ঈদের দিনটা খুবই বেকুব বেকুব লাগে নিজেকে। বাসার, পাড়ার, দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ যার যার সাধ্যমত নতুন পোষাক পড়ে, মজাদার খাবার খেয়ে ঘুরে বেড়ায় চারপাশে। আমি চেয়ে থাকি। বাচ্চা-কাচ্চারা টু-পাইছ কামানোর মতলবে ঝুপ-ঝাপ পায়ের উপর উপুর হয়ে পড়ে সালাম করে চেয়ে থাকে। আমি বলি বেঁচে থাক। হাঁড় কিপ্টে নামে বাচ্চা সমাজে পরিচিতি পাবার হাত থেকে পরিত্রান পেতে নববর্ষে সাধ্যের আতীত খরচ করি। ধর্মের প্রতি মোহ কেটে যাবার পর থেকে এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো আমার ঈদ।কিন্তু এভাবে আর যেন চলছেনা। বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ীতে গেলাম ঈদের ছুটিতে। উদ্দেশ্য একটু গ্রামের তাজা হাওয়া খেয়ে আসা। কিসের কি? মামা শ্বশুর, চাচা শ্বশুরদের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াত দিয়ে শুরু। তার পর আসে মাগরিবের নামাজের সময়। দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া কোন উপায় থাকলোনা। তারাবির আগে পেট খারাপের ভান ধরলাম। এতে সফলতা আসলো। ঈদের আগে আমাকে নিয়ে টানাটানি কমলো কিছুটা। আমার অবস্থা দেখে আপনাদের ভাবীর আনন্দ আর ধরেনা। তবে তার করুনাতেই অনেক উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেয়া গেছে। হুজুরে জোনপুরী আল্লামা আলা আলু বোখারা………(রাঃ)র সাথে সাক্ষাতের কবল থেকে তার আসীম কৃপায় রক্ষা পেয়েছি। ব্যাটা নাকি সুযোগ পেলেই নিজের পানের ছিবড়ে অন্যকে খাইয়ে দেয়। যাক সে কথা।

প্রতিবারি লক্ষ্য করছি নানা ওছিলায় ঈদের ছুটি ৩ দিনের পরিবর্তে ইনিয়ে বিনিয়ে কমপক্ষে ৭ দিন হয়ে যাচ্ছে। তিন দিনের ছুটি্তেই ঢাকা শহরের এক-চতুর্থাংশ খালি হয়ে যায় সেখানে ৭ দিনের ছুটিতে ঢাকার তিন-চতুর্থাংশ খালি হয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। বাড়ী ফেরা মার্কা গানে গানে প্রচারিত হচ্ছে নারির টান, সেই সাথে ঈদের মাহাত্ম্য মিলে মিশে একাকার। অন্যদিকে ঢাকা খালি করে জমে উঠে গ্রাম এই সময়ে। বহু মিসিং লিংক বাল্য- বন্ধুদের মিলন মেলা বসে। প্রচুর বিয়ের অনুষ্ঠান দেখলাম ঠিক ঈদের পর দিন থেকে একটানা। খবর নিয়ে জানলাম ছুটির কারনে সব আত্মীয়-বান্ধবের উপস্থিতী নিশ্চিৎ করতেই এই ব্যাবস্থা।

গেলাম মাছ বাজারে। সে এক এলাহি কান্ড। তিনশ টাকা দামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে পনেরশ টাকায়। লন্ডন ফেরত, ইটালি ফেরতদের ইউরোর ঝংকারে বাজার মাতোয়ারা। আমিতো নতুন জামাই আমাকেকি দমে গেলে চলে ! ফলত পরের দিন ১২ কিলো মিটার দূরে জেলা শহরে গিয়ে মানি ব্যাগের স্বাস্থ পুনরূদ্ধার করতে ATM বুথের স্মরনাপন্ন হতে হলো।

টিভি চ্যানেল গুলি এক অলিখিত প্রতিযোগিতার মত একটানা বাজিয়ে যাচ্ছে- ওমোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ-। এদিকে পুরোটা রোজার মাস জুড়ে কেনা-কাটার উপরে শপিং সেন্টার থেকে স্পট রিপর্টিং -” এবারে অন্যান্ন বারের চেয়ে দামটা একটু চড়া তবে বেচা-বিক্রিও ভালো।” মেয়েদের পোষাকের হিট আইটেমে এবারেও ছিলো যথারিতী হিন্দি সিরিয়ালের নাম আনুসারের পোষাক যেমন -ছোটি বহু, বেটিয়া আর সবাইকে টেক্কা দিয়েছে এবারে মাশাককালি। অভিজাত এলাকার শপিং সেন্টার গুলো থেকে রিপর্টিংএ থাকবে- “ওদের জিনিষগুলো এক্কেবারে ইউনিক, তাই দামটা একটু বেশি।” বদর উদ্দিন ওমরের চোখে যা কিনা চুড়ান্ত অশ্লীল কথাবার্তা।

আসলে আমি বলতে চাইছিলাম সরকারি পৃষ্ঠপোসকতার কথা। ঈদকে জাতীয় বৃহত্তর অনুষ্ঠানে পরিনত করার জন্য তার চেষ্টার অন্ত নেই। আর ব্যবসায়ীদের দরকার মওকা। ব্যাস দুয়ে মিলে দিনকে দিন কঠিন জমে উঠছে ঈদ। পূজোর জন্য কেনা-কাটা করতে এসে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মাথায় হাত। দোকানিরা ঈদের জন্য সেবা দিতে দিতে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে যে এখনো দোকান খুলে উঠতে পারেনি। অথবা হতে পারে এত ভাল ব্যবসা হয়েছে যে পূজোতে বেচা-বিক্রি না করলেও তাদের চলবে। সেই সাথে পূজো মন্ডপ গুলোর নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলছে কি বিপন্ন এখানে আজ সংখ্যালঘুরা। যাই হোক, এই বৈষম্য আমার আজকের আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় না। আমি মূলত বাংলা নববর্ষ উৎসবের প্রতি আমাদের সরকারের বিমাতা সুলভ আচরনের কথাই এখানে বলতে চেষ্টা করছি। কেবল মাত্র সুযোগ ও যথাযথ মনোযোগের অভাবে সব ধরনের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই জনপদের মানুষের প্রধান উৎসব হয়ে উঠতে পারছেনা বাংলা নববর্ষ। শুধু মাত্র, আমি আবার বলছি- শুধু মাত্র তিন দিনের সরকারি ছুটি নববর্ষের উৎসবকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে তা কল্পনা করা অনেকের জন্যই বেশ কঠিন। এক দিনের জায়গায় তিন দিনের ছুটি হলে দেখবেন কোথায় থাকে ঈদ আর কোথায় থাকে দূর্গা পূজা। তিন দিনকে কিভাবে পাঁচ দিন আর পাঁচ কে সাতদিন বানাতে হয় তা বাঙ্গালী জানে। আসুন ভাই, সকলে মিলে একটু সোচ্চার হই। খালি দরকার একদফা এক দাবির ভিত্তিতে ছুটি বৃ্দ্ধির জন্য কলম সংগ্রাম শুরু করা। ধীরে ধীরে এর প্রতিধ্বনি আছড়ে পড়বে মিডিয়ার আন্যন্ন শাখায়, সংস্কৃতি পাড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। এখনি সময়, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতি সহানুভূতিশীল সরকার আছে ক্ষমতায়। চলুন ভাই্‌, যার কাছে যে কলম আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ি। তিন দিন নববর্ষে্র ছুটির দাবি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এই কলম চলবে।

নববর্ষে তিন দিনের ছুটি বদলে দিতে পারে আমাদের অনেক কিছু। অতর, টুপি, সেমাইএর চেয়ে পিঠা, লাঠি খেলা, পুতুল নাচ যে অনেক চেনা তা মনে পড়ে যেতে পারে এক নিমেষে। ধর্ম নাই, জাত-পাত নাই, মূল জাতি- উপজাতি নাই এমন উৎসবিতো আমরা চাই।

বর্তমান নববর্ষে দেশের চিত্র হলো, দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরের এক-তৃ্তিয়াংশও যদি আনন্দের খোঁজে বাসার বাইরে বের হয় তবে যানজটের অবস্থা হবে ঠিক একটা স্থিরচিঁত্রের মত। হচ্ছেও তাই। ছুটি যেহেতু একদিনের তাই ঢাকার বাইরে যাবার সুযোগ নেই। গ্রামের বটতলার মেলা গুলো ভুগছে সঙ্গতির অভাবে।

তিনদিনের নববর্ষের ছুটি মঞ্জুর হলে পরে দেশের চিত্রঃ ছেলে-ছেলে বউ, নাতি-নাতনি বাড়ী আসবে তাই সাত দিন যাবৎ চলছে পিঠা-পুলি বানাবার ধুম। প্রিতি ফুটবল ম্যাচ হবে নববর্ষের পরের দিন। একপক্ষে বিবাহিতরা, অন্য পক্ষে অবিবাহিতরা। মেলা ফেরত বাচ্চাদের বাঁশির বেসুরো শব্দে আর ঢোলের বারিতে গ্রাম, পাড়া মুখোরিত। বাজারের দোকানে দকানে হালখাতা। এদিকে ঢাকাবাসী চওড়া রাস্তাগুলোর মোরে স্টেজ ফেলে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যাস্ত, এখন যেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া বিরল দর্শন।

লাল-সাদার এই মিলন মেলার দরকার শুধু একটু খোলা জায়গার। গাছ যেমন খোলা আকাশের নিচে নির্বীঘ্নে বেড়ে উঠে, তেমনি ছায়াটুকু সরিয়ে দিতে পারলে কোনদিন হয়তো চাইনিজ New Year এর মত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাস ব্যাপি বর্ষবরন উৎসবে আমরাও মেতে উঠতে পারবো। আমরাও বিশ্ববাসীকে বলতে পারবো- আহ্- বিরক্ত কোরোনা, দেখছোনা আমরা উৎসবে ব্যাস্ত।।