বাংলার আকাশ শত্রুমুক্ত হতে শুরু করে।মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে চলে মুক্তি । এদিন মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী্র কতিপয়কোম্পানী বক্সিগন্জের শক্তিশালী পাক ঘাটি এড়িয়ে দুটি ভিন্নপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ।ভোর নাগাদ বক্সিগন্জে যৌথবাহিনী্র পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য,আগের রাতেই পাকিরা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে পেছনের দিকে পালিয়ে যায় ।এদিন বাওরামারি ও ঝিনাইগাতিও মুক্ত হয় ।

সকাল ৯ টায় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল রাও কোম্পানি কমান্ডার রহমতুল্লাহকে নির্দেশ দেন সন্ধা ৭টায় পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতা আক্রমন করতে হবে। শুরু হল তাদের যাত্রা । ঘুটঘুটে অন্ধকার ,সামনে ছোট নদী পার হয়ে পানিহাতার দিকে নিরবে চললেন ।আনুমানিক রাত ১১টায় পাকবাহিনীর ক্যম্পের অতি নিকটে তারা পৌছেন । আঁধার রাতে কিছুই দেখা যাচিছল না । কিন্তু ক্যাম্পটি দেখা যাচেছ হারিকেন এর প্রজ্জ্বলিত আলোয় ।বেশ কিছুক্ষন কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে চুপটি মেরে থাকার পর কোম্পানি কমান্ডার রহমতুল্লাহ আদেশ দেন ফায়ারিং এর । মিত্রবাহিনী শেল মারা শুরু করল । আর মুক্তিরা এল এম জি, এস এল আর ও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলেন । প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলল । পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে সাজোঁয়া গাড়ি করে পালিয়ে গেল । ভোর ৪টায় পানিহাতা ক্যাম্পে রেড করা হল। বিজয় নিশান উড়ানো হল ময়মনশিংহ জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতায়। শত্রুমুক্ত ঘাটিতে শুরু হল আনন্দ উল্লাস।

এদিন মিত্রবাহিনী্র ব্রি. ক্লেয়ার ও জেনারেল গিলের জিপ কামালপুরের ফাড়ির নিকট বিধ্বংসী মাইনে উড়ে গেলে তারা উভয়েই গুরুতর আহত হন । উল্লেখ্য, যৌথবাহিনী্ সর্বাত্মক লড়াই আর বিমান হামলায় ঘায়েল হয়ে কামালপুরের পাকিরা ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আত্মসমর্পন করে , মুক্ত হয় শক্তিশালী ঘাটি কামালপুর ।

ফেনী ও বেলুনিয়া এলাকা সম্পূর্ণভাবে শত্রূমুক্ত হবার পর পাকিরা লাকসামের দিকে চলে যায় ।

ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহী আমীর হোসেন, লেফট্যানেন্ট বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমীন, সিপাহী সাহাব উদ্দীন, সিপাহী মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর কিছু পাক সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পালিয়ে যাওয়ার সময় মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।

এই দিনে মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলি এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এই দিনে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশে পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান। ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো সারাদিন ধরে অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো।

নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের নৌবাহিনী্র জাহাজগুলো খুলনা ও মংলার ওপর আঘাত হানতে থাকে । পাক নৌবহরের গর্বের সাবমেরিন ‘গাজী’ নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে ধ্বংস হয়।

এদিকে পাকস্তানের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ উদ্যোগে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা ডাকা হয় । সভায় যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় । ১১টি দেশ এর পক্ষে ভোট দেয়, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। সংকটের মূল কারণ দূরীভূত করা এবং শরণার্থী প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে প্রস্তাবে কিছু বলা হয়নি বিধায় রুশ প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক এর বিরুদ্ধে ভেটো দেন। ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি প্রস্তাব উত্থাপন করে চীন-আমেরিকা ছাড়া ১১টি দেশ সম্মিলিতভাবে। এই প্রস্তাবের সূচনাংশে সংঘাত সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান এবং শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দ্রুত রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। প্রস্তাবটি অপর্যাপ্ত গণ্য করে এবারও রাশিয়া ভেটো দেয়।

এদিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পুতুল শাসক গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, দেশ আক্রান্ত। ভারতীয়দের সহযোগিতায় কিছু বিশ্বাসঘাতক দেশ আক্রমণ করেছে। এ দেশের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করছে। তাদের সাহায্য করার জন্য প্রতিরক্ষা তহবিল করা হয়েছে। সে তহবিলে মুক্তহস্তে সাহায্য করার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। তার আহ্বানে কেউ যে এগিয়ে আসেনি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।