প্রথমাংশ

মোটাদাগে মোটাভাগে

‘রাত্রিশেষ’-এর প্রায় সব কবিতাই ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ সময় পরিসরে রচিত।১২ সুতরাং উপরোল্লিখিত ঘটনাপরম্পরা এ কবিকে ছুঁয়ে গেছে এরকম মনে করাই সঙ্গত। অর্থাৎ কিনা আমরা ধরে নিতে চাই এ কবিও সময় ও সমাজ কর্তৃক তাড়িত হয়েছেন। এখানে আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, চল্লিশ দশকে সমাজ-সচেতনতার নিরিখে কবিতা-বিচার করার প্রবণতাটি প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু এ দশকে কবিতা লিখছেন এমন কবিদের মধ্যে নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকার, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখকে ছাড়া সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, দিনেশ দাশ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, রাম বসু, সিকানদার আবু জাফর, আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ (পরবর্তীসময়ে কাব্য দর্শনের ব্যাপক রদ), আহসান হাবীব, জগন্নাথ চক্রবর্তী, সানাউল হক, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরীন্দ্র মৈত্র, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, রামেন্দ্র দেশমুখ্য, মৃগাঙ্ক রায়, সিদ্ধেশ্বর সেন, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় (পরবর্তীসময়ে সমালোচক হিসেবে খ্যাত), সৈয়দ নূরুদ্দীন, গোলাম কুদ্দুস, অসীম রায় (পরবর্তীসময়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত) প্রমুখ কবিগণ তাঁদের কবিতায় সমাজভাবনার রূপায়ণে আত্মনিবিষ্ট ছিলেন।১৩ ফলে কাব্যবিচারের এই প্রবণতাও সিদ্ধ ও যৌক্তিক পরিগণ্য হতে পারে। একজন কবি সমালোচিত হবার জন্যে লেখেন না বটে, কিন্তু সম-সময়ের প্রথাকে পুরোপুরি উপেক্ষাও তিনি করতে পারেন না বললে মোটেই অসত্য বলা হয় না বোধকরি। আহসান হাবীবের সমাজভাবনার উৎস সন্ধানে নিম্নোদ্ধৃত মন্তব্যত্রয়ের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। সৈয়দ আলী আহসানের মতে, ‘সে সময়কার [৪০ দশকের] অসহায় মানুষকে নিয়ে লেখা [আহসান হাবীবের] কোনোও কোনোও কবিতায় মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সামান্য আভাস পাওয়া যায় কিন্তু উক্ত দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন কাব্যপ্রথার সমর্থনে এসেছে, প্রবল কোনোও বিশ্বাসের অন্তঃসার হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।’১৪ তুষার দাশ নিশ্চিত জানান দেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনে বাঁচার সংগ্রামও যে তাঁকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো সমাজ-সময়-সভ্যতা সম্পর্কে সচেতন হ’তে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।’১৪ সাজ্জাদ শরিফ সিদ্ধান্ত দেন, ‘তাঁর সমাজ-চৈতন্য রাজনীতির পথ ধরে আসেনি কবিতায়, এসেছে ব্যাপ্ত জনস্থলির সাথে একাত্মতার উৎকাঙ্ক্ষা ও তার সংবেদনার পরিপ্রেক্ষণরূপে।’১৫ অর্থাৎ ‘তৎকালীন কাব্যপ্রথার সমর্থন’, ‘বেঁচে থাকার সংগ্রাম’ এবং ‘ব্যাপ্ত জনস্থলির সাথে একাত্মতার উৎকাঙ্ক্ষা’ থেকেই তাঁর সমাজমুখীনতা, তিনি নিজে সমাজবাদী বলে নন। এ প্রতীতীর সঠিকতা অসঠিকতা সম্পর্কে, কবিতা বিশ্লেষণক্রমে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা নিশ্চিত হবো। (চলবে)

দোহাই

১২. দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ, আহসান হাবীব : রাত্রিশেষ, ১৩৬২, ঢাকা
১৩. ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস, আবদুল মান্নান সৈয়দ : অপ্রকাশিত
১৪. সৈয়দ আলী আহসান : আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে, ১৯৯৩, ঢাকা
১৪. আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতা, তুষার দাশ : সাহিত্যপত্র, ১৯৮৫, ঢাকা
১৫. বিদীর্ণ দর্পণে মুখ, সাজ্জাদ শরিফ : অধুনা, ১৯৮৬, ঢাকা