যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ফোর্টহুড সেনানিবাসে মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন মেজর নিদাল মালিক হাসান তারই সহকর্মী সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ১২ সৈন্য এবং এক অসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করলেন। আহত করলেন আরও অন্তত তিরিশজনকে। সেই সংবাদ যেমন বিষাদের, তেমনি বিস্ময়েরও বটে। আহত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া মেজর হাসান সেনাবাহিনীর একজন চিকিৎসক, যিনি মূলত সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের মনোরোগের চিকিৎসা করতেন। তার সহকর্মীদের বরাত দিয়ে এখানকার পত্র-পত্রিকায় যা লেখা হচ্ছে তা হলো, তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ছিলেন এবং পর্যাপ্ত যত্ন নিয়েই সহযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। বিশেষত যুদ্ধে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত সৈন্যদের চিকিৎসার ব্যাপারে তার বিশেষ প্রশিক্ষণও রয়েছে। এ ধরনের একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক-সৈন্য, যখন এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে তার সহকর্মীদের হত্যাযজ্ঞে একক ভূমিকা পালন করেন, তখন বিস্ময়ে-বিষাদে আমরা সবাই বিচলিত বোধকরি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজ দেশের মাটিতে দেশের সৈন্যদের এই প্রাণ সংহারে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং সেসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলেছেন কোনোরকম আঁচ-অনুমাননির্ভর মন্তব্য না করতে। স্বভাবতই ওবামা প্রশাসনের সামনে এমন একটি সময়ে একটি নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হলো যখন প্রশাসন আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর বিষয়ে সেখানকার সেনা কমান্ডারের অনুরোধ পর্যালোচনা করে দেখছে। এ ঘটনা যে সেই পর্যালোচনায় একটি প্রভাব ফেলবে না সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।


মেজর হাসানের এ হত্যাযজ্ঞের কারণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে যেমন সংবাদ মহলে, তেমনি স্বভাবতই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার পেছনে বাহ্যত যে কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে সেটি হলো, তিনি সম্ভবত এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন নিজেও এবং দ্রুত সেনাবাহিনী ত্যাগ করার ইচ্ছা ছিল তার। হাসানসহ হতাহত সব সৈন্যই ওই কেন্দ্র থেকে ইরাক ও আফগানিস্তানের দুটি ক্ষেত্রে মোতায়েনের অপেক্ষায় ছিলেন এবং যুদ্ধে অংশ নিতে অনিচ্ছার কারণবশতই নিদাল হাসান এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটালেন। অনেকেই বলেন, প্রায় এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যে একাধিক প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িত রয়েছে এবং যেখানে তার হতাহতের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়, সে ক্ষেত্রে মরিয়া হয়ে সৈন্যদের মধ্যে আত্মহনন বা এ জাতীয় উষ্মা প্রকাশ বোধকরি বিস্ময়কর কিছু নয়। তবে মেজর হাসানের কর্মকাণ্ডটি একটু ভিন্ন। তিনি আত্মহননের পথে যাননি, সম্ভবত তার গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস তাকে সে কাজটি করতে দেয়নি। তবে সেই একই ধর্মীয় মাপকাঠিতে তিনি অন্য মানুষকে (যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল সৈন্য) হত্যা করতে দ্বিধান্বিত হননি। অতএব মেজর নিদাল মালিক হাসানের এ আচরণের কারণ সম্ভবত অন্যত্র সন্ধান করতে হবে। প্রথমত নিদাল হাসান আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধকে সমর্থন করতেন না বলে কোনো কোনো সূত্র থেকে বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত তিনি একজন কট্টর ধর্মানুসারী ছিলেন, যা সম্ভবত তাকে তার নিজ ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণে কুণ্ঠিত করেছিল এবং সেই বিবেচনায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেসব সৈন্যকে হত্যা করেছেন, যাদের যুদ্ধে যাওয়ার কথা ছিল। নিদাল হাসানের এই বদ্ধ মনোভাব বা মাইন্ডসেটটা বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে, কেবল তার জন্য নয়; বরং তাদের জন্যও যারা অনুরূপ ধারণা পোষণ করে থাকেন। এ বিষয়টির তাত্তি্বক বিশ্লেষণ দরকার মূলত ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখার প্রয়োজনের জন্য। প্রথমত এটি মনে রাখা প্রয়োজন, ইরাক-আফগানিস্তান কিংবা অন্যত্র যুদ্ধ করা যৌক্তিক কি-না তা নিয়ে রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য থাকতে পারে; কিন্তু এসব যুদ্ধের কোনোটিই যে ধর্মযুদ্ধ নয়, সে কথা বলাবাহুল্য। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশ এক সময় ক্রুসেড শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বটে এবং যে জন্য বিশ্বের অনেক জায়গাতেই সমালোচনার ঝড়ও উঠেছিল; কিন্তু তার ওই শব্দ ব্যবহারটি ছিল নিতান্তই প্রতীকী। যেমন আমরা প্রায়ই বলি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জিহাদ যেমন ধর্মযুদ্ধ নয়, বুশ উচ্চারিত ক্রুসেডও তেমনি ধর্মযুদ্ধ নয়, যুদ্ধের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই বুশ এ
শব্দটি অনবধানতাবশত ব্যবহার করেছিলেন, যা স্পর্শকাতর পরিবেশে ভিন্ন ও ভুল ব্যাখ্যা পেয়েছে। অন্যদিকে তালেবান, আল কায়দা কিংবা অন্য জঙ্গি মৌলবাদীরা যে সহিংস আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক কিংবা অন্যত্র_ তারা নিজেরা একে জিহাদ বা মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ বলে যতই অপপ্রচার চালাক না কেন, একে ধর্মযুদ্ধ মনে করাটা ঠিক নয়। এসব সহিংস কার্যক্রমে ধর্মকে ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না ধর্ম ব্যবসায়ী একদল লোক। বিভ্রান্ত করছে শান্তিপ্রিয় ধর্মানুরাগী মানুষকে। এই বিভ্রান্তির মূল কারণ হচ্ছে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও নির্দিষ্ট আচারের বাইরে রাজনীতিতে সম্প্রসারিত করা। ধর্মকে যখন রাজনীতির একটি কথিত আদর্শ হিসেবে দেখা হবে, তখনই ধর্মের সর্বোচ্চ অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। নিদাল হাসানের ক্ষেত্রে এ কথাটি সম্পূর্ণ প্রযোজ্য। নিদাল যতক্ষণ ধর্মকে তার ব্যক্তিক আচরণের অংশ হিসেবে রেখেছিলেন নিয়মিত ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের মধ্যে, ততদিন তিনি ধর্মের সঙ্গে যুদ্ধকে সম্পৃক্ত করেননি; কিন্তু যখনই তিনি যুদ্ধকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভবত দেখার চেষ্টা করেছেন, তখনই তার মনে ভিন্ন ও ভ্রান্ত চিন্তার উদ্রেক ঘটেছে। মনে রাখা প্রয়োজন, স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কারণে তিনি নিশ্চয়ই জানতেন তাকে সেনাজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। হয়তো যুদ্ধটি যদি হতো, চীন কিংবা উত্তর কোরিয়া অথবা কিউবার বিরুদ্ধে তাহলে নিদাল হাসান একজন দেশপ্রেমিক আমেরিকান সৈন্যের মতোই যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন; কিন্তু যুদ্ধের আদর্শিক প্রতিপক্ষ যেহেতু ঘটনাচক্রে তার নিজ ধর্মী, সেহেতু তিনি বিভ্রান্ত হয়ে এই পাশবিক ঘটনাটি ঘটালেন। অথচ যুদ্ধটি যে ধর্মযুদ্ধ নয়, মুসলমানদের বিরুদ্ধেও নয়_ তার প্রধান প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে প্রচুর মুসলিম সৈন্য রয়েছে এবং তারা অন্যান্য দেশের সৈন্যের মতোই নিজ দেশের প্রতি অনুগত থেকেছেন। দ্বিতীয় প্রমাণটি হচ্ছে, এ যুদ্ধে কেবল আমেরিকানরা নয়, পাকিস্তানি সৈন্যরাও তালেবান ও আল কায়দার ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। এটিকে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখলে পাকিস্তানিদের এই যুদ্ধে বরং প্রতিপক্ষের সঙ্গেই থাকাটা সমীচীন হতো। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর ভেতরে আল কায়দা ও তালেবানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ সত্ত্বেও এখনও পাকিস্তানি সৈন্যরা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছে তারা মূলত আল কায়দা ও তালেবান। অতএব স্বদেশানুগত্যের সঙ্গে স্বধর্মানুগত্যের যে বাহ্যিক দ্বন্দ্ব নিদাল হাসান লক্ষ্য করেন, সেটি রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটানোর এক ভ্রান্ত তত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল। কারণ ইরাক কিংবা আফগান যুদ্ধসহ বিশ্বের যে কোনো যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণ, রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার বিস্তৃতি, এর সঙ্গে এই একুশ শতকে ধর্মের কোনো সম্পৃক্ততা থাকার কথা নয়।

 
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে যারা বিশ্লেষণ করে থাকেন, তারাও রাজনৈতিক বিভ্রান্তি দ্বারা আক্রান্ত। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান অনেকের কাছেই একেবারে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কারণেই সমালোচিত হয়েছে এবং আমরা জানি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরাক থেকে পর্যায়ক্রমে সৈন্য প্রত্যাহারের যে প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছেন, তাতে সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। ইরাক অভিযানের যৌক্তিকতা রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মধ্যে সমালোচনার সম্পূর্ণ ঊধর্ে্ব নয়; কিন্তু আফগানিস্তানের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামী মৌলবাদী তালেবানের শাসনামলে আল কায়দা নেতৃত্বকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে বড় রকমের আক্রমণ চালিয়ে, যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল আল কায়দা এবং তাদের মদদদানকারী তালেবান। সে কারণেই এমনকি বুশ যখন আফগানিস্তানে আক্রমণ-অভিযান শুরু করেন তখনও বিশ্বের কোনো মুসলমান দেশই এর বিরোধিতা করেনি। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধের পেছনে ছিল জাতিসংঘের অনুমোদন এবং এতে সম্পৃক্ত হয় ন্যাটোও। সুতরাং ইরাক যুদ্ধের সঙ্গে একে একাত্ম করে দেখলে বাস্তব ইতিহাসকে অতিসরল করে ফেলা হয়। আক্রান্ত একটি দেশ আত্মরক্ষার্থে এবং এই উগ্র জঙ্গিবাদ থেকে বাদবাকি বিশ্বকে মুক্ত করতে যে অভিযান শুরু করে, তাকে ধর্মযুদ্ধ বলে অভিহিত করাটাই সবচেয়ে বড় অধর্ম। আর এই অধর্মের কাজটিই করছে তালেবান, আল কায়দারা যারা ধর্মকে ব্যবহার করছে নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে।

 

 

নিদাল হাসানের এই মর্মান্তিক আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে আসে, যে হতাশা কিংবা কল্পিত আত্মগ্গ্নানিই কি তার অস্ত্র চালনার পেছনের প্রকৃত কারণ, নাকি এক ধরনের উগ্র ও ভ্রান্ত ধর্মীয় চেতনাবোধই তাকে প্রণোদিত করেছিল ওই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ নয়, বিশেষত ঘাতক নিদাল হাসান যখন এখনও (এই নিবন্ধটি লেখা পর্যন্ত) অচেতন এবং তাকে কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করা সম্ভব হয়নি; কিন্তু প্রথম কিংবা দ্বিতীয় যেটিই কারণ হোক না কেন নিদাল যে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি ও যুদ্ধ এবং স্বদেশপ্রেম সবকিছুকে সম্পৃক্ত করে এক বিশাল ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ দেখি না। টেক্সাস ট্র্যাজেডি আবারও প্রমাণ করল দার্শনিক ও প্রায়োগিকভাবে ধর্ম এবং রাজনীতিকে পৃথক করে দেখা অত্যাবশ্যক। না হলে সভ্যতার সংঘাতের নামে ঘটবে সভ্যতারই সর্বনাশ।

[email protected]

 

অনিরুদ্ধ আহমেদ 

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার