picture-015প্রকৃতির কোলে সৃষ্টি এক কালের স্রোতশ্বিণী পাহাড়ের সুন্দরী কন্যা তিস্তা, মানুষের হাতে মৃত্যুই যেনো এখন তার নিয়তি। উজানে ভারতের গজলডোবা নামক স্থানে প্রবেশ মুখে ও নীলফামারীর দোয়ানিতে ব্যারেজ নির্মাণ করে এ নদীর উচ্ছল দূর্বার গতিকে রোধ করে দেয়া হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে নদীর স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে তার বুক থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে এ নদীর পানি বা জীবন। মরে যাচ্ছে তিস্তা। এ নদীর পারে দাঁড়ালেই বাতাসে যেনো এখন শুনতে পাওয়া যায় ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস আর গুঁমড়ে ওঠা কান্নার শব্দ।
উজান থেকে ভাটিতে যেখানে এসে তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলেছে, এই তিনশ’ কিলোমিটার নদীকে ঘিরে দুপাড়ের যে সব মানুষ গড়ে তুলেছিলো বসতি ও জীবিকা, প্রকৃতি এঁকেছিলো জল রঙে সবুজের ছবি ; এখন তা ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওযায় মরে যাচ্ছে বড় বড় গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে জীব বৈচিত্র।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানাচ্ছে, তিস্তার পানি প্রবাহ এ এযাবতকালের সর্ব নিম্ন পর্য়ায়ে নেমে এসেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে যেখানে প্রয়োজন ৪ হাজার কিউসেক পানি সেখানে শুধু ব্যরেজ এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২শ’ কিউসেক। ভাটিতে এই প্রবাহ একবারেই কমে যাওয়ায় এর প্রভাবে তিস্তা ব্যারাজ থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত নদী এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। স্রোত না থাকায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। যতদুর চোখ যায় শুধু ধূধূ বালুচর।
হিমালয়ের চো লামু লেক থেকে তিস্তার উৎপত্তি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৫শ ফিট উচ্চতায় এ নদীর উৎস হওয়ায় উজানে তিস্তার গতি ছিলো উচ্ছল ও দূর্বার। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের উজানে গজলডোবা নামক স্থানে ভারত একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তার এই দূর্বার গতিকে থামিয়ে দেয়। তিস্তার মূল স্রোতধারাকে ব্যারেজের বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে তারা তাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন সেচ কাজে লাগায়। গজলডোবা ব্যারেজ থেকে শুস্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি ভাটিতে বাংলাদেশকে দেয়া হয় ওই পরিমান পানি প্রায় ৭০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তিস্তা ব্যারেজে এসে পৌঁছে তখন নদীর স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু ফিতার আকার ধারণ করে।
তিস্তা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ এই পানিই আবার ব্যারেজের গেট বন্ধ করে ঘুরিয়ে দেয় তাদের মূল সেচ খালের রিজার্ভারে। তারপর ব্যারেজরে গেট খুলে মাঝে মাঝে যে পানি দেয়া হয় ওই পানিতে নদীর বুক ভেজে না। কোনো রকম তির তির করে ভাটিতে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যেনো কয়েক ফোঁটা পানি ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসায় উচ্ছল পাহাড়ি কন্যা তিস্তা এখন ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে।
নীলফামারী জেলার ছাতনাই গ্রাম। যেখান থেকে তিস্তা বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করেছে সেখান থেকে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পর্যন্ত যেখানে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিলিত হয়েছে, এই দীর্ঘ দেড়শ’ কিলোমিটারের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে তিস্তা তার নাব্যতা হরিয়ে শীর্ণ, কঙ্কালসার। নদী যখন উচ্ছল স্রোতশ্বিণী ছিলো, দুপাড়ের হাজার হাজার পরিবার যারা এই নদীকে ঘিরে গড়ে তুলে ছিলো বসতি ও জীবন, তিস্তার এ করুণ পরিণতিতে এখন তারা পুরোপুরি বেকার। নদীপারের স্থানীয় মানুষজন জানায়, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বর্ষা হলেই দু’কুল ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠে তিস্তা। প্রতিশোধ নেয় সে মানুষের উপড়। ঘরবাড়ি, ফসল সব কিছু উজার করে ফেলে। এভাবে বার বার ভাঙ্গনে নিঃস্ব হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মৎসজীবিরা তাদের বাপ-দাদার পুরনো পেশা ছেড়ে এখন দিন মজুর কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে হয়ে পড়েছে ছিন্নমূল। ছোটো ছোটো খেয়াঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যাবস্থা একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে। যাদের নৌকা আছে এখন তা তুলে রেখেছে। হারিয়ে গেছে রঙিন পালের নৌকা আর সেই চির চেনা সুর- নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা…..।
এদিকে ঘন্টার পর ঘন্টা বালুচর পাড়ি দিয়ে গন্তব্য কিংবা হাট-বাজার সারতে হয় বলে ক্রমান্বয়ে বসতি গুটিয়ে ফেলছে নদী পাড়ের মানুষজন। ভেঙ্গে পড়া যোগাযোগ ব্যাবস্থায় যারা এরপর টিকে আছে তারা এ- চর ও- চর করে যাযাবরের মতো জীবন যাপন করছে। পাহাড়ি নদী ও স্বচ্ছ পানি হওয়ার কারনে এ নদীতে পলি মাটির আস্তরন পড়ে না। তাই বর্ষা চলে যাওয়ার পর নদীর বুক জুড়ে বালির বিশাল আস্তরনে স্বাভাবিক চাষবাস হচ্ছে না। একারণে নদীতে চর পড়ে যাদের জমি ভেসে উঠেছে তারা প্রয়োজনীয় চাষ, সার ও অর্থের অবাবে ফসল ফলাতে পারছে না। এভাবেই এ অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে চরের ঐতিহ্যবাহি ফসল বাঙ্গি, তরমুজ, সাতপুঁথি, ধনে আর মৌরি। পানির অভাব, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জীব বৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। মারাত্মক হুমকীর মূখে পড়েছে পরিবেশ। বড় বড় গাছপালা মরে উজার হয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্সেনিক কর্মসূচীর উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, পনির স্তর ক্রমশঃ নিচে নেমে যাওয়ায় ভূগর্ভের গভীর থেকে স্যালো ও গভীর নলকুপের দিয়ে ব্যাপক পানি উত্তোলন করায় মাটির স্তরের মধ্যবর্তী স্থান শূন্য হয়ে বাতাস প্রবেশ করছে। ফলে ভূগর্ভে অক্সিজেনের বিস্তৃতি ঘটেছে। এই অক্সিজেন, লৌহ ও আর্সেনিক যৌগের (আর্সেনোপাইরাইট) সাথে বিক্রিয়ার ফলে মুক্ত আর্সেনিকের সৃষ্টি হচ্ছে। এই মুক্ত আর্সেনিক-ই মানুষজন বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে হুমকীর সম্মুখীন হচ্ছেন।
রংপুর অংশের তিস্তা পাড়ের নোহালী গ্রামের প্রবীণ মানুষ আকালু শেখ জানান, এখন যেখানে তিস্তা বয়ে চলছে তার দেড় কিলোমিটার পূর্বে তার ৩০ বিঘা জমি ছিলো। ১৯৭৪ সালে তার প্রথম নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব হন। এরপর ’৭৬ সালে চর ভেসে ওঠে। ওই বছর চরে কিছু কাউনও চিনা আবাদ করলেও পরের বছর আবার তিস্তা আবার গ্রাস করে নেয়। এভাবে একের পর এক ভাঙ্গনে তিনি উচ্ছেদ হতে থাকেন তিস্তার পাড় থেকে। তার স্মৃতিতে এখনও ভাসে বাড়ি থেকে একটু দুরে ছুটে চলেছে কাকচক্ষু জল তিস্তা – সৌম্য, শান্ত কিন্তু উচ্ছল। গ্রামজুড়ে মানুষের মনে তখন ছিলো অনাবিল শান্তি। বড় বড় গাছপালা আর পাখিদের কলতানে মুখরিত থাকতো গোটা গ্রাম। আকাশে উড়তো শঙ্খ কিংবা হলুদ ডানার চিল। বট-পাকুরের ফল খাওয়ার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে আসতো হরিয়াল পাখির দল। অতিথি পাখিদের কলরবে ঘুম ভাঙতো গ্রামের মানুষজনের। সে ছিলো এক অন্যরকম সকালের অনুভূতি। আর এখন যতদুর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। হারিয়ে গেছে সেই সব পাখিদের দল।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ গ্রামের জহুর মিয়া জানান, পানি কমে যাওয়ায় বর্ষা কালেও নদীতে আর এখন দেখা যায় না ঘড়িয়াল কিংবা শুশুক। এ গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তি হরিপদ বিশ্বাস জানান, চৈত্রের শেষ দিকে নদীর মাছ উজানে যায় ডিম ছাড়ার জন্য। এখন নদীতে পানি না থাকায় মাছও নেই তাই উজানেও যায় না তারা। একারনে মাছের আকাল এখণ তিস্তায়। তার স্মৃতিতে এখনও আছে তিস্তায় জাল ফেললেই ধরা পড়তো রুপোর মতো চকচকে কাজলি মাছ। তাজা কাজলী মাছ ভাঁজার গন্ধ এখনও তার নাকে লেগে আছে। কিন্তু সেদিন আর নাই। এখন যতদুর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। নদীর বুক চিরে সরু ফিতের মতো কোনো রকমে বয়ে চলেছে তিস্তা। ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বর্ষা হলেই দু’কুল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দেয় বাড়ি-ঘর। আর ফাল্গুন কিংবা চৈত্রের বাতাসে ধূলো বালির বাতাসে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে জীবন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, ১৯৭৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিস্তার ভাঙ্গনে বিলিন হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার ঘরবাড়ি। নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়েছে ১০ হাজার পরিবার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানাচ্ছে তিস্তার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীতে স্যুট চ্যানেল বা সরু নালার সৃষ্ঠি হয়। এই স্যুট চ্যানেল দিয়ে পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হলে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়। উন্মত্ব হয়ে যায় নদীর স্রোত ধারা। এবাবে উজার হয় তিস্তা পাড়ের গ্রামের পর গ্রাম। উচ্ছেদ হয় বসতি।
লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার তিস্তার চর ডাউয়াবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও বিশিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সাদেকুল ইসলাম বলেন, তিস্তার উজানে ভারত ব্যারাজ নির্মাণ করে বাংলাদেশ অংশে নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিয়েছে। এখন এই ব্যারাজ রাখার অর্থই হলো তিস্তা নদীর টুঁটি চিপে ধরে তাকে মেরে ফেলা। এবােই মেরে ফেলা হচ্ছে পাহাড়ের সুন্দরী কন্যা তিস্তাকে।
দেশের প্রখ্যাত নদী ও পানি বিশেষঞ্জ ড. আইনুন নিশাদ জানান, ভারতের গজলডোবায় তিস্তার উপড় ব্যারাজ নির্মাণ করে প্রথমে নদীর স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে। এরপর এর ৭০ কিলোমিটার ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করায় এর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ একেবারেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নদীর বুকে পানি না থাকায় তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এর প্রভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে গেছে। তিস্তার শাখা-প্রশাখা গুলো পানির অভাবে মরে যাওয়ায় কারণে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায় বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন ধরণের গাছ-পালা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঘরিয়াল, শুশুক বিলুপ্ত হওয়ার পাশাপাশি বড়-ছোটো বিভিন্ন দেশি জাতের মাছ বিশেষ করে কই, শোল ও খরিকাটি মাছ এখন একেবারেই চোখে পড়ে না। তিনি নদী মরে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত দু’দেশের দু’টি ব্যারাজকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, তিস্তা নদীকে বাঁচাতে হলে এর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। এ জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।