Dr. Ahmed Sharif (1921-1999)মানবতা উদারতা যুক্তিবাদিতা

ড. আহমদ শরীফ

আদর্শ-উদ্দেশ্য-লক্ষ্য-দায়িত্ব-কর্ম-বৃত্তি যদি অপরিবর্তনীয় ও অভিন্ন হয়, তা হলে অনেক ভাব-চিন্তা-কর্ম-কথা-আচরণ আবর্তিত ও পুনরুক্ত হয়ই। একে পুরুক্তি বা পুনরাবৃত্তি দোষ বলা যাবে না। আমাদের অনেক লেখা ও কথা এ কারণেই বার বার বিভিন্ন প্রবন্ধে ও গ্রন্থে পারম্পর্য রক্ষার, প্রসঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার, যুক্তির, তত্ত্বের, তথ্যের ও সত্যের সূত্র স্মরণ করিয়ে দেয়ার গরজে পুনরুক্ত হয়। আমরা এসব সচেতনভাবে বাদ দিয়ে বঞ্ছিত বক্তব্য শ্রোতার বা পাঠকের বোধগম্য করে হৃদয়বেদ্য করে, মর্মভেদ্য করে মগজগম্য করে বলতে পারিনে। আমাদের মতো দুর্বল মনের, নিম্নমানের মননের ও স্বল্প মগজ-মনীষার লেখকের এ দোষ তাই ক্ষমা করতেই হয়, অন্তত সহ্য করতেই হয়। এ কৈফিয়তের পর কথা শুরু করছি।

নিতান্ত প্রাণিত্বের, অরণ্যতার, হিংস্রতার, জাঙ্গলিক বর্বরতার, অসভ্যতার ও অসংস্কৃতির লক্ষণ হচ্ছে সাধারণভাবে জৈব বৃত্তি-প্রবৃত্তি তাড়িত কর্মে-আচরণে জীবন যাপন। ভব্যতার, সভ্যতার নীতিনিয়ম, রীতিরেওয়াজ, প্রথাপদ্ধতি, শাস্ত্র-সমাজ-সংস্কৃতি, শাসন-প্রশাসন, রুচি-সৌন্দর্য-বিবেক-বিবেচনা প্রভৃতির অনুরাগী, অনুগামী ও অনুগত মানুষ সচেতনভাবে সতর্কতার সঙ্গে সযত্ন অনুশীলনে ও প্রয়াসে জৈবজীবনের বৃত্তি-প্রবৃত্তি সংযত, পরিমিত, পরিমার্জিত, পরিশীলিত ও পরিশোধিত করে। মানবপ্রজাতির প্রাণী থেকে জীব জগতের জল-স্থল-আকাশচারী প্রাণীর মুখ্য পার্থক্য এক্ষত্রেই ঘটে শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের ফলেই।

আমরা ভব্য সভ্য নীতিনিষ্ঠ, শাস্ত্রশাসিত শিক্ষিত সংস্কৃতিমান রুচিপুষ্ট ন্যায়বান বিবেকী মানুষে ধীরবুদ্ধি, সংযম, পরমত ও পরআচরণ সহিষ্ণুতা এবং যথাকালে যথাস্থানে যথাপ্রয়োজনে ও যথাপাত্রে যথেষ্ট গুণের, মানের, মাপের ও মাত্রার সৌজন্য ও শোভন আচরণ প্রত্যাশা করি।

যে-ব্যক্তির, যে-পরিবারের, যে-দলের, যে-সমাজের, যে শাসক-প্রশাসকের, যে-সরকারের, যে রাষ্ট্রের কিংবা দেশের যে সব গাইয়ে-বাজিয়ে-নাচিয়ে-আঁকিয়ে-লিখিয়ে, সঙে-শিল্পীতে-স্রষ্টায়-চিন্তাকে-বিজ্ঞানীতে-দার্শনিকে-শাস্ত্রীতে-সরদারে ক্ষোভ-ক্রোধে-জ্বালায়-যন্ত্রণায়-মগজে-আবেগে [Intellect-এ ও Emotion-এ] কথায়-কাজে-আচরণে বাঞ্ছিতমাত্রার সংযম নেই, পরমতে ও পরাআচরণে সহিষ্ণুতা বা নানা বিবেচনায় সহ্য করার ধৈর্য নেই, অবৌদ্ধিক-অযৌক্তিক সামান্য কিংবা লঘু বা তুচ্ছ বলে ক্ষতির আশঙ্কারিক্ত বলে কান-মন-গুরুত্ব না দেয়ার মতো উদারতা কিংবা সৌজন্য নেই, তাকে বা তাদের কোনো সংজ্ঞায় বা সংজ্ঞাতেই পরিশিলীত রুচি-বুদ্ধি-যুক্তির শিক্ষিত রুচিমান সংস্কৃতিমান বিবেক-বিবেচনাসম্পন্ন শিক্ষক-উকিল-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সাংবাদিক শাস্ত্রী, সমাজপতি, দলনেতা, শিল্পী-স্রষ্টা-বিজ্ঞানী-দার্শনিক-ঐতিহাসিক বলা যাবে না। আশৈশবলব্ধ বিশ্বাস-সংস্কার-আচার-আচরণ-ধারণা ও শাস্ত্রে আস্থাচালিত জিজ্ঞাসারিক্ত মানুষের চৈতন্যে মার্কসবাদের প্রয়োগে-প্রয়োজনীয়তা আপাতত ঢোকানো সহজে সম্ভব না হলেও একালে ইউরোপে অনুশীলিত ও বিকশিত – Humanism, Liberalism and Rationalism-এর অনুশীলন-পরিশীলন সচেতন হয়ে সতর্কভাবে সযত্নপ্রয়াসে করতে হবে নতুবা সমকালীন যন্ত্রযুগে, যন্ত্রজগতে যন্ত্রনির্ভর স্বাতন্ত্র্য-ব্যবধান-বিচ্ছন্নতাবিনাশী যন্ত্র-প্রকৌশল-প্রযুক্ত ও জীবন-জীবিকা পদ্ধতিচালিত বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক জীবনে অন্যদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হবে না। মধ্যযুগের অবসান হবে না আমাদের মনে-মননে-মনীষায়-রুচিতে-সংস্কৃতিতে। বিবেকে-বিবেচনায় মিলবে না বাঞ্ছিত মাত্রার সংযম, পরমতসহিষ্ণুতা ও আচারিক সৌজন্য। উল্লেখ্য যে চিরকালই এক প্রকারের কৌমী, গোষ্ঠিক-গৌত্রিক, দালিক, সাম্প্রদায়িক, জাতিক, শাস্ত্রিক, রাষ্ট্রিক মানবিকতা, মানবতা, উদারতা, গ্রহণশীলতা এবং বিশ্বাস সংস্কারানুগ যুক্তিশীলতা চালু ছিলই। কিন্তু তাতে মনের, মননের, বুদ্ধির, যুক্তির, মনীষার, বিবেকের, ন্যায্যতার অবাধ ও মুক্ত চিন্তা-চেতনা ছিল না, কতগুলো ধরা-বাঁধা নীতি-নিয়মের, রক্তের, ভাষার, অতীতের, ঐতিহ্যের স্বাতন্ত্র্য সম্পৃক্ত সংকীর্ণ সীমিত পরিসরের বেষ্টনী ছিল। তাই সে-সব নীতি-নিয়ম মানবিক উদারতা ও যুক্তিবাদিতা স্বদলের, স্বকৌমের, স্বগোষ্ঠীর, স্বগোত্রের, স্বসম্প্রদায়ের, স্বজাতির ক্ষেত্রেই ছিল প্রযোজ্য। অন্যরা ছিল শত্রু কিংবা শত্রুকল্প অথবা সম্ভাব্য শত্রু। একালের উদার ইউরোপীয় মনের মননের মনীষার ফল ও ফসল শিল্প-সাহিত্য, দর্শন। আর জীবন-জীবিকাচেতনা, সমাজবোধ, রাষ্ট্রচিন্তা, দেশপ্রেম, মানবসেবা, ব্যক্তিসত্ত্বার মুল্য ও মর্যাদাজ্ঞান, ব্যক্তি-সমাজ-প্রশাসন-সরকার ও রাষ্ট্র প্রভৃতির পারস্পরিক দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারগত সম্বন্ধ ও সম্পর্কও আধুনিকতম চেতনার ফল, গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, গণমুক্তি প্রভৃতি সম্বন্ধে শোনা-জানা-বোঝা জাত ধারণা ও সযত্নলব্ধ-জ্ঞান এবং মানুষ, মনুষ্যত্ব, মানব মর্যাদা, ব্যক্তিজীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য, অধিকার সম্বন্ধে শিল্প সাহিত্য দর্শন পাঠই কেবল একালের দিগন্তহীন উদারতা, সীমান্তহীন মানবতা এবং অশেষ অবাধ যুক্তিবাদিতা বোধগম্য করে। ইউরোপীয় ফরাসী ইংরেজ জার্মান ভাষার কোনো একটি ভাষায় বই-পত্র না পড়লে কেউ একালোপযোগী মানবতা, উদারতা ও যুক্তিবাদিতা প্রত্যাশিত মাত্রায় আয়ত্ত করতেই পারে না।

আশৈশবপ্রাপ্ত বিশ্বাস-সংস্কার-ভয়-ভরসা-ধারণা-আস্থা কূপমান্ডক্য ও রক্ষণশীলতা পরিহার সচেতন ও সযত্ন প্রয়াসে সম্ভব কেবল একালের ইউরোপীয় লিবারেল শিক্ষাব্যবস্থায় ও জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে লবারেল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে। মানুষকে কালো-ধলো, পণ্ডিত-মূর্খ-পাগল-পঙ্গু, নারী-পুরুষ অবিশেষে কেবল মানুষ হিসেবে জানা-বোঝা-মানাও সম্ভব কেবল এ যুগের দার্শনিক রাষ্ট্রিক আধুনিকতম দায়িত্ব-কর্তব্য-অধিকারসম্পৃক্ত মানবসত্তার মূল্য-মর্যাদা-গুরুত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই। এ-ও আজকের ইউরোপীয় বিদ্যালয়ে লভ্য। আর আমরা জানি এবং বুঝিও যে জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তি ধীর বিবেচনায় স্থির লক্ষ্যে সচেতনভাবে সতর্কতার সঙ্গে সযত্নপ্রয়াসে সাহসের সঙ্গে শক্তির যোগে, অঙ্গীকারের সঙ্গে উদ্যমের উদ্যোগের ও আয়োজনের সমতা রেখে জীবন-জীবিকাক্ষেত্রে যথাপ্রয়োজনে, যথাকালে, যথাস্থানে ও যথাপাত্রে স্বাধিকারের সীমা লঙ্ঘন না করে প্রয়োগ করলেই ব্যক্তির নৈতিক সামাজিক জিবন সমাজে শ্রদ্ধার ও সম্মানের না হয়েই পারে না। এ একান্তভাবেই একালে যুক্তিনিষ্ঠার ও যুক্তিবাদিতার প্রসাদ। বলতে গেলে Rationalism- ই মনুষ্যত্বের বীজ-বৃক্ষ ও ফল। একালে মানুষের ভরসা হচ্ছে প্রতীচ্য উদার চিন্তা-চেতনালব্ধ উদারতা, মানবতা ও যুক্তিবাদিতা। এর ফলেই সম্ভব হয়েছে আধুনিকতম গণতন্ত্রে সেক্যুলারিজম। জাত-জন্ম-বর্ণ-ধর্ম-শিক্ষা-সম্পদ-ভাষা-নিবাস নির্বিশেষে আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের সম ও সহ নাগরিকত্ব। স্বয়ং গণতন্ত্রও এ অবিশেষ মানব চৈতন্যের দান। একালের গণতন্ত্রের তথা মানবতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ দান হচ্ছে ব্যক্তির যথেচ্ছ চিন্তা করার, চিন্তা উচ্চ কণ্ঠে কিংবা লিখিত-মুদ্রিতভাবে ঘোষণার-প্রচারের-প্রচারণার এবং নির্বিঘ্নে-রাষ্ট্রে বাসের, কাজের, বলার ও ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও জন্মগত স্বাধিকারের স্বীকৃতি। ইউরোপীয় মনন মনীষার প্রভাব ব্যতীত এ মানবতা, এ উদারতা, এ যুক্তিবাদিতা যে সম্ভব নয়, তার প্রমাণ ফ্রান্সের প্রাক্তন উপনিবেশে মৌলবাদী-ঠেকানো সম্ভব হয়েছে ফরাসী জানা লোকের আধিক্যে, মৌলবাদ-ঠেকানো অসম্ভব হয়েছে প্রতীচ্য শিক্ষা-বিরল আফগানিস্থানে, মোসাদ্দেকের ইরানে খোমেনির কর্তৃত্বের দরুন।

ড. আহমদ শরীফ, মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সন্দেশ প্রকাশনী, প্রকাশকাল জুলাই ২০০৪, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৯।