আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌত্রিশ বছর এগে এক অভাবনীয় নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা শহরের এক অভিজাত আবাসিক পাড়ায় যেখানে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সপরিবারে বাস করতেন। গভীর রাতের নীরবতাকে লঙ্ঘন করে বন্দুকের অগ্নি বর্ষনে রক্তের এক বন্যা বইয়ে এক ডজন নীচু স্তরের সামরিক অফিসার দেশের গণতান্ত্রিক ভোটে যিনি কর্নধার হয়েছিলেন মাত্র বছর কয়েক আগে, তাকে সপরিবারে হত্যা করে দেশে গণতন্ত্রের বদলে সামরিক আইন এনে দেশের ভাবমূর্তি বদলে দিল তারা।

১৯৭১ সনে আমরা পাকিস্তানের নাগপাশ হতে চলে এলাম এই জন্যে যে বাংগালীরা উর্দী পরা লোকদের দ্বারা শাসিত হতে আর চায় না। ১৯৫৮ সনের অক্টোবর মাস থেকে চালু করে ১৯৭১ সন পর্যন্ত এক নাগাড়ে ক্যান্টনমেন্টের জেনারেলদের দ্বারা আমরা শাসিত হয়েছি। বলতে গেলে এক রকম ঘেন্নাই ধরে গিয়েছিল আমাদের সামরিক আইনের উপর। আমি নিজে ১৯৬৯ সনের ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে যখন ইয়াহিয়া খান ক্যু করে আইউব খানকে সরিয়ে গদীতে আসে, তখন আমি ঢাকা থেকে মার্কিন মুল্লুকে চলে আসি এই জন্যে যে দেশের বাতাসে আর যেন অক্সিজেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না । ১৯৭৫ সনে সেই আবার একই অবস্থা! আমেরিকায় বসে তখন মনে হচ্ছিল যে দেশটিকে কেন আমরা স্বাধীন বানিয়েছিলাম? সামরিক আইনের প্রতি এত মোহ কেন বাঙ্গালীদের? এর সদোত্তর তখন খুঁজে পাইনি। তবে পরে বেশ অনুধাবন করতে পেরেছিলাম যে একাত্তুরে পাকিস্তান দু’টুকরো হবার পর দেশে এমন শ্রেণীর লোকজন ছিল যারা সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে ঘৃণার চোখে দেখতো এই জন্যে যে উনার কারণেই জিন্নাহ সাহেবের “প্রাণের পাকিস্তান” ভেঙ্গে দুটুকরো হয়ে গেল তাদের চোখের সামনে। তাছাড়াও ২৪ বছরে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সন পর্যন্ত, পাকিস্তানের প্রোপাগান্ডায় আমাদের অনেকের মাঝে ভারত বিদ্বেষীতা মাত্রাধিক বেড়ে যায়। আর ১৯৭১ সনের পর অনেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের মুখে শুনতাম যে মুজিব নাকি দেশটাকে ভারত-রাশিয়ার কাছে বিকে দিয়েছে!

বাংলাদেশে বলতে গেলে এক রকমের “কানে ফুস্‌ফুসানো কেম্পেইন্‌” বা কানাঘুষা যাকে ইংরেজীতে বলে “হুইস্পারিং কেম্পেইন্‌” তা চালানো হয়েছিল ১৯৭২ সন থেকে নিয়ে ১৯৭৫ সন পর্যন্ত। শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারবর্গের নামে কুৎসা রচনা এটি যেন একটা ‘কটেজ ইন্ডাস্ট্রী’ এর মতই হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়ে। এখন ভাল মতই উপলব্ধি করতে পারছি যে দেশের পঞ্চম বাহিনীরা তখন আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছিল শেখ সাহেবকে গদীচ্যুত করতে। ১৬ই আগষ্টে নাকি শেখ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বশরীরে গিয়ে নিজেকে চীর জীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করবেন আর এটিও ছিল কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট ও ঢাকার সুশীল সমাজের “হুইস্পারিং কেম্পেইন্‌” এর এক অন্যতম বিষয় বস্তু। দেশ থেকে নাকি গণতন্ত্র চীরতরে বিদায় নেবে। একনায়কত্ব আবার ফিরে আসবে, ইত্যাদী, ইত্যাদী, ছিল কেম্পেইন্‌ এর ধূপ-ধুনা। শেখ মুজিব ছিলেন পার্লামেন্টারীয়ান যিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন পুরোপুরি। তাঁর পক্ষে এ’রকম একটা অগণতান্ত্রিক পদ্বতি বেছে নেয়া যার দ্বারা তিনি নিজেকে চীর জীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ঘোষনা করবেন এটা ভাবা দুঃষ্কর। তাছাড়া সরকারী গেজেটে এ’রকম কোন কিছু লেখা বা এর আভাস পর্যন্ত দেয়া হয় নি। আসল কথা হচ্ছে যে, যারা তাঁকে পছন্দ করতো না তারাই জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাঁর নামে আজেবাজে ও উড়োকথা বলে ঢাকার রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষাক্তময় করতে সক্ষম হয়েছিল। এই রকম একটা জঘন্য পরিবেশে ১৫ই আগষ্টে ট্যাঙ্ক নিয়ে বেরিয়ে আসে কুর্মীটোলার দামাল ছেলেরা। আর কোন কথা নেই। ধানমন্ডীর জলাশয়ের সামনে শেখ সাহেবের বাড়ীর সামনে এসে চালালো বন্দুকের গুলি বিরামহীন ভাবে। উড়িয়ে দিল শেখ পরিবারকে এই ধারিত্রী হতে। এই রক্তগরম ছেলেরা কিছুতেই অনুধাবন করতে পারেনি সেই রাত্তিরে যে এই অবৈধ ও পৈশাচিক অপারেশনের জন্য আগামীতে তাদেরকে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

এই হত্যাযজ্ঞের ‘গড-ফাদার’ যিনি বা যারা ছিলেন তারা কি জুনিয়র অফিসারদের এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন, “কুছ পরোয়া নেই, কাজটি ভালয় ভালয় সেরে ফেল, তোমাদের বাঁচানোর দায়-দায়িত্ব – সেটিতো আমাদের”। এই এত বছর পর ঢাকার খবরের কাগজে সেদিন পড়লাম যে যিনি শেষ অবধি ক্ষমতা দখল করেছিলেন তিনি নাকি খুনী জুনিয়র অফিসারদের কোন কোন পরিবারকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বিদেশে পালতেন। তিনি নাকি এদের কয়েকজনকে লিবিয়ায় পাঠানোর জন্য তদবিরও করেছেন পাকিস্তানের প্রধান। আর ‘ইন্ডেম্‌নিটি’ আইনের এর কথা নাইবা তুললাম! এতশত কর্মকান্ডের পরও কি বুঝা মুশকিল এই হত্যাযজ্ঞের হোতা কে বা কারা ছিলেন?

১৯৭৫ সনের পর হতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আবস্থার আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। কোথায় গেল স্যাকুলারিজম দেশের শাসনতন্ত্র বা ‘কন্স্‌টিটুশন’ হতে। যেই আদর্শের ভিত্ততে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেল, সেটিকে দেয়া হোল নির্বাসন! এর ফেলে দেশে গত ত্রিশ বছরে গড়ে উঠলো ধর্ম-উন্মাদনা। হাজারো রকমের ফান্ডামেন্টালিস্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলো প্রতিটি জেলায় জেলায়। বগুড়া-রাজশাহীতে বাংলাভাইদের দৌরাত্বে কত সাধারণ লোকরা যে প্রাণ খুইয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে? দেশে ধর্মীয় কারণে সহিংশতা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতায়। শেষ অবধি বিদেশী সরকার বিশেষত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকার চাপে ২০০৭-২০০৮ সনে তত্ত্বাবোধক সরকার বাধ্য হয়েছে বাংলাভাই ও তার উস্তাদসহ কিছু গ্রুপ মেম্বারকে শূলে দিতে।

১৯৯৬ সন থেকে চালু করে ২০০১ সন পর্যন্ত শেখ হাসিনা প্রাণপন চেষ্টা করেছেন তাঁর পরিবারের খুনীদের বিচার করতে, তবে সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে জয়ী হয়েছেন তিনি। তাঁর একান্ত চেষ্টায় সেই কুখ্যাত ‘ইন্‌ডেম্‌নিটি বিল’ খানা ওবৈধ ঘোষনা করা হোল পার্লামেন্টে। দেশে অবস্থানরত খুনীদের কাউকে কাউকে ধরা হোল, ফাটকে গেল তারা, আর বাকীরা দেশ থেকে উধাও হোল। বিচার শুরু হোল কোর্টে দেশের বিধান মত। তবে হাইকোর্টের কিছু কিছু বিচারপতি নাকি রায় দিতে বিব্রত বোধ করেন। এদের গড়িমশিতে খুনীদের বিচার আর হয়ে উঠলো না ২০০৮ সন পর্যন্ত।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পাপের ভান্ডার পুরো হয়েছিল ২০০৬ সনের শেষের দিকে। দেশের আপামর জনসাধারণ সেটি অনুধাবন করতে বেশ পেরেছিল। সে সময় সরকারী দল যে সব অবৈধ প্রক্রিয়া দ্বারা ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করেছিল তা ধূলীসৎ হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক বা ‘কেয়ারটেকার’ সরকার প্রায় বছর দুয়েক রাজত্ত্ব করে পরিশেষে একটা স্বচ্ছ ‘ইলেকশন’ এর বাস্তবায়ন করেছিল ডিসেম্বর ২০০৮ সনে। দেশবাসী পাপগ্রস্থ সেই দলটিকে ভোট দ্বারা পরাজিত করে শেখ হাসিনার দল ও তাঁর জোটকে জয়ী করে বিপুল সংখক ভোট দিয়ে। গত একবছরে হাসিনা সরকার শেখ মুজিব মার্ডার কেসটি আবার পেছনের ঠান্ডা চুলা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে সামনের গরম চুলাতে দিয়ে দেয়। ফলে আইনের চাকা আবার ঘুরতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে রায় বেরুলো যে মার্ডার কেসের আসামীদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হোক। এরপর সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলো এই রায়ের বিরুদ্ধে। সেটিতেও কাজ হলো না। ১৯ই নভেম্বর সুপ্রীম কোর্ট হাই কোর্টের রায়কে সমর্থন করলো। সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা এখন দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভীক্ষা চাইবে। সেটি না পেলে এক এক করে সবাইকে ফাঁসীমঞ্চে উঠতে হবে ২০০৯ ডিসেম্বর বা জানুয়ারী ২০১০ সনের কোনো এক নির্ধারিত দিনে।

খুনীদের সমর্থন করে একমাত্র ঢাকার ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হলিডে’ তে সাদেক খান সম্পাদকীয় লিখেছেন এই বলে যে, জুনিয়র অফিসাররা ক্যুঁদেতা করেছিল জোরকরে ক্ষমতা বদল করার জন্য দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। তাই এদের বিচার সিভিল কোর্টে না হওয়াই উচিত। সাদেক খান কী ভাবে দিব্যি ভূলে গেলেন যে ১৫ই আগষ্ট কেবল ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নিহন হোন নি, তার সাথে নিহত হয়েছেন সে বাড়িতে উপস্থিত পরিবারবর্গ ও ঢাকায় আরো অনেক আত্মীয়স্বজন। শেখ পরিবারের ছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি বন্দুকের গুলি থেকে। সাদেক খান কী ‘আলহাইজমার’ বা স্মৃতিভ্রম রোগে আক্রান্ত?

বহু বছর পর ঘণ অন্ধকারের এক অমানিশা বাংলাদেশ থেকে চীর বিদায় নিতে যাচ্ছে। দিগন্তে দেখা যাচ্ছে এক নয়া সূর্য্য। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টে যে পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল সেটির পুনারাবৃত্তি আর যেন না ঘটে। দিনকাল অবশ্য পাল্টে গেছে। আজকাল হচ্ছে ‘আন্তরজাল’ বা ইন্টারনেটের যুগ, ওয়াই-ফাইয়ের যুগ, আর সেল-ফোনের যুগ। এইসব বিজ্ঞানের অবদান সমাজকে সমৃদ্ধশালী করেছে আর তার সাথে দেশকে নিয়ে গেছে ‘ইনফরমেশন’ যুগে। আমি সর্বান্তকরনে বিশ্বাস করি যে এখন থেকে বাংলাদেশ ঠিক রাস্তায় চলবে। সামরিক বাহিনী থাকবে কেন্টমেন্টে আর পরিচালিত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রাধাণমন্ত্রীর দ্বারা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে এই মাফিক সামরিক বাহিনী পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রের জয় হোক চীরকাল বাংলাদেশে সেই কামনাই করি ।
————-
ডঃ জাফর উল্লাহ্‌ একজন বৈজ্ঞানিক ও কলাম লেখক, লিখেন নিউওর্লিয়ান্স থেকে; ঢাকার বিভিন্ন ইংরেজী পত্রিকায় তিনি নিয়মিত উপ-সম্পাদকীয় লিখেন।