আপনি কোন্টা পছন্দ করেন বেশি? স্বাধীনতা, না দাসত্ব?
ঠাট্টা করছিনা। সিরিয়াস প্রশ্ন। দাসত্ব শব্দটা একটু কানে লাগছে বুঝি? একটু কড়া, তাই না? ঠিক আছে, বলা যাক আজ্ঞাবহতা। আরো নরম শব্দ যদি চান তাহলে বলা যেতে পারে পারবশ্যতা। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার চেয়ে সোজা দাসত্ব বলাই ভাল। আমি চাই না চাই দাসত্বই আমার রক্তে, আমার মজ্জামাংসে। আমার ইতিহাস খুঁড়ে দেখা যাবে বলতে গেলে এর পুরোটাই দাসত্বের গ্লানিতে ভরা। আমার ঐতিহ্য দাসত্বের ঐতিহ্য।
‘আমার‘ বলতে ভাবছেন কেবল আমারই কথা বলছি আমি? তাহলে আয়নার সামনে দাঁড়ান একবার।
আপনি আমার দিকে শানিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হয়ত বলবেনঃ আপনার কি মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে? আপনি জানেন না দাসপ্রথা উঠে গেছে বহু আগে?
জবাবে আমি বলবঃ তাই নাকি? তাহলে আপনার বাড়িতে এই যে বাচ্চা ছেলেটি আমাদের জন্যে জলখাবার রেখে গেল টেবিলে, যাকে আপনি ‘চাকরবাকর‘ বলে আখ্যায়িত করেন, সে আসলে কি? ‘চাকর‘ শব্দটার উত্পত্তি কোথায় জানেন তো? শব্দকোষে দেখবেন এটা ফারসি শব্দ–পারস্য থেকে আমদানি। ওই অঞ্চলে আধুনিক যুগের ঊষাকালেও দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। ‘বাকর‘ শব্দটা অবশ্য বিদেশ থেকে আসেনি। ওটা আমাদেরই উর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভাবন। এতে চাকর বহুত্বলাভ করে, একটা শ্রেনীতে পরিণত হয়।
আমার প্রতি আপনার ক্রোধ ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। হয়ত বলবেনঃ দাস্যবৃত্তি আর পরিচারণবৃত্তি কি এক হল? দাস বলতে বোঝায় ক্রীতদাস, অর্থের বিনিময়ে ক্রীত সেবক যার কাজ দিবারাত্র তার প্রভুর সেবাতে নিয়োজিত থাকা। চাকর হল গৃহপরিচারক–স্বেচ্ছায় চাকরিতে ঢোকে, ভাল না লাগলে ছেড়েও দিতে পারে। সে দাস নয়, শ্রমজীবি। তর্কের খাতিরে আপনার যুক্তি মানতে পারি আমি, কিন্তু আপনার ‘শ্রমজীবি‘ পরিচারকটি পারবে কি? ওর কাছে কি দাসের জীবন আর শ্রমিকের জীবনে খুব একটা তফাত্ আছে? আপনার পরিচারক্ কি আপনার সঙ্গে টেবিলে বসে খায়? সোফায় বসে টেলিভিশন দেখে? একই শৌচাগারে মলমূত্র ত্যাগ করে? হ্যাঁ, আপনি তার স্বত্বাধিকারী নন তা মানি, কিন্তু তার আত্মসম্মান, উচ্চাকাংখা, তার মনুষ্যত্ব–সবই আপনার দখলে। আপনার ছেলেমেয়েদের মত স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠবার, বইখাতা নিয়ে রোজ স্কুলে যাবার স্বাধীনতা আপনি তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন অতি অল্পমূল্যে। ওর বাবামায়ের দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ওর স্বপ্নকে, জীবনকে জিম্মি করে রেখেছেন আপনার ও আপনার পরিবারপরিজনের আরাম ও পরিচর্যার জন্যে। আপনার কেনা দাস সে না হতে পারে, কিন্তু তাতে কি বেচারার কষ্ট কমে গেল?
আধুনিক যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী প্রতিটি মানুষের অন্তহীন সুখ আর বিলাসভোগের উপকরণ পৌঁছে দিয়েছে একেবারে হাতের কাছে–মুঠো মুঠো অর্থসহ তা হাত বাড়িয়ে সংগ্রহ করবার ব্যাপারমাত্র। খুব বেশিদিনের কথা নয় যখন বাংলাদেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে পানির কল ছিল না বলে বাইরে থেকে পানি আনতে হত চাকরের সাহায্যে, বিদ্যুত্ ছিল না বলে চাকরকে দিয়ে কেরোসিন্ আনিয়ে হারিকেন জ্বালাতে হত, গ্যাসের চুলা ছিল না বলে চাকর পাঠিয়ে কাঠ কেনা হত। আগে পরিবারের কাপড় কাচত চাকর, এখন করে মেশিন। বাসনপত্র ধোয়ামাজা করত চাকর, এখন করে ডিশওয়াসার। গোসলের পানি গরম করত চাকর, এখন বাথরুমের শাওয়ারে বোতাম টেপার সাথে সাথে গরম পানি অবিরাম ধারায় ঝরতে শুরু করে। এমনকি সাহেবের পা টেপার কাজটিও এখন চাকরকে করতে হয়না, সাহেব নিজেই জিমে গিয়ে শরীরচর্চা করে আসেন ইচ্ছে হলে। অর্থাত্ পশ্চিমজগতের যা কিছু সুখস্বাচ্ছন্দ্য তার চেয়ে কম সুখে নেই প্রাচ্যের নব্যধনী সাহেববিবিরা। তফাত্ এই যে পশ্চিমের মধ্যবিত্ত পরিবারে ‘চাকর‘ শব্দটা গত দুয়েক শতকের ভেতর কেও শোনেনি, কিন্তু আমাদের দেশের পশ্চিমায়িত সমাজে এখনও চাকরবাকর ছাড়া কারো জীবন চলে না। আজকের চাকরেরা হারিকেনে তেল ভরে না ঠিক, বা পানির কলস বয় না মাথায়, সাহেবের পায়ে,তেল মাখে না, কিন্তু সে এখনও চুলার ধারে জীবন কাটায় প্রত্যুষ থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত, অতিথির জন্যে নাস্তা আনে দিনে হাজারবার, বাচ্চাকে ঘুম পাড়ায়, বিবিসাহেবের পানের বাটি এগিয়ে দেয়, মোবিল বাজলে হাতে তুলে দেয়, ধূলা ঝাড়ে দিনে একশবার, মশারি টাঙ্গায়, মাছি তাড়ায়, লোডশেডিং হলে দুহাতে পাংখা চালিয়ে সাহেববিবির গা ও মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করে, পরিবারের কেও বাইরে গেলে জুতো এগিয়ে দেয়, গাড়ির দরজা খুলে দেয়, হ্যাণ্ডবাগ জাতীয় কিছু থাকলে গাড়িতে তুলে দেয়। যন্ত্র আর ভৃত্য দুয়ে মিলে আমাদের দেশের সনাতন ছোটসাহেব আর ছোটবিবিদের পরিণত করেছে সীমাহীন আরাম ও সুখোপভোগী বড়সাহেব ও বড়বিবিতে।
কিন্তু কেন? পশ্চিমের কাছ থেকে সুখবিলাসের সর্বপ্রকার উপচার সংগ্রহ করবার পরও আমরা পুরনো অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারছিনা কেন? পারছিনা এজন্যে যে আমরা নিজেরাই একপ্রকার ঐতিহাসিক দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছি যুগ যুগ ধরে। এত আন্দোলন, এত বিদ্রোহ বপ্লব আর এত যুদ্ধ ত্যাগ রক্তক্ষয় সত্বেও কিছুতেই যেন সেই সূক্ষ শৃংখল থেকে মুক্ত হতে পারছিনা আমরা। বরং অলক্ষ্যে অজ্ঞাতে যেন আরো জড়িয়ে পড়ছি এক অপ্রতিরোধ্য বশ্যতার মোহবন্ধনে। এ পারবশ্যতা দৈহিক নয়, স্নায়বিক নয়, সজ্ঞানও নয়, এ বশ্যতা আত্নিক, সাংস্কৃতিক। এ বশ্যতা বুদ্ধি ও চিন্তার, চিত্ত ও দৃষ্টির। এ দাসত্ব শুধু অভ্যাসের নয়, এ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দাসত্ব আমাদের পরিচিতির সন্ধানে, আমাদের জাতিসত্তা অন্বেষণের প্রকৃতিতে।
আমরা যারা বাঙ্গালি মুসলমান, বিশেষ করে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের মুসলমান, আমরা পরিচয় খুঁজি কোথায়? আমরা কারা এই প্রশ্নটির পূর্ণ মীমাংসা এখনো হয়নি। পরিচয়ের সন্ধানে যষ্ঠিহারা অন্ধের মত আমরা ইতিহাসের অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি অনন্তকাল। একদিকে আমরা বাংলায় কথা বলি, বাংলার মাটি, সমাজ ও সবুজ শ্যামলিমা নিয়ে গান করি কাব্য করি, অন্যদিকে ঈদের চাঁদ দেখার জন্যে প্রায়শঃই আরবদেশের শরণাপন্ন হই। আমাদের মধ্যে কেও তার পরিচয় খোঁযে বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে, কেও খোঁজে আরবের বেদুইন জাতির মধ্যে। পরিবারের নবজাতকের নাম খুঁজতে কেও জায় বাংলা শব্দকোষের পাতায়, কেও পবিত্র কোরাণের দুরূহ আরবিতে। এক আশ্চর্যরকম বিভ্রান্ত জাতি আমরা। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এতগুলো মানুষ প্রাণ দিল অকাতরে, এতগুলো নারী হারালো তাদের সম্ভ্রম, তারপর চারবছর যেতে না যেতেই সংবিধানের ভাষাতে প্রবেশ করল বিসমিল্লাহ, এবং তার অনতিকাল পরে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হল। আমরা জানিনা আমরা বাঙ্গালি, না, মুসলমান, না, বাঙ্গালি মুসলমান, না, মুসলমান বাঙ্গালি, নাকি বাংলাদেশী মুসলমান। শুধু জানি যে দেশটাকে এখন আর ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার বলার কোনও উপায় নেই। ফলে একে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলার চেষ্টাও হাস্যকর, কারণ আমার মতে যে রাষ্ট্র সেকুলার নয় সে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র একটি ভোটসর্বস্ব প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে একদিন সেকুলার হয়ে উঠবে, সে আশাও মূর্খের দিবাস্বপ্নই মনে হয় আমার কাছে। ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে ভাবতে যে মানসিকতার প্রয়োজন হয় তা আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে আছে বলে আমি বিশ্বাস করিনা। পঁচাত্তর বছর আগে কামাল আতাতুর্ক জোর করে যা আরোপ করার চেষ্টা করেছিলেন জাতির ওপর, বর্তমান যুগের ধর্মোন্মাদনাতে তার মৌলিক দুর্বলতা আত্নপ্রকাশ করতে শুরু করেছে।
এসবের মূল কারণ, আমার মতে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম একপ্রকার দাসপ্রথা। তবে গতানুগতিক দাসত্ব এটা নয়–অর্থাত্ জলজ্যান্ত মানুষকে দড়িবাঁধা অবস্থায় বাজারের পণ্যদ্রব্যের মত ক্রয়বক্রয়ের বালাই নেই এতে। এ-দাসত্বের পণ্য কোনও সুস্থসবল যুবকের পেশীজাত কর্মক্ষমতা নয়, নয় কোনও শিশুর আজীবন বশ্যতা, নয় কোনও কিশোরী-যুবতীকে যদৃচ্ছ ব্যবহারের অবাধ অধিকার। ধর্মীয় দাসত্ব তার চেয়েও ভয়ংকর–এর লক্ষ মানুষের শরীর নয়, মন। মনকে, বুদ্ধিকে, স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতাকে সারাজীবনের জন্যে পঙ্গু করে দেওয়া হয় এই দাসত্বে। ভিক্ষাবৃত্তির পিশাচ বণিকরা যেমন অপহৃত শিশুকে আংটাতে বেঁধে বিকলাঙ্গ করে ফেলে চিরদিনের জন্যে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের লক্ষ্ হল মানুষের মুক্তচিন্তার ক্ষমতাকে শিশুকাল থেকেই অক্ষম করে ফেলা। মাতৃভাষার বর্ণমালা শিখবার সাথে সাত্থে তাকে শিখতে হয় নিজ নিজ ধর্মের মৌলিক সূত্রাবলী, এবং সেই সূত্রাবলীকে তার গ্রহণ করতে হয় ধ্রুব সত্য হিসেবে। কোনও দ্বিমতের অবকাশ নেই তাতে, কোনও প্রশ্ন করা যাবে না, কোনো তর্ক করা যাবে না। শুধু ভক্তিগদগদ চিত্তে উচ্চারণ করতে হবে, মন্ত্রপাঠের মত গাম্ভীর্যসহকারে—হে প্রভু, তুমি সর্বশক্তিমান, আমাকে ধন্য কর তুমি তোমার তুচ্ছ গোলামের সম্মান দিয়ে। এই আমরণ গোলামির শপথ তাকে নিতে হয় যখন ‘গোলাম‘, ‘প্রভু‘–এ শব্দগুলোর অর্থ বোঝারও বয়স হয়নি তার। এই মহান গোলামির শেকল যারা সারাজীবনের জন্যে বেঁধে দেন আমাদের পায়ে তাঁরা কোনও ঘৃণ্য নরপিশাচ নয়, তাঁরা আমাদেরই স্নেহান্ধ পিতামাতা, পিতামহ মাতামহ, তাঁরা নিজেদের জীবন দিতে প্রস্তুত আমাদের প্রাণরক্ষার জন্যে। অথচ তাঁরাই সানন্দে, সাগ্রহে বিগলিত বিনয়ের সাথে তাঁদের সন্তানদের সমর্পণ করে দেন সেই মহাপ্রভুর সেবাতে। একবারো সামান্যতম প্রশ্ন জাগে না তাঁদের মনে যে এই ‘মহাপ্রভু‘টি যে সত্যি সত্যি আছেন কোথাও তার কোন সরাসরি প্রমাণ নেই, তিনি যে একটি মনুষ্যসৃষ্ট কাল্পনিক মূর্তিও হতে পারেন সে সম্ভাবনাটুকু তাঁরা ভুলক্রমেও প্রশ্রয় দেননা মনে। প্রশ্রয় দেননা কারণ তাঁরাও ঠিক একইভাবে প্রভুপাদমূলে সমর্পিত হয়েছিলেন তাঁদের শৈশবে। ধর্মের বণিকেরা মনস্তত্ব প্রয়োগে দারুন পারাদর্শী আদিকাল থেকেই। তারা জানে, সব ধর্মেই মূলত একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যে পালের গারুর গায়ে যেমন মালিকানার ছাপ বসাতে হয় বাছুর থাকাকালে, তেমনি মানুষের আনুগত্য নিশ্চিতায়নের জন্যে তার মনের ওপর চিরস্থায়ী ছাপ মারার প্রকৃষ্ট সময় হল শৈশব। ছোটবেলায় মুখস্থ করা নামতা আর ছড়া যেমন কখনো ভোলেনা মানুষ, ছোটবেলার ধর্মশিক্ষাও তেমনি গেঁথে থাকে চিরকাল। এ শিক্ষা এমনই দাগ কেটে রাখে যে পরবর্তীকালে হাজার লেখাপড়া করেও তার রাহুগ্রাস থেকে সাধারণত মুক্ত হতে পারেনা মানুষ। পারেনা বলেই অনেক উচ্চিশিক্ষিত ধর্মযাজক, এমনকি অনেক বিজ্ঞানীও, বৈজ্ঞানিক তথ্যের চেয়ে বরং ধর্মগ্রন্থকেই প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনতত্বের প্রতি ধর্ম ও ধার্মিক বিজ্ঞানীদের বিরূপ মনোভাব তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। মধ্যযুগের খ্রীষ্টান পাদ্রীরা বাইবেলের এক জায়গায় ইঙ্গিত পেলেন যে পৃথিবী একটি স্থির গ্রহ এবং সূর্যসমেত বিস্বব্রম্মাণ্ডের অন্য সকল গ্রহনক্ষত্র তার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে। এই বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীতটাই যে প্রকৃত সত্য তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রমাণ করেছিলেন কপার্নিকাস। সেকালের প্রচণ্ড ক্ষমতাবান ও স্বৈরাচারী চার্চের দীর্ঘ হস্ত কপার্নিকাসকে স্পর্শ করতে সক্ষম না হলেও তাঁর তত্বকে যারা সোত্সাহে গ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেককেই কোনও ছাড় দেয়নি। অবিশ্বাসীদের ধরে ধরে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করার বীভত্স কাহিনী ইউরোপীয়ান মধ্যযুগীয় ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সেযুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলিকে পুড়িয়ে না মারলেও কারাবন্দী করা হয়েছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। অন্ধ, অসহায় অবস্থায়, ভগ্নহৃদয়ে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন কারাগারের অন্ধকারে।
দাসপ্রথার মত মানবতাবর্জিত বর্বর প্রথা—তারও পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বাইবেলের উভয় সংস্করণে–পুরাতন এবং নূতন টেস্টামেন্ট। ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট ধর্মযাজকের ভাষ্য অনুযায়ীঃ
নিগ্রো দাসপ্রথা আন্দোলনের পূর্ণ পরাজয়ের ওপরই নির্ভর করছে সভ্যতার ভবিষ্যত।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের ভিত্তিই ছিল বাইবেলের অনুশাসনঃ দুই বর্ণের একত্রনিবাস সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এমনকি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলে দাবিকৃত পবিত্র কোরাণশরিফেও ‘দাসসপ্রথা উঠে যাক‘ এই মর্মে কোনো স্পষ্ট বিধান নেই, যদিও দাসত্বের চেয়ে হাজারগুণে কম ক্ষতিকর ও কম লজ্জাজনক, যথা শূকরমাংস ও মাদকদ্রব্য, সেগুলোর বিরুদ্ধে অত্যন্ত স্পষ্ট ও কঠোর ভাষায় সাবধানবানী ঘোষণা করা হয়েছে একাধিক জায়গায়।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিবর্তনতত্ব থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিক তত্ব, ডি এন এ, চিকিত্সাশাস্ত্রের অত্যাশ্চর্য অগ্রগতি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রজননপ্রযুক্তি, সবকিছু মিলে আধুনিক মানুষের চিন্তাধারা ও মনোভঙ্গিতে এনেছে আমূল পরিবর্তন। মানুষ যুক্তিবিহীন অন্ধ বিশ্বাসকে বর্জন করে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদকে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। দেড় থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেকার ধর্মগ্রন্থসসমূহের ভিত্তিমূল ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুঃখের বিষয় যে দুর্বল হলেও যুক্তির কাছে বিশ্বাস সহজে নতিস্বীকার করবে সে আশা বৃথা। বিজ্ঞানচর্চার নিষ্ঠাবান সাধকদের মধ্যেই এমন অনেক ধর্মভীরু ব্যক্তি আছেন যাঁরা কিছুতেই মানতে রাজি নন যে ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞান ও যুক্তির কোনরকম বিরোধ আছে। বরং নানারকম মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে সুস্পষ্ট বিরোধকে সুমসৃণ সমন্বয়ে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। কেও কেও এমনো ধারণা পোষণ করেন যে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার বলে যা কিছু দাবি করা হয় তার কোনটাই আসলে নতুন নয়, সবই তাঁদের ধর্মগ্রন্থের সাঙ্কেতিক ভাষাতে কোন-না-কোনভাবে উল্লেখিত হয়েছে যা আগে কারো বোধগম্য হয়নি। অর্থাত্ সব জ্ঞানের একই উত্স, নতুন জ্ঞান বলতে কিছু নেই। এই বিশ্বাসটি এমনই শক্তভাবে গেঁথে দেওয়া হয় তাঁদের মনে, সেই শিশুকাল থেকে, যে তাঁদের নিজেদের গবেষণাজাত জ্ঞানকেও তাঁরা নতুন জ্ঞান বলে গণ্য করেন না। একে আজন্ম বশ্যতা ছঁড়া আর কি বলবেন আপনি?
কোনও বৃহত্তর শক্তির অধীনস্থ হবার আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত প্রকৃতি, না সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রবৃত্তি, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করবার মত জ্ঞান আমার নেই। অনুমান করি যে এটা আমাদের সকলেরই মৌলিক ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে জড়িত। হয়ত এটাকেই ইংরেজীতে বলা হয় বিলংগিং। আইডেন্টিটিও বলা যেতে পারে, যদিও দুটো ঠিক এক জিনিস নয়। বিলঙ্গিগের আকাংখাটি আমি খানিক বুঝি, কিন্তু আইডেন্টিটি বিষয়টি তত সহজ নয়। আমার জন্ম বাংলাদেশের পল্লীগ্রামে, তাই গ্রাম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরত্বে বসবাস স্থাপন করার পরও নিজেকে গ্রামের ছেলে বলে ভাবতে লজ্জা তো নেইই, বরং গর্ববোধ করি। গ্রামের কাকামামাদের মত কোনদিন হালচাষ না করেও নিজেকে চাষী বলে দাবি করতে আমি আনন্দ পাই। কিন্তু সেটা আমার রক্তের পরিচয়, আমার উত্সের ঠিকানা, সেখানেই আমি বিলং করি। আমার বুদ্ধির জগত, চিন্তা ও চেতনার জগত স্বতন্ত্র। সেখানে আমার পরিচয়কে কারো কাছ থেকে ধার করতে চাইনা, তাকে আমি নিজের বুদ্ধি দিয়ে, কর্ম দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। জানি, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই আইডেন্টিটি বলতে বোঝে তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পরিচয়কে। ওটাই সহজ ও নিরাপদ। কিন্তু সেই পরিচয়কে আমি নিজের পরিচয় বলে গণ্য করি না–সেটা আমার অর্জিত পরিচয় নয়। যা আমি অর্জন করিনি তার স্বত্ব আমি কেমন করে নিজের বলে দাবি করব? তাই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পরিচয়কে আমি অধীনতার পরিচয় বলে মনে করি। সে-পরিচয় আমার কাম্য নয়।
স্ট্যাটেন আইল্যাণ্ড,নিউ ইয়র্ক,
৮ সেপ্টেম্বর, ‘০৯
মুক্তিসন ৩৮
এক আশ্চর্যরকম বিভ্রান্ত জাতি আমরা।
>> This is the biggest tragedy for citizen of Bangladesh. They need to boost Bengali identity over Islam-because nationalism is not part of Islam.
এই উইকেন্ডে একজন পরিচিত জনের বাসায় গিয়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানা পত্রিকাতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ভেতরের একটা পাতায় দেখলাম গত ১৫ই সেপ্টেম্বর ঘটা করে নিউইয়র্কে অধ্যাপক মীজান রহমানের ৭৭ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হল।
আমরাও মুক্তমনার পক্ষ থেকে লেখককে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। :cake:
ড মীজান দীর্ঘজীবী হোন এবং আমাদের আলো ছড়িয়ে যান আজীবন। :rose:
@অভিজিৎ,
প্রিয় অভিজিত,
জ়ন্মদিন নিয়ে বাড়াবাড়ি কেবল দু’টি বয়সেই মানায়—একেবারে প্রথমটি, যখন বাচ্চার বয়স হয়না কিছুই বোঝার, এবং একশততমটি, যখন বয়স পার হয়ে যায় কিছু বোঝার। মাঝেরগুলো একান্তই বাতুলতা। তবুও, ধন্যবাদ শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে। তোমরা ভালো থেকো। মীজানভাই।
খুবি ভাল লাগলো অনেকদিন পরে মীজান রহমানের লেখাটি পড়ে। আমি এই চিন্তা জাগানিয়া লেখাটির অবাধ সত্যতা আমাদের সমাজে দেখি। কিন্তু একটা জায়গায় আমার ঘোড়তর আপত্তি আছে, সেটা হলো মিজান রহমানের এই বিশ্লেষন মূলক যুক্তির উৎস, যেখানে তিনি কোরানের একটি আয়াত থেকে দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন যে আমাদের মনোজাগতিক দেশে ক্রিয়াশীল দাসত্বের যে আবহ, তার উৎস হচ্ছে কোরানের আয়াত কিংবা বাইবেলীয় উক্তি; তিনি লিখেছেন,
সেই সাথে অভিজিৎ রায় তাঁর একটি লেখায় তুলে ধরেছেন যে হিন্দু ধর্মও অতি হিংস্রভাবে দাস প্রথাকে সমর্থন করে। এতোটুকুও দ্বিমত নেই আমার। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সৃষ্টিইতো হলে সেই দিন। আমার হাতের কাছে কোন তথ্য বা রেফারেন্স এই মূহূর্তে নেই, তবে এই ইতিহাস সাকুল্যে পাঁচ হাজার বছরের বেশী পুরাতন নয়। কিন্তু ইতিহাসবিদদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে দাস প্রথার ইতিহাস আরোও পুরোনো। তাহলে কি ঢালাও ভাবে দাস প্রথা তথা দাসত্ব সুলভ মানসিকতার জন্যে প্রচলিত ধর্ম গুলোকে দায়ী করা সমীচিন? আমার কাছে ধর্ম নিছকই কাল, স্থান আর সমাজ ভেদে প্রতিষ্ঠিত দর্শন। কখনো কখনো এসব দর্শনের পেছনে সমসাময়িক দার্শনিকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবছিলো, কখনো তা সমাজের সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর বা তার কোন আপাতঃ শক্তিশালী অপভগ্নাংশের। যেমনটি ঘটেছে হিন্দু ধর্মের বেলায়।
মানব ইতিহাসের পর্যায়ক্রমিক অগ্রযাত্রায় ধর্মনামের দর্শন গুলো কোন কোন এলাকায়, কোন বিশেষ সামাজিক সন্ধিক্ষনে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর তৎপরতায় বিকশিত হয়েছে। কালক্রমে তার অনেক হাড়িয়েও গিয়েছে। যেমন করে হাড়িয়ে গিয়েছে অনেক জাতি, গোষ্ঠী, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি। এরাও হাড়িয়ে যাবে কালক্রমে! যে যুগে ধর্মগুলোর উৎপত্তি, সে যুগে সমাজে স্বাভাবিক দাস প্রথা বিদ্যমান ছিলো। আর তৎকালীন দার্শনিকেরা ঐ সমাজেরই অংশ। সমাজের নিগড়ে প্রথিত যে শেকড়, সেখান থেকে তো তাঁদের আত্মা পুরো মুক্ত থাকার কথা নয়, আর তার প্রকাশ তো থাকার কথা আরোও শৃংখলিত। কাজেই বিভিন্ন ধর্মে যে দাসত্বের প্রতি অনুরক্ততা তা একটি স্বাভাবিক অনুযোজনা। আজ সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে, বিজ্ঞান এগিয়েছে, তথ্য এবং তার সরবরাহ অবাধ হয়েছে, যুক্তি-বুদ্ধিবৃত্তিকতার বিকাশ ঘটেছে, তাই আমরা কেউ কেউ স্রোতে ভেসে না গিয়ে যুক্তি বুদ্ধি নির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছি মাত্র। অথচ সমাজের সবচেয়ে বড় অংশটিই আজও রক্ষনশীল ভুমিকায় পশ্চাদপদতার পঙ্কিলে হাবুডুবু খাচ্ছে। রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে আপনাকে-আমাকে কারন, আমরা হয়তো বিদ্যমান স্রোতের প্রতিকূলেই সাঁতরে চলেছি, ওরা সংখ্যাগড়িষ্ঠ আর আমরা লঘিষ্ঠতম! এছাড়াও আরো একটি ব্যপার এখানে ক্রিয়াশীল, সেটি হলো আপনি আজ আপনার আত্মা এবং তার প্রকাশে হয়তো শতভাগ খাঁটি। কারন, আপনার রয়েছে অবাধ তথ্য এবং যুক্তি, স্বসমাজে আত্মপরিচয়ের প্রকাশে আছে মানসিক এবং দৈহিক নিরাপত্তা, আর আছে বিশ্বভূমন্ডলের সর্বত্র অবাধ যাতায়াতের অধিকতর সুবিধা। সেকালে এর কোনটিই ছিলোনা। আবার আজ আপনার যুক্তি যেমন বিনা প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠিত হবার যো নেই সেইকালে এজায়গাটি ছিলো অনেক অনেক দুর্বল। সুতরাং সমাজের অপেক্ষাকৃত মেধাবী অংশের দ্বারা প্রচারিত তত্ত্ব সমাজে গৃহীত হয়েছে অবাধে।
আমেরিকাতে দাস প্রথার দীর্ঘ করুন ইতিহাস আছে। সেকি বৃটিশ পাদ্রীদের দ্বারা সংযোজিত হয়েছিলো? কখ্খনোনা। বৃটিশ উপনিবেশিকতার ফল। নেহাতই রাজনৈতিক। তবে হ্যাঁ, ধর্ম সবসময়ই অপরাজনীতিকে উৎসাহিত করেছে। কারন সামাজিক বিবর্তনে সমাজের ক্ষমতাধর অংশ দেখেছে যে ধর্মকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর উপরে চাপিয়ে দিয়ে ওদের চমৎকার নিংড়ানো যায়! আর একাজে দরকার সমাজের আর একটি অংশের সক্রিয় সহায়তা। সেটা হলো কালক্রমে গড়ে উঠা সুবিধাভোগী, কপট, ধূর্ত এবং হিংস্র সেই ধর্ম ব্যবসায়ী শ্রেণী। কাজেই সমাজের ক্ষমতাধর অংশটি এবং এই ধূর্ত ধর্ম ব্যাবসায়ীরাই যুগ যুগ ধরে সমাজের, রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিকে ভাগাভাগি করে ভোগ করে আসছে। দুয়ে দুয়ে হলো চার!
আর এই ধর্ম ব্যাবসায়ী শ্রেণীটিও আসলে গড়ে উঠেছে সমাজের ক্ষমতাধরদের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে। সেই আবহমান কালের চিরাচরিত নিয়মেই। আজো তা অব্যাহত আছে অতি নির্লজ্জ ভাবে। বেশীদূর যেতে হবে না, এই এক বছর আগেই আমাদের দেশের রাজনৈতিক পটভুমির দিকে চোখ ফেরালেই পাওয়া যাবে তাকে, মহীমাদের যন্ত্রনা দগ্ধ শেষ মুহূর্তগুলো আজও ভারী করে রেখেছে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস।
জীববৈচিত্রের বিবর্তনের মতো ঘটে চলেছে সামাজিক বিবর্তনও। মানুষের মনের গহীনে চিরকালীন যে ঔৎসুক্যবোধ, যে অনুসন্ধিৎসা সহসা এক সময় তাকে ধামা চাপা দেয়া হয়েছিলো। আজ আবার সেই ধামার তলা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসে আলোর দিকে তাকাতে চাইছে। অতীতে কালে ভদ্রে যাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন, আজ তাঁরাই আমাদের পথিকৃৎ। সামাজিক আন্দোলনের এই যে সন্ধিক্ষন এর একটা গভীর তাৎপর্য আছে। সেই আলোকেই মীজান রহমানের বর্তমান প্রবন্ধটি সচেতন মহলে আলোড়ন তুলবে। প্রচলিত ধর্ম গুলো অপেক্ষাকৃত আধুনিক দর্শন, তাই এদের আয়ুষ্কালও হবে নেহাৎই খানিক দীর্ঘ! কালের পরিক্রমনে আজই এই সব দর্শনের অধিকাংশই হয় বিবর্তিত হয়েছে নতুবা হয়েছে পরিত্যাক্ত। হিন্দু ধর্মেরএর দিকেই তাকিয়ে দেখুন, ক’জন হিন্দুধর্মাবলম্বী এই ধর্মের নিয়মিত চর্চা করেন? সমাজের বৃহত্তর অংশটিই যা করে তা হলো এর আনুষ্ঠানিকতা, সম্ভবতঃ ৭০ ভাগই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে পালিত। বাকীটুকু সাময়িক ভক্তি গদ গদতায় নিমজ্জিত।
আসলে দরকার, সমাজে আধুনিক চিন্তা ধ্যান ধারনার বহুমাত্রিক বিকাশ সেই সাথে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। মানুষ, বিশেষ করে আমরা যে আসলে মনোজাগতিক পরিমন্ডলেই দাসত্বের নিগড়ে বন্দী এবং তা যুগ যুগের ধর্মীয় অনুশাসনের নির্যাস, বিতর্কের অবকাশ খানিকটা যেনো থেকেই যায়। এইযে দেখুন আজকাল গৃহিনীরা তারৎস্বরে চিৎকার করছেন এই বলে যে ঘরে কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছেনা। এর মূল বিষয়টি দুটি মাত্র ফ্যাকটরের উপরে নির্ভরশীল। একটি হলো, সামাজিক যোগাযোগ তথা অবাধ তথ্যের ব্যাপকতা এবং সামাজিক অর্থনৈতিক বন্টন। আর যারা চিৎকার করছেন এটি তাদের মানসিক দৈন্যতা যুগ যুগের অভ্যাসের ফল। যাঁরা উন্নত বিশ্বে বসবাসরত, আশ্পাশে তাকিয়ে দেখুন, দেখা যায়কি ধর্মকে আশ্রয়করে দাসপ্রথার চর্চা? যায়না কারন, সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার সাথে সাথে ধর্মীয় দর্শনের বিধি বিধানে পরিবর্তন এসেছে, এসেছে বিবর্তন। সমাজের ক্ষয়িষ্ণু অংশটি চিরকালই রক্ষনশীল হয়ে থাকে। আমাদের সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি হয়তে তাই।
সমাজের অগ্রসর অংশটি অতি সন্তর্পনে সরে এসেছে ওজায়গা থেকে। ধর্মকে দিয়ে মানুষ নিংড়ানো আগামীতে আর সম্ভব হবে না, কারন তাঁর (ঈশ্বরের) অস্তিত্ত্বের সংকট দেখা দেবে অচীরেই! উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক পরিমন্ডল এর উদাহরণ। তৎপরিবর্তে যেটা ঘটতে চলেছে তা হলো কূটচালে বিশ্বের তাবৎ সম্পদের উপরে অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। অতীতে ব্যক্তিকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে অতি পৈশাচিকতায়, আগামীতে হয়তো গোটা জাতি এক বা একাধিক জাতির দ্বারা নির্যাতিত হবে! তবে আশার কথা হলো এই যে পুরো ব্যপারটি নির্ভর করছে কোন সংকটটি আসলে মানব জাতির ভাগ্যাকাশে স্থায়ী সংকটে রূপ নিতে যাচ্ছে তার উপরে।
অনেকদিন পর মীজান সাহেবের লেখা দেখে ভাল লাগল। তার সহজ সরল ভাষায় বড় রেফারেন্স লিষ্ট ছাড়া লেখাগুলি বোঝা খুব সহজ।
পশ্চীমের দেশে এসে আমি নিজে যে জিনিস দেখে সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং এখনো হই তা হল এদের তূলনামুলকভাবে উন্নত শ্রেনীবিহীন সমান ব্যাবস্থা। যা আমাদের অঞ্চলে অত্যন্ত নির্লজ্জ ও প্রকট। পশ্চীমে এরা কিভাবে যেন বহু আগেই শ্রেনী বৈষম্য অনেক আগেই অনেক কমিয়ে আনতে পেরেছে আমরা যা এখনো পারিনি, বরং বলা যায় কিভাবে জিইয়ে রাখা যায় সে চেষ্টাই আরো করি।
যে সমাজে মানুষে মানুষে অত শ্রেনীভাগ থাকে সে সমাজে হয়ত প্রাচূর্য আসতে পারে, তবে স্বস্থি আসতে পারে না।
তবে এর জন্য ধর্ম কতটা দায়ী তা আমি নিশ্চিত নই। ইসলাম ধর্মে দাস প্রথা বিলুপ্ত করা না হলেও শ্রেনীবিভাগের কোন কনসেপ্ট মনে হয় না আছে বলে। দাসের প্রতি যা তা ব্যাবহারের বিরুদ্ধেও মনে হয় বিধান আছে।
@আদিল মাহমুদ,
এ কি বলছেন?ইসলাম যে সমগ্র মানব জাতিকে মুসলিম আর অমুসলিম -এই দুটো ভাগে ভাগ করল এটা দেখছেন না।স্পষ্টতই ইসলাম হল এক ধরনের ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং অমুসলিমরা সবাই তাদের কাছে অন্ত্যজ! 🙂
@আগন্তুক,
মূল অভিযোগ মানি, ইসলামে আসলেই সমগ্র মানব জাতিকে মুসলিম-ননমুসলিম ভাগে ভাগ করেছে, এতে কোন লুকোচুরি নেই।
তবে দাসত্ব ইস্যুতে তো মুসলিম নন মুসলিম কোন ইস্যু নেই। ইসলাম তো অন্য কোন ধর্মের মত কোন নির্দিষ্ট গোত্রকে দাস বা আর কেউকে সমাজের উচ্চবর্নের মর্যাদা জন্মসূত্রে দেয়নি।
ইসলামিক দেশগুলিতে কি চাকর বাকর শুধু নন-মুসলিমরাই হয়? কোনদিন ই না। যারা জন্মসুত্রে গরীব সে মুসলিম/হিন্দু যি হোক সে বেচারাদের কপালেই ওসব কাজ জোটে।
@আদিল মাহমুদ,
That means Islam approves slavery, but instructed to behave appropriately (that might not be ‘equal right’) with the slaves.
অনেকদিন পর মুক্তমনায় মীজান ভাইয়ের লেখা দেখে ভাল লাগলো। তার চিন্তা জাগানিয়া লেখার সব সময়ই বড় ভক্ত আমি। এ লেখটিও ব্যতিক্রম নয়। সত্যি তো বাংলাদেহের গৃহ পরিচারিকারা দাস দাসী ছাড়া আর কি। যারা আমরা মানবতার কথা বলি, সাম্যের কথা বলি তারদের বাসাতেই কি পরিচারক্ গৃহকর্তার একসাথে সঙ্গে টেবিলে বসে খায়? সোফায় বসে টেলিভিশন দেখে? না দেখে না, দেখতে পারে না। সমাজ রি রি করে উঠবে, আসলেই! (পশ্চিমে থাকার ফলে এই অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হওয়া গেছে, যে যাই বলুক)
আরেকটা ব্যাপার বলি। অনেকেই হয়ত ভাবেন শুধু ইসলাম আর খ্রীস্টান ধর্মেই কেবল দাসত্বের কথা আছে। হিন্দু ধর্ম বোধ হয় এগুলো থেকে মুক্ত। একবার হাসান মাহমুদ (ফতেমোল্লার) একটি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আমি হিন্দুধর্মের মধ্যকার দাসত্বের কিছু উল্লেখ করেছিলাম । লেখাটা আছে এখানে।