[প্রবন্ধটি বেশ বড়। ধারাবাহিক ভাবে সচলায়তনে প্রকাশ হয়েছিল। মুক্তমনার পাঠকদের জন্য পুরো পর্বটি এক সাথে দিলাম। সময় হাতে নিয়ে পড়ার অনুরোধ রইল।]

একঃ দর্শন ও বিজ্ঞান

দেশ নিয়ে চিন্তার কোন এক প্রাক্কালে সমাজতন্ত্রের চিন্তা প্রথম মাথায় চলে আসে। আমার মত এমন অনেকেই মনে হয় আছেন যারা জীবনের কোন না কোন সময়ে সমাজতন্ত্রের প্রেমে পড়েছেন, আবার সেই প্রেম ছুটে যেতেও বেশি সময় নেয়নি। আপনি যদি মানবতাবাদী হোন তবে সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদ স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে। কোন যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে শ্রেনীবিভেদ, লিংগবিভেদ, কিংবা ধর্মবিভেদ- এগুলোর কারণে সৃষ্ট শোষন মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করি। এ রকম একটি অবস্থায় আমি মার্ক্সের এর দর্শন নিয়ে আগ্রহবোধ করলাম। তবে মার্ক্সের দর্শন নিয়ে লেখার আগে আমি একটু বিস্তারিত বলার চেষ্টা করবো দর্শন কিভাবে কাজ করে। আমার মতে সেটা না জানা থাকলে যে কারো দর্শন নিয়ে আলোচনার চেষ্টা বৃথা।

আমি যেভাবে দর্শনকে দেখি তা হলো যুক্তির মাধ্যমে, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন পদ্ধতিতে, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। প্রতিটি দার্শনিক যেটা করে থাকেন – তিনি প্রথমে তাঁর পূর্ববর্তী সকল দার্শনিকদের চিন্তাভাবনা গুলো পর্যবেক্ষন করেন তাঁদের প্রকাশিত লেখার মাধ্যমে। যে কারনে প্রত্যেক দার্শনিক তাঁর সময়ের সর্বোচ্চ তত্বটিই প্রদান করেন তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ভুলগুলো শুধরে দিয়ে। তারপরও প্রতিটি দর্শনের ক্ষেত্রে একটি কথা এখানে প্রযোজ্য যে যেকোন দর্শনই তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারে না। সকল দার্শনিক তাঁর সময়কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ। কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ গুলোর জন্য। সাধারনত প্রতিটি শেষ ধর্ম বা দর্শন আগের গুলোর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই তৈরী হয় বলে শেষের ধর্মটি বা দর্শনটি হতে পারে সর্বোত্তম। ধর্মগ্রন্থ গুলোকে আমি দর্শনের ইতিহাসের একটি অংশবিশেষ হিসেবে দেখি। শুধু পার্থক্য এই যে দাবী করা হয়ে থাকে যে ধর্মের কথাগুলো সরাসরি ঈশ্বরের, আর দর্শনের গুলো মানুষের।যদি কেউ বলে থাকেন যে কারোর দর্শন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য তবে তিঁনি ইতিহাসকেই অস্বীকার করেন।

এখন কথা হল দর্শন আর বিজ্ঞানের মাঝে পার্থক্য কি? বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কার তাঁর পূর্ববরর্তী জ্ঞান বা তত্বকে পর্যালোচনা করেই সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যে কোন তত্ব হয় কালের উর্ধ্বে। যদি একটি তত্ব তাঁর পর্যবেক্ষনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা যেমন তাঁর পূর্ব ও বর্তমান কালে সত্য তেমনি তা হতে হবে ভবিষ্যতেও সত্য। যদি ভবিষ্যতের কোন একটিও পর্যবেক্ষন দ্বারা সেই তত্ব অসত্য প্রমানিত হয় তবে তা আর বৈজ্ঞানিক তত্ব থাকে না। দর্শনগুলো যেহেতু তাদের কালকে অতিক্রম করতে পারে না তাই দর্শনের মাঝে বিজ্ঞান খোঁজা অবান্তর। সম কারনে ধর্মের মাঝেও বিজ্ঞান খোঁজাও অবান্তর।

তবে প্রত্যেক দার্শনিকই বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষন প্রনালী ব্যবহার করে থাকেন – জেনে বা না জেনেই। যে কোন কিছু জানার চেষ্টা করা- পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রশ্ন এবং তার উত্তরের মাধ্যমে – তাহাই বৈজ্ঞানিক প্রনালী। যেমন আদিম সমাজে মানূষ জানার চেষ্টা করতো কেন তাঁরা অসুস্থ হয়। তাঁদের যেহেতু জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছিল তাই তাঁরা বের করলো দেবতাদের খুশী রাখলে, পূঁজা করলে তাঁরা সুস্থ হয়ে যাবে। তাঁরা বের করলো জটিল মন্ত্র, যার হয়তো কোন ব্যাখ্যা নেই কিন্তু তারপরেও তা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের তুলনায় কোন অংশে কম ছিল না তাঁদের কাছে। তবে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন প্রনালী ব্যবহার করলেই সেটি বৈজ্ঞানিক তত্ব হয়ে যায় না, যেমনটি হল আদিম সমাজের মন্ত্রতত্ব। আজ আমরা যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষনা করতে গেলে আমরা কি করি? প্রথমে আমরা ঠিক করি আমি কি নিয়ে কাজ করতে চাই এবং কেন করতে চাই। তারপর লিটেরেচার রিভিউ করি। আমার আগে যারা একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছে তাঁরা কি কি করেছেন দেখি। তাঁদের সীমাবদ্ধতা কোথায় ছিল বোঝার চেষ্টা করি। এটা যখন ধরা যায় তখনি কেবল নিজের পক্ষে কতটুকু কাজের সুযোগ আছে এই বিষয়ে সে সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। এই ধারণাটি যখন হয়ে যায় তারপরের কাজ বেশ সহজ। কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করা হয় যা আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সাহায্য করে। এভবে পরীক্ষা আর প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলতে থাকে যতক্ষন না আমি সন্তুষ্ট হই।

দর্শনের ক্ষেত্রেও দার্শনিকরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজে চলেছেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁরা পর্যবেক্ষন করে থাকে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস। যিনি যত পরে এসেছেন তাঁর কাছে পূর্ববর্তী ইতিহাসের তথ্য বেশী ছিল, তাই তাঁর পর্যবেক্ষন তত ভাল হয়েছে। সক্রেটিস, এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেল, মার্ক্স– তাঁরা সবাই অনেক প্রতিভাবান ছিলেন কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁরা সকলেই তাঁদের সময়কাল দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন। তাঁরা যেটুকু ইতিহাস দেখেছেন তাই শেষ নয়, তাই তাঁদের কথাই শেষ নয়। তবে তাঁরা যে কথাগুলো বলেছেন তা বুঝতে হলে আপনাকে তাঁরা যে ইতিহাস দেখে উনাদের সিদ্ধান্তে এসেছেন আপনাকেও পৃথকভাবে তাঁর কাছাকাছি যেতে হবে। যখন আপনি সেটা করতে পারছেন তখনি কেবল সম্ভব হবে চিন্তা করতে যে তাঁরা আজ বেঁচে থাকলে কি বলতেন।

নিছক মার্ক্সবাদের সমালোচনা করা, বা কারো ব্যাক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মার্ক্স এর দর্শন যা বুঝেছি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কেবল। চেষ্টা করেছি মার্ক্স এর দূর্বলতা গুলোকে চিহ্নিত করে তাঁর প্রকৃত দর্শনকে তুলে ধরতে। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষন একশত ভাগ সত্য হবে তা মনে করি না, তবে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে দ্বিমত পোষন করলে যুক্তি খন্ডন করে মতামত দিলে খুশি হবো। লেখার সময় চেষ্টা করেছি প্রতিটি রেফারেন্স উল্লেখ করতে এবং সমস্ত রেফারেন্সই অন্তর্জালে আছে। তাই আমার বক্তব্য খতিয়ে দেখা খুব বেশী কঠিন নয় বলেই মনে করি।

দুইঃ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ

মার্ক্স (karl Marx, 1818-1883) এর দর্শনের প্রধানত দু’টি দিক- একটি বস্তুবাদ এবং অন্যটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। এই দু’য়ের সংমিশ্রনে সৃষ্ট তাঁর দর্শন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। বস্তুবাদ কিংবা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, মার্ক্সই প্রথম বলেন তা নয়। বস্তুবাদ দর্শন আমরা দেখতে পাই গ্রীক দার্শনিক থেল্‌স্‌ (Thales, 624 BC-546 BC), ডেমোক্রিটাস্‌ (Democritus, 460 BC-370 BC ), ইপিকিউরাস্‌ (Epicurus, 341 BC-270 BC) এর মাঝে [১]। তারপরে দেখা যায় হব্‌স্‌ (Thomas Hobbes, 1588-1679), ফুয়েরবার্খ (Feuerbach, 1804-1872), মার্ক্স (Marx, 1818-1883), এংগেল্‌স্‌ (Engels, 1820-1895), বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel, 1872-1970) এর মাঝে [১]। বর্তমান সমসাময়িকে দেখা যায় ডেনেট (Dennett, 1942-), কুইন (Quin, 1908-2000), ডেভিডসন (Davidson, 1917-2003) প্রমুখ দার্শনিকের মাঝে [১]।

বস্তুবাদ দর্শনের মূল কথা হল, বস্তুই সব। পৃথিবীর সমস্তই বস্তু দ্বারা গঠিত এবং তা সর্বদা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বস্তুবাদ দর্শনে মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়াই হল মন। মার্ক্স এর পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিল “The difference between the Democritean and Epicurean philosophy of nature”. উক্ত কাজের সময় এবং পরবর্তীতে জার্মান দার্শনিক হেগেল ও ফুয়েরবার্খ নিয়ে কাজ করার সময় তিনি বস্তুবাদী দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন বলে মনে হয়।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিও মার্ক্স সর্বপ্রথম বলেননি। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস্‌ (Socrates, 469 BC-399 BC), প্লেটো (Plato, 428/427 BC-348/347 BC), এরিষ্টটল্‌ (384 BC-322 BC) এর মাঝে দ্বান্দ্বিক কথোপকথন লক্ষ্য করা যায় [২]। তবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন জার্মান দার্শনিক হেগেল (Hegel, 1770-1831), যার ধারনা তিনি পেয়েছিলেন আরেক জার্মান দার্শনিক কান্ট (Kant, 1724-1804) থেকে [২]। এই পর্যায়ে হেগেল এর কথা কিছুটা না বললেই নয়। হেগেলকে বলা হয় ভাববাদী দার্শনিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। প্রাচীন গ্রীক দর্শনের যুগের পর বিশাল মধ্যযুগে (রোমান সভ্যতার পতনের পর, পঞ্চম শতাব্দি, থেকে রেনেসাঁস্‌, ষোড়শ শতাব্দি, এর আগ পর্যন্ত) দর্শনের বিষয়বস্তু মূলত সীমাবদ্ধ থাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে এবং তার ভাল গুণাবলীর আবিষ্কারে [৩]। মধ্যযুগের পর আধুনিক দর্শনকালে গ্যালিলিও (Galileo, 1564-1642), ডেস্‌কার্টেস (Descartes, 1596-1650), স্পিনোজা (Spinoza, 1632-1677), লিব্‌নিজ (Leibniz, 1646-1716) কান্ট, হেগেল অন্যতম [৩]। এই সময়কার দর্শনের মূল বিষয়বস্তু ছিল যুক্তির ব্যবহার। আর হেগেল এই যুক্তির ব্যাবহার কে এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে। তাঁর Lectures on the History of philosophy [৪] পড়লে দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কে পুরো ধারণা লাভ করা যায়। সেখানে তিনি প্রাচীন কাল হতে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত সকল পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দার্শনিকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর লেখা হচ্ছে দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বোধ্য।

তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মূল বিষয় হল thesis (তত্ব) এবং antithesis (প্রতিতত্ব) এর দ্বন্দ্ব এবং এই দু’য়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটি synthesis এ পৌঁছা। synthesis কে অবশ্যই antithesis কে যুক্তি দিয়ে জয় করে আসতে হবে। হেগেল যেটি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারনে প্রতিটি বস্তু প্রতি নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেও মানব জাতির মাঝে একই রকমের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। হেগেল এবং মার্ক্স দু’জনেই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন। শুধু পার্থক্য এই যে হেগেল সবকিছুতে ছিলেন ভাববাদী আর মার্ক্স ছিলেন বস্তুবাদী। মার্ক্স এর নিজের ভাষায় তিনি হেগেল এর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে মস্তিষ্ক (ভাব) থেকে পাঁয়ে (বস্তু) নামালেন, বলা যায় একেবারে উল্টিয়ে দিলেন [৫]।

হেগেল সব কিছু পর্যবেক্ষন করে যেটা শেষমেশ দাঁড় করালেন তা হল, বস্তু হচ্ছে ‘absolute idea’ এর দ্বান্দ্বিক প্রকাশ। তিনি যেটা ধরে নিয়েছেন তা হচ্ছে আইডিয়া হল ‘অরিজিনাল আইডিয়া’। কিন্তু তার মধ্যে স্ববিরোধী দ্বন্দ্ব আছে, এবং সেই দ্বন্দ্বের ফলেই বাস্তব জগতের সৃষ্টি। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায়, বাস্তব জগৎটা হচ্ছে একটা ছবি এবং সেই অর্থে সেটা হল ‘absolute idea’ এর প্রকাশ [৫]। অর্থাৎ দুনিয়াতে যা কিছু ঘটছে তা সেই absolute idea এরই বহিঃপ্রকাশ। এই কারনে হেগেলরই কিছু ছাত্র যাদের বলা হত বাম-ঘেঁষা (Left Hegelian), তাঁরা তাঁদের শিক্ষকের ‘অরিজিনাল আইডিয়া’ কে মানতে রাজী হল না। এর মাঝে ফুয়েরবার্খ, মার্ক্স অন্যতম। তাঁরা যেটা বললেন, ভাব থেকে বস্তু সৃষ্ট নয়, বরং ভাবই বস্তু থেকে সৃষ্ট। মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ফলেই মন বা ভাবের সৃষ্টি। মানুষের মস্তিষ্কেই ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁরা বললেন হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সব ঠিকই আছে শুধু তাকে ভাববাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এভাবেই সৃষ্ট দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত [৫]। এই দ্বন্দ্ব আবার দুই প্রকারঃ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব। কোন বস্তু নিজের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্ব তা হল অন্তর্দ্বন্দ্ব আর একটি বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর যে দ্বন্দ্ব তা হল বহির্দ্বন্দ্ব। তবে মার্ক্স এর ভাষায় এই দুই দ্বন্দ্বের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্বই হল পরিবর্তনের ভিক্তি। বহির্দ্বন্দ্ব কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু যতক্ষন পর্যন্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব পরিপক্কতা লাভ না করে ততক্ষন পর্যন্ত বহির্দ্বন্দ্ব কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এটার উদাহরন হিসেবে বলা যায় যখন কোন সমাজ বা গোষ্ঠী নিজেরা বিপ্লব বা পরিবর্তনের জন্য তৈরি না হয় তখন বাহির হতে কেউ তাদের কোন সাহায্য করলে বিশেষ লাভ নেই।

মানব সভতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে সমাজের অভ্যন্তরেও প্রতি নিয়ত বহুধরনের শক্তির দ্বন্দ্ব চলছে। শ্রেনী, বর্ণ, লিংগ, ধর্ম, জাত, রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ এরকম আরো অনেক বিভাজনের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলছে। তবে মার্ক্স এর মতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সকল দ্বন্দ্বের মূল হল শ্রম ও পুঁজির মধ্যে দ্বন্দ্ব, যা নিয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করবো। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি মূলনীতি বলে আজ শেষ করবো। প্রথমটি হলঃ বিরোধী শক্তির ঐক্য (unity of opposites)[৫]। একটি মানুষের মাঝে যেমন ভাল-খারাপ দুই গুণই বর্তমান, তেমনি সকল বস্তুতে এবং সমাজেও স্ববিরোধী শক্তির সহবস্থান আছে। ধনাত্মক ও ঋনাত্মক চার্জ, ইলেক্ট্রন ও প্রোটন, কিংবা সৌরজগতের আকর্ষন ও বিকর্ষন শক্তি এর উদাহরন। এই পরস্পরবিরোধী শক্তির সাম্যবস্থার কারনে সব স্বাভাবিক ভাবে চলছে। যখন কোন একটি শক্তি অন্যটি অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী হয়ে যায় তখন দ্বিতীয় নীতিটি আসে, তা হলঃ বিকাশের পথে অবলুপ্তি, অবলুপ্তির পথে বিকাশ (Negation of the negation)[৫]। এই নীতির অর্থ হচ্ছে নিছক সৃষ্টি বা ধ্বংস বলে কিছু নেই। সৃষ্টি মানেই হচ্ছে ধ্বংস আবার ধ্বংসের মাঝেই হচ্ছে নুতনের সৃষ্টি। মানব শরীরে যেমন শৈশবের ধ্বংসের মাঝে একজন মানুষ কৈশোরে পদার্পণ করে, আবার সে কৈশোরকে ধ্বংস করেই যৌবনে পদার্পন করে। মার্ক্সের মতে সমাজেও সে রকম এক সমাজ ধ্বংস হয়ে নুতন সমাজ গড়ে উঠে। সবশেষ তৃতীয় নীতিটি হলঃ পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (From quantitative change to qualitative change)[৫]। এই নীতির কথা হল যে সকল পরিবর্তনই গুণগত পরিবর্তন আনে না। যেমন পানিকে তাপ দিলে তা বাষ্প হয় না যতক্ষন না তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হচ্ছে। তেমনি সমাজে হয়তো প্রতিনিয়ত অল্প অল্প পরিমাণগত পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু তা যখন বিশাল আকারে হয় তখনই একে গুণগত বা বৈপ্লবিক বা মৌলিক পরিবর্তন বলা হয়।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। দর্শন নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আর আমি তেমন জানিওনে। দর্শন আমার বিষয়ও নয়। শুধু আমার মূল বক্তব্য ভালভাবে প্রকাশের জন্য একটি হালকা ধারনা দিচ্ছি। শুধু হেগেল কিংবা মার্ক্স এর দর্শন পুরোপুরি বুঝতে, যে কারো সারাজীবন চলে যাবে। আমার মূল উদ্দেশ্য মার্ক্সবাদ আর সমাজতন্ত্রের মাঝে কি পার্থক্য আছে তা খুঁজে বের করা। সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ এর দ্বন্দ্ব থেকে কিছু সমাধান পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা করা। আজ আমরা দেখলাম যে বস্তুবাদ এবং দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কিভাবে আসলো। পরবর্তীতে দেখবো সমাজতন্ত্রের এবং সাম্যবাদের ধারনা কিভাবে আসলো।

তিনঃ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ

সমাজতন্ত্রের ধারণাও মার্ক্সই প্রথম বলেননি। ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯-১৭৯৯) আগে দার্শনিক রুঁসো (Rousseau, ১৭১২-১৭৭৮) রচনা করেছিলেন ‘সামাজিক চুক্তি (social contract)’। যেখানে তিনি বলেন- মানুষ জন্ম নেয় মুক্ত হয়ে, কিন্তু জন্মের পর দেখে চারিদিকে শুধু বাঁধার শেঁকল [৬]। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বলেছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা, যে আইন হবে সকল মানুষের নিজেদের তৈরী আইন- এক ধরণের সামাজিক চুক্তি [৬]। রুঁসো সমাজতন্ত্রের কথা সরাসরি না বললেও তাঁর লেখায় ছিল নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির কথা। যে কারনে ফরাসী বিপ্লব যদিও রুঁসোর মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পর সংঘঠিত হয়, তারপরও ফরাসী বিপ্লবে রুঁসোর দর্শনের অবদান ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির চিন্তা মনে হয় মার্ক্স পেঁয়েছেন এই ফরাসী বিপ্লব থেকেই।

সেইণ্ট সিমন (Saint Simon, ১৭৬০-১৮২৫) ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সন্তান। তাঁর মতে ভবিষ্যত সমাজে সকলকে অবশ্যই কাজ করতে হবে, এবং সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির স্থান নির্ধারিত হবে তার শ্রমের কৃতিত্বগুলো দিয়ে[৭]। তবে রাজনীতিক সংগ্রাম ও বিপ্লব সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক অবস্থান গ্রহন করেছিলেন। ফরাসী বিপ্লবে সর্বহারাদের শাসন কে আখ্যায়িত করেছেন ‘সন্ত্রাসের শাসন’ হিসেবে [৮]। তিঁনি চেয়েছিলেন সরকারি সংস্কারকর্ম আর এক নুতন ধর্মের চেতনায় সমাজের নৈতিক প্রশিক্ষনের ফলেই শ্রেনী-বিরোধের বিলুপ্তি ঘটবে [৭], যা মার্ক্স এবং এংগেলস এর মতে ইউটোপিয়।

পরবর্তীতে ফুঁরিয়ে (Charles Fourier, ১৭৭২-১৮৩৭), তাঁর লেখায় বুর্জ়োয়া সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তবে তিনিও হিংসাশ্রয়ী বিপ্লবের ধারণার বিরোধিতা করতেন এবং মনে করতেন যে ভবিষ্যত সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে শান্তিপূর্ণ প্রচারনের মধ্য দিয়ে-যেখানে লোকে কাজ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে [৭]। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, যে কোন একটি সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হল সে সমাজের নারী মুক্তির মান [৮]।

ইংলেন্ডে যখন শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়, সে সময় ওয়েন (Robert Owen, ১৭৭১-১৮৫৮) একটি সুতাকলের সুপারেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তিনি মনে করতেন যে সামাজিক অসাম্যের প্রধান কারণ যথেষ্ট জ্ঞানালোকের অভাব যা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দ্বারা দূর করা যায় [৭]। তাই যেখানে অন্য কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করতো দৈনিক তেরো-চৌদ্দ ঘন্টা সেখানে তাঁর শ্রমিকরা কাজ করতো সাড়ে দশ ঘন্টা [৮]। তিনি শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কিন্ডারগার্ডেন এর ব্যাবস্থা করেন। যখন কারখানা বন্ধ থাকে তখনো তাঁর শ্রমিকরা পুরো মজুরি পেয়েছে। এ সব সত্ত্বেও তাঁর কারখানার মুনাফা কম হয় না।

সেইণ্ট সিমন, ফুঁরিয়ে কিংবা ওয়েন এরা সবাই সামজিক অসাম্য দূর করতে চেয়েছেন সমাজকে সংস্কারের মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব ইংলেন্ডে সবে মাত্র শুরু হয়েছে, এমন সময় পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার স্বরূপ তাঁদের পক্ষে ধরা অসম্ভব ছিল আর তাই তাঁদের সমাজ সংস্কারের ধারণা ইউটোপিয় হতে বাধ্য বলেই মার্ক্স ও এংগেলস মনে করতেন [৮]।

মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়কালে আরো বেশ কয়েকজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন। যাদের মধ্যে প্রুধুন (Prudhon, ১৮০৯-১৮৬৫), বুকিনিন (Bukinin, ১৮১৪-১৮৭৬), এবং ব্লাঙ্কুই (Blanqui, ১৮০৫-১৮৮১) অন্যতম। প্রুধুন এবং বুকিনিন ছিলেন ণৈরাজ্যবাদী (Anarchism) সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিতা। তাঁরা মার্ক্স এর শ্রমিক শ্রেনীর একনায়কতন্ত্রিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। আর ব্লাঙ্কুই ছিলেন মুলত বিল্পবী চিন্তা ধারণার।

এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি তাতে দেখা যায় যে মার্ক্স এর সাম্যবাদ এর ধারণার পেছনে যে সমস্ত মানুষের অনুপ্রেরণা আছে তাঁরা হলঃ
১। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দর্শনঃ জার্মান দার্শনিক হেগেল।
২। বস্তুবাদ দর্শনঃ আরেক জার্মান দার্শনিক ফুয়েরবাখ।
২। সমাজতন্ত্র অথবা সাম্যবাদ এর প্রাথমিক ধারণাঃ রুঁসো, সেইন্ট সিমন, ফুরিয়ে, ওয়েন।

এর বাহিরে আরো কয়েকজনের কথা উল্লেখ করতে হয়। মার্ক্স এর বস্তুবাদী হবার পেছনে ডারউইন (Darwin, ১৮০৯-১৮৮২) এর বিখ্যাত ‘অন দা ওরিজিন অফ স্পিসিস’ এর অবদানও ছিল [৮]। মার্ক্স এর কাজকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি মুলত দর্শন নিয়ে এবং আরেকটি হল অর্থনীতি নিয়ে। রাজনৈতিক অর্থনীতি (Political Economy) এর উপর মার্ক্সের বেশ কয়েকটি লেখা আছে যেখানে তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর আলোচনা করেছেন। অর্থনীতি একটু কম বুঝি বিধায় সে গুলো নিয়ে আলোচনায় গেলাম না। রাজনৈতিক অর্থনীতির মুল ধারণা তিনি নিয়েছেন এডাম স্মিথ (Adam smith, ১৭২৩-১৭৯০) এবং রিকার্ডো (David Ricardo, ১৭৭২-১৮২৩) থেকে। এর মাঝে স্মিথ কে বলা হয়ে থাকে আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে। স্মিথ তার লেখায় প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা এবং মুনাফার জন্য শোষন এর ব্যাপারটি তুলে এনেছিলেন, যা পরপর্তীতে মার্ক্সকে অনুপ্রানিত করেছে।

সর্বশেষ ব্যক্তিটি হল তাঁর বন্ধু এবং সহলেখক এঙ্গেলস (Engels, ১৮২০-১৮৯৫)। মার্ক্স এর লেখায় আমি একধরণের অস্থিরতা লক্ষ্য করেছি, যা তাঁদের সম্মিলিত লেখায় নেই। আমার মতে তাঁর কারন এঙ্গেলস এর লেখার ধরণ অনেক গোঁছানো। তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনা অনেক পরিষ্কার। এঙ্গেলস অবশ্য নিজে স্বীকার করেন যে সাম্যবাদের মূল ধারণা মার্ক্সেরই [৭], তথাপী এটাও অনস্বীকার্য যে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির স্বপ্ন এঙ্গেলস নিজেও দেখতেন। মার্ক্স এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এর মাধ্যমে এঙ্গেলস দেখলেন যে পুঁজি এবং শ্রেনীর দ্বন্দ্বটি প্রমান করা সম্ভব। যে কারনে সাম্যবাদের বা মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূল্ক বস্তুবাদের উপর বিজ্ঞানের তঁকমা লাগানোর কাজটিও তিনিই করেছেন তাঁর ‘ইউটোপিয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ লেখায় [৮]।

চারঃ সাম্যবাদ

তাহলে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম বা সাম্যবাদের মাঝে পার্থক্য কি? মার্ক্স এর মতেই ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা চান সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমনকি সবচেয়ে সুবিধাভোগীর অবস্থার উন্নতি করতে [৭]। আর মার্ক্সবাদীরা চান কেবল শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি, যা কিনা হবে বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে [৭]। মার্ক্স মনে করতেন না যে সমাজের সকল সদস্যের মুক্তি সম্ভব, তাই এই ধরণের যে কোন চিন্তা ইউটোপিয় হতে বাধ্য। এটা পরিষ্কার যে মার্ক্স নিজেকে মানবতাবাদী বলে মনে করতেন না, বরং মানবতাবাদীদের তিনি আখ্যা দেন রক্ষনশীল বলে যারা আসলে বুর্জ়োয়া সমাজ ব্যবস্থাকেই রক্ষা করতে চায় মানবতার আড়ালে [৭]।

এবার দেখা যাক মার্ক্সবাদের মূল ধারণা কি এবং তা কিভাবে আসলো। মার্ক্স হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে বস্তুবাদের উপর দাঁড় করিয়ে দেখলেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস [৭]। ডারউইন তার বিবর্তনবাদে যেমন দেখালেন যে প্রকৃতিতে সব সময় বিবর্তন হচ্ছে এবং যোগ্যতমরাই টিকে থাকছে, সে রকম মার্ক্সও দেখলেন যে মানব সমাজে সর্বত্র অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চলছে, এবং একটি সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার উপর আরেকটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। প্রাচীন রোমান যুগে ছিল দাসভিত্তিক সমাজ। পরে মধ্যযুগে সেটা ভেঙ্গে হয় সামন্তপ্রথা সমাজ। সামন্তপ্রথা হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশের জমিদারী প্রথার মত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে মধ্যযুগে এই সামন্তপ্রথার সমাজই ছিল। আধুনিক যুগে সেই সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে হল বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা যা মার্ক্স এর মতে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা। মার্ক্স এর মতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে মধ্যবিত্ত শ্রেনী পুরোনো সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করে আজকের এই সমাজ, যার সুচনা হয় ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে [৭]।

আধুনিক এই বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট কি? ব্যক্তি স্বাধীনতা, অবাধ বানিজ্য, ব্যক্তি মালিকানা, পুঁজিবাদ। এ সবই হল বৈশিষ্ট, কিন্তু বুর্জ়োয়া বা পুঁজিবাদী সমাজের মুল দ্বন্দ্ব কি – তা হল পুঁজি এবং শ্রমের দ্বন্দ্ব। এখন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির নিয়ম অনুসারে এই পুঁজি এবং শ্রম তারা বিরোধাত্বক, অর্থাৎ তারা একত্রে অবস্থান করতে পারেনা। তারা একে অপরকে উচ্ছেদ করতে চায়। পুঁজির কাজ হল শ্রমকে শোষন করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। শ্রমিক শ্রেনী যতদিন পর্যন্ত না পুঁজিকে উচ্ছেদের মত শক্তি অর্জন করছে, ততদিন তারা সহবস্থান করবে। যখনি সেই শক্তি অর্জন করবে তখন পুঁজির পতন অনিবার্য। এই হল স্বল্প কথায় মার্ক্স এর মুল তত্ব।

এখন মার্ক্স এই তত্ব কিভাবে পেলেন? মার্ক্স(১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়টা এমনই যে তখন ইউরোপের চারিদিকে শিল্পের ব্যাপক প্রসার। স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে সর্বত্রই কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এই সব কারখানায় কাজ করে প্রচুর শ্রমিক। ১৮২৫ সালে ইংলেন্ডে প্রথম একটি অর্থনৈতিক মন্দা আসে [৮], যার কারনে প্রচুর শ্রমিক চাকুরী হারায়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা তখন অঙ্কুরে বিধায় মন্দা প্রায় দশ বছর পর পর দেখা দিত [৮], আজ যেটা অনেক বছর পর দেখা দেয়। ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত এরকম মন্দা আসে পাঁচবার এবং ১৮৭৭ সালে আসে ষষ্ঠবার [৮]। বলাই বাহুল্য যে মার্ক্স এই সব মন্দা এবং এর ফলাফল খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং একই কথা প্রযোজ্য এঙ্গেলস এর জন্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে বেশ ভাল ভাবে ধরেছিলেন। কিভাবে এই মন্দা আসে এবং এই মন্দার চিত্র তিনি বেশ ভাল ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। একের পর এক কারখানা গড়ে উঠার ফলে, উৎপাদন হয়ে যায় প্রচুর। এক পর্যায়ে অতিপ্রাচুর্যের ফলে অনেক উৎপন্ন পন্য অবিক্রিত থেকে যায়, কারখানা লোকসান দেয়। কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকেরা চাকুরী হারায়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরো কমে যায়, পন্য বিক্রি আরো কমে যায়। এভাবেই চলতে থাকে যা ঠিক হতে কয়েক বছর লেগে যায়- ঠিক যেন আমাদের এখনকার (২০০৯ সালের) মন্দারই চিত্র।

এরকম একটি চিত্র থেকে মার্ক্স তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়োগে স্বিদ্ধান্তে আসলেন যে, বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থা যেমন সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে উৎপত্তি, তেমনি বুর্জোয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরি হবে নুতন একটি সমাজ ব্যাবস্থা। এটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দ্বিতীয় সুত্র ‘বিকাশের পথে অবলুপ্তি (Negation of the Negation)’ থেকে পাই। সেই নুতন সমাজ হবে প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেনীর সমাজ। তিনি ভাবলেন যেভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিচ্ছে, অচিরেই শ্রমিক শ্রেনী হবে সংখ্যায় গরিষ্ঠ। আর সেই শ্রেনী একদিন এই বুর্জ়োয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করবে কমিউনিষ্ট সমাজ। কমিউনিষ্ট পার্টির কাজ হচ্ছে সেই শ্রমিক শ্রেনীকে সংঘবদ্ধ করা, তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে সাহায্য করা।

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল। মার্ক্সবাদ এর সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কিভাবে আসলো। বিজ্ঞান যেভাবে তত্ব প্রদান করে যা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য, সে রকম মার্ক্সও সমাজের ক্ষেত্রে তার তত্বটি দিয়েছিলেন। মার্ক্স যেমন বলেন নি যে শ্রমিক শ্রেনীর সংঘবদ্ধ হওয়া উচিৎ বা তাদের ক্ষমতায় যাওয়া উচিৎ তাদের মুক্তির জন্য। তিনি বলেছেন শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি আর বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংস দুইই অনিবার্য [৭]। অর্থাৎ এটি বস্তুবাদের ইতিহাসের নিয়মে বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সুত্র অনুসারে হবেই, এক ধরণের প্রেডিকশন (ভবিষ্যতবানী)। বলাই বাহুল্য সে রকম কিছু হয়নি আজো। বব্রং আধুনিক সমাজ এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বেশ ভাল ভাবেই আছে এবং থাকবে।

তাহলে মার্ক্স এর তত্বের ভুল কোথায়? কোথায় মার্ক্স ভুল বুঝেছেন? আমি বলবো প্রতিটি দার্শনিক বা গবেষক যেমন তাঁর সময়কাল দ্বারা আবর্তিত, তেমনি মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি দেখতে পারেননি। পুঁজিব্যবস্থা তখন সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে আমি বলবো। এটা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স এর পর প্রায় দেড়শত বছর পার হয়ে গেলেও বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অনেক ভুল আছে, যার কারনে এখনও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। কিন্তু সেটা কেটে যায়, তা থেকে মানুষ নুতন কিছু শিখে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরো সুসংহত হয়।

আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুবই জটিল একটি ব্যাপার। একক ভাবে মানুষ নিজে একটি জটিল প্রানী। তার মাস্তিষ্কের ব্যবহার অন্য যে কোন প্রানী থেকে অনেক বেশী বিধায় তাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এমন কোন তত্ব নেই যা দিয়ে বলা সম্ভব মানুষ একটি অবস্থায় কিভাবে নিজেকে বদলে নিবে বা কাজ করবে। অতীত ইতিহাস দেখে আমরা একটি ধারণা করতে পারি, কিন্তু সেটা ঘটবেই বলতে পারি না। আর এই মানুষ যখন গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবে চলে, যখন একটি সমাজ গঠন করে, সেই সমাজে উক্ত মানুষগুলো কিভাবে চলবে সেটা কোন তত্ব দিয়ে প্রকাশ করা আরো অসম্ভব। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর সমাজ ব্যবস্থা দুইই সরাসরি ব্যক্তি ও গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষের কাজের সাথে জড়িত। এই দুই ব্যবস্থা এতই নন-লিনিয়র (Non-linear) এবং নন-ডিটারমিনিষ্টিক (Non-Deterministic) যে সমাজ বিজ্ঞানে বা অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে সে রকম কোন নির্দিষ্ট তত্ব নেই। যা আছে তা কোন নির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকতার ক্ষেত্রে কিছু ইম্পিরিকাল (empirical) সুত্র।

একটি নন-লিনিয়র চিত্রের উদাহরণ যদি দেই তাহলে আরো পরিষ্কার হবে। সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিচলণ প্রক্রিয়া। আমাদের জলবায়ুর মডেল আছে, তাত্বিক সুত্র আছে- তথাপি এই প্রক্রিয়া নিজেই এত নন-লিনিয়র যে সে প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে প্রেডিক্ট করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা সর্বোচ্চ পাঁচদিন পর্যন্ত প্রেডিকশন করতে পারি, তারপরেও বলা হয়ে থাকে ৩০% বা ৬০% বৃষ্টি হবার সম্ভবাবনার কথা। কোন ভাবে হয়তো এই মুহুর্তের কথা বলতে পারবো, যদি পর্যাপ্ত তথ্য থাকে, বা পরবর্তী এক ঘন্টার কথা বলতে পারবো কিন্তু এক মাস পর কি হবে তা বলা অবাস্তব বা ইউটোপিয়। যে কারণে আজকের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না ঠিক কোন পদ্ধতিতে বা কবে বর্তমান মন্দা দূর হবে।

নন-লিনিয়র প্রক্রিয়ার এর আরেকটি মজার দিক রয়েছে, যা তার প্রেডিকশনকে আরো কঠিন করে তুলে। তা হল এক কথায় ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’। বলা হয়ে থাকে আজ যদি বাংলাদেশে কোন একটি প্রজাপতি তার পাখা নাঁড়ায় আর সেই সঞ্চালণ, নন-লিনিয়র এফেক্ট এর কারণে বাড়তে বাড়তে নিউইয়র্কে বৃষ্টি ঘটাতে পারে। যেমন ঘটতে পারে – কোন এক পথচারীর আকষ্মিক মৃত্যু, যা রূপ নিতে পারে বিশাল ভাংচু্রে। সেখানে কিছু হলে সেটা আরো বড় আকার হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।

এরকম একটি জটিল সামাজিক এবং অর্থৈতিক ব্যবস্থাকে অঙ্কুরে দেখে যে তত্বই দেওয়া হোক না কেন তা কাজ না করাটাই স্বাভাবিক, বরং যদি কাজ করে আমি বলবো সেটাই কাকতলীয়। তা হলে মার্ক্স এর দর্শনের সব কিছু কি ভুল? না তা নয়।

পাঁচঃ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র

আমি মার্ক্স এর কমিউনিষ্ট পার্টির ইস্তেহারের প্রথম কথা দিয়েই শুরু করছি। তিনি বলছেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস [৭]। কথাটি আমি বলবো আংশিক সত্য। এ কথা ঠিক যে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে আমরা বেঁচে থাঁকার জন্য সংগ্রাম করি। সেই সংগ্রাম হয় প্রকৃতির সাথে আমাদের, প্রকৃতির অন্য প্রানীদের সাথে আমাদের এবং আমাদের নিজেদের সাথে নিজেদের। যখনই উৎপাদন এর তুলনায় চাহিদা বেশি থাকবে তখনই দ্বন্দ্ব থাকবে। আজ পর্যন্ত যত সংগ্রাম হচ্ছে তা হচ্ছে সেই চাহিদা আর উৎপাদনের মাঝে ব্যবধান এর জন্য। সেই সংগ্রাম ভিন্ন শ্রেনীর মধ্যে হতে পারে আবার নিজস্ব শ্রেনীর মাঝেও হতে পারে। পৃথিবীতে যদি কোন সাদা-কালো না থেকে শুধু সাদারাই থাকতো তবে কি রক্ত ঝরতো না? যদি কোন বুর্জোয়া শ্রেনী না থেকে শুধু শ্রমিক শ্রেনী হয় তবে কি কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না? বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চলবে যতদিন পৃথিবীতে সম্পদের উৎপাদন তার চাহিদার তুলনায় কম থাকবে। যদি সমাধান খুঁজতেই হয় তবে চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যাবধান কমাতে হবে। তা জনসংখ্যা সীমিত করে বা উৎপাদন এর পরিমাণ বাড়িয়ে।

তবে হ্যাঁ একটি সুষ্ঠ সামাজিক ব্যবস্থা দরকার যা চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যবধানকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করবে। মার্ক্স তাঁর দর্শনে যেটা বলার চেষ্টা করেছেন তা হল বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা সেটা করছি না। যার কারনে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছেকৃত ভাবে চাহিদার পরিমাণকে বাড়িয়ে রাখা হয় শুধু মাত্র পন্যের মান ধরে রাখার জন্য। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ম বানানো হয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেনীর তাঁদের সুবিধার্তে। জনগণের করের টাকায় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেনী বা নিম্ন বিত্তের জন্য করা হয় কম। রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিৎ করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হয়ে উঠে শোষনের যন্ত্র। এ ধরণের সমাজ ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের ব্যবধান শুধু বৃদ্ধি পায়। মার্ক্স এটাকেই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফল (Output) হিসেবে বলেছেন। কিন্তু আমি একে পুঁজিবাদ এর দোষ বলবো না। আমি বলবো এটা মানুষের মানসিকতার সমস্যা, নৈতিকতার দৈন্যতার প্রকাশ। এবং এই সমস্যা যে কোন সাম্যবাদী দলের শাসনের ক্ষেত্রেও হতে পারে যদি মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটায়। যেমনটি আমরা দেখতে পাই বর্তমান কমিউনিষ্ট শাসিত দেশ গুলোর ক্ষেত্রেও।

মার্ক্স সমাজ ব্যবস্থার এই ত্রুটিকে ভালভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং খুব ভাল ভাবে বুঝেছেন যে শুধু শাসক গোষ্ঠির পরিবর্তন বা শাসন ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াদের দূর করালেই সমাজে পরিবর্তন হবে না, করতে হবে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। যে কথাটি আমার মতে আজো প্রযোজ্য। শুধু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞাটিকে একটু বদলাতে হবে। শিল্প বিপ্লবের সময়কালে মার্ক্স দেখেছিলেন শুধু দু’টি শ্রেনী- বুর্জ়োয়া আর প্রলেতারিয়েত। সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় এই দু’টি শ্রেনীই প্রধান ছিল। মার্ক্স এর ভাষায় নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীরাও স্বল্প পুঁজির কারণে এক সময় প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে পরিণত হবে [৭] এবং পুঁজি আরে শ্রমের দ্বন্দ্বে প্রলেতারিয়েতের সংখা বৃদ্ধি পাবে [৭]। কিন্তু আজ যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো সমাজে এখন স্পষ্টতই তিনটি শ্রেনী। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে আমরা আরো কিছুটা ভাগ করতে পারি, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে। আজকের সমাজে যদি বুর্জোয়া বলতে হয় তবে আমি বলবো উচ্চবিত্ত আর উচ্চ-মধ্যবিত্তদের। আর যদি প্রলেতারিয়েত বলতে হয় তবে বলবো নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর নিম্ন বিত্তদের। আজকের যুগের বিশাল এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অবস্থান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অঙ্কুরকালে তেমন প্রকট ছিল না, এবং এই শ্রেনীটি মার্ক্স এর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি শুধু বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে ধরে নিয়ে এগিয়েছেন এবং আমার মতে মার্ক্স এর প্রধান ভুলটি এখানেই। আজ যদি কেউ এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়া শ্রেনীর মাঝে ফেলে চিন্তা করে তবে তিনি আরো বড় ভুল করবেন। কারণ আজ এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীই সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী।

সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আর শাসক গোষ্ঠির পরিবর্তন এর মধ্যকার পার্থক্যটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই যদি উদাহরণ দিয়ে বলি- আগে শাসক গোষ্ঠি ছিল মোঘলরা, তারপর এল ইংরেজরা, তারপর -পাকিরা, তারপর আওয়ামী লিগ, বিএনপি, এরশাদ। কিন্তু মানুষের প্রকৃত মুক্তি কখনই আসেনি। এর কারন সেই সমাজ ব্যবস্থাটির কখনো পরিবর্তন হয়নি। শাসকদের মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি আমাদের রাষ্ট্রের মানসিকতা। যারাই শাসন করেছে তারা সাধারন জনগণকেই শোষন করেছে। সেই সমাজ ব্যবস্থাটির পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রের সুবিধে বঞ্চিত মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। ঋণখেলাপী ব্যবসায়ী, দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্থ আমলা, এদের সুবিধার্তে রচিত শাসন ব্যাবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আজকের যুগে এরাই প্রকৃত বুর্জোয়া। তাদেরকেই শাসনের ক্ষমতা থেকে উতখাত করতে হবে। সৎ ও যোগ্য রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় আনতে হবে। তারপর সংবিধান সংশোধন করে সকল দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাবিদদের হাত হতে দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দিতে হবে। সমাজতন্ত্র মানে সকল মানুষ সমান তাই নয়। মানে হল সকল মানুষের সমান সুযোগ সুবিধে প্রদান। সকলের জন্য মৌলিক চাহিদার সমান সুযোগ। সকলের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ। তারপর যার যার যোগ্যতার ভিক্তিতে যে যার মত অবস্থানে যাবে।

মার্ক্স গোলমাল করে ফেলেছেন সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের পথ খুঁজতে গিয়ে। সকল সমস্যার সমাধান তিনি দেখেছেন প্রলেতারিয়েতের শাসনে। কিন্তু বর্তমানে বা উত্তর আধুনিক যুগে প্রলেতারিয়েত শ্রেনী সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী নয়। সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেনী। তাই প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসন কখনই মার্ক্সের সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন হতে পারে না, অন্তত আজকের যুগে। তাছাড়া মার্ক্স এর এই প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসনের প্রক্রিয়ায় কিছু স্ববিরোধিতা আছে বলে আমি মনে করি। যেমন তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বুর্জোয়া শ্রেনীর মধ্য থেকে কোন ভাল দল এসে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি ঘটাতে পারবে না। আমার মত প্রকৌশলীরা, অর্থনীতিবিদরা, সমাজসেবীরা সবাই বুর্জোয়া, তাই আমাদের প্রদত্ত সমাজতন্ত্রও বুর্জ়োয়া বা রক্ষনশীল সমাজতন্ত্র [৭]। এমন কি পেটি-বুর্জোয়া (নিম্ন মধ্য বিত্ত) শ্রেনীও সেটা করতে পারবে না। পারবে শুধু প্রলেতারিয়েত শ্রেনী যদি বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়াদের উৎখাত করে। কিন্তু প্রলেতারিয়েত শ্রেনী কিভাবে সংঘঠিত করবে এই বিপ্লব? মার্ক্স এর মতে সেটা হবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের মাধ্যম্যে যা একদিন রূপ নিবে বিশাল পরিবর্তনে (দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তৃতীয় সুত্র (পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (From quantitative change to qualitative change)))। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্রমিক আন্দোলন গুলো হতে শ্রমিক শ্রেনী আস্তে আস্তে তার অবস্থান সম্পর্কে সচেতণ হবে এবং একদিন এই সমাজ ব্যবস্থা বদলের জন্য, কমিউনিষ্ট সমাজ গঠণের জন্য বিপ্লবের পতাকাতলে একত্রিত হবে।

কিন্তু বিপ্লব এক জিনিস আর একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা ভিন্ন জিনিস। শোষনে অতিষ্ঠ হয়ে যে কোন সমাজ, জাতি বা দেশ নিজেদের মুক্তির জন্য বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতেই পারে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থা থেকে অন্য আরেকটি সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তর কিভাবে সম্ভব তা শ্রমিক শ্রেনী কিভাবে শিখবে তা তিনি বলেননি। এই দ্বান্দিক বস্তুবাদ, ইতিহাসের শ্রেনীর সংগ্রাম এ সব কিভাবে প্রলেতারিয়েতরা জানবে তা তিনি বলেননি। আমি যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখি লেনিন, মাও, ফিডেল ক্রাষ্টো এরা কেউই প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে আসেননি। তাঁরা সবাই রীতিমত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন, সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণাগুলো লাভ করেছেন, তার পর তাঁরা বিপ্লব সংঘঠিত করছেন। আর মার্ক্স কিংবা এঙ্গেলস তাঁরা নিজেরাও কি প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে এসেছেন? এক জনকে আমি বলতে পারি যিনি প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে উঠে এসেছেন তিনি হল – স্টালিন। তাই তাঁর শাসনের সহিংসতা ছাড়িয়ে যায় সকলকে, যা ‘The Soviet Story ’ ডকুমেন্ট্রিটিতে উঠে এসেছে।

তাই শ্রমিক শ্রেনী যে শুধু তৈরী শাসন ব্যবস্থাটিকে পেলেই যে সমাজের পরিবর্তন হবে না সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন প্যারিস কমিউনে (১৮৭১) কমিনিউষ্টদের দুই মাসের শাসন কালে। ১৮৭২ সালের ইস্তেহারের মুখপত্রেই যা তিনি স্বীকার করেছেন [৭]। মার্ক্স তরুণ বয়সে বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সে পথ থেকে সরে এসেছিলেন, যার নমূণা পাই ১৮৭২ সালে আমর্স্টাডাম এ দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে, যেটা আমি পাই কার্ল কাউটস্কি এর ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি ভার্সাস কমিউনিজম’ লেখায় [৯]। যেখানে তিনি বলেছেন- “ শ্রমিকদের অবশ্যই কোন একদিন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, নুতন সামাজিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে। তাদের অবশ্যই পুরাতন রাজনৈতিক যন্ত্রটিকে উতখাত করতে হবে যা কিনা ক্রিষ্টিয়ানদেরর জীর্ণ কাঠামোর উপর গঠিত। কিন্তু এই অর্জনের পন্থা সর্বত্র একই রকমের হতে পারে না। আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন দেশের বর্তমান কাঠামো, সংস্কৃতি, রীতিণীতি এই সমস্ত বিষয়কে চিন্তায় রাখতে হবে। আমরা এটা অস্বীকার করতে পারিনা যে-কিছু দেশ যেমন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কিংবা হলান্ড- সেখানে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের লক্ষে পৌছতে পারে যা অন্য সব দেশে সম্ভবপর নয়।” এখানে তিনি স্পষ্টতই সে সব দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শ্রমিক শ্রেনীর লক্ষ্যে পৌছার কথা বুঝিয়েছেন।

মার্ক্স শ্রমিক শ্রেনীর শাসনের মাঝ দিয়ে সমগ্র সমাজের মুক্তির পথ দেখেছেন। তাতে যদি বুর্জোয়া সমাজ ধ্বংস হয়, মানুষের মনে সহিংসতা আসে তাতে তিনি বিচলিত নন। যে কারনে মার্ক্স এর এই পন্থা অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। যারা মানবতাবাদী, সমগ্র মানব জাতির মুক্তি চায়-নির্দিষ্ট কোন শ্রেনীর মুক্তি চায় না- তাদের পক্ষে জেনে শুনে মার্ক্সবাদ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আমিও নিজেকে মানবতাবাদী হিসেবেই দেখতে চাই। সমগ্র মানবের মুক্তি কামনা করি, একটি সুষ্ঠ সমাজের স্বপ্ন দেখি। বোমা মেরে, নিরীহ মানুষ মেরে যেমন ধর্মের প্রচার করা অসম্ভব বলে মনে করি তেমনি বিপ্লব করে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিও অসম্ভব বলে মনে করি। যে পন্থাই অবলম্বন করতে আপনি চান তা সর্বপ্রথম সেই সমস্ত মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হতে হবে যাদের মুক্তি আপনি চান। এ রকম একটি অবস্থা থেকেই আমি মনে করি যে গণতান্ত্রিক উপায়েই সম্ভব একটি নুতন সমাজ ব্যবস্থা চালু করা। যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পৌছে দিতে পারেন আপনার দলের আদর্শ কি, কিভাবে আপনার দল ক্ষমতায় গেলে সমাজ ব্যস্থায় কি ধরণের পরিবর্তন আনবে ও কেন, তা হলে আমার বিশ্বাস তারা তা গ্রহন করবে। আর যদি তারা আপনার আদর্শ গ্রহন না করে, তবে সহিংস পদ্ধতিতে যদিও আপনি সাময়িক ক্ষমতা লাভ করেন, একদিন তা ইতিহাস হয়েই যাবে।

সমাজতন্ত্র মানেই যে ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ, বা সকল কিছু রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হতে হবে তা নয়। আজ অনেক দেশে মিশ্র অর্থনীতি বিরাজমান। রাষ্ট্রীয় তদাকরীতে বেসরকারীভাবে সব কিছু চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করছে। আমেরিকার কথা বিস্তারিত বলতে পারবো না, কিন্ত কানাডায় পাঁচ বছর ধরে আছি দেখছি- এখানে বিনামূল্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পাবেন, বাচ্চাদের পড়াশুনা পাবেন। আঁয় ভাল না হলে স্বল্প ভাড়ায় সরকারী বাসা পাবেন, বেকার ভাতা পাবেন। কোন কিছু জানতে চাইলে সমস্ত তথ্য ইন্টারনেট এ দেওয়া আছে, ফোন লাইন দেওয়া আছে, জানতে পারবেন। এরা সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক অধিকার গুলো বাস্তাবায়নের চেষ্টা করছে। উন্নত দেশেও যে সমস্যা নেই তা নয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান নেই, বেকারত্ব নেই, অপরাধ নেই তা নয়। যেখানেই সমাজ আছে তা থাকবেই এবং সে গুলো দূর করার চেষ্টাই হল আদর্শ রষ্ট্রের কাজ।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখন যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজনঃ
১। একটি আদর্শ নির্ভর তৃতীয় শক্তির দল। একটি যোগ্য নেতৃত্ব দেবার মত একটি দল। যাদের প্রধান উদ্দেশ্য হবে রাষ্ট্রীয় তত্বাবধানে (পরিচালিত নয়) দেশীয় শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করা। দেশের অর্থনীতিকে সবল করা। দেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে একটি মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। রপ্তানী নির্ভর শিল্প গড়ে তুলা।
২। দেশের সকল বিভাগ হতে দুর্নীতি দূর করা। বিচার ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা, এবং সচিবালয় বা সরকারী ব্যবস্থাকে স্বাধীন ভাবে নিজ নিজ বিভাগের রুলস অনুসারে চলতে দেওয়া। প্রয়োজন হলে দেশের সকল সরকারী/বেসরকারী বিভাগের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করে দেওয়া, যার বাহিরে কেউই চলতে পারবে না।
৩। দেশের জনসংখ্যার বিষ্ফোরন রোধ করা। বিশাল জনসংখ্যাকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রতিটি মানুষকে একটি জাতীয় নম্বর দেওয়া যেতে পারে, যার বিপরীতে তার যাবতীয় (জন্ম, আয়, চাকুরী, সম্পত্তি, বিবাহ, সন্তান, বিদেশ গমন, যা যা সম্ভব) তথ্য থাকবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই নম্বর প্রদান করতে হবে, তাতে করে একই নামে অঢেল সমপত্তি বা কর ফাঁকি, বা বহু বিবাহ সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রন করা সহজ হয়ে যাবে।

আমাদের দেশের শাসকেরা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশ পরিচালনা করে থাকে, কখনো বা দলীয় স্বার্থে। দেশের স্বার্থ বিবেচনা বা সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের চিন্তা তাঁরা কখনই করে না। অথচ শুধু মাত্র পাঁচ বছরই যদি দেশের স্বার্থের কথা বিবচনা করে দেশ পরিচালনা করতো তবে আজ আমাদের দেশ প্রভুত উন্নতি করতে পারতো। এটা আমরা সবাই জানি। সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ও জানে এটা। গত দশ বছরে দেশের মোবাইল, বেসরকারী টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা, ইন্টারনেট এর বদৌলতে এখনকার মানুষ আগের তুলনায় অনেক সচেতন। মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে পায় না। তাই হতাশ হয়ে মইন বা ইউনুস বা ফখরউদ্দিন যাকে পায় তাকেই ধরার চেষ্টা করে। আমি আমাদের প্রজন্মকে অনুরোধ করবো রাজনীতিতে আসুন। নুতন দল গঠন করুন। সেই আদর্শের বানী নিয়ে প্রতিটি জনগণের কাছে যান। ভুলে যান অতীতের ব্যর্থতা। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন প্রতিটি সমাজে, জাতিতে, এ রকম ক্রান্তিকালে তাদের নব জাগরন হয়েছে। আমাদের দেশেও সেই নব জাগরনের সূচনা হোক আমাদের হাত ধরে।

আমার এই লেখার মুল উদ্দেশ্য বিশেবিদ্যালয়ে পড়ুয়া সেই সব মেধাবী ছাত্রদের প্রতি যারা মানুষের জন্য একটি নুতন সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যে নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় করে চলে আর জাতিকে উপহার দেয় পরবর্তিতে কিছু হতাশাগ্রস্থ যুবক। এটা যতটা না তাদের ব্যর্থতা তার চেয়ে বেশী হল আমাদের তথাকথিত বাম রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা। আমার কথা হল- ইস্তেহারটি নিজে পড়, সাথে মার্ক্স এর আরো কিছু বই পড়, এংগেলস এর কিছু লেখা পড়। সব লেখাই http://www.marxists.org/ এই ঠিকানায় পাওয়া যায়। তারপর নিজের বিবেচনা বুদ্ধি কাজে লাগাও। অন্ধের মত যে কোন কিছু বিশ্বাস করাকে আর যাই বলুক প্রগতিশীল বলা যায় না। একটি নুতন সমাজ গড়ার আগে নিজেকে গড়তে হবে। তার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে। প্রতিটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। সর্বোপরি মানব সভ্যতার ইতিহাসটুকু জানতে হবে।

১. http://en.wikipedia.org/wiki/Materialism
২. http://en.wikipedia.org/wiki/Dialectic
৩. http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_philosophy
৪. http://www.marxists.org/reference/archive/hegel/index.htm
৫. মার্ক্সবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক- শিবদাস ঘোষ http://www.ganadabi.in/works1/marxism_b.pdf
৬. http://www.marxists.org/reference/subject/economics/rousseau/social-contract/ch01.htm
৭. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1848/communist-manifesto/istahar.pdf
৮. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1880/utopia/Socialism,%20Utopian%20and%20Scientific.pdf
৯. http://www.marxists.org/archive/kautsky/1930s/demvscom/index.htm

পরিশিষ্টঃ আজকের যুগে প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া কারা

[লেখাটি লিখার পর অনেকেই নানান মন্তব্য করেছেন। তবে একজন মার্ক্সবাদী, তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি প্রলেতারিয়েত বা বুর্জোয়ার সজ্ঞা সঠিক বুঝতে পেরেছিলাম কিনা। সাধারনত আমি মুল বইয়ের কোন উদ্ধৃতি সরাসরি দিই না। আমি মনে করি একটি নির্দিষ্ট লাইন তুলে দিয়ে কখনই একজন লেখকের পুরো বক্তব্য বুঝানো যায় না, তার জন্য মুল বই পুরো পড়তে হয়। উক্ত মন্তব্যের জবাবে আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি মার্ক্স এর ভাষায় কাদের তিনি প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া বলেছেন এবং সেই সজ্ঞা মেনে আমি আজ উত্তর আধুনিক যুগে কাদের প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া বলবো]

যা হোক – কমিউনিজমের মূলনীতি [১] থেকে প্রলেতারিয়েতের যে সজ্ঞাটি পাইঃ

“The proletariat is that class in society which lives entirely from the sale of its labor and does not draw profit from any kind of capital; whose weal and woe, whose life and death, whose sole existence depends on the demand for labor – hence, on the changing state of business, on the vagaries of unbridled competition. The proletariat, or the class of proletarians, is, in a word, the working class of the 19th century. “

একই বইয়ের [১] আরো এক স্থানে তিনি বলেছেনঃ

“The class of the wholly propertyless, who are obliged to sell their labor to the bourgeoisie in order to get, in exchange, the means of subsistence for their support. This is called the class of proletarians, or the proletariat. “

সুতরাং এই দুই সজ্ঞা থেকে এবং মার্ক্স ও এংগেলস আর অন্যান্য লেখা থেকে আমি যা বুঝেছি – প্রলেতারিয়েত হল তারাই যারা জীবন ধারণের জন্য তাদের শ্রম বিক্রি করে এবং যারা কোন লভ্যাংশ পায়না তাঁদের সে শ্রম দ্বারা তৈরী পূঁজি বা মুনাফা হতে। প্রলেতারিয়েতের কোন নিজস্ব সম্পত্তি নেই, যার কারনে তাঁদের শ্রম বিক্রি ব্যাতীত অন্য কোন উপায় নেই বেঁচে থাকার জন্য। সেই শ্রমের বিনিময়ে যেটুকু মুজুরী পায় তা দিয়ে তাঁরা কোনমতে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু কোন সম্পত্তি গড়তে পারে না। শিল্প বিপ্লব এর সময়কালের ইংল্যান্ডে তাই মার্ক্স প্রলেতারিয়েত বলতে বুঝিয়েছেন তখনকার কারখানার কর্মজীবি শ্রমিক শ্রেনীদের।

ঠিক এ কারনেই আমি বুঝি আজকের যুগে প্রলেতারিয়েত হল আমাদের দেশের খেঁটে খাওয়া মানুষেরা, যারা শুধু শ্রম বিক্রি করে জীবন ধারণ করে থাকে। যারা দিন আনে দিন খায়। কোন বেলা কাজ না থাকলে তাদের সংসারে খাবার থাকে না। তাঁদের আয় এতই কম যে তা মৌলিক চাহিদা পূরোনেও যথেষ্ট নয়। এ কারনেই আমি আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা নিম্ন বিত্ত শ্রেনীকে বলেছি প্রলেতারিয়েত হিসেবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় – গার্মেন্টস কর্মী, বর্গা চাষী, দৈনিক মুজুর, রিক্সাচালক, সরকারী/বেসরকারী চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেনী সংখ্যা গরিষ্ঠ কিনা তা আমি জানি না, তবে তাদের সংখ্যা যে অনেক তাতে কোন সন্দেহ নেই। একই কারনে আমি মনে করি না আমার বা আপনার মত পেশাবিদ শ্রমিকেরা প্রলেতারিয়েতের শ্রেনীতে পরি। কারন আমরা যে মুজুরী পাই তা থেকে উদ্ধৃত থাকে এবং তা দিয়ে আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানাতে পারি, যদিও আমরাও শ্রম বিক্রি করেই জীবিকা অর্জন করে থাকি।

উন্নত পুঁজিবাদী দেশে কোন প্রলেতারিয়েত শ্রেনী পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কারণ সেখানে শুধু শ্রম বিক্রির আয় ছাড়াও সরকার থেকে অনেক ধরণের সুবিধে পাওয়া যায়, যেমন বিনামুল্যে চিকিৎসা, সাবসিডাইজড বাসা, বিনামুল্যে পড়াশুনা ইত্যাদি। এগুলো আসে জনগণের ট্যাক্স এর টাকা থেকে। এবং ট্যাক্স আসে উচ্চ আয়ের লোকদের কাছ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের থেকে। সুতরাং সেখানে নিম্নবিত্তের লোকেরাও ঘুরিয়ে রাষ্ট্রে মাধ্যমে এক ধরণের লভ্যাংশ/সেবা পায়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখবেন যে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বছর শেষে বেতনের বাহিরেও প্রতিষ্ঠানের মূল লভ্যাংশের ভাগ পায়। সে ক্ষেত্রেও এদেরকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে ফেলতে পারবেন না।

এবার আসি বুর্জোয়া প্রসংগে। একই বইয়ে [১] তিনি বলেছেন-

“The class of big capitalists, who, in all civilized countries, are already in almost exclusive possession of all the means of subsistance and of the instruments (machines, factories) and materials necessary for the production of the means of subsistence. This is the bourgeois class, or the bourgeoisie. “

বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।

মার্ক্স এর সময়কালে হয়তো ইংল্যান্ডে মধ্যবিত্তেরাই বেশী ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিল। উচ্চবিত্তের প্রচুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকার কারনে তাঁরা সেই সব সম্পত্তির থেকে প্রাপ্ত খাঁজনা থেকেই জীবিকা অর্জন করতো। এ কারনেই হয়তো মার্ক্স সে সময়কার মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছিলেন, এবং যাদের ধ্বংসের মাঝে দিয়ে নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আমি সকল ব্যবাসায়ী বা পূজিঁপতিদের কে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলতে রাজী নই। সে কারনেই রাজী নই আজকের যুগের মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়ার সজ্ঞায় ফেলতে। আমি যা বুঝেছি তা হল বুর্জোয়া তারাই যারা সমাজকে শোষণ করে অন্যায়ের মাধ্যমে, অসৎ পথে, দূর্ণীতির মাধ্যমে। তাঁরাই দেশের শত্রু হতে পারে, সমাজের শত্রু হতে পারে, সকল ব্যবসায়ী বা পূঁজিপতি নয়। তাই বলেছিলাম আজকের যুগে আমার চোঁখে বুর্জোয়া হতে পারে – দূর্ণীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, দূর্ণীতিগ্রস্থ আমলা, দূর্ণীতিগ্রস্থ পেশাবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপী ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী ইত্যাদি।

আমি খুব চিন্তিত ছিলাম আমি নিজে কোন শ্রেনীতে পড়ি তা নিয়ে। সেটার জবাব পেলাম ইস্তেহারে [২]।

“A part of the bourgeoisie is desirous of redressing social grievances in order to secure the continued existence of bourgeois society. To this section belong economists, philanthropists, humanitarians, improvers of the condition of the working class, organisers of charity, members of societies for the prevention of cruelty to animals, temperance fanatics, hole-and-corner reformers of every imaginable kind. This form of socialism has, moreover, been worked out into complete systems.”

আমার মনে হয় আমার মত পেশাবিদরা – ডাক্তার, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ ইত্যাদিরা – সরাসরি বুর্জোয়া না হলেও আমাদের সহানুভুতি থাকবে সমাজের উচ্চশ্রেনীর প্রতিই। সেটা মনে করেই মার্ক্স হয়তো আমাদেরকে রক্ষনশীল বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছেন। প্রশ্নদাতার কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল যে তিনি নিজে পেশাবিদ হয়েও কোন কারনে নিজেকে মার্ক্সবাদী বলছেন অথচ যেখানে কমিউনিজম হচ্ছে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসন। অথবা নিজেকে তিনি প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই ভাবছেন কিভাবে? আমি উনাকে আরো প্রশ্ন রেখেছিলাম, আজকের যুগে কাদেরকে আপনি বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত বলে মনে করেন তা আমার মত উদাহরণ সহকারে তুলে ধরলে আমার নিজেই বুঝতে পারতাম কোথায় আমাদের মতবিরোধ।

উনার মন্তব্যের একটি বক্তব্যের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছিলাম। উনি বলেছেন আমার লেখা সম্পর্কে যে ঃ

“আমি মধ্য আয়ের বেতন ভোগী ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিতদেরকে মধ্যবিত্ত বা পেটিবুর্জোয়া বলেছি”

কিন্তু আমি পেশাবিদদের মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে ফেলিনি আর পেটি-বুর্জোয়াতেতো নয়ই। আমি তাঁদের ফেলেছি উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে বা বুর্জোয়া সমাজের যন্ত্রবিশেষ হিসেবে। পেটি-বুর্জোয়া বলতে আমি বুঝেছি মধ্যবিত্তের নিম্ন শ্রেনী বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেনী কে, যারা স্বল্পপূঁজির ব্যবসায়ী, কিন্তু বৃহৎ পুঁজির শোষণে একদিন প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই রূপান্তরিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (হস্তশিল্পী, ফুটপাতের ব্যবসায়ী) সরকারী/বেসরকারী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। যাদের আয় খুব সামান্য এবং যে কোন বড় বিপদে সর্বসান্ত হয়ে পথের ভিকিরি হয়ে যায়।

পেটি বুর্জোয়া সম্পর্কে ইস্তেহারে [২] যা মার্ক্স বলেছেনঃ

“The lower strata of the middle class — the small tradespeople, shopkeepers, and retired tradesmen generally, the handicraftsmen and peasants — all these sink gradually into the proletariat, partly because their diminutive capital does not suffice for the scale on which Modern Industry is carried on, and is swamped in the competition with the large capitalists, partly because their specialised skill is rendered worthless by new methods of production. Thus the proletariat is recruited from all classes of the population. “

ইস্তেহারের [২] অন্য এক স্থানে বলেছেন –

“In countries where modern civilisation has become fully developed, a new class of petty bourgeois has been formed, fluctuating between proletariat and bourgeoisie, and ever renewing itself as a supplementary part of bourgeois society. The individual members of this class, however, are being constantly hurled down into the proletariat by the action of competition, and, as modern industry develops, they even see the moment approaching when they will completely disappear as an independent section of modern society, to be replaced in manufactures, agriculture and commerce, by overlookers, bailiffs and shopmen. “

আমি আমার অবস্থান পরিষ্কার করেছি। কোন্‌ কারণে এবং কাদের কে আমি কোন্‌ শ্রেনীতে ফেলেছি। আমার স্বল্প জ্ঞানের অভাবে বুঝার ভুল হতে পারে। তবে নিশ্চিত থাকবেন ভুল বুঝে থাকলে তা শুধরে নেওয়ার সুযোগ আমার কাছে সব সময় আছে। আপনার মত সমাজের পরিবর্তন আমিও চাই। তবে কিভাবে চাই সেটাই এখনো খুঁজছি। আমি মার্ক্স বা এঙ্গেলস এর লেখা দিয়ে তাঁদের বুঝতে চাই, লেনিন বা মাও বা অন্য কারোর চোখ দিয়ে নয়। তাই নিজের মত করেই তাঁদের বুঝতে চাই।

১. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1847/11/prin-com.htm
২. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/communist-manifesto/index.htm

আমার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মার্ক্সবাদী ভাইয়ের জবাবঃ

স্বাধীন, আপনাকে নতুন করে আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ। আপনার আলোচনার ধরনটা বেশ ভালো লাগলো কেননা গ্রহন বর্জন করার একটা মানসিকতার ছাপ রয়েছে সেখানে। আর আদর্শগত অর্থে আপনিও আমার মত এই বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থার আমুল পরিবর্তনই বোধহয় চাইছেন। যাই হোক, আমার মনে হয় আমার আগের মন্তব্যে আমি আজকের যুগে কারা প্রলেটারিয়াত আর কারা বুর্জোয়া সে বিষয়ে আমার বক্তব্য পরিস্কার করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপরও এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে আমার আগের বক্তব্যটি পরিস্কার করার চেষ্টা করি। ধরা যাক এক জন প্রকৌশলী একটি রিয়েল এস্টেট কম্পানি খুলেছেন যেখানে তিনি আরও ১০ জন প্রকৌশলী, ২০ জন টেকনিশিয়ান, ১০০ জন নির্মান শ্রমিককে বেতন দিয়ে পোষেন। কোম্পানীর মালিক প্রকৌশলী পুজি বিনিয়োগ করে বিভিন্ন প্লটে ফ্লাট বানানোর কাজ শুরু করেন। প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানরা তাদের দক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে নকশা এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার কাজ করেন। নির্মান শ্রমিকেরা সেই নকশা অনুযায়ী তাদের অদক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে সেই কাজটিকে বাস্তবায়ন করেন। এখন এখানে কার কি শ্রেণী অবস্থান?

# নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।

# বেতন ভোগী প্রকৌশলী/টেকনিশিয়ান আর মজুরী ভোগী নির্মান শ্রমিক প্রত্যেকেই শ্রমিকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত যেহেতু তারা তাদের শ্রম বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করছেন। বেতনভোগী প্রকৌশলী টেকনিশিয়ানরা হলো হোয়াট কালার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশী দেয়া হয়, যেহেতু এরা মূলত মানসিক শ্রম বিক্রী করে এবং এদের শ্রমকে দক্ষ শ্রম বলা হয় যেটাকে অর্জন করতে নির্দিষ্ট ধরনের ট্রেনিং বা শিক্ষার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। আর নির্মান শ্রমিকরা হলো ব্ল-কলার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য কম দেয়া হয়, যেহেতু এদের শ্রম অদক্ষ বা আধা দক্ষ এবং শারীরিক শ্রম নির্ভর। এরা শ্রম বিক্রিয়কারী হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত বা Class in itself হলেও চেতনাগত অর্থে প্রলেতারীয় শ্রমিক শ্রেণীর চেতনা ধারণ নাও করতে পারে অর্থাত Class for itself হলো রাজনৈতিক চেতনার ব্যাপার যা অর্জন করার বিষয়।

উচ্চ বেতন ও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে বেতনভোগী প্রকৌশলীরা নিজেকে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ইত্যাদি অনেক কিছুই ভাবতে পারে কিংবা নিজেদের সুবিধা জনক অবস্থান বজায় রাখা এবং মূল্যবান চাকুরীটি হারানোর ভয়ে মালিক প্রকৌশলীর একান্তঅনুগত হিসেবে সেই বুর্জোয়া মালিকের শোষণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে—অর্থাত সাংস্কৃতিক বিবেচনা, লাইফস্টাইল মূল্যবোধ ইত্যাদি অর্থে সে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বিভিন্ন ধরণের মানসিকতা ধারণ করতে পারে কিন্তু অর্থনেতিক হিসেবে উতপাদনের উপকরণের সাথে মালিকানা সম্পর্ক বিচারে তার অবস্থান কিন্তু শ্রমিকতার অবস্থান। একইভাবে একজন টেকনিশিয়ান এমনকি কোন কোন উচ্চমজুরী প্রাপ্ত দক্ষ নির্মান শ্রমিকও পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিচারে নিজেকে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ভাবতে পারে, চাকুরী হারানো বা অন্যান্য বিবেচনায় মালিক শ্রেণীর স্বার্থবাহক শোষনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে কিন্তু তাই বলে সে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিচারে কখনও বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত হয়ে যায় না। উচ্চ বেতন পাওয়ার জন্য হোয়াট কলার শ্রমিকদের কারও কারও হাতে উদ্বৃত্ত থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেই অর্থকে পুজিতে রুপান্তর না করছে অর্থ মুনাফা অর্জনের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে কারখানা বা কোম্পানী না খুলছে ততক্ষণ পর্যন্ত উতপাদন সম্পর্ক বিচারে তারা শ্রমিক শ্রেণীরই অংশ, যাদের কে লেনিনের ভাষায় বলা যায় লেবার এরোস্টেক্রেট। লেনিন উন্নত ধনবাদী দেশে ক্রমশ এই লেবার এরোস্প্রোক্রেটদের বৃদ্ধি দেখে বলেছিলেন কার্যকর শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই লেবার এরোস্ট্রোক্রেসি একাটা বিরাট বাধা, কাজেই এটাকে ভাঙা খুবই জরুরী।

এভাবে হোয়াইট কলার শ্রমিকেরা স্বাভাবিক সময়ে তাদের সুবিধাজনক অবস্থা হারানোর ভয়ে পুজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বে পুজির পক্ষাবলম্বন করলেও সংকটের সময় যখন ব্ল-কলার শ্রমিকদের মতই তাদেরকে ছাটাই হতে হয় তখন কিন্ত দেখা যায় এরা শ্রমিকদের মতই ট্রেড ইউনিয়ন জাতীয় সংগঠন করে মালিক বুর্জোয়ার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। আপনি আপনি আপনার আলোচনায় যেসব স্যোসাল ওয়েল ফেয়ারের উদাহরণ দিয়েছেন এগুলো কিন্তু এই হোয়াট কলার আর ব্লু কলার শ্রমিকদের মিলিত আন্দোলনের ফল। এখন তারা তাদের সেই শ্রেণী চেতনা কতটুকু ধরে রাখবে এটা পুরোপুরি নির্ভর করে সেই সময়ের রাজনৈতিক অর্থনেতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সর্বপরি শ্রমিক শ্রেণীর চেতনাগত মান ও তার প্রয়োগ সক্ষমতার উপর।

আর আমি নিজে একজন প্রকৌশলী হয়েও কেন সর্বহারা শ্রেণীর শাসন কমিউনিজমে বিশ্বাস করি তার উত্তরে বলবো
মার্কস/এঙ্গেলস নিজেরাও কিন্তু সেই অর্থে কারখানায় কাজ করা সর্বহারা শ্রমিক ছিলেন না কিন্তু চেতনাগত অর্থে তারা সর্বহারার সাথে একাত্মতা বোধ করেছেন অর্থাত ডি-ক্লাসড হয়েছিলেন। আর আমি তো নিজে একজন হোয়াট কলার শ্রমিক- আমার কেবল দরকার নিজেকে মধ্যবিত্তের মানসিকতা থেকে বের করে নিজের শ্রেণী অবস্থানটাকে বুঝে নেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করা।

যার প্রেক্ষিতে আমার জবাব ও উপসংহারঃ

ধন্যবাদ আপনাকে আপনার মন্তব্যের জন্য। আপনার বক্তব্যের পর এটা বুঝতে পারলাম আপনার সাথে আমার চিন্তার পার্থক্য খুবই সামান্য, তবে তা মৌলিক পার্থক্য। শুধু এইটুকু পার্থক্যের জন্যই আপনি নিজেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে একাত্মতাবোধ করেন এবং মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হয়ে সমাজ পরিবর্তণের স্বপ্ন দেখেন। পার্থক্যটি হল যত না প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞায় তার চেয়েও বেশী বুর্জোয়ার সজ্ঞায়। প্রলেতারিয়েত এখানে মূল বিষয় নয়, শোষিত শ্রেনী মানেই প্রলেতারিয়েত। কিন্তু বুর্জোয়া কারা।

আপনারই ভাষায় –নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।

আমিও ঠিক এটাই বুঝেছি যে মার্ক্স তাই বুঝিয়েছেন। আমি বলেছি- বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।

সুতরাং দেখতেই পারছেন আমার মার্ক্স এর সজ্ঞা বুঝায় আর আপনার সজ্ঞায় তেমন বেশী পার্থক্য নেই। পার্থক্য হল আমি মার্ক্স এর এই সজ্ঞাকে মনে করি খুবই সরলিকৃত একটি সজ্ঞা হিসেবে। সকল পুঁজিপতিদেরই তিনি শত্রুর কাঁতারে ফেলেছেন। তিনি যেটা দেখেছেন যে সকলে মিলে লাভ করা হয়, কিন্তু সে লভ্যাংশ শুধু পায় পুঁজিপতি। সেই বাড়তি মুনাফা আবার বিনিয়োগ হয়, তা থেকে আরো মুনাফা হয়, সেটাও যায় পুঁজিপতির ঘরেই। সুতরাং যে কারোরই সেই পুঁজিপতির উপর ক্ষোভ হতেই পারে।

কিন্তু পুঁজিপতি যে বিনিয়োগটি করছে তার যে রিস্ক আছে সেটাও তো পুঁজিপতির, তাই না। সে কিছু লাভের আশায় ব্যবসায় এসেছে। আপনার সেই প্রকৌশলী তো নিজে ব্যবসায় না এসে সারাজীবন শ্রম বিক্রি করেই চলতে পারতো। কিন্তু সে ব্যবসায় এসেছে কারণ ব্যবসায় লাভ আছে আবার লোকসানের ভয়ও আছে। এখানে আপনি যে সিস্টেম এর কথা বলছেন সেটাই ক্লাসিকাল অর্থনীতি। সেই একই অর্থনীতি মেনেই কমিউনিষ্ট সমাজেও রাষ্ট্রকে ব্যবসা করতে হবে। পুঁজি খাটাতে হবে, সেখান হতে মুনাফা করতে হবে, সেই বাড়তি মুনাফা দিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। যদি এটা না করে তবে সে দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়বে। তবে এটাও মনে রাখা উচিৎ রাষ্ট্রের পক্ষে ব্যবসা করে মুনাফা করা এত সহজ কথা নয়, যার প্রমান আমাদের দেশের সকল রাষ্ট্রীয় শিল্প বা প্রতিষ্ঠান গুলো। যে কারনেই ব্যক্তি মালিকানায় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়। রাষ্ট্র সেখান হতে কর আদায় করে, অর্থ্যাৎঘুরিয়ে বললে রাষ্ট্র একটু কম মুনাফা করলো। রাষ্ট্রের বাকি মুনাফা ব্যক্তিকে দেওয়া হল কারণ সেই ব্যক্তি নিজে রিস্ক নিয়ে একটি কর্মক্ষেত্র তৈরী করলো এবং রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। রাষ্ট্র শুধু পুঁজি ধার দিয়ে মুনাফা করলো, আর ব্যক্তি তার শ্রম ও মেধা খাটিয়ে নিজে ও রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। এমন ব্যক্তিকে আমি কিভাবে শত্রু শ্রেনী হিসেবে চিহ্নিত করবো। আমার সাথে আপনার বা মার্ক্স এর মূল পার্থক্য এখানেই।

আরেকটি ক্ষুদ্র পার্থক্য হল, মানবতাবোধ বা নীতিবোধ। আপনি যেভাবে খুব সহজ করে বলে দিতে পারেন এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। আমি তা পারিনা। কারণ নীতি এবং মানবতা আমার কাছে অনেক বড়। একজন মানুষকে আমি শ্রেনী শত্রু আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলে আর যাই করি কারোর ভাল করতে পারবো এ ধরণের বিশ্বাস আমার পক্ষে অসম্ভব। সে কারনেই বোমা মেরে মানুষকে ধর্মের বাণী পৌছে দেওয়া সম্ভব বলেও আমি মনে করি না।

মুনাফা, সে ব্যক্তিই করুক বা রাষ্ট্রই করুক, রাষ্ট্রের উচিৎ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তাবায়ন হচ্ছে কিনা তার তদারকি করা। অর্থাৎ সেই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত মুজুরি পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিৎ করা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র সেটা না করলে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে, তার জন্য আন্দোলন হতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। কারন মার্ক্স যাকে পুঁজিবাদ বলেন তাকে আমি বলি আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থা। মার্ক্স যাকে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা বলেন আমি তাকে বলি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই অর্থনৈতিক বা সমাজ ব্যবস্থা এসেছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ হিসেবেই। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা মানে হল সভ্যতার চাকাকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া ।

এটা ঠিক যে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম শাসন ব্যবস্থা এখনো পাওয়া যায়নি। তাই বলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। যদি সমাজে পরিবর্তন আনতেই হয় তবে আমি বর্তমান ব্যবস্থাকেই ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করবো। আমি সভ্যতার চাকাটিকে সামনের দিকেই নিয়ে যাবার চেষ্টা করবো, পেছনের দিকে নয়।