবই কঠিন। আমাদের জগত আমাদের মানসিকতা অনুযায়ী গড়ে ওঠে। আমাদের পটভূমি, আমাদের মানসিকতার গড়ন জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রুত বদলানোর, নতুন করে গড়ার জন্য আমাদের পথ ও উপায় বের করতে হবে। আমরা যদি আমাদের মানসিকতার আদল নতুন করে গড়তে পারি, আমরা আমাদের জগতও বদলাতে পারবো।

আমরাই দারিদ্র্যকে পাঠাতে পারি জাদুঘরে

আমি বিশ্বাস করি, আমরা দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে পারি কেননা, দরিদ্ররা দারিদ্র্য সৃষ্টি করেনি। এটির জন্ম দিয়েছে, লালন করেছে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা যে ব্যবস্থা আমরা গড়েছি, সে ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান, ধারণা ও নীতি তৈরি করেছি আমরা। সে নীতিও অনুসরণ করেছি আমরা ।

দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়েছে কারণ আমরা আমাদের যে তাত্ত্বিক কাঠামো গড়েছি তাতে মানব সামর্থ্যরে ঊনমূল্যায়ন করে নানা ধারণা ও প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে যেগুলি খুবই সঙ্কীর্ণ (যেমন,ব্যবসা, কেউ ঋণ দেওয়ার মতো আস্থাযোগ্য কিনা, উদ্যোক্তার ভূমিকা ও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত ধারণা) ও অসম্পূর্ণ (যেমন, আর্থপ্রতিষ্ঠানসমূহ যেখানে দরিদ্রদের প্রবেশাধিকার নেই)। মানুষের সামর্থ্যরে ঘাটতি নয় বরং ধারণাযন পর্যায়ে ব্যর্থতাই দারিদ্র্য সৃষ্টির কারণ।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার থাকলে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব রচনা করতে পারি। দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বে আপনারা কেবল একটি জায়গাতেই দারিদ্র্যকে দেখতে পারেন আর সেটা হলো জাদুঘর। শিশুদের তখন এরকম দারিদ্র্য সংক্রান্ত জাদুঘর দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে। আর তারা মানুষকে কেমন দুঃখ-দুর্দশা ও অবমাননায় পড়তে হয় তা দেখে তারা শিউরে উঠবে। এ রকম দীর্ঘকাল ধরে চলা এতোগুলি মানুষের অবিশ্বাস্য মানবেতর অবস্থা তাদের পূর্বপুরুষ কেমন করে মেনে নিয়েছে তা ভেবে শিশুরা তাদেরকে দোষারোপ করবে।

মানব শিশু পৃথিবীতে তার নিজের যত্ন নেওয়ার মতো করেই শুধু নয় বরং, তারা সামগ্রিকভাবে গোটা পৃথিবীর কল্যাণ প্রসারে অবদান রাখার যোগ্যতা রাখার মতো পরিপূর্ণরূপে সজ্জিত হয়েই ভুমিষ্ঠ হয় । কেউ কেউ তাদের জীবনে এ সম্ভাবনা কিছুটামাত্রায় কাজে লাগানোর, তাদের অনেকে জন্মসূত্রে পাওয়া সামর্থ্যরে অপূর্ব উপহারকে পূর্ণ বিকশিত ফুলের মতো মেলে ধরার সুযোগ পায় আবার অনেকেই পায় না। তাদের সে সুপ্ত সম্ভাবনা অনাবিষ্কৃত থাকা অবস্থায়ই তাদের জীবনাবসান ঘটে, তাদের সৃষ্টিশীলতা থেকে, তাদের অবদান থেকে পৃথিবী বঞ্চিত থেকে যায়।

গ্রামীণ আমাকে মানুষের সৃষ্টিশীলতার অটল বিশ্বাসে বিশ্বাসী করেছে। আর সে কারণে আমার এ বিশ্বাসও জন্মেছে যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের দুর্বিষহ দুর্দশা ভোগের জন্য মানুষ জন্মায়নি।

আমার কাছে গরিব মানুষ বনসাই বৃক্ষের মতো। আপনি যখন কোনো মহীরুহের বীজ ফুলের টবে বপন করেন তখন আপনি ঐ সুউচ্চ বৃক্ষের মাত্র কয়েক ইঞ্চি উঁচু একটা প্রতীকমাত্র পান। আপনি যে বীজ ফুলের টবে বপন করেছিলেন তাতে কোনো ত্রুটি ছিল না, কেবল মাটির বুনিয়াদটুকুই ছিল অপর্যাপ্ত। প্রতীকী এই কথাগুলির সরলার্থ হলো এই যে গরিব মানুষ বনসাইয়ের মতো। এ সব মানুষের বীজে তথা সম্ভাবনায় কোনো গলদ নেই, গলদ কেবল এই যে সমাজ তাদের প্রতিভা বা সামর্থ্য বিকাশের জন যথেষ্ট বুনিয়াদ দেয়নি। এই দরিদ্র লোকগুলিকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে আমাদের যা করা দরকার তাহলো তাদের জন্য সামর্থ্যদায়ক পরিবেশ দেওযা।

তাই আসুন যাতে প্রতিটি মানুষ তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটানোর ন্যায্য সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে সকলে হাত মেলাই।

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,

আমি আমার কথা শেষ করবো নরওয়ের নোবেল কমিটিকে আমার গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এ জন্য যে, তাঁরা স্বীকার করেছেন যে দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র নারীর মাঝে যেমন তাদের এক চমৎকার জীবন যাপনের সম্ভাবনা বর্তমান তাদের সে অধিকারও একই কারণে রয়েছে। আর ক্ষুদ্র ঋণ এ সম্ভাবনার দ্বার অবারিত করে দেওয়ার জন্য সহায়ক।

আমি বিশ্বাস করি, আপনারা আমাদেরকে যে সম্মাননায় সম্মানিত করলেন তা আমাদেরকে বিশ্ব পর্যায়ে দারিদ্র্য অবসানে একটা বিরাট আগ্রগতি নিয়ে আসতে পৃথিবী জুড়ে এ ক্ষেত্রে আরও অনেক ও বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

আপনাদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।


মূল ইংরেজি থেকে অনূদিত।
(কৃতজ্ঞতা: দৈনিক ‘প্রথম আলো’)