চুয়াত্তর সালের কথা। তখন গোটা রংপুর জুড়ে দুর্ভিক্ষ। প্রতিদিন অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। খোলা হয়েছে লঙ্গর খানা।এই লঙ্গরখানা কেন্দ্রিক এক বিস্ময়কর ঘটনা জানার জন্য একটু ভুমিকা টানতে হচ্ছে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। এ সময় আমার মধ্যে তবলাবাদক হবার ইচ্ছা প্রবল। এই বাসনার কথা প্রকাশ করি আমার এক নিকটতম প্রতিবেশী বাবন ব্রহ্ম’র কাছে। তিনি একাধারে আমার বড় ভাই এবং বন্ধুও বটে। তিনি আমাকে তালিম দেয়া শুরু করলেন। কিন্তু গোড়াতেই বিপত্তি দেখা দিলো। আমি বা হাতে ডুগী বাজাতে পারিনা। ডান হাতে ডুগী বাজাই আর বা হাতে তবলা। এতে তবলার চাটি বা আওয়াজ ঠিকমতো হয়না। কিন্তু আমার ওই ওস্তাদ হাল ছাড়েন না। তিনিও ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন আমাকে তবলাবাদক বানাবেনই। আমার তবলার ওস্তাদ বাবনদার যথেষ্ট আর্থিক অনটন ছিলো। এ কারনে তিনি গানের টিউশনি করতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় যার বাড়িতে টিউশনি করাতে যেতেন তিনি ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। পি.আই.ও বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। তার কিশোরী মেয়ে হেলেন গান শিখতো বাবনদার কাছে। তারা থাকতেন সি.ও ( বর্তমান উপজেলা পরিষদ )অফিসের সরকারি কোয়াটারে। এই হেলেনের বড্ড বেসুরো গলা ছিলো। এ নিয়ে এক কাহিনী আর একদিন বলা যাবে।
যাহোক, সম্ভবত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ। বাবনদা আমাকে বললো, চল হেলেনদের বাড়িতে, সেখানে হেলেনকে গান শেখাবো আর তোকে তবলার তালিম দেবো। আমি রাজী হলাম। তখন রংপুরের এই থানায় বিদ্যুত আসেনি। হেরিকেন আর কুপীর আলোই এখানকার মানুষের সম্বল। আমরা রাত আটটার দিকে গায়ে চাদর মুড়িয়ে রওনা দিলাম হেলেনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমরা সি.ও অফিস পার হওয়ার পর যখন একটা ফাঁকা যায়গায় পৌঁছলাম, তখন অন্ধকার ফুঁড়ে এক বয়স্কা মহিলা আমাদের গতি রোধ করলো। বাবনদা তার নিস্তেজ ব্যাটারির নিভু নিভু টর্চের আলোয় মহিলার মুখ দেখে বললেন, কে রে হাজিরন ? তারপর হাজিরনের কান্না জড়িত ক্ষীন কণ্ঠ- বাবা ‌দুই দিন হাতে (থেকে) না খায়া আছোঁ (আছি)কাইল নঙ্গরখানা (লঙ্গরখানা) হাতে কয়টা উটি (রুটি)আনি মোক(আমাকে)দ্যান। বাবনদা রাজী হলো। বললো কাল দুপুরে আমার সাথে দেখা করিস, তাহলে নিয়ে দেবো। হাজিরন বাবনদার গায়ে হাত বুরিয়ে দোয়া করলো- আল্লা তোর ভালো কইরবে। এরপর আবার সে অন্ধকারে মিশে গেলো। বাবনদা আমাকে বললো এই মহিলা হেলেনদের বাড়িতে মাঝে-মধ্যে কাজ করে দেয়। বাড়ি হায়াতখাঁ গ্রামে। আমরা এরপর হেলেনদের বাড়িতে পৌঁছলাম। হেলেনের গান আর আমার তবলার তালিম হলো। এরপর শুরু হলো চা পর্ব। চা খেতে খেতে পি.আই.ও সাহেব কথা তুললেন দূর্ভিক্ষ আর দেশ নিয়ে। এই কথার ফাঁকে বাবনদা বললো, আপনাদের বাসায় হাজিরন নামে যে মহিলা মাঝে-মধ্যে এসে ফুট-ফরমাশ খাটে ওই মহিলা এখানে আসার আগে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বললো, সে নাকি দুই দিন থেকে অনাহারে আছে। কাল লঙ্গরখানা থেকে রুটি এনে দেয়ার জন্য খুব অনুরোধ করলো। একথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বাসার পরিবেশ মুহুর্তে বদলে গেলো। ঘরে পিন পতন নিস্তব্ধতা। ঘরভর্তি সবাই আমাদের দু’জনের দিকে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি নিরবতা ভাঙ্গলাম। বললাম কি হলো আপনাদের! সম্বিত ফেরে সকলের। এরপর যা ঘটলো তা অবিশ্বাস্য ও ভীতিকর। হেলেনের মা জানালো, হাজিরন অনাহারে থেকে থেকে সাতদিন আগে মারা গেছে। এ কথা শোনার পর আমার গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠলো। বাবনদা শীতের রাতেও ঘামতে শুরু করলো আর ঘনো ঘনো বাথরুম যেতে লাগলো। আমরা সহ বাড়িসুদ্ধ মানুষের তখন ভয়ে ভুতঙ্গ অবস্থা। পি.আই.ও সাহেব চিতকার করে অফিসের পাহারাদারকে ডাকলেন। কারন, জীবিত হাজিরনের চেয়ে মৃত হাজিরন তখন আমাদের কাছে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
এরপর পাহারাদার আমাদের বাসায় পৌঁছে দেয়। এঘটনার পর আমারো আর তবলা শেখা হয় নাই। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। আসলে আমরা কি সেদিন হাজিরন কে দেখেছিলাম নাকি অন্য কোনো ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতীকি আত্মা ? যে আমাদের সামনে এসেছিলো আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে ? এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নাই। হয়তো জানতে পারে হুমায়ুন আহমেদ’র মিসির আলী সাহেব।