আজকাল দু’টাকা তিন টাকা দামের পত্রিকাগুলো বেশ জনপ্রিয়। সকালে অফিস যাবার পথে, কিংবা বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে যখন অসহনীয় জ্যামের মুখোমুখি হতে হয় নগরবাসীকে তখন অনেকেই সময় কাটাবার জন্য এই পত্রিকাগুলো কিনে থাকেন। এমন পত্রিকা এখন বেশ কয়েকটা আছে। তারা সকলেই যাত্রাপথের এই বিরাট পাঠক গোষ্ঠিকে ধরতে চায়। যেহেতু পাঠক শুধুমাত্র লাল রঙের শিরোনামটিই দেখে নির্ধারণ করেন কোন পত্রিকাটি তিনি কিনবেন, তাই পত্রিকাওয়ালা সবসময় চেষ্টা করেন আকর্ষণীয় কোনও শিরোনাম দিতে। এই যেমন ধরুণ, “বাংলাদেশ দ্বিখন্ডিত হচ্ছে” কিংবা “অস্কার পাচ্ছে ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’ সিনেমাটি”। বাংলাদেশ দ্বিখন্ডিত কিংবা বাংলাদেশের একটি সিনেমা অস্কার পাচ্ছে এমন খবরে আশ্চর্যান্বিত হয়ে আপনি সেই পত্রিকা কিনলেন। কিন্তু মূল খবর পড়ার পর দেখতে পাবেন, সেখানে লেখা আছে বাংলাদেশের এক উগ্রপন্থি রাজনৈতিক দল ঘোষণা দিয়েছে তারা চায় বাংলাদেশকে ভেঙ্গে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করা হোক, কিংবা ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’ ছবির পরিচালক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার ছবিটি অস্কার পাবার যোগ্য।

আমার এই প্রবন্ধের শিরোনামটিও অনেকটা এমন। শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে, এখানে বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে হিসেব নিকেশ করে বলে দেওয়া হবে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। শুরুতেই তাই বলে রাখি বিবর্তন এভাবে কাজ করে না। প্রাকৃতিক নির্বাচনের কোনও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই। এটি কাজ করে অনেকটা ব্লাইন্ড ওয়াচমেকারের মতো। কার ভবিষ্যতে কোন কোন বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হবে, কোন কোন বৈশিষ্ট্য বিয়োজিত হবে- এই নিয়ে বিবর্তনের মাথা ব্যাথা নেই। সাধারণভাবে তার মাথায় তাকে শুধু টিকে থাকার সংগ্রাম। টিকে থাকতে গিয়ে যে বৈশিষ্ট্যগুলো অভিযোজনের সহায়ক, সেগুলোই সে রক্ষা করে চলে।

মানুষের পরবর্তী ঠিকানা কী? কোটি বছরের বিবর্তনে ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ নামক এক উচ্চবুদ্ধি সম্পন্ন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে, আরও কোটি কিংবা লক্ষ বছর পর তারা দেখতে কেমন হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাধারণভাবে দুইটি মতবাদ উঠে আসে। একদল মনে করেন, অনান্য প্রাণীর তুলনায় আমাদের মস্তিষ্কের আকার বড়। সেই মস্তিষ্ক আরও বড় হতে থাকবে, আমরা সময়ের সাথে সাথে আরও বুদ্ধিমান হবো। আবার অনেকে বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে আমরা আমাদের শারিরিক পরিবর্তনের পথ বন্ধ করে দিয়েছি।

“বড় মাথা, বড় মস্তিষ্ক” হবার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অবশ্য নেই। মানুষের করোটির কয়েকহাজার বছরের ফসিল গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, হোমোসেমিয়ান্স দের দ্রুত মস্তিষ্ক বৃদ্ধি এখন বন্ধ। ফসিল রেকর্ড আরও বলছে গত কয়েকহাজার বছরে শারিরিক ভাবে মানুষের কোনও পরিবর্তন হয়নি। কয়েকবছর আগেও বিজ্ঞানীরা তাই মনে করতেন, মানুষের শারিরিক পরিবর্তন এখন বন্ধ। মানুষের বিবর্তন হচ্ছেনা। আধুনিক মানুষ হবার পর শারিরিক ভাবে তারা অপিরিবর্তীত আছে, হয়তো থাকবে।

কিন্তু ডিএনএ প্রযুক্তির উদ্ভাবন গবেষণার এই ক্ষেত্রে এক বৈপ্ললিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। মানুষের জিন এখন বলছে অন্য এক গল্প। মানুষের বিবর্তন হচ্ছে এবং সেটা অন্যান্য অনেক প্রজাতির চেয়ে দ্রুত। উপরের করা প্রশ্নগুলো এখন আবার ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের। বড় মস্তিষ্ক হবার যদি সম্ভাবনা না থাকে তাহলে কী হবে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত উদ্ভুত নতুন নতুন রোগ- ব্যাধি কিংবা বৈশ্বিক উষ্ণতা (global warming) বৃদ্ধি এইসব নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কী নতুন কোনও প্রজাতির উদ্ভব হবে। নাকি প্রযুক্তির ব্যবহারে মানুষ নিজেরাই নিজেদের বিবর্তিত করে তৈরি করবে মানুষ-বট। যাদের মস্তিষ্ক হবে সিলিকনের আর দেহ হবে স্টিলের।


হোমোসেপিয়েন্সদের সাথে অন্যান্য প্রজাতির পার্থক্যঃ

অন্যান্য সকল প্রজাতি থেকে মানুষের যোজন যোজন পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা। এর ব্যাপক উন্নতি মানুষের বিবর্তনে ঢের প্রভাব ফেলছে। যেমন, কিছু জেনেটিক কারণে অনেক শিশু “ডায়বেটিস” রোগ নিয়ে জন্মায়। আদিম যুগে এই ধরণের মিউটেশন বিলুপ্ত হয়ে যেত, কারণ- তারা বংশবৃদ্ধি করে সন্তান উৎপাদনের অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কিন্তু আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আমরা ইনসুলিন দিয়ে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারছি। ফলে শিশুটি প্রাকৃতিক নিষ্ঠুরতা উপেক্ষা করে টিকে থাকতে পারছে এবং সন্তান জন্ম দিচ্ছে পরিনত বয়সে। অর্থাৎ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ব্যবহার করে আমরা শিশু মৃত্যুর হার বহুলাংশে কমিয়ে এনেছি। ফলে কম বেশি সবাই বংশ বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছে।

মিলার বলেন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, শক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কাপড়ের ব্যবহার, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, ভাষা, সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন এতোসব কারণে মানুষ অন্যান্য সবার থেকে আলাদা। যদিও পূর্বপুরুষের অনেক স্বভাব আমাদের মধ্যে আজও দেখা যায় তবুও এটা অনস্বীকার্য যে, অন্যান্য সকল প্রজাতির বিবর্তন থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে আমরা মানুষের বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারবোনা।

হোমোসেপিয়েন্সরা কী কী কারণে বিলুপ্ত হতে পারেঃ

১। একটি নির্দিষ্টি প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্থ প্রজাতিরা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, যদি পরিবেশ বদলে যায়। এমনটা মানুষের ক্ষেত্রে ঘটার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। কারণ মানুষের প্রাকৃতিক বিভিন্ন পরিবেশ খাপ খাওয়ানোর উচ্চক্ষমতা আছে। যেমন, বাংলাদেশের গড়ে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অভ্যস্থ একজন ছাত্র যখন উচ্চ শিক্ষার্থে কানাডা যায় তখন সে কানাডার মাইনাস ২০ ডিগ্রিতেও অভ্যস্থ হয়ে যায়, আবার কানাডার মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অভ্যস্থ একজন কর্মসুত্রে আফ্রিকার তীব্র গরমেও বেঁচে থাকতে পারেন।

এছাড়াও সম্পূর্ন পৃথিবীজুড়েই এখন মানুষ ছড়িয়ে আছে। সুতরাং একটা বড় উল্কাপাতে অধিকাংশ মানুষ ধ্বংস হয়ে গেলেও সম্পূর্ণ প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে না, যারা বেঁচে থাকবেন তারা বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে ঠিকই আবার মানব সভ্যতার দৌড় অব্যাহত রাখবেন।

২। মানুষ প্রকৃতিকে বদলে দিচ্ছে (বন উজাড় করা, কার্বন- ডাই- অক্সাইড দূষণ)। ফলে এমনটা হতে পারে যে, বদলাতে বদলাতে তারা প্রকৃতির এমন অবস্থা করে ফেলবে যে, তাতে নিজেদেরই বাঁচার কোন উপায় থাকবে না।

৩। অনেক সময় একটি প্রজাতি আরেক প্রজাতির দ্বারা বিতাড়িত হয়। যেমন আমরা হোমোসেপিয়েন্সরা পৃথিবীর বুক থেকে নিয়ান্ডার্থালদের বিতাড়িত করেছি। অর্থাৎ প্রকৃতির বুকে আমাদের সাথে প্রতিযোগীতায় নিয়ান্ডার্থালরা টিকে থাকতে পারে নাই, তারা হারিয়ে গেছে।

এখন কথা হলো, প্রকৃতিতে এখন এমন কোন প্রজাতি নেই যারা মানুষের সাথে পাল্লা দেবার সামর্থ্য রাখে। তবে এমন একটা সম্ভাবনা আছে যে, মানুষ থেকেই আরেকটি প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে যার পাল্লা দেবার যোগ্যতা থাকবে। তবে সেক্ষেত্রে মানুষ হারিয়ে যাবে না, বরঞ্চ যোগ্যরা হবে মানুষের পরিবর্তিত একটি রূপ।

৪। প্রাকৃতিক নির্বাচন মূলত কাজ করে ভৌগলিক ভাবে স্বতন্ত্র অঞ্চলে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জনসংখ্যা বিশিষ্ট প্রজাতির উপর। [Mayr 2001 p 254]আর এই কারণেই সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হোমোসেপিয়েন্সদের উপর প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাব কম। যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যপক উন্নতি আজ পৃথিবী মূলত একটা গ্রামে পরিনত হয়েছে। সকল জনগোষ্ঠি একে অন্যের সান্নিধ্যে আসছে, তাদের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে। ফলে জিনেটিক মিক্সিং হচ্ছে অহরহ।

৫। জীবন বিধ্বংসী কোন ব্যাকটিয়ে বা ভাইরাসে সৃষ্টি হতে পারে। তবে সেই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস প্রতিরোধের ব্যবস্থা মানুষ নিমেষেই করে ফেলতে পারবে। আর না পারলেও এই কারণে পৃথিবীর সকল মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাবে না।

কীভাবে এমন একটি প্রজাতির উদ্ভব হতে পারে, যা হোমোসেপিয়েন্সদের পূণঃস্থাপন করতে পারবেঃ

১।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে মানুষ থেকেই যদি অন্য একটি প্রজাতির উদ্ভব হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে সে মানুষকে প্রতিস্থাপন করার যোগ্য হবে। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে এমনটা হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন মূলত কাজ করে, ভৌগলিক ভাবে স্বতন্ত্র অঞ্চলে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জনসংখ্যা বিশিষ্ট প্রজাতির উপর।

২। বিজ্ঞানীরা এখনও জিন প্রযুক্তি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ব করতে পারেন নি। যদি জিন প্রযুক্তি মানুষের সম্পূর্ণ আয়ত্বে এসে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো বাবা মা তাদের ভবিষ্যত সন্তানের সকল খারাপ জিন (শারিরিক ভাবে দূর্বল, মাদকাসক্ত, চোখে কম দেখা ইত্যাদি) আগে থেকেই সনাক্ত করে সেগুলো নির্মূল করে দিবেন। ভালো জিন (গান গাওয়া, অংকে ভালো) অন্তর্নিবিষ্ট করবেন। সবাই না করলেও অনেকেই এই সুযোগ গ্রহণ করবে। ফলে এমন একটি মানবগোষ্ঠির উদ্ভব হবে, যারা একদম পরিপূর্ণ।

৩। কৃত্রিমভাবে তৈরী প্রজাতির দ্বারা। তবে সেই প্রজাতি কম্পিউটার ভিত্তিক হবে। মানুষ হয়তো তার মস্তিষ্ক কম্পিউটারে আপলোড করে দিবে, আর শরীর পরিবর্তন করে রোবট বানিয়ে ফেলবে। তবে “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বিভিন্ন ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রযুক্তি যে উন্নতি হয়েছে তাতে করে, অদূর ভবিষ্যতেই মানুষের রোবট হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। [Pearson 2004]

উপরের তিন ধাপের আলোচনায় আমরা তাহলে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। তা হলো, প্রাকৃতিক নির্বাচনে মানুষের বিবর্তন হবার সম্ভাবনা খুবই কম, বিবর্তন হতে পারে তবে সেটা হবে কৃত্রিম নির্বাচনের (জিন প্রতিস্থাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি) কারণে। সত্যিকার অর্থেই কী হবে তা আমরা দেখে যেতে পারবো না। কারণ বিবর্তন বিরক্তিকর ধীর গতির। লক্ষ্য বছর পর হয়তো আমাদের থেকে উদ্ভুত নতুন কোন প্রজাতি ফসিল বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের পরিবর্তন নিয়ে বই (কিংবা electronic- book) লিখবে।

তথ্যসূত্রঃ

১। সায়েন্টিফিক এমেরিকান। জানুয়ারি ২০০৯ সংখ্যা
২। The Future of Homo Sapiens- http://www.web4health.info/en/aux/homo-sapiens-future.html
৩। The Future of Human Evolution by Nick Bostrom, Future of Humanity Institute, Faculty of Philosophy & James Martin 21st Century School, University of Oxford