আমার কোরানের ব্যখ্যা ও কিছু কথা লেখাটিকে কেউ কেউ ছদ্মবৈজ্ঞানিক লেখা বলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন; কিন্তু আমিতো কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা লিখিনি, এমন কি কোরান ও বিজ্ঞানের মধ্যে যোগাযোগ আছে সেটা বলারও চেষ্টা করিনি। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোরান ব্যখ্যাকারীদের সমালোচনা করা। আর সেটা করতে গিয়ে আমি এমন কিছু কোরানের আয়াত select করেছিলাম যেগুলো এই মুক্ত-মনাতে অন্য লেখাতে ব্যবহার করা হয়েছিল সৃস্টি রহস্য নিয়ে কোরানের গাঁজাখুরী ব্যাখ্যা বর্ণনা করতে। আর সেই লেখা কিছু পাঠক দ্বারা সমাদৃত হয়েছিল এই কোরানব্যখ্যাকারীদেরই অসীম জ্ঞান-ভান্ডার ও চিন্তা-চেতনার গুনে। Think & Reflect কথাটি সবার জন্য প্রযোজ্য। আরো একটা বিষয় নিয়ে অনেকেই আমার লেখার সমালোচনা করেছেনসেটা হচ্ছে শব্দের বিভিন্ন অর্থ। অনেকেই বলেছেন যে বর্তমান সংস্কারকরা শব্দের নতুন নতুন অর্থ বের করছে। কেউ কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে নতুন কোন অর্থ বের করেনি। আপনি পুরনো আরবী ডিকশনারী খুলে দেখুন, দেখবেন না ব্যবহার করা শব্দগুলো সেখানেই আছে। আরো একটা বিষয়ে খুব সমালোচনা করে গেছেন, সেটা হচ্ছে ‘context’ অনুযায়ী শব্দের অর্থের ব্যবহার। এ প্রসঙ্গে একটা আয়াতের ব্যাখ্যা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছি। যদিও ব্যাপারটা চর্বিত-চর্বন তারপরেও না উল্লেখ করে উপায় নেই। সূরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াত– যেটাতে স্ত্রী-প্রহারের অনুমতি আছে বলে অনেকেই নাক সিটকেছেন।দারাবা শব্দের অনেকগুলো অর্থ হয়, যেমন- প্রহার করা, আঘাত করা, ভ্রমণ করা, বের হয়ে যাওয়া, উপেক্ষা করা, ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন, ব্যখ্যাকারীরা কেন প্রহার করা অর্থটাই গ্রহণ করলো? বাকীঅর্থগুলো ব্যবহার করে দেখলোনা কেন? একটা শব্দের অনেকগুলো অর্থ থাকলে সবগুলোই on test এ ব্যবহার করে দেখা উচিত। আর test এ যদি প্রহার করা কথাটিই টিকে যায় তবে পরের লাইনে (আয়াত ৩৫) আছে, যদি স্বামী-স্ত্রীর আর একসাথে থাকার উপায় না থাকে তবে দুপক্ষের লোক ডেকে সালিশের চেষ্টা করতে হবে। এটা কেমন কথা, গায়ে হাত তুলে মার-পিটের পর সালিশে আর কি বিচার করবে সেই স্ত্রীর!!! স্বামীতো বিচার করেই ফেলেছে। এর পর সালিশিটা একটা তামাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে না? সেক্ষেত্রে ব্যাখ্যাকারীর শব্দটির অর্থ ব্যবহারের পূর্বে think & reflect ব্যাপারটি বোঝার কি দরকার ছিলনা? আমি মনে করি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দোষ সেই সব ব্যাখ্যাকারীদের। আর কোরানের ভেতর থেকেই কোরানের ব্যাখ্যা করা যায়। কোরানে যেখানে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পোশাক স্বরুপ বলা হয়েছে, সেখানে প্রহারের অধিকার দিলে এই কথাটার কোন মানে হয় না। তাই ৩৪ নম্বর আয়াতে প্রহার অর্থটি ব্যবহার না করে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে যাওয়া বা ত্যাগ করা কথাটি বেশি মানান সই। আর যারা মনে করেন স্ত্রীকে পেটানোর কথাই আছে তাদের কে বলব, সূরা রাদ-এর ১৭ আয়াতে বলা আছে এভাবেই আল্লাহ সত্য অসত্যরে দৃষ্টান্ত প্রদান করেন। এখানেও দারাবা শব্দটি আছে যা দৃষ্টান্ত প্রদান করা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আর যদি এটার পরিবর্তে প্রহার করা শব্দটি ব্যবহার হয় তবে অর্থ হবে এভাবেই আল্লাহ সত্য অসত্যরে প্রহার করেন। অর্থটি কি বোধগম্য হচ্ছে?

 

কোরান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরো একটা বিষয় খুব বিবেচনা করা হয়, আর তা হচ্ছে হাদীসের আলোকে কোরান ব্যাখ্যা। খুব silly লাগলেও বলছি, কোন অনুবাদক যদি শার্লক হোমসের একটি গল্প বাংলা অনুবাদ করতে চায় তবে কি সে সেই গল্পের বাইরের কোন বিষয় কি সেটাতে ঢুকিয়ে দেবে, নাকি ভাষাটা প্রাঞ্জল করার জন্য শব্দ-অর্থ নিয়ে খেলা করবে? আমার মতে শুধু ভাষা ও শব্দ নিয়েই গবেষনা করা উচিত। অথচ কোরানের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ(শুধু আমরা যারা বিশ্বাস করি, নাস্তিকগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়)বইয়ের ব্যাখ্যায় বা অনুবাদে সব সময়ই শুনি কোরানের বাইরে হাদীসের উপর নির্ভর করতে। কেন? মুহম্মদের মৃত্যূর প্রায় দুইশ বছর পর থেকে তাবারী, বুখারী আর অন্যান্য যারা হাদীস সংগ্রহ করছিল, তাদের এই মহৎ কাজের আগের দুইশ বছর মুসলমানরা কোরান ব্যাখ্যা করলো বা বুঝল কিভাবে? এর মাঝে কি কেউ মুহম্মদ সম্বন্ধে কিছু লিখে যান নি? সেগুলো গেলো কোথায়? খলীফা উসমানের সময়ে মুখে-মুখে বলার চেয়ে লিখিত বিষয়ে গুরুত্বপ্রদান করা হতো। এর বেশ প্রমান পত্র আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় উসমানের শাসনকালের ইসলামিক রাস্ট্রের নথি-পত্র কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারনটা কি? লিখিত বা প্রমান নেই এমন ঘটনাগুলো যা সত্য-অসত্যের মিশ্রণে বর্ণনাকৃত তা কোরান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এমন কি মুহম্মদের চরিত্র ব্যখ্যার ক্ষেত্রে reference হয়ে উঠে কি করে? মুহম্মদ তো একটি ঐতিহাসিক চরিত্র, কোন কাল্পনিক চরিত্র নয়। সেক্ষেত্রে referenceগুলোর credibility, accountabilityর ব্যাপারটা তো থেকেই যাচ্ছে। নাস্তিক বা যারা ইসলাম সম্বন্ধে নিন্দা করতে পছন্দ করেন এক পর্যায়ে এসে মুহম্মদের নারী প্রীতি নিয়ে আলোচনা করতে বেশ প্রীত বোধ করেন এবং এর সপক্ষে হাদীস বইগুলো থেকে উদাহরণ হিসেবে অনেক হাদীসই তুলে ধরেন এবং সেই হাদীসের support এ কিছু আয়াতও দেখিয়ে দেন যা মুহম্মদ সুবিধা অনুযায়ী (তাদের মতে) আল্লাহর নামে সৃষ্টি করেছিলেন। এখন আমি উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করব। চিন্তা করে দেখুন এগুলো আপনারা বিশ্বাস করেন কিনা?

 

The Messenger (S) used to visit all nine of his wives every night. [Vol 3 pg 52 Book of Nikah, #34].

কিন্তু অন্যদিকে বুখারী বারে বারে বিভিন্ন যায়গায় বর্ণনা করেছেন যে নবীজী সারারাত এত নামাজ পড়তেন যে তার পা ফুলে যেত। এই দুইটা কাজ কি একসাথে করা সম্ভব?

 

The Messenger (S) used to have intercourse with all of his wives in one hour of the day and night (without taking a bath) and these (wives) were eleven. The narrator tries to preempt an objection by stating that he had the (sexual) power of 30 men. [Vol 1 pg 189, Book of Bath #266].

এখানে বুখারী ১১জন স্ত্রীর কথা বলেছেন। তাহলে তার কোন তথ্যটা সঠিক? আর একজন মানুষের ৩০ জনের সমান power কথাটার মানে কি? এটা কিভাবে পরিক্ষীত হলো? পৃথিবীর আর কোন মানুষের এমন ক্ষমতার কথা শুনেছেন? এটা তো মাত্র ১৪০০ বছর আগের ঘটনা। এ রকম power কি সম্ভব? যদি হাঁ বলে স্বীকার করেন, তবে প্রমাণ চাইব। আর যদি না মনে করেন, তবে যে বইতে এই ধরনের প্রকৃতি বিরুদ্ধ তথ্য দেয়া হয় সেই বই মুহম্মদের চরিত্র বর্ণনার reference হিসেবে কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে!! বুখারী শরীফ থেকে তার নারীভোগের অন্যান্য হাদীসগুলো বিশ্বাস করলে তার ৩০ জন পুরুষের সমান ক্ষমতা হাদীসটাও বিশ্বাস করতে হবে। কারণ, দুটো তথ্যই বুখারীর দেয়া।

 

The sun rises between the two antlers of Satan. [Beginning of Creation 2:235 #504].

মুহম্মদ সম্বন্ধে বুখারীর কথা বিশ্বাস করলে তার দেয়া এ তথ্যটাও গ্রহণ করা উচিত।

 

Hoors (beauties of the heaven) will be full-breasted and free of menstruation. [Bukhari, Beginning of Creation 2:225 #473].

“Hoor” শব্দটি আরবীতে বহুবচন হিসেব ব্যবহিত যার অর্থ বুদ্ধিমান, যোগ্যসঙ্গী। আর “Ahwar” পুরুষ-বাচক এবং “Haoora” স্ত্রী-বাচক। কিন্তু শত শত বছর ধরে ইসলামের ইতিহাসবিদরা এবং ইমামগণ “Hoor” বলতে voluptuous নারীদের ছবিই এঁকে গেছেন। অতৃপ্ত মন যা চেয়েছে সেভাবেই সবকিছুর ব্যাখ্যা করে গেছে। কেউ তলিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। কোরান ব্যাখ্যাকারীদের অপব্যাখ্যার কারনে নাস্তিকরাও ভেবে যাচ্ছেন মুসলামান পুরুষরা এই ৭০/৭২জন হুরের আশায় দুনিয়ার ইসলাম পালন করে যাচ্ছে। বলছেন তারা ঠিকই। এক পক্ষ মিথ্যা আশায় বুক বেঁধে আছেন, আর অন্য পক্ষ মিথ্যে বিষয় নিয়ে মাতামাতি করে কোরানকে গাঁজাখুরীর ঝাঁপি বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। শুনেছি, অনেক নাস্তিকই নাকি কোরান-হাদীস সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান নিয়েই নাস্তিক হয়েছেন। নাস্তিকরা তো সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেনা। কোরান সংস্কারবাদীরা যদি হাদীসের credibility না থাকা প্রমান করতে পারে এবং এতদিনের ইসলাম যে মিথ্যের খোলসে আবৃত ছিল সেটা প্রমান করতে চায় তাতে নাস্তিকরা এত বিমুখ কেন?

Prophet Job was bathing. Locusts of gold started raining on him. [Vol 2 Kitabul Anbia, pg 281 #616] এটা ব্যাখ্যা করার কি আর প্রয়োজন আছে?

 

The earth is resting on the horns of a great bull. When he shakes his head he brings earthquakes. (Ibne Kathir 2:29, 50:1).

Then Ibne Kathir changes his mind:

The earth is resting on a fish. The fish is resting on water, water

on the Mount Safa in Makkah, Safa on an angel, the angel on a rock, the rock on air. When the fish moves, it causes earthquakes. (Imam Ibne Kathir, Tafseer part I pg 76).

তাহলে এ হাদীসটাও বিশ্বাস করতে হয়। আমাকে কি কেউ বলতে পারবেন এই হাদীসটা কোরানের কোন অংশের ব্যাখ্যা করে?

In the night of Me’raaj (Ascension), Imam Ghazali rebuked Prophet Moses. Prophet Muhammad said, “Respect him O Ghazali!” (Malfoozat Haji Imdadullah Mahajir Makki, Imdadul Mushtaq by Ashraf Ali Thanwi).

উল্লেখ্য যে গাজ্জালী মুহম্মদের মৃত্যূর ৫ শতক পরে জন্মেছিলেন। আর তিনিই কিনা নবী মুসাকে তিরস্কার করেছিলেন। বুঝুন তা হলে কার বই reference হিসেবে ব্যবহার করছেন!!

Allah sits in His chair, but the chair rests in His feet like sandals. (Tabari 1:21).

ব্যাপারটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারবেন কি?

শাহ ওয়ালিউল্লাহ Durr-e-thameen নাম দিয়ে ৪০টি হাদীস বানিয়েছিলেন।তিনি দাবী করেন যে মুহম্মদ প্রায়ই তার কাছে আসত এবং অনেক কিছু বলত ও করত. (Dr. Masood-ud-Din Usmani, Iman-e-Khalis pg 74) মনে রাখবেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ জন্মেছিলেন মুহম্মদের মৃত্যুর ১১ শতক পরে।

 

Reference হিসেবে মানুষতো সেই তথ্যই ব্যবহার করে যা সত্য ও প্রমাণ করা যায়, কোন উদ্ভট কিছু নয়। আর যে বই বা লেখায় এমন বানোয়াট এবং উদ্ভট কথা লেখা থাকে সেগুলো কি করে reference হয় একজন মানুষের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে তা আমার বোধগম্য নয়। তাই মুহম্মদ সম্বন্ধে সমালোচনায় অবশ্যই বিবেচনার প্রয়োজন। ইসলাম bashing এর নামে মিথ্যা বিষয় নিয়ে মাতামাতি করা, আর যারা সে সুযোগটা করে দিয়েছে তারা, দুদলই মানুষ ও সমাজের ক্ষতি ছাড়া ভাল কিছুই করেনি। অসত্য তথ্যের উপর গবেষনামুলক বই লিখলেই কি আর সত্য উদঘাটন হয়। বরং আরও সত্যের রাস্তায় pitfall তৈরী করা হয়।