বাংলার জাগরণ : ডিরোজিও প্রসঙ্গ
প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরী
উনিশ শতকের বাংলার জাগরণ অতিকথার বিন্যাসমাত্র নয়, তার ঐতিহাসিক মূল্যের সত্যতা প্রমাণিত। আমাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাপ্রবাহে গত দেড়শো বছর ধরেই ‘রেনেসাঁস’ উদ্ভূত চেতনা ক্রিয়াশীল। এই ক্রিয়াশীলতার প্রচেষ্টা এবং তাৎপর্য কোথায় সুগভীর? কোথায় চাপা? কোথায় ভাসা?―নানা জনের তর্কপ্রশ্নগুলো এড়িয়েও নিশ্চিন্তে বলা যায় এর প্রভাবে একটা সবল আলোড়ন সম্ভব হয়েছিল। এই আলোড়নের সাথে জড়িত থাকা না-থাকার প্রেক্ষাপটে সেকালের জনজীবন মোটামুটি তিনটি অভিধায় প্রকাশিত হয়―একদল শিক্ষিত আলোড়ক, একদল বিরোধী এবং আরেকদল অপর দুই দলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গৌণার্থবাহক। সে-সময়ের কলকাতার এক পর্তুগিজ-ভারতীয় মিশ্রণজাত ইউরেশীয় পরিবারের সন্তান হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ; উপরোক্ত প্রথম দলের জীবনদায়ী প্রেরণার অগ্রজ্ঞানী। হিন্দু কলেজে শিক্ষকতাকালে তিনি বাঙালি তরুণদের ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-তথ্য-তত্ত্ব সর্বোপরি জীবন পিপাসার সাথে গভীরভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। শুধু পরিচয় করানোই নয়, যথার্থ আত্মবিকাশের জন্য তিনি ছাত্রদের অবাধে বিতর্ক করতে এবং যেকোনো রচনা বা রীতি সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে উৎসাহ যোগাতেন; শেখাতেন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে, কোনো বিশেষ আপ্তবাক্য বা Idol দ্বারা প্রভাবিত না হতে, সত্যের জন্য বাঁচতে, সত্যের জন্য মরতে। ফলে যে ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনা ডিরোজিও ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতেন বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ছাত্ররা নিজেদের মত করে সেসব চিন্তা-চেতনাকে অনুসরণ করার প্রয়াস পেতো। আসলে “রামমোহন ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চমৎকারিত্বের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মাত্র, কিন্তু সেই জ্ঞানের স্বাদ বাঙালি প্রকৃত প্রস্তাবে পায় ডিরোজিওর কাছ থেকে”। ডিরোজিওর কাছ থেকে পাওয়া এই স্বাদের প্রবল আকর্ষণ ও সুখদ প্রভাবে সে-সময়ের তরুণদের মনে নবজাগরণের চিন্তা-প্রবাহ তরঙ্গায়িত হয়। যেন কোনো উৎসবে যোগদানের সোৎসাহে তারা তীব্র জীবনচেতনা এবং আত্মজিজ্ঞাসায় উদ্বুদ্ধ হয়। যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানব-মহিমার জয় ঘোষণা, স্বাধিকার চেতনা, আত্মজাগরণে বিশ্বাস, সত্যনিষ্ঠা, জ্ঞানপিপাসা, স্বদেশানুরাগ, বলিষ্ঠ প্রত্যয়, কুসংস্কার বিরোধী জাতীয়তাবাদী―প্রগতিশীলতার এই বৈশিষ্ট্যগুলি তরুণদের জীবনাচরণে ক্রমান্বয়ে প্রবেশ করতে থাকে। আর এসব চিন্তা-চেতনার অপ্রতিরোধ্য গতিই তৎকালীন নগরজীবনে নিয়ে এল অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য। এ প্রাণচাঞ্চল্য আমাদের প্রচলিত ইতিহাসকে এতটুকুও খাতির করেনি, বরং রেনেসাঁস-উত্তর ইউরোপীয় জীবনের সাথে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিবেকী এবং বহির্মুখী প্রতিবিন্যাস স্থাপন করেছিল। এ প্রতিবিন্যাস আবার উনিশ শতক জুড়ে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা প্রকাশ এবং সেই সূত্রে জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল বৃদ্ধি ও নানা ভাবনাচিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতের সমাবেশ ঘটাল। “গড়ে উঠল এই দেশের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনার সাধনীপদ্ধতি, তথ্য সংগ্রহ ও আবিষ্কার এবং সেই তথ্যের সত্যতা নির্ণয় করবার আগ্রহ, উপায় ও সামর্থ্য, ঐতিহ্যকে নির্ভরযোগ্যভাবে বিচার বিশ্লেষণের প্রণালী। … প্রাচীন উত্তরাধিকার ও নবাগত সম্ভাবনাকে বিকাশের উপাদানে রূপান্তরিত করবার ব্যগ্রতা, অধ্যবসায়, পরিবারে সমাজে ও রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করবার উদ্যম ও তজ্জনিত সংঘাত … নারীকে পুত্রার্থে নয় মানুষ হিসেবে মূল্য দেবার দাবি ধ্বনিত হল। … অন্যায়ের বিরূদ্ধে প্রতিবাদে অনেকে প্রকাশ্যে অংশ নিতে শুরু করলেন … জমিদারি ও জাতপাতের সমালোচনা শোনা যেতে লাগলো; ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে সামাজিক সাম্যের আদর্শের প্রতিও কেউ কেউ আকৃষ্ট হলেন।” বাঙালি তরুণের মনস্বিতার এই যে নির্ণায়কের ভূমিকার বিস্ময়কর প্রকাশ, নাগরিক বাংলার জীবনে যে নানা সম্ভাবনা সূচিত হয়েছিল তার চারিত্রিক প্রবণতা তৈরি করে দিয়েছিলেন ডিরোজিও। হিন্দু কলেজের এই তরুণ শিক্ষক নিজের ব্যক্তিত্বের বলে তৎকালে অতীতাশ্রয়ী সমাজে র্যাডিক্যাল মনোভাবের স্ফূরণ ঘটাতে পেরেছিলেন।
সচারাচর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মতো সে-সময়ের অবিভক্ত বাংলাও ছিল মূলত গোঁড়ামি, সামাজিক অসঙ্গতি, ধর্মীয় অনাচার, মানসিক বিকৃতি, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, শিক্ষার নামে উৎপীড়ন, নীলকরদের অত্যাচার, দাস-গোলামদের উপর নিপীড়ন, বাবুভদ্রলোকদের বেহায়াপনা এবং সর্বোপরি একটি শোষিত দেশ। ১৮১৩ সালের আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষ বহির্বাণিজ্যে শুধু রপ্তানীকারক দেশ ছিল। তখনকার ইংরেজ শিল্পপতিদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে তাদের কারখানার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে পরিণত করা। তাছাড়া ইংরেজরা কলকাতা শহরে যে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেছিল সেখানেও শিক্ষাগত বৈষম্য বিরাজমান ছিল। এরকম বৈষম্যমূলক আচরণ এবং ধর্মীয় আচার ও রক্ষণশীলতায় রামমোহন-বিদ্যাসাগর আঘাত করেন বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণ-বৈদ্য সমাজের বাইরে অর্থাৎ শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার মৌলিক ও তীব্র প্রবণতা তাঁদের মধ্যে দেখা যায়নি। ঔপনিবেশিকতার মধ্যে থেকে তাঁরা ভাবগত ও বস্তুগত উভয় অর্থে এমন কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেননি ‘যা পরবর্তীকালে সমাজ পরিবর্তনকামী চেতনার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।’ তাঁদের প্রতিষ্ঠিত দৃঢ়তা অংশত হলেও খর্বিত এবং খণ্ডিত। বলা যায় রামমোহন-বিদ্যাসাগর আমাদের সমাজের বহিরঙ্গের জাড্যতা―তার সাথে প্রবলভাবে সংশ্লিষ্ট রীতিনীতিতে আঘাত করেছেন এবং সেটা ঔপনিবেশিকতাকে অনেকটা মেনে নিয়েই। কিন্তু ডিরোজিও নতুন করে গড়তে চেয়েছেন এদেশের অন্তরকে, চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি প্রথমেই উপনিবেশ এবং ফ্রিট্রেডের বিরোধিতা করেন, তারপর ধর্র্মীয়বৃত্তের বাইরে এসে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের ইউরোপীয় রেনেসাঁর reformation এবং enlightenment-এর সাথে সংযোগ স্থাপন করে মানবমহিমার উজ্জ্বল জয় ঘোষণা করেন। এদিক থেকে তিনি উনিশ শতকীয় ভারতবর্ষের সকল অগ্রদূতের শীর্ষস্থানীয়।
বঙ্গীয় জাগরণে ডিরোজিওর আগমন এবং তাঁর কর্মযুগ সম্পর্কে বলতে গেলে প্রাসঙ্গিক হিসেবে দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা চলে আসে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান হল:― ডেভিড ড্রামন্ড পরিচালিত ‘ধর্মতলা একাডেমি’ এবং ‘হিন্দু কলেজ’। ড্রামন্ডের এই একাডেমি তখন এদেশের সবচেয়ে নামকরা বিদ্যালয়―এখানেই পড়াশুনা করেন ডিরোজিও। ড্রামন্ড ছিলেন একাধারে পণ্ডিত, দার্শনিক, কবি এবং সাংবাদিক। তাঁর প্রভাবেই ডিরোজিওর মধ্যে গড়ে ওঠে স্বাধীন চিন্তাশক্তি, সাহিত্য-দর্শন প্রীতি, সত্যাদর্শ এবং ইউরোপীয় বিপ¬ব মতবাদে বিশ্বাস। ছাত্র অবস্থায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বার বার কৃতিত্ব অর্জনের জন্য ডিরোজিও সংবাদপত্রের শিরোনাম পর্যন্ত হন। বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে তিনি কিছুদিন কেরানির চাকরি করেন। তারপর কিছুদিন অবস্থান করেন ভাগলপুরের তারাপুরে তাঁর মাসির বাড়িতে। এই ভাগলপুরেই উন্মেষ ঘটে তার লেখকসত্তার, বিকশিত হয় কবি প্রতিভা ও প্রবন্ধচর্চা। সেখান থেকে ডিরোজিও ‘ইন্ডিয়া গেজেট’-এর সম্পাদক গ্রান্টের কাছে নিজের কবিতা ও প্রবন্ধ পাঠাতেন; আর গ্রান্ট আগ্রহভরে সেগুলো প্রকাশ করতেন। ১৮২৬ সালের প্রথম দিকে কলকাতায় ফিরে এসে ডিরোজিও ‘ইন্ডিয়া গেজেট’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই কাজের পাশাপাশি এসময় তিনি ক্যালকাটা ম্যাগাজিন, ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন, ক্যালাইডোস্কোপ, বেঙ্গল এ্যানুয়াল প্রভৃতি পত্রিকায় সব্যসাচী লেখকের মতো প্রচুর লেখালেখি করেন। এসব লেখায় সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত মানসিকতা, নিজস্ব হৃদ্যিক যুক্তিবোধ এবং রেনেসাঁস পরবর্তী ইউরোপের কলা ও দর্শন সর্বজনীনভাবে সঞ্চারিত হওয়ায় ডিরোজিও খুব তাড়াতাড়ি খ্যাতি অর্জন করেন। এই খ্যাতির কারণে তিনি হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হন―১৮২৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি হিন্দু কলেজের উঁচু শ্রেণিগুলির শিক্ষক নিযুক্ত হন। বলা বাহুল্য হবে না যে ১৮২৪ সাল থেকে ডা. হোরেস হেম্যান উইলসন পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ফলে ততদিনে হিন্দু কলেজের ক্লেশাবহ অনেকটা পাল্টে গেছে, ইতিহাস-ভূগোল-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানী-মননশীল শিক্ষক যোগ দিয়েছেন। জীবন চেতনার একটা আলতো উত্তাপ তখন ছাত্রদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছিল―হিন্দু কলেজের এমন আবহে আত্মনিয়োগ করে ডিরোজিও ‘সত্যের সন্ধান ও কদভ্যাসের প্রতি ঘৃণার’ আদর্শ ও দৃঢ় মানসিকতার সোহমতাপ ছড়িয়ে দিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায়―“ডিরোজিও হিন্দু কলেজে পদার্পণ করিয়াই চুম্বক যেমন লৌহকে টানে, সেইরূপ কলেজের সকল শ্রেণির বালককে আকৃষ্ট করিয়া লইলেন। … এইরূপ অপূর্ব আকর্ষণ, শিক্ষাক্ষেত্রে এরূপ সম্বন্ধ, কেহ কখনও দেখে নাই। … এইরূপে বালকগণের স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ হইতে লাগিল।” প্রকৃতপক্ষে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে যোগদানের বছরখানিকের মধ্যেই ছাত্রদের মনের যুগযুগান্তরের সংস্কারে বৈপ¬বিক পরিবর্তন আসে; স্পষ্টই দেখা গেল ছাত্রদের সংবেদনশীল মুক্তচিন্তা, আত্মজাগরণের স্পৃহা এবং বিজ্ঞানমনস্কতা-যুক্তিবাদী প্রবণতা।
কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে আলোচনা শেষ হতো না বলে ১৮২৮ সালে ডিরোজিও আর তাঁর ছাত্ররা গড়ে তোলেন ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন’। এ সংগঠন ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম বিতর্ক সভাস্থল; সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের ‘ইয়ং-বেঙ্গল’ বলে পরিচয় দিতেন। প্রতি সপ্তাহে বসত তাঁদের দীর্ঘ অধিবেশন, সভাপতিত্ব করতেন ডিরোজিও। “ইয়ং-বেঙ্গলদের অধিবেশনে সমুদয় নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে স্বাধীন ও অসংকুচিতভাবে বিচার করা হইত।” ডিরোজিওর কাছ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করে সত্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার যে শিক্ষা ইয়ং-বেঙ্গল পেয়েছিল তা প্রয়োগ করা হত “স্বাধীন ইচ্ছা ও ভবিতব্য, সদগুণ ও কদভ্যাস, দেশপ্রেম, ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে-বিপক্ষে, মূর্তিপূজা ও পুরোহিততন্ত্রের ক্ষতিকর দিক” প্রভৃতি স্পর্শকাতর বিষয়ের উপরেও। তাঁরা স্মিথ-বেন্থাম-নিউটন-ডেভিড হিউম-পেইন-রুশো-বেকন প্রমুখ মনীষীদের চিন্তাভাবনা নিয়ে গভীর অধ্যয়ন শুরু করে। ফলে তাঁদের মনে নতুন মূল্যবোধের অভ্যুদয় হল―তাঁদের রক্তচক্ষু না মানে কারো কর্তৃত্ব, না গ্রাহ্য করে কোনো শাস্ত্র। পোশাকআশাক, খাদ্যাভ্যাস, বক্তব্য ও জীবনযাত্রা দিয়ে তাঁরা রক্ষণশীলতার উপর প্রবল আক্রমণ শুরু করল। “… A through revolutions took place in their ideas … they began to reason to question, to doubt”- লাল বিহারী দে এমন ভাষাতেই ইয়ং-বেঙ্গলদের গতিবিধিকে ধরার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য ইয়ং-বেঙ্গলদের প্রকাশ্য আত্মঘোষণা শুরু হয় বছর দুই-একের মাথায়। কিন্তু তার আগেই নাগরিক অস্তিত্বে তাঁরা ওহঃবষষবপঃ এর ঢেউ তোলেন; তাঁদের মর্মভেদী উচ্চারণে ‘ঘর কাঁপতো, সমাজও কাঁপতো’। ডিরোজিওর অনুসন্ধানের পথে হাঁটা ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন’ যথার্থ রেনেসাঁস বা পরিবর্তনকামী চেতনা ভারতবর্ষের এই একটি স্থানেই সংগঠিত হয়েছিল। তবে শুধু ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন’ নয় সেদিনকার মুক্তমনা অন্যান্য সংগঠন এবং তাদের কার্যগতির সাথেও ডিরোজিও নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন। ‘জনবুল’ পত্রিকার বিবরণী থেকে জানা যায় তিনি পটলডাঙ্গার ংড়পরবঃু ংপযড়ড়ষÑএ বক্তৃতা দিতেন, তাঁর উদ্যম এবং উৎসাহেই ‘বাংলা ভাষা প্রকাশিকা সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাছাড়া ‘বেঙ্গল ক্রনিকেল’ ‘হেসপেরাস’ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি সেসময় ‘ইষ্ট ইন্ডিয়া’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে থাকেন। ভারতীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দুর্দশা লাঘবে তাদের মধ্যে সাম্য ও সৌহার্দ্য গড়ে তোলার স্বপক্ষে প্রচার চালানো, সমাচার চন্দ্রিকাসহ অন্যান্য রক্ষণশীল পত্রিকার সমালোচনা করা, ঐঁসধরহংস এর প্রতি ঐকান্তিক চর্চা করা―ডিরোজিওর নিজের কাগজের প্রবন্ধমালার এই প্রবণতাগুলি আমাদের আধুনিক স্বাদেশিকতা বা জাতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বনিয়াদ।
প্রগতিবাদী ও রক্ষণশীল এই দুইবোধের সহাবস্থান কখনো সুখের নয়। একজন পদত্যাগ করলেই বরং সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয়। উনিশ শতকীয় বঙ্গীয় জাগরণে সেটা সংকীর্ণ অর্থেই ধরা হোক আর বৃহৎ অর্থেই ধরা হোক এই দুই দলের কোন দল পদত্যাগ গ্রহণ করেছিল বা করতে বাধ্য হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত যথার্থ বিচারের সম্মুখীন হয়নি―এটাকে আমরা বর্তমানের বিচেনায় যদি পরিতাপের বিষয় মনে করি তবে কিছুটা আশা টিকে থাকে, কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। তা হলেও সেসময় মনের ঢোল-দামামা বাজিয়ে সংঘর্ষ একটা হয়েছিল সত্যি। এ সংঘর্ষ জিজ্ঞাসায়-জিজ্ঞাসায়, মতবাদে-মতবাদে, আদর্শে-আদর্শে, প্রতিষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে, সর্বোপরি হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের এবং এর ব্যাপ্তি ছিল নগরের ঘরে ঘরে। যখন এক আদর্শ মনে করে ‘এক এক গ্লাস মদ খাওয়া কুসংস্কারের উপর জয়লাভ করা’ এবং অন্য আদর্শ মনে আনে ‘পুরাণ পাঁচালি ও ধর্মেই উচ্চতর মানসিকতার প্রকাশ’ তখন সেখানে ইতি টানবার কেউ কি থাকেন? উনিশ শতকে এহেন সংঘর্ষের দুটি প্রধান বিপরীত মেরু ছিল হিন্দু কলেজ এবং সংস্কৃত কলেজ। ইয়ং-বেঙ্গলরা যেসব বিশ্বাস-প্রয়াস-উল্লাস প্রচার করেছিল স্বভাবতই সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা এবং তাদের অভিভাবকেরা এসবের প্রচণ্ড বিরোধিতা করে প্রতিকারের দাবি জানিয়েছিল―“ক্রমে শহরে একটা হুলস্থুল পড়িয়া গেল।” ডিরোজিওর উপদেশ ও নির্দেশনায় সেসময় হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ‘পার্থেনন’ নামক সাপ্তাহিক প্রকাশ করলে সে বিরোধ যেন আরো চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এ অবস্থার অবসানের জন্য আতঙ্কিত হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে দোষী সাব্যস্থ করা যুক্তিযুক্ত মনে করল, কেননা ডিরোজিওই তখন ইয়ং-বেঙ্গলদের মনের একচ্ছত্র সম্রাট। ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে কলেজ কমিটি ডিরোজিওকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে ডিরোজিওকে সরাসরি কর্মচ্যুত করা হয়নি―তাকে অনুরোধ করা হয় স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য। তিনি তৎক্ষনাৎ পদত্যাগপত্র লেখেন বটে কিন্তু সেখানে নিজের বিরূদ্ধে আনীত ‘বাজারি অভিযোগের’ প্রতিবাদ জানাতে ভোলেননি। কলেজ ছাড়ার পরেও ডিরোজিও সমান উদ্যমেই তাঁর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সুযোগ পেলেই কলমের আঘাতে জর্জরিত করেন ধর্মসভাকে, যুগধর্মের ঘনিষ্ঠতায় বিরোধিতা করেন স্বাদেশিকতার নামে সামন্ততান্ত্রিক অনুশাসনের, সমাজকে নিরাপদ রাখার জন্য জমিদার-কৃষক দ্বন্দ্বের অবসান করার প্রস্তাব প্রদান; জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এরকমই আপোষহীন অবস্থানে ছিলেন ডিরোজিও। ১৮৩১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি কলেরায় আক্রান্ত হন। প্রিয় শিষ্যদের হাত ধরে এক সপ্তাহ শয্যাশায়ী থাকার পর ২৪ ডিসেম্বর বাংলার রেনেসাঁসের অগ্রদূতের প্রাণের স্পন্দন থেমে যায়।
‘ইতিহাসের অনেক যুদ্ধ কখনো সম্পূর্ণ শেষ হয়না’―ডিরোজিওর নবজাগৃতির আন্দোলনও কখনো থেমে যায়নি। তাঁর মৃত্যুর পর ‘এনকোয়ার’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘কুইল’, ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে ইয়ং-বেঙ্গলরা যুগধর্মিতা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকাশ্যে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ডিরোজিওর সংস্পর্শে তাঁরা জীবনজিজ্ঞাসার যে তীব্রবেগের সন্ধান পেয়েছিল তাকে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা বদ্ধ পরিকর ছিলো। ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন’ টিকে ছিল ১৮৩৯ সাল পর্যন্ত। ১৮৩৮ সালে গঠিত হয় ‘জ্ঞানোপার্জিকা সভা’। এরপর ডিরোজিওপন্থীদের নের্তৃত্বে একে একে গঠিত হয় ‘লিপিলিখন সভা’, ‘দেশ হিতৈষণী সভা’, ‘হিন্দু ফিলানথ্রপিক সোসাইটি’, ‘চক্রবর্তী গোষ্ঠী’, ‘বেঙ্গল বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’। কলকাতার সেরা তরুণেরা এই সংগঠনের সভাগুলিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ তৎকালীন সামাজিক, নৈতিক তথা যাবতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতো। প্রথম সচেতন স্বদেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁদের মাধ্যমেই পাই। এমন কী প্রথম সচেতন অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্রও আমরা তাঁদের মাধ্যমেই পাই। এভাবে দেখা যায় ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ইয়ং-বেঙ্গলরাই ভারতীয় জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা-অভাব-অভিযোগ-দাবি-অধিকার ও স্বাধীনতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলেছেন। ইংরেজ শাসন-শোষণের ফলে এদেশের দুর্দশতার চিত্র ধরে তারা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছে―‘‘ভারতবর্ষ জয় করার আগে এদেশ বর্বরতার স্তরে ছিল, ইংরেজদের একথা মনে করার অধিকার কে দিয়েছে? ভারত ছিল একটি শিল্পসমৃদ্ধ ও উন্নত সভ্যদেশ এবং আমেরিকার দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে, ইংরেজদের পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে তবেই ভারতবাসীর দুর্গতির মোচন হবে”। “এদেশে ইংরেজ রাজত্বের সূচনা থেকেই, ইংরেজরা ভারতীয়দের সব রকমের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এই স্বাধীনতা হরণই সমস্ত দুর্গতি ও অধঃপতনের কারণ”।
কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, পরবর্তীতে ডিরোজিওপন্থীদের ব্যক্তিগত প্রতিভা স্বীকৃত হলেও সামগ্রিকভাবে তাঁদের প্রবণতাকে খাটো করে দেখানো হয়। “ইয়ং-বেঙ্গলদের নাম কতকটা অন্যায় রূপেই পরবর্তীকালে মসীলিপ্ত করা হয়েছে”। ফলে তাঁদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অনেকটা বিকৃত হয়ে পড়ে। তাছাড়া তাঁদের নিজেদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সেসময় প্রকট হয়ে উঠেছিল যে কারণে পাশ্চাত্যমুখী পরিকল্পিত ধ্যানধারণাগুলি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ‘ঐতিহ্যপ্রিয়তা, অতীন্দ্রিয়তাবাদ, ধার্মিকতা ও ধর্মীয় পুনরুত্থানের স্রোতের’ মুখে শক্ত বাঁধ বসাতে পারেনি―সাম্প্রতিককালের দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে এখানেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় আমাদের রেনেসাঁ। ‘আমাদের রেনেসাঁস ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঘটেছে, কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে ধারাবাহিকতার সূত্রে আসেনি”।―এটাকে কারণ ধরলে সে প্রশ্নবিদ্ধ সীমাবদ্ধতাকে স্বাভাবিক মনে হলেও যুগের নিরিখে তা সংকীর্ণতারই পরিচায়ক। তবে তাতে ডিরোজিওর বুদ্ধিমার্গীয় সজীবতার কমতি হয় না। কেন-না রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজচিন্তা সর্বোপরি এ জাতির সংস্কৃতির বিবর্তনে তাঁর নতুন বাণী তোলে ধরার সুদূর প্রসারী প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করবে কে? তথাপি এখানেও যে আমাদের উপলব্ধিগত ব্যথা নেই তা নয়। ডিরোজিওর মধ্যে ইউরোপীয়, ইউরেশীয়, হিন্দু, মুসলমান এককথায় সকল সম্প্রদায়ের মানসিক ও আত্মিক সম্পর্ক স্ফুরিত হয়েছিল। সেজন্য তাঁর দেখানো স্রোতপ্রবাহই সে সময়ের সাধারণ নিয়ম হবার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট উদারতার অভাবেই তা আর হয়ে ওঠেনি। এত অভিনবত্বের ধারক-বাহক হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু সমালোচকেরা তাকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। অথচ একমাত্র ডিরোজিও ব্যতীত বৃটিশ শাসনের সেই সর্বগ্রাসী চরিত্র এবং সেহেতু এ সমাজের মর্মব্যাথা বাংলার জাগরণের প্রচলিত নায়কেরা সম্যকভাবে উপলব্দি করতে পারেননি বলেই কৃষক-হস্তশিল্পীর দল বঞ্চিত ও শোষিত আর আমাদের ‘বুদ্ধিমার্গীয় দাসত্বের প্রলেপ আজও অম্লান’ রয়ে গেলো।
তথ্যসূত্র :
১। শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা: লি:, কলকতা।
২। সফিউদ্দিন আহমদ, ডিরোজিও জীবন ও সাহিত্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৩। বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, ওরিযেন্ট লংম্যান লিমিটেড, কলকাতা।
৪। বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙ্গালী সমাজ, ওরিযেন্ট লংম্যান লিমিটেড, কলকাতা।
৫। অন্নদাশঙ্কর রায়, বাংলার রেনেসাঁস, মুক্তধারা, ঢাকা।
৬। দীপংকর চক্রবর্তী, বাংলার রেনেসাঁস এবং রামমোহন, পিপল্স বুক সোসাইটি, কলকাতা।
৭। দীপংকর চক্রবর্তী (সম্পাদিত), বাংলার রেনেসাঁস, অনীক, কলকাতা।
৮। সুশোভন সরকার, বাংলার রেনেসাঁস, দীপায়ন, কলকাতা।
৯। বিনয় ঘোষ, বাংলার বিদ্বানসমাজ, প্রকাশ ভবন, কলকাতা।
১০। নরহরি কবিরাজ (সম্পাদিত), উনিশ শতকের বাঙলার জাগরণ তর্ক ও বিতর্ক, কে পি বাগচী এ্যান্ড কোম্পানী, ।
১১। আবুল কাসেম ফজলুল হক (সম্পাদিত), কাজী আবদুল ওদুদ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।
১২। শিবনারায়ণ রায়, প্রবন্ধ সংগ্রহ-২, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
১৩। গোপাল হালদার, বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা (অখণ্ড), শুভ প্রকাশন, ঢাকা।
লেখক পরিচিতি : শিক্ষার্থী, মুরারি চাঁদ কলেজ, সিলেট। এবং বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল-এর সদস্য।
কিন্তু তার আগেই নাগরিক অস্তিত্বে তাঁরা ওহঃবষষবপঃ এর ঢেউ তোলেন; তাঁদের মর্মভেদী উচ্চারণে ‘ঘর কাঁপতো, সমাজও কাঁপতো’।
ভাই, একটু বুঝিয়ে বলবেন উদ্ধৃত করা অংশটি কী, কেনো এবং কিভাবে লেখে। :-Y
খুব ভাল লেখা। তবে ডিরোজিওর ওপর আরেকটি বাংলা ভাল বই আছে-গবেষনা ধর্মী লেখা-স্কুলে থাকতে পড়েছিলাম। ডিরোজিওর কবিতা নিতে একটু আলোচনা হলে ভাল হত।
My Country! In the days of Glory Past
A beauteous halo circled round thy brow
And worshipped as deity thou wast,
Where is that Glory, where is that reverence now?
এছাড়া ডিরোজিও রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে সুপষ্ট কিছু লেখা উচিত ছিল। থমাস পাইনের রাইট অব ম্যান ছিল তার রাজনৈতিক মতবাদের ভিত্তি।
ঠিক কথা। ডিরোজিওকে নিয়ে আরো বেশি করে লেখা দরকার। আমাদের এই প্রজন্ম তো তার কথা জানেই না। বাংলার রেঁনেসার অগ্রদূত ছিলেন ডিরোজিও। তার মধ্যে ডেভিড হিউম, জেরেমি বেনথাম ও টমাস পেইনের প্রভাব ছিলো। তিনি শুধু যুক্তিবাদী শিক্ষকই ছিলেন না – এমনকি ইংরেজদের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার – যা সে সময় এমনকি রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় নি। আমি হাল্কা ভাবে তার অবদানের কথা উল্লেখ করে একটি লেখায় লিখছিলাম – আমরা জাহানারা ইমাম স্মৃতি পুরস্কার পাবার পর। লেখাটা আছে এখানে।