প্রত্যেকটি মানুষ কখনো না কখনো সাম্প্রদায়িক;আবার একই ব্যক্তি কখনো কখনো মানবিকবোধে বিভোর। আবার নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে দুইজন মানুষের একই বিষয়ে অনুভুতির বহিঃপ্রকাশকে সংজ্ঞায়িত করা যায় সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। একজনের আবেগ-উদ্বেগ আশংকা, উচ্ছ্বাস, বিশ্লেষণ চিহ্নিত হয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা হিসেবে আর একই বিষয় অন্যজনের মন্তব্য, মতামত পরিগণিত হয় সংকীর্ণতায় সীমাবদ্ধ হিসেবে। (পিলখানায় ২৫শেফেব্রুয়ারি ২০০৯ বাংলাদেশে রাইফেলস কর্তৃক সংগঠিত ঘটনা নিয়ে আমার লেখা সংখ্যালঘুর মানচিত্র (১) পড়ে অনেকেই আমাকে সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ মনে করেছিলেন।)

কোন সংখ্যালঘু মানুষ যদি তার সম্প্রদায়ের স্বপক্ষে নিরপেক্ষভাবেও কিছু বলে তবুও তাকে মনে হয় সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক। আবার কোন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কোন মানুষের বাস্তবতায় নিরিখে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে করা মন্তব্য যদি সংখ্যালঘু মানুষের সংকীর্ণ স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় তখন তাকে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক মন্তব্য হিসেবে গণ্য করে।
আসলে সাম্প্রদায়িক শব্দটি আপেক্ষিক। স্থান, ব্যক্তি, সময় নির্বিশেষে এর অর্থের ব্যাপ্তি ঘটে। আবার কোন সংখ্যালঘু ব্যক্তির স্বার্থ আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত স্বার্থ চিহ্নিত করতে না পারলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা চিহ্নিতকরণে বিভ্রান্তি হওয়াই স্বাভাবিক।

আবার প্রগতিশীলতার বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে অনেকে সাম্প্রদায়িকতাকেই সম্প্রসারিত করে থাকে। যেমনঃ খুলনার সাংবাদিক মানিক সাহার হত্যাকাণ্ড সাম্প্রদায়িক নয়। ইডেন কলেজের ছাত্রী পলির হত্যাকাণ্ডটি প্রযুক্তির অপব্যবহারে হলেও সাম্প্রদায়িক নয়। কোন এক মুসলিম ছেলের সাথে পলির মোবাইলে মিস কলের মাধ্যমে কথোপকথন থেকে প্রেম। ফ্লেক্সি লোড করিয়ে নিত ছেলেটিকে দিয়ে। প্রেমের টানে ছেলেটি সিলেট থেকে ঢাকায় আসে। দেখা হয় ইডেন কলেজে পড়া পলির সাথে। পরে ছেলেটির সাথে পলির বিশ্বাসঘাতকতা। পরিণামে ঐ প্রেমিকের হাতে পলি খুন হয়।

মানিক সাহাকে হত্যার পর অতি আগ্রহী দুয়েকজন একে সংখ্যালঘু ইস্যু হিসেবে দেখতে বা দেখাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন যা তার প্রতি অবমাননা মনে হয়েছিল। অন্যদিকে মানিক সাহার স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তিকে আবার অনেকে আওয়ামীলীগের আমলে সংখ্যালঘুদের সুযোগ বলে মন্তব্য করেছেন। দুই দলেই হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের লোক ছিল এবং তাদেরকে আমার সাম্প্রদায়িক এবং সংকীর্ণ মনে হয়েছে। মানিক সাহা একজন প্রগতিশীল সাংবাদিক ছিলেন এ-ই ছিল তার বড় পরিচয়।
সাম্প্রদায়িকতা,বর্ণবাদ ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ বা প্রায়োগিক দিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যেমনঃ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দলের নির্বাচনী ইস্তেহার ইন্টারনেট থেকে নিয়েছি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বি এন পি ) নির্বাচনী ইস্তেহার খুঁজতে গিয়ে Manifesto of BNP চাপ দিতেই বৃটিশ ন্যাশনাল পার্টির ওয়েব পৃষ্ঠা পেয়ে দেখলাম লেখা আছে —– If your are n’t British, get out!

মর্মাহত হলাম। কষ্ট হল। বৃটিশরা যে কী পরিমাণ কট্টর জাতীয়তাবাদী তা তাৎক্ষণিকভাবেই উপলব্ধি করলাম। শেখার জন্যেও তো তাদের ইস্তেহার যে কেউও পড়তে পারে। হ্যাঁ পড়তেই পারতাম। কিন্তু আমারও অভিমান হলো, ঘৃণাও হলো বৈ কি! এটা কোন পর্যায়ে পড়ে? পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা আমি ? না ঐ ওয়েব পৃষ্ঠার মালিকেরা বেশী কট্টর?

আমাদের দেশে সব ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতিগতগোষ্ঠির মধ্যে সাম্প্রদায়িক লোক রয়েছে। ঐসব সাম্প্রদায়িক লোক বা গোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার দায় ও দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও সরকারের। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার যদি নিজেই সাম্প্রদায়িক পরিচয় বহন করে তখন কে রক্ষা করবে সংখ্যালঘুর অধিকার! রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মূল গ্রন্থ বাংলাদেশের সংবিধানকেই একটা গোষ্ঠি সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট করে রেখেছে; তার প্রমান ১৯৭৮ সালে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক ১২ অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা। এতে ছিলঃ
‘’১২। ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন
বিলোপ করা হইবে।‘‘

দুঃখজনক সত্য হলো — আমার রাষ্ট্র ও সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে বিলোপ না করে সংবিধান থেকে এ বিষয়ক অনুচ্ছেদটিই বিলুপ্ত করে ফেলেছে। এ বিলুপ্তকে বলা যায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাংবিধানিক অধিকারকে ধ্বংস করে ফেলেছে, সংখ্যালঘুর অধিকারকে হরণ করেছে, ডাকাতি করেছে, হাইজ্যাক করেছে, চুরি করেছে।
পাশাপাশি সংবিধানের ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত করেছে। এখন বাংলাদেশের সংবিধানে ১২ নং অনুচ্ছেদ নামে কোন অনুচ্ছেদই নেই।
উপরন্তু ১৯৭৮ সালে সংগঠনের স্বাধীনতা বিষয়ক ৩৮ নং অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশটুকুও বিলুপ্ত করেছে ; যাতে বলে ছিলঃ
‘তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সঙ্ঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যেসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।‘
৩৮ নং অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশটুকু বিলুপ্ত করে প্রত্যক্ষভাবেই ধর্মীয় উন্মাদনাকে উসকে দেয়া হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতাকে শক্তি যোগানো হয়েছে, সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে মুছে দেয়ারই প্রয়াস।
অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে, আবহকে প্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৭২ সালের সংবিধান ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। এর সাথে যুক্ত হতে হবে দেশের আনাচে কানাচে শিকড় গাড়া ও হন হন করে গজিয়ে উঠা সাম্প্রদায়িক শক্তিতে নির্মূল করার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও প্রশাসনিক উদ্যোগ।