সেলিনা হোসেনের “পূর্ণ ছবির মগ্নতা’ বইয়ে রবি ঠাকুরের কৃষ্ণকলি লেখার পটভূমি পড়তে গিয়ে মনে হলো ছোটবেলায় কালো নিয়ে আমাদের অনুভূতি। যদিও আমার বাবার গায়ের রং কালো ছিল, কিন্তু আমার কাছে কালো মনে হতো না। ছোট দুই ভাইবোনও কালো অথচ আমার জ্যেঠতুত ভাই কে বলতাম —-
“কাইল্যায় আনে বাইল্যা মাছ
খোলায় দিলে সর্বনাশ।”
খোলা মানে তাওয়া। তবে কালোকে নিন্দা করে নয় — খেপানোর জন্যে এ ছড়াটি বলতাম। এজন্যে নিজেকে যে সুন্দরী ভাবতাম বা মনে হতো তা কিন্তু নয়। শুধু আমি নই—আমরা বলতাম। যার গায়ের রঙ কালো সেও অন্যকে এই ছড়াটিই বলতো। ঐটা ছিল এক ধরণের খেলা। ছড়াময় জীবন যাপন। এখন বুঝি অনেক পুরুষের এ খেলুড়ে মনোভাবের জন্যে কত নারীকে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি বা বিন্দুর মতো জীবনের পরিণতি নিতে হয়।
ওয়ান —
গু খাইয়া জোয়ান
টু
কলকাতার এস ডি ও
থ্রি
খালি খায় পান বিড়ি
এমন করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বলতাম। তুই কোন ক্লাসে? যদি উত্তর হতো সিক্স ।
তবে বলতাম —খালি খাস কিসমিস।
তুই কোন ক্লাসে?
সেভেনে।
তুই যাবি হেভেনে।
আর ক্লাস সেভেনে পড়া ছাত্রটির মুখাবয়ব উজ্জ্বল হয়ে উঠতো হেভেনের — স্বর্গে যাবার সুখানুভূতিতে।
টু কলকাতার এস ডি ও। আর ক্লাস টু তে পড়া শিশুটির মুখাবয়ব উজ্জ্বল হয়ে উঠতো এস ডি ও এর মর্যাদায়। কিন্তু ওয়ানে পড়ুয়াটির কষ্টে চোখে জলও আসতো।
এ নিয়ে চিল্লা ফাল্লাও কম হতো না।
ছুটির পর বাড়ি ফিরতে ফিরতে বলতাম –
ওয়ান ছুট্টি
বাড়িত গেলে পিট্টি
গরম গরম রুটি।
আরেক ধরণের কথা বলতাম। শব্দের প্রথম বর্ণের সাথে স লাগিয়ে। যেমন— তুসতোর নাসনাম কিস কি? মানে — তোর নাম কি?
কস কথা কসকইস নাসনা। অর্থাৎ কথা কইস না।
তথাকথিত অবৈধ সম্পর্ককে দাদু তার গল্পে বলতেন —- পান তামুক খায়। রাণী কোর্তালের (কতোয়ালের) সাথে পান তামুক খায়। অর্থাৎ — কোর্তালের (কতোয়ালের) সাথে রাণীর অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। রাণীর সাথে কোর্তালের (কতোয়ালের) নয়। বিষয়টিকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যেভাবেই হোক গল্পে রাণীকে মনে হতো কূটচরিত্র। আর তথাকথিত অশ্লীল কথাকে ভাষার মারপ্যাঁচে বুঝানো হতো। কতোয়াল মনিবের স্ত্রীর সাথে পান তামাক খেলেও গতানুগতিক রীতিনীতির প্রতিফলন করে রাণীকে অর্থাৎ নারীকে দোষী সাবস্থ্য করা হতো দাদুর গল্পে। এখনও সে ধারাবাহিকতা থেকে সমাজ বিচ্যুত হয়নি। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি নারীটি কী করেছে এ কাহিণী। নারীটির ধর্ষণের শিকার হবার পেছনে তাকেই দায় দায়িত্ব বহন করতে হয়। ধর্ষণের শিকার নারীর নাম ধাম পড়ি ও ছবি দেখি। আর ধর্ষক রয়ে যায় অপরিচয়ের বলয়ে। অপরাধী থাকে অজ্ঞাতবাসে আর অপরাধের শিকার নারীটি আজীবন ‘ধর্ষিতা’র পরিচয় তথা অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়।
ছোটবেলায় কুশি কাঁটার কাজ আর ওলের কাঁটার কাজ খুব চোখে পড়তো। কাকীমাদের অবসর বলতে ঐসব কাঁটা নিয়ে গুতাগুতি। ওলের কাটার কাজ ধরতো শীত আসছি আসছি করার সময়। প্রায়শঃই সোয়েটার শেষ হতো চাইতো না। অগত্যা রাতেও শ্রম দেয়া চলতো। কোন কোন সোয়েটার দুই শীত লাগাতো, অথচ গরমকালে বুনতো না। সে আমাদের বর্ষাকালে রাস্তা খঁড়াখুড়ির মতো। পরে জেনেছি ওলসূতা ছিল না। রঙ মিলাতে পারেনি। অথবা গরমকালে কাকারা ওলসূতা কিনে আনতো বা বাজারে সহজলভ্য ছিল না। এত ভেতরের খবর নিতাম না, তবে কাকীমাদের সোয়েটার শেষ করার জন্যে জরুরীভাব অনুভব করতাম।
এখন এসব ক্ষেত্রে শ্রম দেয়ার মতো ইচ্ছে বা শখ দেখি না। একে কেউ খরচের সাশ্রয় বলেও মনে করে না। তৈরী শীত বস্ত্র কিনে ফেলাই আধুনিক জীবন যাপনের অঙ্গ। কাকীমাদের স্নেহের হাতের ছোঁয়া, তাদের রাত জাগা ঝুলুনীর ক্লান্তি মাখানো ভালবাসা,অবসর সময়ের আলসেমী নিঙড়ানো হেমের ফোঁটা থেকে বঞ্চিত শীত বস্ত্রের ওম।
বাৎসরিক পরীক্ষার পরে সারা বছরের খাতাপত্র, পুরানো বই যেগুলো মোটামুটি ছিঁড়ে গেছে সে সব সের দরে বেচার জন্যে উদগ্রীব থাকতাম। নিজেরটা তো অবশ্যই ছোট ভাইবোনদেরটাও বেচে সে সব বেচার টাকা নিজের ইচ্ছে মতো খরচ করা অধিকার ছিল আমারই। সোনাকাকার হাতে এ নিয়ে কানমলাও খেয়েছি। কারণ ওয়ার্ড বুক, বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার বই বেচা নিষিদ্ধ হলেও পয়সার লোভে দুয়েকবার সে সব বেচে দিয়েছি। তবে ছোট ভাইবোন একটু বড় হয়ে গেলে এ নিয়ে খটখাট লাগতো। স্বাভাবিক কারণেই নিজেরা বেচতে চাইতো। এখন দেখি বড়রা কয়লা আর গ্যাস বেচার তাল করে। ক্ষমতাহীনরা – ছোটরা দেশের স্বার্থে অথবা ভাগ পাবে না ভেবে বিরোধিতা করে।
এখনো আমি ছোটবেলার খাতাপত্র ও পুরানো বই বিক্রির মতো পুরানো দৈনিক পত্রিকার সাথে আন্যান্য কাগজপত্র বিক্রির টাকা হাতে পেয়ে আনন্দ পাই। নূন্যতম এ টাকা আমাকে ছোটবেলার সুখ দেয়। স্মৃতি উথলে দেয়।
তবে এখনকার ছেলেমেয়েদের এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখি না। আমাদের মতো এরা এতো অল্পতে তুষ্ট নয় বলেই হয়তো।
কেয়া,
এ স্বতঃস্ফূর্ততা —- মনের স্বতঃসিদ্ধ আবেগের বহিঃপ্রকাশের লাগাম টেনে ধরে তথাকথিত সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বলয়।আমরা অনেকেই আরোপিত সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বলযয়ের ভার বয়ে চলি অনিচ্ছাসত্ত্বেও।
আপনি কিন্তু আমার লেখায় মন্তব্য করতে গিয়ে জীবনের চমৎকার একটা অংশকে তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ আমাকে লেখার আরও খোরাক যোগানোর জন্যে।
আমার জীবনের চমৎকার অংশ কিনা জানি না তবে এটা বলতে পারি আমার যাপিত জীবনে অনেক হেঁয়ালীপনা, অনেক বৈচিত্র্য আছে। হয়তো সবারই থাকে-কেউ বলে, কেউ বলে না।
আপনার আরো একটা নতুন লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
মাহবুব সাঈদ মামুন ,
ফিরে যাওয়া যায় না বলেই তো এতো স্মৃতিজাগানিয়া আফসোস এবং অতীতকে খুঁজে ফেরা। 😎
@গীতা দাস,
অতীতে ফিরে যাবার ইচ্ছেটাই স্বপ্নীল এবং আনন্দময়, সত্যিকারের ফিরে যাওয়াটা স্বপ্ন মলিন এবং যন্ত্রণাময়।
তাই- ই অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করা যায়, স্মৃতিতে বাস করাটা ঠিক নয়।
ফরিদ,
এখনো পান তামাক খাবার সাধ জাগে! :lotpot:
গীতা দি,
পুরোন বই পত্র বিক্রী করার কথা পড়ে মনে পড়লো, পুরনো বই, কাঁচ, বোতল ভাংগা বিক্রী হতো, আর বাচ্চাদের দেখতাম কটকটি বলে জাল দেয়া গুড়ের ঢেলা কিনতো। ছোটবেলায় আমার জীবন খুব নিয়ন্ত্রিত ছিলো। এখন মনে হয় অনেক কিছুর শখ হতো। আমি হলিক্রস স্কুল কলেজে পড়েছি, স্কুলের সামনে দেখতাম এক ভদ্রলোক সাইকেলের সামনে একটা বাক্সে রেখে কালো গুড়ো জাতীয় কিছু বিক্রী করতেন, ওপরে এক চিমটে গ্লুকোস দিতেন- নাম ছিলো হেনা কেমিক্যাল চাটনী। পাশেই বৈচী ফল মালার মত করে গেঁথে বিক্রী হতো। মনে আছে একটা কাঁচের বাক্সে গোলাপী গোলাপী আম ঝুলতো আর এক টুকরো খবরের কাগজের ওপরে যত্ন করে দোকানি এক এক চিমটি শনপাঁপড়ি বিক্রী করতেন।
আমার আরো কিছু অতৃপ্তি আছে, দেখতাম কলা গাছের মাথায় গোলাপী আঠালো কিছু একটা দিয়ে মালা বানিয়ে বিক্রী হতো, হাওয়াই মিঠাই মনে হয়। ফেরী ঘাটে এস এর মতো দেখতে কলা বিস্কিট বলে একটা জিনিস দেখতাম। বৈয়ামে সার সার সাজানো থাকতো।
সেই না পাওয়ার কারনেই বোধ হয় আমার বোহেমিয়ান জীবনে রাস্তায় সব খাবার খেতে খেতে এতোই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে এখন পেট বোমা পর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারে। চাঙ্খার পুলের একটা দোকানে কাঠের বেঞ্চিতে বসে হালিম খেতাম। যে ভদ্রলোক রাঁধতেন তার ঘর্মাক্ত দেহ রান্নায় লবনের স্বাদ মেটাতো। জিঞ্জিরায় গিয়ে শাক আলু আর আখ খেতাম নৌকায় বেড়াতে বেড়াতে। টি এস সি তে আবুল ভাইয়ের দোকানে লাশের গায়ে ব্যাবহার করা চা পাতার চা খেতাম দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে।
আমার বোনরা আমার সাথে বাইরে যেতে অস্বস্তি বোধ করতো। মনে আছে একবার আমার মেজো বোন কোন একটা কনফারেন্সে যাচ্ছে, প্লেন ছাড়তে দেরী হবে বলে আমরা একটা সম্ভ্রান্ত রেস্তুরেন্টে বসে চা খাচ্ছি। আমি স্বভাবসিদ্ধভাবে ওয়েটারকে বললাম, “উপ্রে একটু কাঁচা পাত্তি ছাইড়েন তো”। মনে হলো ঘরে বাজ় পড়লো। ওয়েটার বেচারার চোখ সকেট থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়।আমার বোন লজ্জায় অপমানে অস্থির।
সেই আমিই যেদিন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারী করতে ঢুকলাম, আবার নিয়ন্ত্রণ করে ফেললাম শখ গুলো। দুদিন আগেও আমি রাস্তায় চিংড়ীর মাথা ভাজা আর ধুগনী খেয়েছি আর দুদিন পরই আমি “নিয়ন্ত্রিত আমি।”
আমারও পান তামুক খেতে ইচ্ছে করে। 😀
@ফরিদ আহমেদ,
পান তামুক খেতে ইচ্ছে করে। 😀 আর আমার শুধু ভাং বা তাড়ি পান বা খেতে ইচ্ছে করে । :laugh:
গীতা দি, সব হলো সময়,সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি বদলায়,প্রযুক্তি্র সাথে শুধু এক প্রজন্মের সাথে অন্য প্রজন্মের দেখাদেখি,চাওয়া-পাওয়ার,হায়-হুতাশ,আশা ও ভালোবাসার ধরন পাল্টায় বলে মনে হয়।তবে আপনার লেখা পড়লে শুধু সে-ই দাদা-দাদীর বা দিদিমার কোলে ফেরত যেতে মন সারাক্ষন চটপট,টনটন করে, আহা রে এমন দিন যদি আবার এই নশ্বর জীবনে ফেরত আসতো ??