‘প্রিয়তমাসু’ কবিতায় পাই তাঁর প্রেমিক হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, প্রিয়ার প্রতি আস্থার স্বাক্ষর। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে এশিয়ার বার্মা পযর্ন্ত সৈনিক হিসেবে ঘুরলেও প্রিয়ার মুখখানি ক্ষণে ক্ষণে মনে উঁকি দিয়েছে, তাড়িত করেছে, দহন করেছে। তাই তো রাইফেলের কলমে নীল কালিতে লেখা ——–
“তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধ জয়ের ফাঁকে ফাঁকে,
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।“
এ যে এক প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ের ক্ষত যাকে নারীর মুখ যুদ্ধ ক্ষেত্রেও পুড়িয়েছে, ভাবিয়েছে ঝালিয়েছে ও জ্বালিয়েছে।
যুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরার পালায় কবির আকাঙ্ক্ষা মালা নয়, প্রদীপ বা মঙ্গল ঘট নয়, শুধুই একটি হৃদয়ের প্রতীক্ষার প্রত্যাশার কথাই ব্যক্ত ‘প্রিয়তমাসু’ কবিতায়।
‘তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তোমার হৃদয়।‘
কবি সচেতনভাবে স্বজ্ঞানেই দরজা জানালা বন্ধ করে নিজের মনের কুঠুরিকে অন্ধকার করে রেখেছেন বলে স্বীকারোক্তি। নিজের সাথে, নিজের জন্যে যুদ্ধ বাকী রেখেই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে।
“পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার ও আমার জন্যে।“
কিন্তু সময় যে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই—-
‘নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার’’।
আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো আমরা তাঁর নির্ঝর প্রেমের কবিতা পেতেই পারতাম।
‘সূচনা’ কবিতাটি রূপকাশ্রয়ী। সুকান্ত ভারত মাতাকে অহল্যা রূপে কল্পনা করেছেন। পৌরাণিক কাহিনীর শাপগ্রস্থ অহল্যা যেমন রামের পদ স্পর্শের জন্যে অপেক্ষায় ছিল তেমনি কোন এক নাম না জানা নারীও কী কবির মতো কারো হৃদয় স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল! পরাধীন দেশের প্রেমিক হৃদয় পাষাণ হতে বাধ্য বলে বসন্তেও সাড়া দিতে পারেনি! আর অনামিকা নারীর প্রেমস্নাত হবার দুর্লভ সুযোগ ঘটেনি।
“ কত বসন্ত গিয়েছে অহল্যা গো,
জীবনে ব্যর্থ তুমি বার বার,
দ্বারে বসন্ত একবার শুধু জাগো
দুহাতে সরাও পাষাণের গুরুভার।“
ভারত মাতাকে অহল্যার পাষাণ রূপে আঁকলেও এর প্রচ্ছদে কোন নারীর প্রতিমূর্তিই তাঁকে উদ্বেলিত করেছিল তা ভাবতে বাধা কোথায়? কবিও তো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ —–
“ অহল্যা, জেনো আমরা তোমার সঙ্গে।’’
‘চিরদিনের” কবিতায় চিরায়ত কৃষক বধূর ঢেঁকিতে ধান ভানা আর ঠাকুমার ঝুলিতে গল্প সম্ভারের সন্ধান পাই। গ্রাম বাংলার পরিবারের প্রধানতম দায়িত্ব পালনকারী নারী চরিত্র চিত্রিত হয়েছে এ কবিতায়। চমৎকার চিত্রকল্প যা অহরহ বাস্তবে দেখা মেলে —–
“হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে
কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে,
ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনো মতে,
সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।’’
কৃষি পরিবারের বধূর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নই তো সোনালী ফসল। আর কৃষক বধূ নৈমিত্তিক কাজের ফাঁকে পরিবারের খাদ্য সংস্থানের উৎসের দিকেই ফিরে চায়।
‘মীমাংসা’ কবিতায় তাঁর আজাহারি আজকের সময়েও ফুরায়নি। সব কালে সব স্থানে নারীর অবস্থান প্রায় অপরিবর্তিত।
“মত্ত যেখানে দৈত্যে দৈত্যে বিষাদ ভারি ঃ
হানাহানি নিয়ে সুন্দরী এক রাজকুমারী
(রাজকন্যার লোভ নেই,— লোভ অলঙ্কারে
দৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা ক’রে চায় তাহারে।)”
কন্যাদের বিবস্ত্র করার ঘটনা, কাহিনী, ইতিহাস উল্লেখ নারীর অধঃস্তন অবস্থা ও অবস্থানকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ চলছে যুগ যুগ ধরে। দ্রোপদীর বস্ত্র হরণ থেকে হাল আমলের বাঁধনদের। দ্রোপদীর বস্ত্র হরণ রাজসভায় আর বাঁধনদের রাজপথে। রাজবধূ থেকে রাজপথে নিজেকে স্বাধীন ভাবা নারী —- কেউই বাদ যায় না দুঃশাসনদের কবল থেকে। আর সুকান্তের আঁকা দৃশ্যপট বদলানোর জন্যে নারী মুক্তি আন্দোলন ও সংগ্রাম আজও চলছে।
সুকান্ত আশাবাদী ছিলেন। পরাধীনতার বেড়ি ভেঙ্গে দেশ একদিন মুক্ত হবেই — এ ছিল তাঁর সুদৃঢ় প্রত্যাশা। বৃটিশ শাসন অহেতুক ভয় দেখালেও চূড়ান্ত সময়ে পরাজিত হবে। কাজেই কাল রাত পোহাবেই এবং ভোর হবেই। তাই তিনি প্রেমের মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। প্রেয়সীকে দেয়া তাঁর আশ্বাস ভরা পংক্তি ‘রৌদ্রের গান’ কবিতায়—-
“তাইতো এখানে সূয তাড়ায় রাত
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘ ভয়ে আজ ভীত?
কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়,
এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।’’
কিন্তু কবির তাঁর জীবনের মেঘ কাটার আগে,পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার আগে,রাত পোহাবার আগে নিজেই কেটে পড়েছেন ক্ষণিকের অতিথির মতো। তা না হলে হয়তো প্রেয়সীর জন্যে প্রেমের অবিনাশী পদাবলী প্রকাশ পেতো, তাঁর ক্ষুরধার কলমের নিব রূপান্তরিত হতো মোলায়েম কোন লেখনীতে।
“দেয়ালিকা”র ৭ নম্বর পদ্যে নারীকে জানিয়ে দিয়েছেনঃ
‘হে রাজকন্যে
তোমার জন্যে
এ জনারণ্যে
নেইকো ঠাঁই।“
নারী ও পুরুষ মনুষ্য সমাজের অবশ্যম্ভাবী, অপরিহায, অবধারিত, অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সামাজিক মানুষ হোক আর বন মানুষ হোক নারী ও পুরুষের মধ্যে যে কোন একটিকে বর্জন অসম্ভব। কাজেই সুকান্তও এ সত্যকে মনে ও মননে ধারণ করতেন, মেনেও নিয়েছেন তাঁর লেখার বিভিন্ন অস্তিত্বে। লালন ও করতেন মনের গভীরে। “ছাড়পত্র’” ও “ঘুম নেই” কাব্যদ্বয় পাঠে এ সত্যকে উপলব্ধি করা কঠিন নয় নিশ্চয়ই।
অনেক সমালোচকই বলেছেন সুকান্তের কবিতা যতটা রাজনৈতিক ততটা নান্দনিক নয়। বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা সম্বন্ধে বলেছেন, ” রাজনৈতিক পদ্য লিখে শক্তির অপচয় করছো তুমি; তোমার জন্য দুঃখ হয়। “
রাজনৈতিক শ্লোগানেই ও তো নান্দনিকতার স্পর্শ পাওয়া যায় আর পদ্যে রাজনৈতিক গন্ধ থাকায় অস্বাভাবিকতা কোথায়!
অন্যদিকে,আমার আলোচনা পড়ে অনেকে বলতেই পারেন যে কবিতায় নান্দনিকতার পরিবর্তে নারীর উপস্থিতি খোঁজা সাহিত্যের শাশ্বত আবেদনকে উপেক্ষা করা অথবা নারীবাদের জ্বালায় বিশুদ্ধ কাব্যরস আস্বাদনেও ব্যঘাত। কিন্তু নারীবাদের সাথে কাব্যরসের সমন্বয় সম্ভব,এ দুইয়ের মাঝে সাংঘর্ষনিক কোন বিষয় নেই। আধুনিক জীবন-যাপন, জীবন বোধ,সৃষ্টিশীলতার এ সব কিছুর সাথে রাজনীতি ও নারীবাদ জড়িয়ে থাকতেই পারে এবং আছেও।
জীবন মরণের জাতীয় সংগ্রামে, মুক্তির যুদ্ধে জড়িত হবার কারণে প্রেমের জারিত রসে স্পন্দিত হবার ও প্রেমের পারিজাতকে ছোঁয়ার বাসনাকে দমিত করে রেখেছিলেন।
সুকান্ত ভট্টাচায্য সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার ভিন্নধর্মী প্রকাশ তাঁর ‘গীতিগুচ্ছ’। রাবীন্দ্রিক ঢঙে প্রকাশিত তাঁর গীতিময় উচ্চারণ। উচ্ছ্বসিত আবেগের বাঁধ ভাঙ্গা পংক্তিতে ভরপুর। আর এমন উথাল পাথাল আবেগে নারী না এসে কী পারে! “গীতিগুচ্ছে” সুকান্তের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহের অংশ হিসেবে নারী উপস্থিতিকে তুলে ধরেছেন। বিরহীর সুরে গাঁথা ‘গীতিগুচ্ছ’ প্রকৃতি, প্রেম ও নারীর সরব সমারোহ। যেমনঃ
• ‘দেখিলাম আমি খোলা বাতায়নে
তুমি আনমনা কুসুম চয়নে”
• “পথ চেয়ে আমি বসে আছি হেথা তোমার আশে।
তুমি এলে যদি কাছে বসো প্রিয় আমার পাশে।“
• তুমি আর নহ আমার অতীত,হে মনোরমা।।
• কার চরণের ছোঁয়া হৃদয়ে উঠিল রণরণি।
• কে তুমি আমারে ডাকিলে শ্রাবণ বাতাসে
তোমার আহ্বান ধ্বনি —
পরশিয়া মোরে গরজিল দূর আকাশে।
• বিরহী যক্ষ রামগিরি হতে
পাঠাল বারতা জলদের স্রোতে
প্রিয়ার কাছেতে জানাতে চাহিল
সব শেষে সব আশার।
সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কাব্যে নারী ভাবনা ও নারী প্রসঙ্গ নিয়ে এ আলোচনা নিতান্তই এবং নেহায়েৎই সাহিত্য পাঠে একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ।
– শেষ-
না পারে না,উথাল পাথাল আবেগ মানেই হয়ত নারী।
কিন্তু তাই বলে নারী মানেই কি শুধু উথাল পাথাল আবেগ?আমার তা মনে হয় না!
সংর্ঘষতো নেই বরং নারী ছাড়া সাহিত্য কি পরিপূর্ণতা পেত? বড্ড শুষ্ক,রুক্ষ,নিষ্প্রান হয়ে যেত না!
জীবনের প্রতিটি ধাপে নারীকে প্রয়োজন,কাব্যে কেন নয়!
যেহেতু বর্জন সম্ভব নয় কাজেই অপরিহার্যতা স্বীকার করেই নিতে হয় !
@নিবেদিতা,
একমত।
আমি নিবেদিতা আইচের ভ্রমণ-কাহিনীতে মুলত মেয়েদের লেখাকে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ বলাতে আপনি জ়েন্ডার অসংবেদনশীলতার প্রশ্ন তুলেছিলেন।আপনিও কি একই কথা বলছেন না?নারী তার স্বভাব-কমনীয়তা দিয়ে পুরুষের হৃদয়ে উথাল-পাথাল আবেগ সৃষ্টি করে।এতে তো দোষের কিছু নেই।প্রকৃতি নারীকে দিয়েছে মাতৃত্বের মহিমা।মনে হয় আদিম কালে মাতৃত্বই নারী-পুরুষের মধ্যে ৯ মাসের ব্যবধান গড়ে দেয়,আর ফলে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক হতে শুরু করে।মেয়েদের কমনীয়তা অবশ্যই ছেলেদের চেয়ে বেশি।সত্যজিত রায়ের মত চাঁচাছোলা গদ্য মেয়েদের হাত থেকে বেরুতে দেখিনি।রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ধারায় অনেক কবিতা পেয়েছি,কিন্তু মেয়েদের কবিতায় সুকান্তের মত বিদ্রোহের রুদ্রবীণার ঝংকার কেন থাকবে না?জীবন-সংগ্রামে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি সংক্ষুব্ধ।তবু তারা সব সময়ই মেঘ,বৃষ্টি,শিশির,কুয়াশা,একাকিত্ব-ইত্যাদি উপমা দেয়।কেন তারা পাশাপাশি ‘দুর্মর’ বা ‘হে মহা জীবন’ লিখতে পারে না?
সুকান্তের কাব্য নিয়ে আপনার এই অনুসন্ধিৎসা ভালো লেগেছে ও অণুপ্রেরণা যুগিয়েছে,যদিও সাহিত্য আমার বিষয় নয়।কিন্তু সাহিত্য ভালো না লাগলে নিজেকে কেমন যেন বুনো মনে হয়।