ইসলামি জঙ্গিবাদের ক্রমবর্ধমান হুমকি
ইসফাক ইলাহী চৌধুরী

আমাদের স্নৃতিতে গেঁথে যাওয়া ২১ আগস্ট আবার ফিরে এসেছে। ২০০৪ সালের এই দিনে ইসলামি জঙ্গিরা আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা করে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বকে হত্যার নিশানায় ফেলেছিল। আক্রমণটি ছিল খুবই পরিকল্পিত এবং বাস্তবায়ন ছিল সাবধানী। আওয়ামী লীগের সামনের সারির নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জনকে মৃত্যুমুখে পতিত করে, শত শত কর্মীকে আহত করে ঘাতকেরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেঁচে যাওয়া ছিল প্রায় অলৌকিক, যদিও তিনি গুরুতর আহত হন। এটা ছিল এমন এক সময়, যখন আমাদের বুনিয়াদি মূল্যবোধগুলো ধর্মীয় চরমপন্থীদের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে পড়ায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নাজুক হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তথাকথিত ‘জিহাদের’ জোশে এই সব চরমপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীসহ অজস্র নিরীহ মানুষের ওপর চালায় হত্যার তান্ডব। তাদের এই বোমাবর্ষণের জোয়ার কয়েক বছর ধরে চললেও সে সময়ের ক্ষমতাসীন সরকার বলে যায় যে বাংলাদেশে কোনো ইসলামি চরমপন্থী দলের অস্তিত্ব নেই। বিগত জোট সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তো বলেই ফেললেন যে, এসবই কিছু মিডিয়ার তৈরি করা মিথ। এমনকি এও বলা হয় যে আওয়ামী লীগ নিজেই সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এবং জনগণের সহানুভুতি কাড়তে ঘটনাটি ঘটিয়েছে।

এখন আমরা জানি, এই দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে এটা বাংলাদেশের ভেতর থেকে তৈরি হয়নি; বরং এটা বৈশ্বিক ইসলামি জিহাদের অংশ। একসময় প্রগতিশীল বিরোধীদের মোকাবিলার জন্য ক্ষমতাবানেরা এর পৃষ্ঠপোষকতা করলেও এখন তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। চরমপন্থী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হয়েছে এবং তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিতও করা হয়েছে। তা হলেও মোটামুটি অর্ধদশক ধরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও এর শেষ এখনো দেখা যাচ্ছে না। যখনই আমরা ভাবি যে ইসলামি জঙ্গিবাদের দগদগে ক্ষত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি, তখনই তারা তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। কয়েক মাস আগেও খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এখন দেশে কোনো ইসলামি জঙ্গি নেই; কারণ তাঁদের আমলে তাঁরা একে নির্মূল করেছেন। কিন্তু এর কয়েক দিন পরই বিপুল বোমাবারুদসহ কয়েকজন জঙ্গিকে আটক করা হয়। কার্যত জঙ্গিবাদের কৌশলই এমন, যখনই ভাবলেন তাদের মোকাবিলা করা হয়ে গেছে, তখনই তারা নতুন কোনো চেহারায় আবির্ভুত হবে। সে কারণেই প্রয়োজন একটি বিশদ ও সমন্বিত কর্মকৌশল প্রণয়ন করা। এবং এটা হতে হবে এমন এক যুদ্ধের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম ও অভিযোজনশীল, যে যুদ্ধের নির্দিষ্ট কোনো রণাঙ্গন বা মেয়াদ নেই।

বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের মুখ ও মুখোশ
এ পর্যন্ত যেসব জঙ্গি ধরা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং গ্রামীণ পটভুমি থেকে আসা। তাদের বেশির ভাগই কওমি মাদ্রাসায় যায় অথবা একেবারেই অশিক্ষিত। এখন অবশ্য নতুন একটি প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, মূলধারায় বা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজে শিক্ষিত শহুরে তরুণদের মধ্যে হিযবুত তাহ্রীরের উপস্িথতি ক্রমশ বাড়ছে। জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের (হুজি) তুলনায় এই প্রবণতা অনেক বেশি বিপজ্জনক। কারণ, তাহ্রীরের টার্গেট হলো দেশের সবচেয়ে অগ্রণী অংশের তরুণেরা−যারাই হবে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অথবা ব্রিটেনে জন্ন নেওয়া একদল ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুণ দৃশ্যত দাতব্য কাজে দেশে আসে, কিন্তু জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। আগে কেবল পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ তরুণেরাই এসবে জড়িত হতো, কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশিরাও এতে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। রসায়নে পিএইচডি করা ফয়সাল মোস্তফা এদের হাতে পড়েন এবং পরিণতিতে ইসলামি জঙ্গি হয়ে যান। তৃতীয়ত, পালিয়ে আসা ভারতীয় জঙ্গিদের গ্রেপ্তার হওয়া। এদের সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে এবং তারা এখন বাংলাদেশে ছদ্মপরিচয়ে লুকিয়ে কাজ করছে। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর তাড়া খেয়ে তারা বাংলাদেশকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে। বছরের পর বছর তারা বিনা বাধায় তাদের জঙ্গিবাদী মতাদর্শ প্রচার করে গেছে। ইসলামি জঙ্গিবাদ যে এখন আন্তসীমান্ত তৎপরতা, তা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত।

জঙ্গিবাদ দমনে আমাদের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা
জঙ্গিবাদ প্রতিহত করায় সহনশীলতা ও বহুত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত আমাদের জনগণের উদার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই হলো বিরাট এক শক্তি। সংগীত, কবিতা, নৃত্য ও নাটক এবং চিত্রকলা ও ভাস্কর্য আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিবিড় অংশ। ধর্মীয় বিধিনিষেধ কখনো এসবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখের উৎসবে বোমা বিস্কোরণের পর থেকে নববর্ষ উৎসবে লোকসমাগম না কমে বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। জঙ্গিরা যেমন ইসলামি রাষ্ট্র চায়, তাতে বাদ্য, গান, নাটক ও সিনেমা থাকবে না, প্রতিটি পুরুষকে দাড়ি রাখতে হবে এবং মেয়েরা পড়বে বোরকা, মেয়েদের সব বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং ছেলেদের বিদ্যালয়কে মাদ্রাসায় পরিণত করা হবে। বেশির ভাগ বাঙালি মুসলমানের কাছে এমন জীবনের কোনো আকর্ষণ নেই। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দেয়। তাই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বেশির ভাগ ইসলামি জঙ্গিরা সৌদি আরব, ইয়েমেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানের গুণগান গায়। এদের মোকাবিলায় আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যই আমাদের শক্তি। তা হলেও আমাদের কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও বেকারত্ব জঙ্গিবাদের উর্বর ভুমি হিসেবে কাজ করে। সমাজের মধ্যে বাড়তে থাকা ধনী-গরিব বিভাজনের বিরুদ্ধের অসন্তোষকেও তারা তাদের পক্ষে ব্যবহারের সুযোগ নেয়। বাইরের নানা শক্তিও জঙ্গিবাদী মতাদর্শের বিস্তারে তহবিল জুগিয়ে থাকে। জঙ্গিরা কোনো সীমান্ত মানে না। বাইরের জঙ্গিরা আমাদের ভুমি ব্যবহার করে যদি তৃতীয় কোনো দেশে আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের নিজেদের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

সন্ত্রাস দমনে সমন্বিত কর্মকৌশল প্রয়োজন
১. আদর্শকে আদর্শিক স্তরেই মোকাবিলা করা প্রয়োজন−বিশেষত তথাকথিত বৈশ্বিক জিহাদের প্রসঙ্গে এটা জরুরি। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে মুসলিম সমাজ তার ভেতর থেকেই সংকটের মুখে পড়েছে। সমাজের একটা অংশ চায় বাকি দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে, অন্যরা চায় ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে মধ্যযুগীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজগুলোয় সামাজিক সংস্কার সম্পন্ন করা এখন জরুরি প্রয়োজন। আমাদের উচিত চরমপন্থী মতাদর্শের বিপরীতে ইসলামের উদারনৈতিক ব্যাখ্যাকে উৎসাহিত করা।
২. জরুরিভাবে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও পশ্চাৎপদতার সমস্যা দুর করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে সমৃদ্ধির শর্তের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। চরমপন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধে সমাজের গণতন্ত্রায়ণই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। অবশ্য একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, গণতান্ত্রিক সমাজের উদারতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার মওকা নিতে পারে।
৩. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দরিদ্র ও নিচুতলার মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে নারীদের ফতোয়ার শিকার করায় মোল্লা-মাতবর ঐক্য সমাজের মধ্যে আইনি সমস্যার বিকাশকেও নির্দেশ করে।
৪. আমাদের তরুণদের আধুনিক শিক্ষার মধ্যে এমনভাবে টেনে আনতে হবে, যাতে তারা আজকের পরিবর্তনশীল দুনিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। দীর্ঘদিন হলো মাদ্রাসা শিক্ষার সার্বিক সংস্কারের বিষয়টি অনিষ্কপন্ন হয়ে আছে। আমাদের এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যার মাধ্যমে উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন এবং মুক্তচিন্তার জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। সমাজের বহু-সংস্কৃতি, ধর্মবৈচিত্র্য এবং অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সহায়ক আইন তৈরি করতে হবে সরকারকে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৫. সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে নিরাপত্তা অভিযান চালাতে হবে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আধুনিকায়নও প্রয়োজন। তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে নির্ভয় ও নির্লোভভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে হবে।
৬. নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়া জঙ্গিবাদী তৎপরতা দমন সম্ভব নয়। সার্ক কাঠামোর মধ্যেও এ ব্যাপারে বেশ কিছু উদ্যোগ রয়েছে। সীমান্ত তদারকি, পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থা, সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের চলাচল সম্পর্কে তথ্য বিনিময় এবং পলাতক সন্ত্রাসীদের আটক ও হস্তান্তরের বিষয়ে সার্ক দেশগুলো একযোগে কাজ করতে পারে। নাজুক সীমান্তাঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান দমনের জন্যও আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
৭. দক্ষিণ এশিয়া সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল হিসেবে বিশ্বে আবির্ভুত হতে যাচ্ছে। এর জন্যও অতি সত্বর জঙ্গিবাদ নির্মূল করা দরকার। সন্ত্রাস দমনে আঞ্চলিক সহযোগিতা টাস্কফোর্স গঠনের যে প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন, সেটাই আসল পথ। যৌথভাবে কাজ করার মাধ্যমেই আমরা জঙ্গিবাদের ক্ষত থেকে রেহাই পাব।

———————-
লেখক বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। লেখাটি প্রথম আলো পত্রিকায় ২১শে আগস্ট, ২০০৯ তারিখে প্রকাশিত।