ছোটবেলায় স্কুলে বসন্তের কলেরার টীকা নিতে হতো। যেদিন টীকা নিতাম সেদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসে টীকার জায়গায় ছ্যাঁক দিতাম। একটা ন্যাকড়ায় লবণ বেঁধে হারিকেনের উপরে গরম করে করে ছ্যাঁক নিতাম। বৈজ্ঞানিক কারণ কী জানতাম না। ঠাকুমা বা বোন ন্যাকড়ায় লবণ বেঁধে দিতেন আর আমরা নিজে নিজে ছ্যাঁক নিতাম। পড়াশুনাও এক রকম মাপ। যতটা না ব্যথা তার চেয়ে বেশী চলতো উঃ আঃ। পরদিন স্কুলে গিয়েও অজুহাত ছিল — ইনজেকশনের ব্যথার জন্যে পড়া শিখতে পারিনি।

একবার উঃ আঃ করেও পার পাইনি, কারণ পড়তে না বসলেও দাদুর কাছে গল্প শুনতে বসেছিলাম ঠিকই, বুঝতে পারিনি যে সোনা কাকা এত সূক্ষ্ণভাবে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করবেন। পড়া মাপ তো খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরা। আর আমার মনে মনে ব্যাখ্যা ছিল — ব্যথায় পড়তে না পারলেও গল্প শুনলে যদি ব্যথা ভুলে থাকা যায় তবে অসুবিধা কী?

আর ঠান্ডা লাগলে ন্যাকরায় কালজিরা বেঁধে নাক নিয়ে উলটা শ্বাস নিতাম । হাতে পায়ে সরিষার তেল ডলতে হতো। নদীতে ডুবানো নিষেধ। আর এখন? নিক্স বা বামসহ আরও কতো কী!

ছোটবেলায় দুটো বিপরীতধর্মী গাছ নিয়ে খুব উপভোগ করতাম। একটা লজ্জাবতী আর অন্যটি নির্লজ্জ। লজ্জাবতীর পাতায় হাত বুলালেই লজ্জায় চোখ মুদে যেতো। উঠানের কোনায় বা রাস্তার পাশে এ গাছ দেখলেই সাধারণত হাত বুলাতাম। এর স্পর্শকাতরতা মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাকেও কী কাতর করতো? তখন ভাবিনি। এখন ভাবতে গিয়ে কেমন জানি গা গুলানো পুরুষতান্ত্রিক স্বভাবজাত আচরণ মনে হচ্ছে। মিইয়ে পরা গোষ্ঠিকে আরও মিইয়ে দেবার মনোবৃত্তি।

আর নির্লজ্জ গাছের দানা পায়জামায় বিধেঁ যেতো। ঠাকুমা ও বোন বহুদিন সাবধান করে দিতেন —- মাঠে নির্লজ্জ গাছের কাছ দিয়া বা উপর দিয়া যাবি না। এ গুলা বাছতে অয়। আজাইরা কাম।

আর আমার বেছে বেছে নির্লজ্জ গাছের কাছ দিয়েই যেতে ভাল্লাগতো। কে শুনতো কার কথা। এমন কি নির্লজ্জ লাগলে পায়জামা না বদলানো পর্যন্ত কূট কূট করে বিঁধতো, তবুও তাই করতাম। নিয়মের বাইরে যাবার আনন্দ উপভোগ করতাম। এখন ছেলেমেয়ের কোন রকম অনিয়ম দেখলে বিরক্ত হই।

রোজা আর গ্রীস্মের ছুটি দীর্ঘ হতো। এ দুই ছুটিতেই সপ্তাহের সাতদিনকে ভিত্তি করে পড়ার জন্যে সময়সূচি বানাতাম। প্রতিদিনকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে নিতাম। সে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন। প্রতিটি ক্ষণকে ফলপ্রসূভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ। ভোর,সকাল,দুপুর,বিকেল ও রাত। সময়সূচিটা পড়ার টেবিলের উপরে টিনের বেড়ার কাঠের খাপের সাথে ঝুলিয়ে রাখতাম। কখনোই আমি ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারতাম না, কিন্তু সময়সূচি বানানোর সময় সেটি বিবেচনায় নিতাম না। সময়সূচি হতো ভোর থেকে রাতে ঘুমানো যাওয়া পর্যন্ত। খাওয়া,পড়া, স্নান করা, দুপুরে ঘুমানো ও বিকেলে খেলা — কয়টা থেকে কয়টা অর্থাৎ কোনটায় কত সময় ব্যয় করবো এর উল্লেখ থাকতো। চর্তুকোণ কাগজে অনেক চর্তুকোণ ঘর করে আড়াআড়ি করে লিখতাম। তবে খেলায় সময় সবচেয়ে কম বরাদ্ধ থাকতো আর ব্যয় হতো সবচেয়ে বেশি। পড়ার জন্যে সময়সুচি বলে পড়ার জন্যে বরাদ্ধকৃত সময়ও থাকতো বেশি, তবে ব্যয় হতো সবচেয়ে কম। এ নিয়ে সোনাকাকার কান মলা কম খাইনি।

এখন হলে সোনাকাকাকে বলতে পারতাম জাতীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই আমি আমার পড়ার বাস্তবায়ন করেছিলাম যা পরিকল্পনার ধারে কাছেও ছিল না। পরিকল্পনা হবে কাগুজে বাঘ আর বাস্তবায়ন হবে নিজের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে। নিজের স্বার্থ —- দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ যে লেখাপড়া তা তখন আমি যেমন বুঝিনি, তেমন নেতারা — নীতি নির্ধারকরা নিজের স্বার্থে অন্ধ হয়ে বুঝেন না জাতীয় স্বার্থ। নির্বাচনী ইস্তেহারকে নির্বাচনে জেতার পর আর গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু কাকা যে আমার সে কথা শোনার জন্যে আর নেই।

আগেও বলেছি দাদু আমাদের অনেক গল্প শুনাতেন। হয়তো কোন কারণে বিরক্ত বা শারীরিকভাবে অসুস্থ আর আমরা গল্প শোনার জন্যে আবদার করছি তখন দাদু শুনিয়ে দিতেন —–
‘রাজায় খায় গাঁজা
রাণী এ খায় পানি
এটুকুই আমি জানি’
আমরা বুঝে নিতাম আজ আর বায়না ধরে লাভ নেই। এখন এ গল্পের মর্মোদ্ধার করতে পারছি। এ গল্প এতো ছোট নয়। এখন রাজা আর রাণীদের গাঁজা আর পানি খাবার কাহিণীতে ইতিহাসের পাতা ভরপুর। দুর্নীতি,দুঃশাসন, দুষ্কর্ম আর দুর্নামের ভারে ইতিহাস লজ্জিত, কুণ্ঠিত ও ভারাক্রান্ত।

ছোটবেলা একটা পদ্য পড়েছিলাম ষোল আনাই মিছে। এক সাঁতার না জানা বাবু ও মাঝির গল্প। এখনকার প্রজন্ম ষোল আনার হিসেব বুঝে না। বুঝে টাকার হিসেব। আনা বা পয়সার হিসেবের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সিকি আর আধুলিরও অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

আমরা ছোটবেলায় এক আনা, দুই আনা, চার আনা, আট আনা আর বারো আনার হিসেব জানতাম। এক পয়সা, দুই পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, সিকি আর আধুলির মুদ্রার ব্যবহার ছিল। অংক বইয়ে এসব মুদ্রার ছবি ছিল হিসেব শেখানোর জন্যে। এখনো ছবি আছে, তবে হিসেবের প্রচলন নেই।

কোন পয়সা চকচক না করলে মাটিতে ঘষে চকচকে বানাতাম। এক সময়ে সমবয়সীদের মধ্যে জোয়ার এসেছিল পুরানো বা দাগপরা পয়সা পেলেই পায়ের মোড়া দিয়ে মাটিতে ঘষেঘষে চকচক বানানো। খেলার ছলে এ যেন এক দায়িত্ববোধ। সরকারী পয়সাকে — জনগণের পয়সাকে চকচক বানানো। ঠাকুরমা ও বোন বকা দিতো—আজাইরা কাম। আজাইরা বউ কী করে? ধানে চাইলে মিশাইয়া বাছে। পইসা লইয়া কীয়ের এতো গসাগসি?

ঘষাঘষি তো করতাম রাষ্ট্রীয় মুদ্রা নিয়ে। সৎ ও স্বচ্ছ উদ্দেশ্য ছিল। এখনকার কৈশোর তো ঘষাঘষি করে জাতীয় মূল্যবোধকে নিয়ে। তারা ব্যস্ত এদেশে অপরিচিত বিদেশী কোন সংস্কৃতির দাগপরা রীতিকে চকচক বানানোতে।