পূর্ব থেকে পশ্চিম

পরশপাথর

পর্বঃ

শহরটাতে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়েও ফেললাম কিন্তু একটা শহরকে প্রথম যেভাবে দেখা হয়, কিছু দিন পর হয়তো আর সেভাবে দেখা হয় না প্রথম দেখার অনুভূতি সবসময় অন্যরকম অতএব, বর্ণিল এই শহরটাকে নিয়ে কিছু বলার সবচেয়ে ভালো সময় হয়তো এখনই নামটা দিয়েই শুরু করি

শিকাগো আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম শহর উইন্ডি সিটি, সেকেন্ড সিটি, সিটি অব বিগ শৌল্ডার পরিচয়ে এর রয়েছে আরো অনেকগুলো নাম অবশ্য অন্য সব নাম মুছে দিয়ে এখন শহরের বড় পরিচয় হয়ে উঠেছে বারাক ওবামার শহর লে আমেরিকার ৪৪তম তথা বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা অঞ্চলেরই প্রতিনিধি এবং শিকাগো শহরে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো স্কুলে ১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছর করেছেন শিক্ষকতার কাজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত শহরে বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় . মিলিয়ন অথচ, ১৮৩৩ সালে যখন প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এর লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ২০০ জন কালের বিবর্তনে এখন এটি পরিণত হয়েছে সমস্ত উত্তর আমেরিকার পরিবহন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে

শিকাগোতে দুটি বিমানবন্দর এর মধ্যে হেয়ারপৃথিবীর দ্বিতীয় ব্যস্ততম মূহুর্তে শিকাগোতে আসলে হেয়ার নামতে না নামতেই শোনা যায় ২০১৬ এর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পকের গল্প ২০১৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক শিকাগোতে হবার জোর সম্ভাবনা রয়েছে সেই গল্পই তারা আগ বাড়িয়ে জানান দেয় সবার কাছে যদিও আয়োজক হবার প্রতিযোগিতায় আছে রিও ডি জেনিরো’, ‘মাদ্রিদএবং টোকিও মত বিখ্যাত সব শহরগুলো বছর ২রা অক্টোবর ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক এসোসিয়েশান (আইওসি)’ ১১৫ সদস্য দেশের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে চূড়ান্ত শহরের নাম অলিম্পিকের নামকরণ দেশের নামে হয় না, হয় শহরের নামে তাই এর আয়োজন বিশ্বের যেকোন শহরের জন্য অত্যন্ত সন্মানজনক ব্যাপার যেকোন শহর চাইবে আয়োজক হবার জন্য সম্ভাব্য সবধরণের চেষ্টা করবার খুব স্বাভাবিকভাবেই শিকাগো শহর কর্তৃপক্ষও চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখছে না

লেক মিশিগানএর তীরে গড়ে উঠা শিকাগোর ডাউনটাউন দেখে অনায়াসে এর নাম দেয়া যায়অট্টালিকার শহর দেখবার মত সুন্দর, চোখধাঁধানো সব উঁচু স্থাপনাগুলো একটার পর একটা যেন পাল্লা দিয়ে ঘোষণা করছে নিজেদের আধিপত্যের কথা হঠা করে মনে হয়, শহরে যেন উঁচু ভবনগুলোর বাহারী মেলা বসেছে এরপরও থেমে নেই নতুন নতুন স্থাপনার কাজ এখনও তৈরী হচ্ছে বহুতল ভবন, সুপার শপ, বিজনেস সেন্টার, এপার্টমেন্ট

আমেরিকার যেকোন শহরে চাইনিজ আর ইন্ডিয়ান নাগরিকের কোনো অভাব নেই গোটা বিশ্বের একতৃতীয়াংশ মানুষইতো দুটো দেশের; তাদের উপস্থিতি থাকাটাই স্বাভাবিক এখানকার যেকোন বড় শহরেই প্রায় অবধারিতভাবে থাকেচায়না টাউন এখানেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি তবে, বাংলাদেশের মানুষজন বেশি থাকে নিউইয়র্কে শিকাগোতে খুব বেশি নেই বললেই চলে তাই কখনো কখনো চলার পথে নিজেকে খুব একা মনে হতে পারে দেশ থেকে অনেক দূরে; মন খুলে কথা বলবার জন্যও কাউকে পাওয়া যায় না কিন্তু তারপরও একটা জিনিস আছে, অনেকটা নিজেদের মনে হয় শিকাগো শহরের যেখানেই যাওয়া হোক না কেন সেটা দেখতে পাওয়া যায়শিয়ার্স টাওয়ার ১৪৫০ ফুট উচ্চতার ১০৮ তলা এই ভবনটি শিকাগোর সর্বোচ্চ টাওয়ার টুইন টাওয়ারএর পতনের পর এটি এখন সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এবং গোটা বিশ্বের ৫ম সর্বোচ্চ টাওয়ার যদিও লন্ডনভিত্তিক কোম্পানী উইলিস্গ্রুপ হোল্ডিংস লিমিটেড কাছে লিজ দেবার পর কাগজে কলমে এই টাওয়ারের নাম এখনউইলিস্টাওয়ার

খুব গর্ব হয় যখন ভাবি শিকাগোর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনের গঠন নকশা করেছেন আমাদেরই একজন ফজলুর রহমান খান (এফ,আর ,খান) স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংএর আইনস্টাইন হিসেবে যিনি বিশ্বখ্যাত যাকে বলা হয়টিউব্যুলার ডিজাইনএর জনক কখনো দেখা হয়নি, কথা হয়নি তবু মনে হয়, কি এক আত্মার বাঁধনে যেন আমরা জড়িয়ে আছি ওই যে! আমাদের দেশ, আমাদেরতো একই বাংলাদেশ শিকাগো শহরের যেপ্রান্তেই যাই না কেন শিয়ার্স টাওয়ারযেন ছায়ার মত অনুসরণ করে, অভয় দিয়ে যায় অবিরত বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় শহর সৃষ্টিতে আমাদেরও অবদানের কথা মহান বাঙ্গালি ১৯৭১সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জনমত তৈরি এবং তহবিল গঠনের জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন তাঁর নেতৃত্বে তৈরী হয় শিকাগো ভিত্তিক সংগঠনবাংলাদেশ ইমারজেন্সী ওয়েলফেয়ার আপীল উল্লেখ্য, এফ,আর ,খানের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং তাঁর প্রতি সন্মাননা দেখাতে গিয়ে ১৯৯৮ সালে শিকাগো নগর পরিষদ এফ,আর ,খানের নামে শিয়ার্স টাওয়ারের সামনের রাস্তার নামকরণ করে শিকাগো শহরে আমার প্রিয় জায়গাগুলোর একটি আমি যখনই এই রাস্তায় গিয়েএফ,আর, খানএর নাম দেখি, তাকিয়ে থাকি কয়েক মিনিট মনে হয় পথচারীদের কাছে গিয়ে বলি, তোমরা কি এই লোকটাকে চেনো? এর বাড়ী কোথায় জানো?

পশ্চিমা বিশ্বের একটি শহর হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই শিকাগোর সংস্কৃতিতে এমন অনেক কিছুই আছে যেটা ঠিক আমাদের দেশের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না কিন্তু কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো দেখে আপনা থেকেই এদের প্রতি সন্মান জেগে উঠে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানো যেতে পারে ডিস্যাবল বা শারীরিকভাবে দূর্বল মানুষজনের প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অবধারিতভাবে প্রতিটি বাস, ট্রেন, সুপার মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, সিনেমা হল, পার্কিং সবখানেই রয়েছে তাদের জন্য আলাদা সুব্যাবস্থা এমন কোন জায়গা পাওয়া যাবে না, যেখানে ডিস্যাবল লোকজনের জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা করা নেই এরা হুইল চেয়ারে করে দিব্যি পাবলিক বাসে চড়ে, সুপার শপে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসছে বলতে পারেন এরাই এখানকার ভিআইপি

এখানে নতুন আসলে সবার আগে অভাব বোধ হবে রিক্সার প্রাইভেট গাড়ী না থাকলে প্রচুর পরিমাণে হাঁটাহাঁটি করতে হবে বলতে গেলে প্রায় সবারই প্রাইভেট গাড়ি থাকে গাড়ির দামও খুব বেশি নয় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম দামে চলার মত গাড়ি কিনে ফেলা যায় তবে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশান এর সুবিধাও আছে অনেক প্রায় প্রতিটা রাস্তায় নির্দিষ্ট নাম্বারের গাড়ি চলে কিছুক্ষণ পরপর স্টপেজ পুরোশহর জুড়ে, প্রান্ত থেকে প্রান্তে রয়েছে বেশ কিছু ট্রেন সার্ভিসও সাধারণত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারকারীরা নির্দিষ্ট খরচের বিনিময়ে কয়েক মাসের জন্য পাসকরিয়ে ফেলেন তারপর সেটা দিয়ে যতখুশি শহরজুড়ে যাতায়াত করে থাকেন একই পাসদিয়ে যেকোন রুটের যেকোন গাড়ি কিংবা যেকোন ট্রেনে চড়া যাবে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সমস্ত সার্ভিসে এরা প্রযুক্তির ব্যবহার করে সম্ভাব্য সব দিক দিয়ে ইন্টারনেটে বসে কোন জায়গা থেকে কোন জায়গা যেতে চান লিখে দিলে আপনাকে রুটম্যাপসহ সবগুলো পথ দেখিয়ে দেবে কোথা থেকে কোন বাস ধরতে হবে, এমনকি কতক্ষণ হাঁটতে হবে, কতক্ষণে গিয়ে পৌঁছাবেন তারও একটা হিসেব দেখিয়ে দেবে একটা ল্যাপটপআর ইন্টারনেটকানেকশান থাকলে আপনি এখানে রাজা প্রায় সবকিছুর হোম সার্ভিস আছে ঘরে বসে অর্ড়ার করবেন জিনিস পৌঁছে যাবে আপনার ঘরে তবে হ্যাঁ, আরেকটা জিনিসও আপনার থাকতে হবে, ‘ডলার’, যেটা এখানে কোনভাবেই সহজলভ্য না 

এবার অন্য একটা দিক বলি এখানে ৯১১ ফোন করলে, আপনার কাছে সাহায্য আসবার সর্বোচ্চ সময় হচ্ছে দুই মিনিট দুই মিনিট বা তার আগেই পুলিশ এসে হাজির কিন্তু যেঅঞ্চলে কালোদের(ব্ল্যাক) বসবাস একটু বেশি, কয়দিন পরপরই দেখা যায়, সেখানে রাতের বেলা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে কেউ না কেউ কাহিনি মোটামুটি সব একইরকমরাত আনুমানিক ১১টা১২টা সময় অমুক কিংবা তমুক স্ট্রীট ধরে হাঁটার সময় বাইশ থেকে পঁচিশ বছরের একজন কালো মত লোক হ্যান্ডগান ধরে সব দিয়ে দিতে বলে হামলার শিকার ব্যাক্তিটি কথা না বাড়িয়ে সবকিছু দিয়ে দেয় এবং তার ভাষ্যমতে, হামলাকারীর পরনে ছিলো বেইগী জিন্স এবং লম্বা লাল রঙের টিশার্ট, উচ্চতা ৫ফুট ১০ইঞ্চির মত শিকাগো পুলিশ এক বিশাল তদন্তে নেমে যাবে ব্যাপারটা নিয়ে ফলাফল হবে কিছুটা বাংলাদেশের মত হামলাকারীর কোনো হদিস পাওয়া যাবে না শিকাগো পুলিশ সবাইকে পরামর্শ দেবে, রাতে দলগতভাবে চলার জন্য এবং হামলাকারী যাচায় দিয়ে দেবার জন্য, তা নাহলে আক্রান্ত ব্যাক্তির আরো খারাপ কোন পরিণতি হয়ে যেতে পারে কিছুদিন আগে ঠিক ধরণের একটা ক্রাইম রিপোর্ট পড়তে পড়তে বিদেশি এক ছেলে হঠা ক্ষোভের সাথে বলে উঠল,‘‘নিজের দেশ ঠিকমতো সামলাতে পারে না,আবার আফগানিস্তান সামলাতে যায় !!!” (চলবে)

*পর্বটিসাপ্তাহিক দিনবদল’- এর গত ঈদ সংখ্যায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত

 

পরশপাথর

নভেম্বার ১৭, ২০০৯

[email protected]