আমাদের চেয়েও উন্নত কোন বহির্জাগতিক সভ্যতার সাথে যোগাযোগ হলে তাদের করা প্রথম প্রশ্নটিই হতে পারে, “তোমাদের কিভাবে জন্ম হয়েছে সেটা কি বের করতে পেরেছ?” আর ২০০ বছর আগে হলেও এই প্রশ্ন শুনে আমাদের লজ্জায় পড়ে যেতে হতো। ডারউইন এসে আমাদেরকে রক্ষা করলেন আর কি! ডারউইন-এর আগেও যে অনেকে বিবর্তন নিয়ে তত্ত্ব দেয়ার চেষ্টা করেন নি তা না। কিন্তু তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত ও পর্যবেক্ষণের দরকার ছিল তা কেবল ডারউইন-ই জোগাড় করতে পেরেছেন। আসলে প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতা দেখে বিবর্তনের বাস্তবতা বুঝতে পেরেছিলেন, এমন অনেক পণ্ডিতই ইতিহাসে গত হয়েছেন। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের মত একটি শক্তিশালী তত্ত্ব দিয়ে সেই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করাটাই ছিল বৈপ্লবিক।

1ডারউইন পর্যবেক্ষণ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ডারউইনের তত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে জীবকূলের ইতিহাস বর্ণনা করে। আর ইতিহাস প্রমাণ করার জন্য এমন কিছু প্রয়োজন যা দিয়ে ইতিহাসের গতিধারাটি চোখের সামনে তুলে ধরা যায়, সচিত্র প্রতিবেদনের মত। এভাবে ইতিহাস উদঘাটনের উপকরণগুলো তখন ছিল না। কিন্তু আজ বিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রমাণের সবচেয়ে বড় দুটি উপকরণ আমাদের হাতের মুঠোয়- এক. বংশগতিবিজ্ঞান, দুই. জীবাশ্ম। বংশগতিবিজ্ঞান সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ হলেও এটা আমাদেরকে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে সাহায্য করে না। কিন্তু জীবাশ্ম একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই ১লা অক্টোবর যখন ৪৪ লক্ষ বছর বয়সী আর্ডিপিথেকাস র‌্যামিডাস (আর্ডি) এর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে টিম হোয়াইট-এর দল ১১টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করল তখন আমি যেন ঠিক একটা ভিডিওচিত্রের মতই মানবজাতির ইতিহাসটা চোখের সামনে দেখতে পেলাম।

আদম-হাওয়া র পৌরাণিক কাহিনীর বিপরীতে ডারউইন স্থাপন করেছিলেন তার “জীবনবৃক্ষ”। বলেছিলেন, পৃথিবীর সকল প্রাণ সূতোয় বাঁধা। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সকল জীবকে একটি গাছের সাথে তুলনা করলে গাছের গুড়িটিকে বলতে হবে প্রাণের আদিতম পূর্বপুরুষ। এই গুড়ি থেকে কাণ্ড জুড়ে বড় হয়েছে গাছ, তৈরি হয়েছে একের পর এক শাখা-প্রশাখা। আমরা জীবনবৃক্ষের যে শাখায় আছি, নিজেদের ইতিহাস জানতে হলে সেই শাখা বেয়ে রওয়ানা করতে হবে গুড়ির অভিমুখে। এ অভিযাত্রায় আমাদের বড় সহায় হবে জীবাশ্ম। ১৯৭৪ সালে লুসি (অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস) আবিষ্কারের পরই জীবাশ্ম বিবর্তনকে সর্বসাধারণের চোখের সামনে মেলে ধরতে শুরু করে। হাটুতে জ্ঞান নিয়ে মহাবিশ্বের কথা বলা জাকির নায়েক বা আত্মপরিচয়হীন হারুন ইয়াহিয়া-রা ২৪/৭ ব্যস্ত থাকে ত্রিশূল দিয়ে মানুষের চোখ অন্ধ করে দেয়ার কাজে। আর্ডি বা লুসি-রা সেই অন্ধত্ব নিরসনে আমাদের সাহায্য করে। তাই অন্ধ-দর্শনক্ষম নির্বিশেষে আসুন সবাই শুরু করি সেই মহান অভিযাত্রা-

গন্তব্য: গাছের গুড়ি

বর্তমানে জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানী দের দেওয়া তথ্য অনুসারে আজ থেকে ৭০ লক্ষ বছর আগে মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স) এবং শিম্পাঞ্জিরা তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়েছিল। তাই আমাদের প্রথমেই বুঝে নিতে হবে- আমরা শিম্পাঞ্জি থেকে বিবর্তিত হই নি, শিম্পাঞ্জি এবং আমরা উভয়েই বরং একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছি যারা মানুষও ছিল না আবার শিম্পাঞ্জিও ছিল না। তার মানে ৭০ লক্ষ বছর আগে গাছের একটি শাখা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল- শিম্পাঞ্জিরা বিবর্তিত হয়েছে একটি শাখা ধরে আর আমরা বিবর্তিত হয়েছি অন্যটি ধরে। এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানুষ ও শিম্পাঞ্জির সেই সাধারণ পূর্বপুরুষটিকে খুঁজে বের করা।

১৯৭৪ সালে লুসি নামের একটি মেয়েকে আমরা মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করি যার বয়স ছিল ৩৩ লক্ষ বছর। অনেক গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা একমত হন যে, সে আমাদেরই পূর্বপুরুষ, কিংবা পূর্বপুরুষদেরই কোন নিকটাত্মীয়। তার মানে লুসি আবিষ্কারের পর মানুষ-শিম্পাঞ্জির সাধারণ জয়েন্ট থেকে আমাদের দূরত্ব থাকে ৩৭ লক্ষ বছর। লুসির সবচয়ে বড় দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল:
– সে দুই পায়ে ভর করে হাটতে পারতো যা শিম্পাঞ্জিরা পারে না
– তার মস্তিষ্ক শিম্পাঞ্জিদের থেকে একটু বড় ছিল

এই আবিষ্কার থেকে সহজেই বোঝা যায়, লুসির আগে পৃথিবীতে আমাদের যেসব পূর্বপুরুষ বাস করে গেছে তাদের দুই পায়ে হাটার ক্ষমতা লুসি-র চেয়ে কম হবে, তাদের মস্তিষ্কও হবে অপেক্ষাকৃত ছোট, তবে খুব বেশি ছোট না কারণ এই বিবর্তনটা অনেক ধীরে ঘটেছে। আর্ডিপিথেকাস র‌্যামিডাস আমাদের সেই প্রকল্পকেই সত্য প্রমাণ করল। ২০০৯ সালের ১লা অক্টোবর “নেচার” পত্রিকায় প্রকাশিত ১১টি গবেষণাপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি,
– আর্ডি-ও একটি মেয়ে যার বয়স ৪৪ লক্ষ বছর
– সে দুই পায়ের উপর ভর করে খুব কম দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে
– আবার গাছে গাছেও আনাড়িভাবে ঝোলাঝুলি করতে পারে

এই মহা আবিষ্কারের পর সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আমাদের দূরত্ব থাকল আর মাত্র ২৬ লক্ষ বছর। লুসি আবিষ্কৃত হয়েছিল ইথিওপিয়া-তে। আর্ডিও ইথিওপিয়ার। ইথিওপিয়া-ই বোধহয় আমাদেরকে নিয়ে যাবে সেই পূর্বপুরুষের কাছে। উপরের ছবিটিতে (ছবির উপর ক্লিক করলে বড় হবে) জীবাশ্মের আলোকে ৭০ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে শুরু করে একেবারে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের ইতিহাস দেখানো হয়েছে। কোন প্রজাতিটি কোন সময়ের এবং সেই প্রজাতির কী কী অঙ্গের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেটাও ছবির মাধ্যমে বোঝা সম্ভব। বুঝতেই পারছেন- একমাত্র লুসি এবং আর্ডি-রই প্রায় পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল নির্মাণ করা গেছে। বাকিদের মাথা বা দেহের বিভিন্ন অংশের কিছু হাড় পাওয়া গেছে কেবল। ছবিতে ৭০ লক্ষ বছর আগেরও একটি জীবাশ্ম দেখা যাচ্ছে, নাম “সাহেলানথ্রোপাস চাদেনসিস”। এর মাধ্যমে মানুষ-শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যেতো, কিন্তু এর কেবল মাথার খুলিটাই পাওয়া গেছে। মস্তিষ্কের আকার এবং খাবার গ্রহণের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় ছাড়া তাই আর তেমন কিছুই জানা যায় নি।

3

পাশের তালিকায় আরেকটু সূক্ষ্ণভাবে আমাদের ইতিহাস দেখানো হল। হোমো স্যাপিয়েন্স পর্যন্ত পাওয়া প্রজাতিগুলোর নাম এবং কোন সময় তারা পৃথিবী বাস করে গেছে সেটা দেখানো হয়েছে।

আবিষ্কারের কাহিনী

১৯৭৪ সালে লুসি আবিষ্কারকারী দলের একজন বিজ্ঞানী ছিলেন টিম হোয়াইট, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-র জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞান গবেষক। ইথিওপিয়া-র আফার নিম্নভূমিতে হোমিনিনি গোত্রের এত জীবাশ্ম পাওয়া গেছে যে, টিম হোয়াইট রীতিমত এই জায়গার প্রেমে পড়ে যান। সাধে কি আর সারাটা জীবন ইথিওপিয়ার এক বিরান সাভানা-য় কাটিয়ে দিলেন! ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা-র অদূরে “আফার” নামে এক বিরাট নিম্নভূমিতেই লুসি থেকে শুরু করে হোমিনিনি গোত্রের সবগুলো জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। শিম্পাঞ্জি, মানুষ সবাই এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।

টিম হোয়াইট১৯৯২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর টিম হোয়াইটের প্রাক্তন ছাত্র Gen Suwa হঠাৎ করে আফার এর নিকটবর্তী আরামিস গ্রামের পাশে এক টুকরো হাড় দেখতে পান। দেখার সাথে সাথেই বুঝে গিয়েছিলেন, এটা হোমিনিনি গোত্রেরই কোন একটি প্রজাতির জীবাশ্ম। সেই এলাকা ঘিরেই হোয়াইট দলের অনুসন্ধান শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে পাওয়া যায় একটি শিশুর নিম্ন চোয়ালের কিছু জীবাশ্ম। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে শ্রোণীচক্র, মাথার খুলি, পা এবং মুখের অনেকগুলো খণ্ডাংশ পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হল সবগুলো হাড়ের অবস্থাই ছিল শোচনীয়। তাই এগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রকৃত গবেষণা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এ কারণেই তাৎক্ষণিকভাবে বিজ্ঞানীরা সাংবাদিক বা বিজ্ঞানী মহলকে তেমন কিছুই জানায়নি। এরই মধ্যে সর্বমোট ১১০ টিরও বেশি খণ্ডাংশ একত্রিত করে সেগুলোর বিশুদ্ধায়ন চলেছে, তারপর শুরু হয়েছে পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল তৈরির কাজ। উল্লেখ্য, এছাড়া অন্যান্য প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রায় ১৫০,০০০ নমুনাও যুগিয়েছে আফার-এর এই সাইট।

ইথিওপিয়ায় কঙ্কাল গঠনের পাশাপাশি টোকিও এবং ওহাইয়ো তেও আর্ডি গবেষণা চলেছে সমান তালে। ওহাইয়ো-তে বিজ্ঞানী সি ওয়েন লাভজয় আর্ডির ভৌত মডেল তৈরির কাজ করেছেন আর টোকিওতে Gen Suwa কম্পিউটার মডেল বানিয়েছেন। এই দুই গবেষণাকেন্দ্রেই মাঝেমাঝে কঙ্কালের বিভিন্ন অংশ পাঠানো হয়েছে সিটি স্ক্যান এবং অন্যান্য পরীক্ষার জন্য। ৯ বছরের কাজ শেষে Suwa গর্বভরে বলতে পেরেছেন, “৪৪ লক্ষ বছর আগে ইথিওপিয়া-তে ঠিক এরকম এক আর্ডিপিথেকাস র‌্যামিডাস-ই ঘুরে বেড়াতো।”

কম্পিউটার মডেলিং হয়ে যাওয়ার পর Suwa ও Asfaw সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন আর্ডির সাথে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির সকল প্রজাতির মিল-অমিল খুঁজে বের করার জন্য। কারণ মানবেতিহাসের ঠিক কোন জায়গায় আর্ডির জায়গা হবে সেটা ডেটিং এর মাধ্যমে জানা গেলেও, এর সাথে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের সব তথ্য মিলিয়ে দেখার দরকার ছিল। দেখেশুনে আপাতত এই সিদ্ধান্তেই এসেছেন যে, আর্ডি অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যানামেনসিস দের পূর্বপুরুষ। উল্লেখ্য এর আগে অ্যানামেনসিস এর জীবাশ্ম ছিল প্রাচীনতম। উপরের ছক থেকেই সেটা দেখা যাচ্ছে। তবে অ্যানামেনসিস এর খুব কম জীবাশ্মই পাওয়া গেছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে আফার নিম্নভূমির যে জায়গায় হোমিনিনি সন্ধান করা হয়েছে তার এক ইঞ্চি মাটিও আর অক্ষত নেই। বিজ্ঞানী ও পেশাদার জীবাশ্ম শিকারীরা প্রতিটা ইঞ্চি খুটিয়ে দেখেছেন। এক সাংবাদিক তো লিখে দিয়েছেন, “They sucked the bones out of Afar.”

আর্ডি-র বৈশিষ্ট্যসমূহ

শ্বদন্ত

5

মানুষের উপরের চোয়ালে দুটি এবং নিচের চোয়ালে দুটি তীক্ষ্ণ দাঁত আছে যেগুলোকে শ্বদন্ত বলে। শিম্পাঞ্জিরও এরকম শ্বদন্ত আছে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে শিম্পাঞ্জিরটা মানুষের চেয়েও তীক্ষ্ণ ও ধারালো। সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের দিকে বয়ে চলা শাখার প্রজাতিগুলোতে শ্বদন্ত দিন দিন ভোঁতা হয়েছে। আর্ডির শ্বদন্ত হচ্ছে একেবারে মাঝামাঝি। পাশের ছবিতে, একেবারে বামের চোয়াল মানুষের, ডানেরটা শিম্পাঞ্জির আর মাঝেরটা আর্ডির। শিম্পাঞ্জির শ্বদন্তের সাথে অনায়াসেই ছুরির ফলার তুলনা দেয়া যেতে পারে।

আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, মানুষের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের শ্বদন্তের আকার প্রায় একই রকম। কিন্তু এমন অনেক প্রাইমেট প্রজাতি আছে যাদের ক্ষেত্রে পুরুষের শ্বদন্ত নারীর তুলনায় অনেক বড়। এর কারণ পুরুষে-পুরুষে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার কারণ যথারীতি নারী, খাদ্য এবং জমি। বিজ্ঞানীদের মতে শিম্পাঞ্জি ও আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় পুরুষের শ্বদন্ত অনেক বড় ছিল। কিন্তু মানুষের শাখা বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর অর্থাৎ হোমিনিড-দের মাঝে শ্বদন্ত ভোঁতাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কারণ মানুষের পূর্বপুরুষরা সন্তান বড় করার ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রাখতে শুরু করে। মা-কে একা ফেলে না দিয়ে বাবা-রাও সন্তান প্রতিপালনে অংশ নেয়। এ কারণে স্বভাবতই তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কমে আসে আর প্রাকৃতিক নির্বাচন শ্বদন্তকে নির্বাচন করা বাদ দিয়ে দেয়। আর্ডি যখন পৃথিবীতে ছিল তখন এই বাদ দেয়ার প্রক্রিয়াটাই চলছিল।

শ্রোণীচক্র

লাভজয় ও তার দল আর্ডির শ্রোণীচক্র নিয়ে অনেক গবেষণা করে দেখেছেন এর সাথে লুসি-র বেশ ভাল মিল আছে। যেমন লুসি-র মতই আর্ডির শ্রোণীচক্র তার দেহের উর্ধ্বাংশকে বহন করতে পারে। অর্থাৎ শ্রোণীচক্রে ভর দিয়ে দুই পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম ছিল আর্ডি। কিন্তু সে খুব ভালভাবে হাঁটতে পারতো না, আর দৌঁড়াতে পারতো না বললেই চলে। এদিক থেকে সে লুসির চেয়ে ভালই পিছিয়ে। এসব দেখে মনে হয়, আর্ডির সময় থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের বিবর্তন ঘটেছে খুব দ্রুত, মাত্র ১০ লক্ষ বছরের মধ্যেই অস্ট্রালোপিথেকাস এর মত প্রায়-মানুষ প্রজাতির জন্ম দেয়ার জন্য যা আবশ্যক ছিল। উপরের ছবিতে আর্ডি ও লুসির শ্রোণীচক্রও দেখানো হয়েছে। বামে আর্ডি আর ডানে লুসির শ্রোণীচক্রের মধ্যে মিলটা লক্ষ্যণীয়।

পায়ের পাতা ও আঙুল

6

আর্ডির পায়ের পাতাকে বলা যায় opposable কিন্তু rigid. অপোজেবল বলতে বোঝানো হচ্ছে, গাছে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার জন্য ডাল-পালার সাথে পায়ের ঠেক দেয়ার যে পদ্ধতি থাকা দরকার ছিল তার কিছুটা হলেও আর্ডির মাঝে আছে। পায়ের পাঁচটি আঙুলের প্রথমটি অর্থাৎ বৃদ্ধাঙ্গুলি এই ঠেক দেয়ার কাজটি করতো। কিন্তু বাকি চার আঙুলের গঠন খুব শক্ত। দেখে মনে হয় এই আঙুলগুলো মাটিতে সমান্তরালভাবে রেখে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব। আর্ডিরা এভাবেই হাটতো। একাধারে মাটিতে হাটতে এবং গাছে চড়তে সক্ষম এমন প্রজাতির সন্ধান আমরা এই প্রথম পেলাম। এরকম আরও কিছু প্রজাতির খণ্ডাংশ আগে পাওয়া গেলেও সেগুলো থেকে এত তথ্য পাওয়া সম্ভব ছিল না।

হাতের তালু ও আঙুল

আর্ডির পায়ের সাথে মানুষের পায়ের মিল বেশি হলেও হাতের সাথে বেশি মিল শিম্পাঞ্জির। শিম্পাঞ্জির মতই তার হাত খুব নমনীয় তথা ফ্লেক্সিবল যা গাছে ঝুলে থাকার জন্য আবশ্যক। আঙুল গুলো বেশ লম্বা লম্বা এবং সহজেই বাঁকানো যায়। হাত, পা এবং শ্রোণীচক্রের গড়ন থেকেই বোঝা গেছে যে আর্ডি একাধারে মাটিতে হাঁটতে পারতো এবং গাছে ঝুলতে পারতো, কিন্তু কোনটাতেই সে বিশেষ দক্ষ ছিল না। মনে হতে পারে তার জীবন ধারণ করতে এতে খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেটা তো প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরোধী। সে সময় ইথিওপিয়ার আরামিস অঞ্চলটা কেমন ছিল তা বুঝলেই আর বিরোধ থাকে না। এ অঞ্চলে তখন বন জঙ্গল ছিল, তবে গাছগুলো খুব বড় বড় ছিল না, আর বনের মাঝে মাঝে ঘাসে ভরা ছোটখাট সমভূমিও ছিল। তাই দুটোতেই চলার চেষ্টা করাটা তার জন্য ছিল স্বাভাবিক।

7

এখন কিন্তু আফার অঞ্চলের সেই বন নেই। একসময় এটা হয়ত বিস্তীর্ণ সাভানায় পরিণত হয়েছিল। এখনও অনেকটা সাভানা-র মত, তবে ঘাসের পরিমাণও বেশ কমে গেছে। উপরের ছবিতে কেনিয়ার Kibwezi বন (বামে) এবং আফার নিম্নভূমির (ডানে) ছবি দেখানো হয়েছে। আর্ডি যখন জীবিত ছিল তখন আফার অঞ্চলটিও ছিল Kibwezi-র মত। বনের মাঝে মাঝে অল্প বিস্তর তৃণভূমি। এরকম একটা অঞ্চলেই মানুষের বিবর্তন নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করেছিল।

১৯৭৪ সালে লুসি আবিষ্কারের পর অনেকদিন জীবাশ্ম মহলের খুব বড় কোন অর্জন ছিল না। এবারের অর্জন লুসি-কেও ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের বিবর্তন কিভাবে হয়েছে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি তো ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা অনেকটা তৈরি করে ফেলেছেন। তবে সেটার প্রামাণ্য ভিত্তি দাঁড় করাতেও এখন কোন বাঁধা নেই। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান চলে সংশয়ের ভিত্তিতে। যেমন, এই ১১টি গবেষণাপত্র প্রকাশের পরই জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানী মহল অনেক ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। বিভিন্ন জন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এটা দেখছেন। মোটকথা আগামী ১৫ বছর আর্ডিকে নিয়ে মুখর থাকবে বিজ্ঞানী মহল। বাকবিতণ্ডা চলতেই থাকবে। এখনই অনেকে বলছেন, আর্ডিকে সরাসরি অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যানামেনসিস এর পূর্বপুরুষ বলে দেয়ার সময় এখনও আসে নি। জীবাশ্মগুলো আরও পরীক্ষা করার পরই কেবল এ বিষয়ে শতকরা ৯৯ ভাগ নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব, আর এটা তো আমাদের সবারই জানা যে, বিজ্ঞানে ৯৯% নিশ্চয়তাই সর্বোচ্চ।

ডারউইন বিশ্বের তাবৎ জীবকে এক সূতোয় বাঁধতে চেয়েছিলেন, যতটা প্রমাণ থাকলে এই বন্ধনটা অন্যকে বোঝানো সম্ভব ততটা প্রমাণ তিনি জোগাড়ও করেছিলেন। কিন্তু মুখরোচক কিছু না হলে সাধারণ মানুষ সাড়া দেয়। বিজ্ঞানের চেয়ে জনপ্রিয় সংস্কৃতি-র দিকে মানুষের ঝোঁক অনেক বেশি। এবার সেই জনপ্রিয় সংস্কৃতিরও অংশ হতে শুরু করবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা। আমরা আর অদৃশ্য পূর্বপুরুষদের প্রার্থনা করবো না, বরং দৃশ্যমান পূর্বপুরুষদের নিরীক্ষণ করে ইতিহাসের ধ্যান করবো। এই ধ্যান একদিন সত্যিকার অর্থেই এক সূত্রে গেঁথে দেবে আমাদের সবাইকে। তখনও আমরা বেটোফেন এর নাইন্থ সিম্ফনি গাইবো, তবে সে গান কেবল মানুষের নয়, বরং পুরো জীবকূলের প্রতিনিধিত্ব করবে:

ডাইনে ৎসাউবার বিন্ডেন ভিডার
ভাস ডি মোডে স্ট্রেং গেটাইল্ট;
আলে মেনশেন ভের্ডেন ব্রুডার,
ভো ডাইন সাফটার ফ্লুগেল ভাইল্ট।

Your magic binds again
What custom strictly divided.
All men become brothers,
Where your gentle wing rests.

বিবর্তন তত্ত্ব আবার একত্রিত করবে পুরো মহাবিশ্বকে। অ্যাডাম-ইভ এর পুরাণ যে বিশ্বকে একাধিপত্য ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র বানিয়ে দিয়েছিল। যে বিশ্বের মানুষ প্রকৃতি থেকে নিজেদের আলাদা করে নিয়েছিল, নিজেদেরকে ভাবতে শুরু করেছিল অতিপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃতের প্রতিনিধি।
প্রকৃতির স্রোত অতিপ্রাকৃত নয় বরং প্রাকৃতের দিকেই ধাবমান। প্রকৃতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে, প্রকৃতির মধ্যে যেসব প্রকৃতিবিরোধী প্রাকৃতিক সত্তার বাস তাদের অন্ধত্ব ঘুচিয়ে তবেই সে শান্ত হবে, ডানা মেলে বিশ্রাম করবে…

তথ্যসূত্র:

Ardipithecus ramidus – অ্যান গিবন্স, সায়েন্স ম্যাগাজিন
Ardipithecus: We Meet At Last – কার্ল জিমার

ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা – অ্যান গিবন্স এবং কার্ল জিমার