সংবিধান ও শিক্ষা

মানুষ পুরোপুরি ব্লাঙ্ক স্লেট হয়ে জন্ম না নিলেও, সুন্দর পরিবেশ এবং সঠিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে একটি শিশুকে মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ কারণে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মাঝে শিক্ষা অন্যতম এবং প্রতিটি মানুষের শিক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতির এক অংশকে শিক্ষার আলো হতে বঞ্চিত রেখে কোন জাতির পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জনগণের করের অর্থ যদি সর্বপ্রথম কোথাও ব্যবহৃত হতে হয় তবে আমি শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিব। আমাদের সংবিধানেও সকলের জন্য শিক্ষার কথা বলা হয়েছে এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এ, সকলের জন্য শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

বৈষম্যহীন শিক্ষার জন্য প্রথমত যেটা প্রয়োজন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিন্ন পাঠ্যসুচি প্রণয়ন করা। শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই যদি তাকে বাংলা, ইংরেজী, ও আরবী মাধ্যমে বিভক্ত করে ফেলি তাহলে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি কি করে? তারপর যেটা প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী এবং শহর ও গ্রাম ভিক্তিক শিক্ষার বিভাজন দূর করা। উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হওয়া উচিত। তবে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা নিখরচার হওয়ার প্রয়োজন নেই এবং প্রয়োজনে সরকার বিনা সুদে বা অল্প সুদে ঋন দিতে পারে। কারিগরী শিক্ষার জন্য সরকার অর্ধেক ঋন এবং অর্ধেক বৃত্তি হিসেবে দিতে পারে। বিদেশ গমন কারীদের জন্য মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকের পরে ছয়মাস বা এক বছরের কারিগরী ও ভাষার প্রশিক্ষন দেওয়া যেতে পারে। যে কোন চাকুরীর ক্ষেত্রেই মাধ্যমিকের নীচে চাইতে পারবে না এমন নিয়ম করা উচিত। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে বা প্রতিটি জেলায় তাঁদের জন্য আলাদা বিভাগ বা বিদ্যালয় রাখা উচিত। এবং দরিদ্র শিশুদের পরিবারের জন্য বৃত্তি প্রদান করা উচিত।

স্নাতক পর্যায় নিয়ে খুব বেশি না বলে স্নাতকোত্তর পর্যায় নিয়ে বলছি। একটি দেশের উন্নতির জন্য খুব প্রয়োজন নিজ দেশের উপযোগী প্রযুক্তি এবং যার জন্য প্রয়োজন গবেষনা। গবেষনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বাড়ানো উচিত এবং স্নাতকোত্তর কোন ছাত্র যেন গবেষনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সকলের স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু মাত্র যারা শিক্ষকতা এবং গবেষনায় আগ্রহী হবে তাদেরকেই স্নাতকোত্তর শিক্ষায় ভর্তির সুযোগ দেওয়া উচিত।

সবশেষে ভাল শিক্ষার প্রথম শর্ত হচ্ছে ভাল শিক্ষক। দেশের মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় আনার জন্য শিক্ষকদের প্রতিটি স্তরে ভাল বেতন প্রদান প্রয়োজনীয়। একজন শিক্ষক যদি জীবন সংগ্রামে নিজেই নৈতিকতার পথ পরিহার করেন, তবে তিনি কি করে অন্যকে শিক্ষা দিবেন। আমরা যতদিন পর্যন্ত শিক্ষককে সম্মানিত না করবো, ততদিন আসলে কোন সংস্কার বা শিক্ষানীতিই কাজে আসবে না। উন্নত শিক্ষক তৈরীর জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষন ব্যবস্থার প্রয়োজন। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই ডিজিটাল পাঠ্য পুস্তক, মাল্টিমিডিয়া লেকচার, অনলাইন গ্রন্থাগার তৈরী করতে পারি। নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির সাহায্যে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি আমি শুধু মাত্র উচ্চ শিক্ষা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করবো। আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যার বিচারে চাইবো যত বেশি মানুষকে কাজে লাগানো যায়। তবে অবকাঠামো তৈরী করে রাখা যায়, যেন প্রয়োজনে দূর-শিক্ষনের সাহায্য নিতে পারে যে কেউ।

এ ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নীতির প্রশ্ন চলে আসেঃ

প্রথমত – শিক্ষা দান পদ্ধতি। মূলত আমাদের দেশের শিক্ষা প্রদান পদ্ধতি এবং পরীক্ষন পদ্ধতি যেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে সেটা মধ্যযুগীয় পদ্ধতি। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষককেরাই শিক্ষা দেওয়া বলতে বুঝায় একটি নির্দিষ্ট বই শুধু পড়ে যাওয়া। যদি শুধু বই এর একটি অংশ পড়তেই হয় তবে তার জন্য শিক্ষকের কি প্রয়োজন, সেটা একজন ছাত্র নিজেই তা করতে পারে। আর পরীক্ষন পদ্ধতিতে এখনো বিচার হয় কে কত বেশি মুখস্থ করতে পারে তা। প্রয়োজন একজন ছাত্র/ছাত্রী বিষয়টুকু কতটুকু বুঝতে পেরেছে সেটি। তার জন্য শিক্ষা প্রদান ও পরীক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন। তবে এটি সর্বাগ্রে বুঝতে হবে একজন শিক্ষককে।

এই শিক্ষা পদ্ধতির জন্য আমি প্রতিটি বিষয়কে তাত্বিক ও ব্যবহারিক ক্লাসে ভাগ করতে চাই। প্রতিটি বিষয়ে ৩০ মিনিট লেকচারের জন্য থাকবে আর এক ঘন্টা থাকবে ব্যবহারিকের জন্য। লেকচার ও ব্যবহারিক ক্লাস এমন ভাবে সমন্নয় করতে হবে যেন শিক্ষক বুঝতে পারেন তিনি যা দিতে চেয়েছেন তা ছাত্ররা বুঝতে পেরেছে কিনা আর ছাত্র/ছাত্রীরাও বুঝতে পারে শিক্ষক যা বুঝিয়েছেন তা তাঁরা বুঝেছে কিনা। ব্যবহারিক ক্লাসের শেষ দশ বা পনের মিনিটে শিক্ষক ছোট্ট কুইজ নিতে পারেন, যার মাধ্যমে ছাত্ররা কতটুকু বুঝতে পারলো তার একটি পরিমাপও হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ছাত্রটির ক্লাসেই পড়া হয়ে গেল এবং তাঁর বাসায় গিয়ে আরো বেশি পড়ার প্রয়োজন পড়বে না। সমাপনী পরীক্ষায় শতকরা ৩০ বা ৪০ ভাগের বেশি নম্বর রাখা উচিত নয়।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল পাঠ্যসূচি। কি কি বিষয় পড়ানো উচিত? মৌলিক বিষয় হিসেবে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর নিম্ন বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। উচ্চ-মাধ্যমিক শেষে একজন ছাত্র/ছাত্রী যেন এই মূল বিষয়গুলোর প্রাথমিক পর্যায়ের জ্ঞানগুলো অল্প বিস্তর জানে সেটা আমাদের নিশ্চিত করা উচিত।

• ভাষাঃ বাংলা, ইংরেজী, ঐচ্ছিক বিষয়ঃ আঞ্চলিক বাংলা ভাষা, আদিবাসী ভাষা, আরবী ভাষা।
• বিজ্ঞানঃ পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, চিকিতসা বিজ্ঞান, জ্যোতির বিজ্ঞান।
• গণিতঃ পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতিসহ সকল ধরনের প্রাথমিক গণিত।
• সমাজঃ সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আইন।
• ইতিহাসঃ বাংলাদেশের ইতিহাস, উপমহাদেশের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান, সম-সাময়িক ঘটনা।
• প্রযুক্তিঃ কম্পিউটার প্রযুক্তি, অন্তর্জাল।
• সাংস্কৃতিকঃ চিত্র কলা, সঙ্গীত, নাটক, লেখালেখি, বিতর্ক ইত্যাদি।
• শারীরিকঃ ড্রিল, খেলাধুলা, সাতার, ভ্রমণ, স্কাউট।
• নৈতিকতাঃ সেইফটি জ্ঞান, ধর্ম, দর্শন ।

সবশেষে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এর খসড়াতে বেশ কিছু ভাল প্রস্তাব উঠে এসেছে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে এবং সকলের ক্ষেত্রে অভিন্ন পাঠ্য সূচি রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং তা অবৈতনিক রাখা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তর ধরা হয়েছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত। বাস্তবতার বিবেচনায় আমি বলব প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করা এবং সে পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক রাখা ঠিক আছে। তারপরেও আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে সবাই যেন মাধ্যমিক স্তর শেষ করে। ২০১১-১২ এর মাঝে ১০০ ভাগ শিশুকে শিক্ষার তলে আনার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দরিদ্র শিশুদের জন্য উপবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। মুখস্থ বিদ্যা থেকে সরে এসে সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলো বাস্তাবয়ন করা গেলে শিক্ষার মান অনেকাংশে বাড়বে বলে আমার ধারণা। তবে একটি বিষয় না বললেই নয় তা হল -বলা হয়েছে সাংবিধানিক সেকুলার নীতির কথা। কিন্তু আমাদের বর্তমান সংবিধান সেকুলার নয়। সে ক্ষেত্রে এই নীতি প্রনয়নের আগে সংবিধানের পরিবর্তন বাঞ্চনীয়। আবার সেকুলারের কথা বলেও নৈতিক শিক্ষার জন্য যার যার ধর্মের মাঝেই ফিরে যাই। এখানে একজন ছাত্র/ছাত্রী শুধু তাঁর নিজের ধর্ম পড়বে নাকি যে মূল চারটি ধর্মের কথা বলা হয়েছে সব গুলোই পড়বে তা পরিষ্কার করা হয়নি। যদিও সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদান মানেই সেকুলার নয়, তারপরেও নিদেন পক্ষে সকল ধর্ম সম্পর্কে জানলেও একজন মানুষ ধর্মের মূল সুরটি ধরতে পারবে বলে মনে হয়। তাই বৈষম্যহীন শিক্ষা দিতে হলে সকল ধর্মই প্রতিটি ছাত্র/ছাত্রীর পড়া উচিত।

সবশেষে নীতি কি করা হল সেটার চেয়ে মুখ্য বিষয় হল নীতির কতটুকু গ্রহন করার জন্য আমরা আন্তরিক। আমরা যদি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি নাই করতে পারি তবে আমাদের সকল সংস্কারই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই মুক্ত চিন্তার জাতি গঠনের জন্য সবার আগে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে হবে।

সংবিধান ও স্বাস্থ্যসেবা

শিক্ষার পর মৌলিক যে চাহিদাটি মানুষের প্রয়োজন তা হল স্বাস্থ্যসেবা। আমি সুস্থ আছি সেটা যে কত বড় নিয়ামক সেটা আমরা অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত বুঝিনা। বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতির পরও এখনো অনেক রোগই রয়ে গেছে আমাদের চিকিৎসার বাহিরে। তাই মৃত্যুকে আমরা জয় করতে পারিনি এখনো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পরিবারের যখন কেউ অসুস্থ হয়ে পরে তখন সেই মানুষটির সুস্থতার জন্য পরিবারের সদস্যরা সর্বপ্রকার চেষ্টাই করে। এটাই মানবের স্বাভাবিক ধর্ম।

একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল মানুষের সমান চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। শুধু মাত্র অর্থের অভাবে কোন প্রাণ বিনা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে মৃত্যুকে বরণ করবে সেটা হতে পারে না। তাই সকলের সমান স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়ভার রাষ্ট্রের। এমন একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিতে হবে যেন সকল চিকিৎসা কেন্দ্র গুলোতে, তা রাষ্ট্র পরিচালিত হোক বা ব্যক্তিগত ভাবে পরিচালিত হোক, জনগণ সমান স্বাস্থ্যসেবা পায়। তার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

একটি কেন্দ্রীয় ভাবে পরিচালিত বীমা এই কাজে সাহায্য করতে পারে। ব্যবস্থাটি এমন হবে যে সকল জনগণ তার স্বাস্থ্য সেবার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রকে প্রতি মাসে প্রদান করবে। যদি কোন মাসে সে অসুস্থ হয় তবে তিনি সরাসরি যেকোন ডাক্তার এর কাছে যাবেন এবং চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তা তিনি করবেন। এর সকল খরচ রাষ্ট্র সরাসরি উক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রকে প্রদান করবে। এই বীমা ব্যবস্থা পরিসংখ্যানের কিছু নিয়ম মেনে চলে। ধরা হয় যে, প্রতি মাসে দেশের সকল জনগণ একত্রে অসুস্থ হয়ে পড়বে না। কিন্তু যেহেতু সবাই প্রতি মাসে তাঁদের কিস্তি প্রদান করে থাকে, তাই যারা অসুস্থ হয়নি তাঁদের টাকা দিয়ে অসুস্থদের চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। এখন, আপনি নিজেও যদি কোন এক সময় কঠিন অসুস্থ হোন, আপনিও চিকিৎসা পাবেন। ব্যাপারটি অনেকটা নিজের ভবিষ্যতের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে সব সময় অল্প অল্প করে অর্থ সঞ্চয় করে রাখা।

তবে এরকম একটি ব্যবস্থা রাতারাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও নীতিমালার প্রয়োজন। একটি সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র থাকতে হবে যেখানে প্রতিটি নাগরিকের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে একটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসতে হবে। দূর-চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুরুতে আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য কিছু বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই দরিদ্র, যাদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়া সম্ভব হবে না আবার বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে সবসময় ভর্তুকি দিয়েও রাষ্ট্র চলতে পারবে না। এই সমস্যা আমাদের সর্ব ক্ষেত্রেই থাকবে। এ কারণে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় না বাড়িয়ে সত্যিকার অর্থে কিছু করা কষ্টকর হবে। তাই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সংবিধান ও অর্থনীতি

মানুষের বাকী মৌলিক চাহিদা গুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। এই সবগুলো সরাসরি জীবিকার সাথে সম্পর্কিত। এক কথায় বলা যায় একজন মানুষ চায় তাঁর একটি জীবিকা অর্জনের পথ থাকবে যা দিয়ে সে তাঁর এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে। মানুষ আসলে কি খুব বেশি কামনা করে? সে চায় সমাজে তাঁর জন্য একটি কাজ থাকবে, যে কাজ দিয়ে সে তাঁর সংসারটিকে সুন্দর ভাবে চালাতে পারবে। পরিবারের সকল সদস্যের মাঝে খাবার তুলে দিতে পারবে। সন্তানদের শিক্ষার আলো দিতে পারবে। পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে তাকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে। পরিশেষে নিজে যখন কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, তখন তাঁর সন্তান বা রাষ্ট্র তাঁর দেখাশুনা করবে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি একটি জটিল ব্যবস্থা। আমরা আজ একটি জটিল ধাঁধার মাঝে আছি। সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী একজোট হয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় মানুষকে শোষণ করে। আবার সম্পূর্ণ সমবায় ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজের শ্রম ব্যয় না করে সমবায় ব্যবস্থার সুবিধে নিয়ে অর্থনীতির চাকাকে স্থবির করে দেয়। এখন এই দুই দ্বন্দের মুক্তি হল মিশ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু ঠিক কতটুকু সমবায় আর কতটুকু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা একটি গতিশীল অর্থনীতির জন্য প্রযোজ্য সেটা বের করাই আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য।

সমাজে বিভাজন নেই সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজে অধিক কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে আবার কম কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে, অধিক মেধাবী আছে আবার কম মেধাবী আছে, অধিক বয়সী বা অভিজ্ঞ ব্যক্তি আছে আবার কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি আছে, কারিগরী ও প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি আছে আবার নন-ঢেঁকি ব্যক্তি আছে। সুতরাং বিভাজন কিছুটা থাকবেই। তবে বিভিন্ন পেশাবিদদের বেতন স্কেল ভিন্ন না করে অভিন্ন করার পক্ষপাতিত্বে আমি। বেতন স্কেলের বিভাজন কেবল মাত্র হবে কর্মক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও মেধার ভিত্তিতে।

অর্থনীতিকে সবল করতে হলে দেশের আমদানি ও রপ্তানীর মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে। আমদানীকে কমিয়ে রপ্তানী যত বাড়ানো যাবে তত অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এখন আমদানী কমানোর অনন্য উপায় হচ্ছে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো। সর্বক্ষেত্রে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা। তার জন্য প্রয়োজন দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো যা বিশ্ববদ্যালয়গুলোতে গবেষনার মাধ্যমে হতে পারে। দেশীয় প্রয়োজন মেটানোর পর, উদ্বৃত্ত দেশের বাহিরে রপ্তানী করা। আমরা যদি কোন পণ্য রপ্তানী নাও করতে পারে, শুধু জনসম্পদ রপ্তানী করেই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।

রাষ্ট্রের যদি কোন খাতে বিনিয়োগ করতে হয় তবে বিনিয়োগ করা উচিত দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত দেশীয় কল-কারখানা গড়ার জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত জনসম্পদ রপ্তানী খাতে। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের জন্য এবং বিদেশ গমণের ব্যয়ভার বহনের জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত তথ্য প্রযুক্তিতে। দেশের সকল জনগণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা উচিত। দেশের সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসা উচিত। সকল সরকারী/বেসরকারি কর্মকাণ্ড অন্তর্জাল ও মোবাইল এর আওয়তায় নিয়ে আসা উচিত। বিনিয়োগ যদি করতে হয় তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা উচিত। গবেষণায় করা উচিত। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় করা উচিত।

শেষ কিছু কথাঃ

অনেকেই লেখাগুলো পড়ে ভাবতে পারেন পুরোটাই ইউটোপিয় চিন্তাভাবনা। আবার অনেকেই এর মাঝে সোস্যালিষ্ট চিন্তাধারণার ছায়াও পেতে পারেন। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তাগুলো স্বপ্নের মতই। দেশের যে কোন উন্নতি সম্ভব, এমন ধারণা পোষণকারী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। কিন্তু আমি বলবো অসম্ভব কোন কিছুই নয়। আমি যে সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছি, তা পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যমান। তাঁরা উন্নত এজন্য নয় যে তাঁদের সমাজ ব্যবস্থা উন্নত। তাঁরা উন্নত কারণ, তাঁরা নিজেদের দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করেছে। এ কারণে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই হবে আমাদের মৌলিক লক্ষ্য। আবার অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শাসন ব্যবস্থা সব এক অপরের উপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কিত। একটি ব্যতীত অন্যটিকে উন্নত করা সম্ভব নয়। তাই আসলে প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। প্রয়োজন গণমানুষের মৌলিক চাহিদার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা এবং একটি স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা, যেন একটি গতিশীল অর্থনীতি পাওয়া যায় এবং সেই সাথে সকলের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।

সোস্যালিজমের ছায়া পেতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে উন্নত দেশগুলো কিন্তু সোস্যালিষ্ট দেশ নয়। বরং বলা যেতে পারে মিশ্র অর্থনীতির দেশ। ধীরে ধীরে সকল রাষ্ট্রই এই সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে। আবার এই সমাজ ব্যবস্থাও যে ত্রুটিমুক্ত তা নয় কিন্তু। এখনো উন্নত দেশগুলোর মাঝে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব বিরাজমান, কারণ আমাদের প্রকৃত গনতন্ত্রের অভাব। বর্তমানে যে গণতন্ত্র বিরাজমান তা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। এই কথাটি উন্নত, উন্নয়নশীল সকল দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এই অসাধু চক্রটি জনগণের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ নিয়ে আসে, কিন্তু আদতে তারা শোষনের যন্ত্রটি ঠিকই চালু রাখে। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য একটিই – জনগণের করের টাকায় জীবন ভোগ (বিভিন্ন রাজনীতিবিদগণ ও ঋনখেলাপীদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ দ্রষ্টব্য)। এরা তাই ঋণ খেলাপী হয়েও বড় বড় দলের অর্থের জোগানদার, এরাই দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারক। এরা তাই দেশের কোন মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয়। এ কারণেই যে সরকারই ক্ষমতা আসুক, শাসন ব্যবস্থা একই ভাবেই চলে।

রাজনীতিবিদগণ ধীরে ধীরে এই অসাধু চক্রটির শোষনের যন্ত্র হয়ে উঠে, কখনোবা নিজেই চক্রটির অংশ হয়ে যায়। এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং এদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বিদ্যমান শাসন যন্ত্রে সেটি কখনই সম্ভব হবে না। আমাদের প্রয়োজন একবিংশ শতাব্দীর জন্য নতুন একটি দল গঠন করা যারা জনগণের সামনে বিকল্প হয়ে আসবে। এটি হতে হবে সম্পূর্ণ এই প্রজন্মের হাতে তৈরি। এদের কাজ হবে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করা এবং জনগণের কাছে এদের মুখোশ খুলে দেওয়া। এভাবে আগামী দশ বা পনের বছরে যদি এই দলটি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারে তবেই কাঙ্খিত পরিবর্তন সম্ভব। অন্যথায় এক শ্রেনীর মানুষ শুধু সম্পদের পাহাড় গড়বে আর অধিকাংশ মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে চলবে এবং ঈশ্বরের দোষারোপ করে চলবে।