হোমিওপ্যাথি কতটা বিজ্ঞানসম্মত?
সুমিত্রা পদ্মনাভন

২০০৭- এ বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ একটি বিশেষ প্রতিবেদন বেরিয়েছে যাতে লেখক জে. গাইল্স হ্যানিম্যানের হোমিও চিকিৎসার মূল পদ্ধতিকে ‘অপবিজ্ঞান’ আখ্যা দিয়েছেন। প্রথমত, ‘বিষে বিষক্ষয়’ জাতীয় উপায়ে রোগ সারানো অর্থাৎ রোগকে বাড়িয়ে তুলে তারপর সারানোর যে কথা হোমিও ডাক্তাররা বলে থাকেন, তাকে ভিত্তিহীন বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেভাবে হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরি করা হয়; বারবার জলে বা স্পিরিটে দ্রবীভূত করে ঝাঁকিয়ে, তার থেকে দশভাগ নিয়ে আবার সেটাকে আরও তরল করে তারপর আবার…আবারও…এভাবে আরও দশবারÑতাও অর্থহীন। কারণ এভাবে বার চব্বিশেক তরলীকরণের পরে ওষুধের গুণসম্পন্ন একটি অণুও অবশিষ্ট থাকতে পারে না সেই দ্রবণে। কিন্তু আমরা দেখছি তারপরও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাপদ্ধতি দিব্যি পসার জমিয়ে চলেছে। অন্তত আমাদের দেশে।

যুক্তিবাদীদের কছে অনেকবারই প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘আপনারা হোমিওপ্যাথি নিয়ে কী বলেন? এটাকে কি বিজ্ঞান বলবেন? কেন এ বিষয়ে আপনারা নীরব?’ আমাদের উত্তর ছিল : ‘এখনও তেমন পড়াশোনা করা হয়নি বিষয়টা নিয়ে।’ আমরা নিজেরাও তো দেখেছি মা, বাবাকে, দিদিমা-ঠাকুরমাকে; ছোট্ট ছোট্ট গুলি বা পুরিয়া খেয়ে দিব্যি সেরে উঠতে। কারুর জ্বর, সর্দি ভালো হয়েছে তো কারুর বাচ্চার তোতলামি সেরেছে। আবার কারুর দিদার হাতের আঁচিলের মতো গুটি একেবারে মিলিয়ে গেছে। আমরা জানি না, ওষুধ না খেলে ওগুলো নিজে নিজে সারত কিনা। বা কেউ মিষ্টি গুলি ছাড়াও বাচ্চাকে কাশির সিরাপ, জ্বরের ওষুধ খাওয়াচ্ছিলেন কিনা। তবে আমরা দেখেছি এমার্জেন্সি হলেÑযেমন হঠাৎ ধুম জ্বর, মাথা ফাটা, পা ভাঙা ইত্যাদিতে কেউ হোমিওপ্যাথি করার কথা মুখেও আনেন না। তাই আমরা এ ব্যাপারে অনেকটাই চোখ বুজে ছিলাম।

বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় রচনা দেখেছি হোমিও চিকিৎসার পক্ষে। ইংরেজি রিডার্স ডাইজেস্টের মতো পত্রিকাও একবার লিখেছিল, পশুদের ওপর হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এটা ‘প্লাসিবো চিকিৎসা’ হতে পারে না। গরুর পায়ে মাদুলি বাঁধার কথা ভেবেছেন কি কেউ? না, কারণÑ‘বিশ্বাসের ব্যাপার’ পশুদের বেলায় খাটে না। কিন্তু এখন দেখছি এটাও অপপ্রচার ছিল।

২০০৫ সালে টেলার নামে এক বিজ্ঞানীর লেখা হতে জানা গেছে, ‘পশুর উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে হোমিওপ্যাথি ওষুধের কোনও প্রভাব পাওয়া যায়নি।’ অর্থাৎ আগের খবরটা নেহাতই গল্প ছিল, কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ছাড়াই মুখে মুখে ছড়ানো হয়েছিল। আজ হতে বহু বছর আগে মজার পরীক্ষা করেন রবার্টস নামে এক বিজ্ঞানী যা ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশ হয় ১৯০৯ সালে। পরীক্ষাটা এরকম : দুটো প্রচলিত কড়া হোমিওপ্যাথি ওষুধ নেওয়া হল। একটি ন্যাট্রিয়াম মিউরিয়েটিকাম থার্টি সি, আরেকটা সালফার থার্টি সি। হোমিওপ্যাথ ডাক্তারদের দৃষ্টিতে দুটোই খুব জবরদস্ত ওষুধ। দুটো ওষুধকে যথারীতি দ্রবীভূত করা হল। হোমিওপ্যাথের ওষুধ তৈরির পদ্ধতি অনুসরণ করে পোটেন্সি বা ওষধিগুণ বাড়ানোর জন্য যেভাবে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বারবার দ্রবণ তৈরি করা হয়, তা করা হল। এরপর একজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে দ্রবণ দু’টি দেওয়া হল। তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ক্লিনিকাল টেস্টÑযাবতীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করেও দুটো ওষুধকে আলাদা করে চিনতে পারলেন না। অর্থাৎ একটাকে আরেকটার থেকে আলাদা করে কোনটা সালফার আর কোনটা ন্যাট্রিয়াম বুঝতে পারলেন না। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি দুটোই এক। কোনওটাতেই আর ওষুধের অণুমাত্রও নেই। তাহলে কী আছে? কোন দাওয়াইটা কাজ করে শরীরের ওপর ?

আমরা মনে করতেই পারি কোনওটাই না। শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ‘ওষুধ খাচ্ছি’ এই মানসিক সাস্ত¡না, আর ধৈর্য ধরে ক’দিন অপেক্ষা করা। এর সবকটাই সম্ভত হোমিওপ্যাথি ওষুধের আপাত সাফল্যের কারণ। অনেক অসুখ, যেমন সর্দি-কাশি, অর্শ বা বাতের ব্যথা ইত্যাদি নিজে থেকেই বাড়ে, কমেÑসেরেও যায়।

এক সময় মনে করা হত জলে মেশানোর পর দ্রবণে মূল পদার্থ কণা কমতে কমতে যখন একটি অণুও থাকে না; তখনও জলে তার ‘স্মৃতিটুকু’ থাকে। আর এই স্মৃতিই মারাত্মকরকম ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু নাহ্! এই থিওরিও নাকচ হয়ে গেছে। ২০০৫-এ নতুন একরকমের স্পেকট্রোস্কোপিক পদ্ধতির সাহায্যে দেখানো হয়েছে যে ‘স্মৃতি’ বা যেটুকু ‘রেশ’ থাকে জলে দ্রবীভূত পদার্থের একটিও অণু না থাকার থাকার পরে সেটিও মুছে যায় ‘এক ফেমটো সেকেন্ড’-এর মধ্যে (ফেমটোসেকেন্ড হলো ১০-১৫ সেকেন্ড)। কাজেই সেই ‘মারাত্মক’ ক্ষমতাকে বোতলবন্দি করে ধরে রাখার কোনও প্রশ্নই উঠছে না।

সাইলেসিয়া ২০০ খেলে শোনা যায় গলায় ফুটে থাকা মাছের কাঁটা গলে যায়। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ সাইলেসিয়া ২০০ ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে কাঁচের প্লেটে সাইলেসিয়া ২০০ নিয়ে তাতে দিনের পর দিন মাছের একটা ছোট্ট কাঁটা ডুবিয়ে রেখে দেখেছিলেন- কাঁটা যেমনকে তেমনই রইল!

আমরা বলতেই পারি হোমিওপ্যাথি একটি লুপ্ত বিজ্ঞান- যদি বা তা আদৌ কোনওদিন বিজ্ঞান বলে পরিগণিত হয়ে থাকত, আজ সেই ভুল ভেঙে গেছে। তার একটা বড় কারণ প্রায় দুশো বছর ধরে এই বিজ্ঞান স্থবির হয়ে রয়েছে। এটা নিয়ে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। যা হয়েছে তাতে বরং পুরনো ধারণাগুলো ভুলই প্রমাণিত হয়েছে।

পুরনো জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়া বিজ্ঞানের ধর্ম। যখন আর এগোনো যাচ্ছে না, তখন বুঝতে হবেÑআর এগোনোর মতো বা ধারণাগুলোকে প্রমাণ করার মতো কোনও তথ্য নেই, কোনও তত্ত্ব তাই খাড়া করা যাচ্ছে না। তখন বিজ্ঞানের ধারাটির সেখানেই মৃত্যু ঘটে। যেমন ঘটেছে জ্যোতিষ নামক বিদ্যার।

জার্মানির ক্যাসেল ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞান বিভাগের কুটশেরা নামে এক স্কলার মজা করে বলেছেন, আজ যদি হ্যানিম্যান আধুনিক যুগের হোমিওপ্যাতি পরীক্ষায় বসেন, ফুল মার্কস পেয়ে পাশ করে যাবেন, কারণ তিনি তখন যা জানতেন, এখনও তার উপর আর নতুন কোন সংযোজন হয়নি। কিন্তু চার্লস ডারউন যদি বিবর্তনবাদ নিয়ে পরীক্ষায় বসেন, ডাহা ফেল করবেন। এখন তার চৎরহপরঢ়ষব ড়ভ উবংপবহঃ রিঃয গড়ফরভরপধঃরড়হ নু ঘধঃঁৎধষ ংবষবপঃরড়হ ধারণাটা আরও গতি পেয়েছে, আরও উন্নত আরও জটিল হয়েছে। ডারউইন সাহেব সব প্রশ্ন বুঝতেই পারবেন না, কারণ নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক শব্দগুলোই তাঁর অজানা ঠেকবে। তা সত্ত্বেও ডারউইন তাঁর সময়ে যা প্রমাণ করেছিলেন ও প্রশ্ন তুলেছিলেন তা মানবসমাজের সামনে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল, তিনি পথপ্রদর্শক হয়ে রয়েছেন বিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটির।

‘হোমিওপ্যাথি’ বিষয় হিসাবে তাই বদ্ধ, স্থবির। “একটা ওষুধ যত কম দেবে তত বেশি কাজ হবে। এক্কেবারে না দিলে সবচেয়ে ভালো কাজ হবে।” এর থেকে হাস্যকার যুক্তি আর কী হতে পারে! তাই বিজ্ঞানের সিলেবাসে হোমিওপ্যাথির স্থান নেই। এরপরও হোমিওপ্যাথির সমর্থকরা এতো জটিল সব কথার অবতারণা করেন, যেমন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণ-রসায়নের বাইরে না-কী ‘স্পিরিচুয়াল’ ‘এনার্জেটিক’ নামের শক্তি আছে, যদিও বিজ্ঞান কখনো এগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করে না।

সোজা কথায় যা বোঝায়, আমাদের সব দৈহিক শক্তির মূলে আছে সঠিক খাওয়া ও ব্যায়াম করা, আর প্রয়োজনে ঔষধ খাওয়া। এর জন্যে শরীরবিজ্ঞানকে জানতেই হবে; অন্য কোন শর্টকাট পথ নেই। এই শরীরবিজ্ঞানের আধুনিকতম প্রয়োগ আজকের এ্যালোপ্যাথি মেডিসিন। ২৫০ বছর আগের অবস্থা থেকে আমাদের জ্ঞান অনেক এগিয়েছে। এখন আমরা জানি শুধু ‘জল’ বা ‘অ্যালকোহল’ এমন কোনো ‘অলৌকিক’ শক্তি ধরে রাখতে পারে না, যা শরীরে কাজ করবে অথচ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ধরা পড়বে না। তাই হোমিওপ্যাথির গোড়াতেই গলদ রয়েছে।

‘স্পিরিচুয়াল স্পিরিট’ বা আত্মা বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। তবু যদি স্পিরিট বলতে মন বুঝি বা মানসিক বলে কিছু ধরে নেই, তাহলে বলতে হয়, ঔষধ বা ডাক্তারে ওপর বিশ্বাস বা ভরসা। এটার অবশ্যই কিছু প্রভাব আছে। এটাই চরম অবস্থায় ‘প্ল্যাসিবো’ চিকিৎসা, যা মানসিক বা সাইকোসোমাটিক রোগ সারাতে পারে। আর শারীরিক অসুখের ক্ষেত্রেও ডাক্তার এর ওপর আস্থা অনেক কাজ করতে পারে। কিভাবে? ঠিকমত ডাক্তারের কথা মেনে চলা, ‘আমি সুস্থ হবোই’ এই প্রত্যয় থেকে সবরকম চেষ্টা করে যাওয়া ইত্যাদি কারণে। এর বেশি আর কোন ‘স্পিরিচুয়াল’ কাজ ঔষধ করতে পারে না।

এরপরও প্রশ্ন উঠতে পারে, তবু কেন এত মানুষ ‘হোমিওপ্যাথি’ ঔষধে ভরসা করে?

১. ডাক্তারকে সব জায়াগায় পাওয়া যায় না, বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে।
২. চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেখানো বেশি খরচসাপেক্ষ ব্যাপার।
৩. ডাক্তার অনেক সময় বেশি ডোজের ঔষধ দিচ্ছেন, ভুল ঔষধ, কড়া বা অপ্রয়োজনীয় ঔষধ দিচ্ছেন।

তারচেয়ে হোমিও-তে- একদম বসে না থেকে কিছু চেষ্টা অন্তত করা হল। একথা ঠিক দুর্নীতিগ্রস্থ ডাক্তাররা ফার্মেসি বা ঔষধ কোম্পানি থেকে বেশি কমিশন পাবার আশায় অতিরিক্ত ঔষধ দিতে চান। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, খুব ভাল ডাক্তাররা খুব কম ঔষধ দেন। আমার মেয়ের চার বছর বয়সে এক অ্যালোপ্যাথ এর ওভারডোজ গ্রহণের ফলে সাংঘাতিক অসুস্থ হয়। হাম (সবধংষবং)-এর তেমন কোন ঔষধ নেই; কিন্তু আমার মেয়েকে যেই ডাক্তার দেখিয়েছিলাম তিনি এমন কড়া এন্টিবায়োটিক এডাল্ট ডোজ দিয়েছিলেন, যে বেচারার সারা মুখ-নাক-চোখে ঘা হয়ে গিয়েছিল বিষক্রিয়া থেকে। অন্য দেশে ডাক্তারদের এমন ভুল প্রেসক্রিপশন প্রদান করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। হোমিওপ্যাথি ঠিক এই জায়গাতেই ‘শূন্যস্থান পূরণ’ করছে।

আপনারা বাড়িতে চেষ্টা করে দেখুন- হোমিওপ্যাথি ঔষধের বদলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় কটা মিচড়ির বা চিনির দানা আর জল খাওয়ানÑভালোই ফল পাবেন। কম ঔষধ আর সঠিক ডায়েট/পথ্যে ভরসা রাখুন। আর ডাক্তার (অ্যালোপ্যাথি)-এর ডিগ্রি না দেখে আগে মানুষ ভালো কি-না, আন্তরিকতা আর সেবার মানসিকতা নিয়ে রোগী দেখেন কি-না সে খোঁজ নিন।

মুক্তমনায় লেখকের অন্যান্য লেখা
মানুষের ধর্ম মানবতা :pdf:
স্বেচ্ছামৃত্যু (যুক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত) :pdf:
আমরা যুক্তিবাদী