দূর্বার উত্তরে সাধারণত জড়তা, স্থিরতা বা দৃঢ়তা কোনটাই থাকে না। স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক ও সহজ উত্তর। এ স্বাভাবিকতাকেও দুয়েকজন সহজভাবে নেয় না। মনে মনে বলে —– ভড়ং। যত্তোসব অথবা তথাকথিত আধুনিক বা যাচ্ছেতাই। এ সব শব্দগুচ্ছ উচ্চারিত না হলেও মুখের চামড়ার ভাঁজ, চোখের পাতার কাঁপুনি আর ঠোঁটের নাড়ানি দেখে দূর্বা আন্দাজ করতে পারে। নিজের কন্ঠ স্বাভাবিক থাকলেও অন্যপক্ষের স্বর অস্বাভাবিক ঠেকে বৈ কি!

অফিসে বা যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার স্বাভাবিক প্রশ্নের সহজ উত্তরটি যে কেন এতো আলোড়িত তা দূর্বার মাথায় ঢুকে না।এমন অনেক কিছুই অবশ্য তার মাথায় ঢুকে না। মগজকে আলোড়িত করে না।

দাম্পত্য জীবনের দৈনন্দিন কিছুটা সময় ছাড়া নারী পুরুষের দৈহিক অস্তিত্ত্ব নিয়ে দূর্বার মাথা ব্যথা নেই। ঐ কিছুটা সময় ছাড়া দাম্পত্য জীবন বলতে একজন বন্ধুর সাহচর্‌য প্রয়োজন। তবে দূর্বাকে কেন অনেকেই নিজের মাথা ব্যথার কারন হিসেবে অনর্থক নেয় তা তার বোধগম্য নয়।
স্বামী হিসেবে নক্ষত্রকে দূর্বার পছন্দ করতে তার পেশা বিবেচনে করেনি। হাজারো মানুষ যা করে। তার নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দূর্বাকে আকর্ষন করেছিল।এক বিয়ে বাড়িতে খাবারের আগে বসে আছে। পাশে দুজন পুরুষের বিরবিরে আলাপ।
একজন বলছে – আরে নক্ষত্র, আর বলো না। মেয়ে মানুষ কলা গাছের মতো। এক বিয়ানেই বুড়া।
নক্ষত্র নামের জন প্রতিবাদ করে বলছে —- না, আমি একমত হতে পারলাম না। নারীরা সরিষা গাছের মতো। একসাথে ফুল মেলে ও দানা ছাড়ে।
দূর্বা পরে খেয়াল করে – খুঁজে খুঁজে একই টেবিলে খেতে বসেছিল।
বছর তিনেক পরে ঐ নক্ষত্রকেই বিয়ে করেছে।
দূর্বার বিয়ের সময় রত্না নিজের অফিস থেকে ছুটি নিয়ে স্বামীর সাথে দেশের বাইরে ছিল। ফিরে দূর্বার বিয়ের খবর শুনে খুশী। উপচে পড়া হাসি। পরবর্তী প্রশ্ন — কর্তাটি কী করেন।
উত্তর শুনে বলেন — এখানে এক্সট্রা লিগ্যাল দেখালেন।
লিগ্যাল্রটি শব্দটি এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় বলে দূর্বা সরে এসেছিল।অনর্থক বিতর্ক করে কাজ নেই।
দূর্বা নিজের বিয়ের আগেও কখনো কাউকে জ্জিজ্ঞেস করেনি , অপনার স্বামী বা স্ত্রী কি করেন। অবান্তর প্রশ্ন।
যাহোক একটা কিছু করে। চুরি, ডাকাত, ভিক্ষা, কালবাজারী, বা ব্ল্যাকমেলিং না করলেই তো হলো। বিয়ের সাড়ে চার বছরে দূর্বার স্বামী কি করে এ নিয়ে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে।এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত কেউ একবারে বুঝে না।অন্তত একাধিকবার উচ্চারণ করতে হয়। সে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে যে আবার বলতে হবে। উত্তটা দ্বিতীয়বার শুনেও কৌতুহলী চোখ — ঠিক শুনেছেন তো? দূর্বা জানে ঠিকই শুনেছেন এবং বুঝেছেনও, তবে বোধের সাথে, অভিজ্ঞতার সাথে মানিয়ে নিতে পারছেন না।

যেমন দুর্বা সব সময়ই কোন বিষয়ে পারলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে যাচাই করার চেষ্টা করে। তবে সব কিছুতে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। কোথাও শুধু চোখ ও বোধ, কখনো নাক ও স্পর্শ, কোন কিছুতে জিহ্বা, চোখ ও বোধ ব্যবহৃত হয়। তবে তিনি এ বিষয়ে সচেতন ও সংবেদনশীল। তারপরও খাপ খাওয়াতে পারে না। অতি সংবেদনশীলতাই হয়তো খাপ না খাওয়াতে পারার কারণ।

তিনি পায়খানা করতে বসলেও চোখ ও অনুভূতি দুটোকেই কাজে লাগান। বোধ দিয়ে বুঝতে পারে না পায়খানা আরও হবে কী না। এর পরিমাণ দেখতে হয়। ছোটবেলা থেকেই এ অভ্যাস। প্রথম প্রথম ঢাকায় উচুঁ কমোটে পায়খানা করার পর বুঝতে অসুবিধা হতো। সব জলে পড়ে। বুঝা কষ্টকর। তবুও অভ্যাসবশত দেখে নিয়ে জল খরচ করতো। শহরের জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে এমন অনেক কিছুর সাথেই ঝুঝতে হয়েছিল —- বুঝতে হয়েছিল।

কেউ প্রথমবার শুনে দুই ভ্রু যতটা সম্ভব কাছে এনেও বাঁকা চোখে তাকায়। এ ভঙ্গি দেখে দূর্বা দ্বিতীয়বার বলে। কেউ কেউ আবার তৃতীয়বার শুনে উত্তরটা যাচাই করে নেন।

সব সময় যা জেনে আসছে তা যে সব সময়, সব জায়গায় এবং সবার সাথে খাটে না তা সে ঠাহর করতে পারে না।

এ উপমহাদেশের বাইরের কোন মহিলা বাংলাদেশে এসে শাড়ি পরলে বাংলাদেশী বাঙালীরা খুশি হয় নিজেদের পোশাক অন্য দেশীয়দের পরতে দেখে।। ভারতীয়রা বাংলাদেশের জামদানী পরলে এ দেশীয়রা আপ্লুত হয়। আহা রে, আমার দেশের জামদানীর কী কদর! আর দূর্বা জামালপুর গিয়েছিল জামালপুরের হাতের কাজ করা শাড়ি পরে। যেটা তার সহকর্মী উপহার দিয়েছিল। দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক, যে উপহার দিয়েছে তাকে দেখানো যে তার শাড়িটি পেয়ে সে খুশি এবং পরতে পছন্দ করে। দ্বিতীয়ত জামলপুরবাসীও ভাববে তাদের কাজের কদর আছে। কিন্তু সহকর্মীটি হতাশ করে দিয়ে বললো,— জামালপুরে আসলেন আর এখানকার শাড়ি নিয়ে আসলেন।
ইচ্ছে করেই তো নিয়ে এসেছি।
সহকর্মীটি মুচকি হেসে মুখে আর কিছু না বললেও মনে মনে হয়তো বলেছে, ভোদাই। কিচ্ছু বুঝে না।
ফ্যাশনেরও যে কতো রকম ফের আছে — গলি ঘুপচি আছে তা দূর্বা বুঝবে কেমন করে?

শাড়ি পরেই অভ্যস্ত ছিল। অনেককে দেখে এবং সালোয়ার কামিজ পরা আরামদায়ক ও সহজে ব্যবস্থাযোগ্য চিন্তা করে এক সেট বানিয়েও প্রথমে পরেনি। লজ্জা কাটাতেই প্রায় চার মাস। প্রথম দিন পরে মনে হয়েছিল ঢাকার সবাই বুঝি দূর্বার দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রথম দিন বলতে সালোয়ার কামিজ পরা ছেড়ে দেয়ার প্রায় পনের ষোল বছর পর। তবে অফিসে কখনো পরে না। বাজার করা। সকাল বিকেল হাঁটতে যাওয়া অথবা বিকেলে কারো বাসায় যাওয়া। এখন অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
তবে কোন অনুষ্ঠানে এবং অফিসে শাড়ি পরে। না হলে নিজের কাছেই নিজেকে বেঢপ বেঢপ লাগে। বুড়ির ছুড়ি সাজার মতো মনে হয়। অনেককে এ সত্য কথাটি বলতে গিয়ে অনেকবার ধরা খেয়েছে।
একবার সহকর্মী রত্নার খটাখট উত্তর — নিজে আচরি ধর্ম অন্যেরে শিখাও। দূর্বাদি নিজে তো সালোয়ার কামিজ পরে প্রায়ই বাইরে যান। অফিস করেন না কেন?
দূর্বার স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর — অফিসে অফিসিয়েল পোশাক পরি। অফিসে ড্রেস কোড মেনে চলা উচিত।
রত্না ঝাঁঝের সাথে বলে — শাড়ি কি আমাদের ইউনিফর্ম নাকি! পরেন। আপনার যা ইচ্ছে আপনি করেন। আমার যা যখন ইচ্ছে আমি তা করি।
এর পর আর কথা জোয়ায়নি দূর্বার মুখে। তাৎক্ষণিকভাবে দূর্বা মুখর হতে পারে না। উত্তরও মুখে জোয়ায় না।

বহুদিন নতুন জলের মাছের স্বাদ চাখা হয় না। বর্ষার গুড়া মাছ খাওয়া হয় না। একদিন ঢাকার বাইরে থেকে ফেরার পথে অফিসের গাড়ি থামিয়ে এমনিতেই দাম জিজ্ঞেস করেছে। এর আগে একদিন কথায় কথায় ড্রাইভারকে ছোটবেলায় বর্ষার গুড়া মাছ খাওয়ার গল্প বলেছিল। দাম জিজ্ঞেস করলেও দূর্বা মাছ কিনেনি। কেনার উদ্দেশ্যেও ছিল না। ড্রাইভার মনে মনে দূর্বাকে দুবল ভেবে নিজেই প্রস্তাব দেয় — ম্যাডাম।, বালতিতে নিয়ে নেন। বালতি ধুয়ে ফেললে গন্ধ থাকবে না।
তবুও নেয়নি। এরপরও বার দুয়েক দূর্বাকে সাধাসাধি করেছে ড্রাইভার। বিফল হয়ে মনে মনে বলেছে —-ভীতুর হাড্ডি। নিজে কিনলে তো আমিও একটু কিনতে পারতাম। অফিসার হলে কী হবে বুক তো ইদুঁরের মতো।

সহকর্মী রত্না লতাকে প্রায়শঃই বলে — দূর্বাদি এক্সটা লিগ্যাল বুঝতে শিখুন।
কিন্তু দূর্বা সাদা কালো বুঝে। লিগ্যাল আর ইল্লিগ্যাল বুঝে। নৈতিক আর অনৈতিক, নিয়ম আর অনিয়ম বুঝে। কিন্তু এক্সটা লিগ্যাল বুঝেও না, বুঝতে চায়ও না। এক্সটা লিগ্যাল তো নিজের মর্জি মতো – ইচ্ছে মতো ব্যাখ্যা করা। আপেক্ষিক ব্যাপার। নিজের স্বার্থে এক্সটা লিগ্যালের ধোঁয়া তোলা। রত্না দূর্বাকে সামাজিক রীতিনীতির আপেক্ষিকতা বুঝাতে গিয়ে ব্যর্থ। অপ্রিয়ে সত্য কথা না বলা যে এক্সটা লিগ্যাল তা দূর্বা মানতে চায় না ঠিক নয় –বুঝে না। ঐ এক্সটা লিগ্যাল এর প্যাঁচে মাঝে মাজ়হে ঘুরপাক খায় দূর্বা।
একদিন অফিসের কাজে নারায়ণগঞ্জে নির্ধারিত অফিস খুঁজতে গিয়ে ড্রাইভার ভুলে চিপা গলিতে ঢুকে পরেছে। গিঞ্জি গলি। আটার বস্তা সারি সারি। ঠেলায় উঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে রিকসা ভ্যান চলছে। এ রাস্তায় গাড়ি যেন গ্রামীণ লোকালয়ে বুনো হাতি ঢুকা। সবাই সন্ত্রস্ত। এ হাতি বের হবে কেমন করে? হাতি এখন এ শরীর নিয়ে ঘুরানোর পযাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না। রাস্তা খুঁজতে গিয়ে লতা সাইন বোর্ড পড়ে দেখে এটি নিতাইগঞ্জ। তখনই তার কাঙ্গালিনী সুফিয়ার “কোন বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই” গানটি মনে পড়ে যায়। জোরে জোরে শব্দ করে গাইতে ইচ্ছে করছিল –“কোন বা পথে নিতাই গঞ্জে যাই” । গেয়েও ছিল তবে গুনগুনিয়ে। ড্রাইভার নিশ্চয়ই তাকে নির্ঘাৎ পাগল ঠাওরেছে এতে আর সন্দেহ কী?

ড্রাইভার যখন নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ থেকে বের হবার পথ খুঁজছে আর দূর্বা তখন তার নিতাইগঞ্জে যাবার পথের দিশা পাচ্ছে না। সে দিশা প্রায়শঃই পায় না।

নিতাইগঞ্জের পথ আর এক্সটা লিগ্যালের যৌক্তিকতা খুঁজে না পাওয়া। জোত সই ব্যাখ্যা বা কথা মুখে না জোয়ানো। বাস্তববাদী হতে উপদেশ শুনতে শুনতে দূর্বার কান ঝালাপালা।

আজ মৌখিক পরীক্ষা দিতে এসেছে। লিখিত পরীক্ষায় টিকেই এ মৌখিক পরীক্ষা। একটু বেশী বেতনের বলেই আবেদন করা। বাচ্চা হবার পর খরচ বেড়েছে।
মৌখিক পরীক্ষায়ও সেই একই প্রশ্ন এবং যথারীতি প্রথমবার উত্তরটা পরীক্ষকদের বোধগম্য হয়নি।
দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন—আপনার স্বামী কী করেন?
প্রথমবার স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক ও সহজ উত্তর দিলেও দ্বিতীয়বার উত্তর দেয়ার সময় জীবনে প্রথমবারের মতো এ উত্তরে স্বরে দৃঢ়তা ও স্থিরতা এনে দূর্বার উচ্চারণ — হাউজ হাজব্যান্ড।